মিথোরনিয়া অভিবাদন, রনি আহম্মেদ । মহসিন রাহুল
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০১৩, ৬:৪৮ অপরাহ্ণ, | ২১২০ বার পঠিত
পশ্চিমের রেনেসাঁ-মডেল ভারতীয় বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য কি না এ-সন্দেহবীজ গত শতাব্দীর ষাট-দশকে ব্যাপক শস্যময় হলেও, ধারণা করা হয়, এটি বিশের দশকেই রোপিত হয় মানবেন্দ্রনাথ রায় কর্তৃক। রেনেসাঁর সে-বিতর্ক নয়, বাঙালির রেনেসাঁকে সদর্থে বিবেচনাশীল গোত্রের একজনকে—শিবনারায়ণ রায়—লক্ষ করছি, বাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণের সমর্থনে প্রচুর বাগ্মিতার পর তীক্ষ্ন সতর্ক এক মুহূর্তে যিনি লিখেন : ইতালীয় মানসের স্ফুরণ ঘটেছিল মুখ্যত চিত্রকলায়, বাঙালি মানসের মুখ্যত কবিতা ও কথাসাহিত্যে। রনি আহম্মেদের প্রদর্শনীর (মিথোরনিয়া) ক্যাটালগে এক অধ্যাপক যখন রনির গায়ে রবীন্দ্রনাথের শিহরণকর আলখাল্লা চাপিয়ে দেন, আবার তাকাই শিবনারায়ণ রায়ের নির্ধারণে,—চিত্রকলা বাদ পড়ে গেল কেন আলোকঘটনার মুখ্য তালিকা থেকে? অবনীন্দ্রনাথ-গগেনন্দ্রনাথ-যামিনী রায়-রবীন্দ্রনাথকে স্মৃতিতে রেখেও রায় চিত্রকলার বিকাশকে কবিতা-কথাসাহিত্যের বিকাশের সমপর্যায়ের বিবেচনা করেন না কেন? ঐতিহ্য/প্রাচীনতা আত্তীকরণের মানঘটনা হিসেবে রায় গভীরতর কিছু ভেবে থাকতে পারেন, যথা : ইম্প্রেশনিজমের অনুঘটকরূপে প্রাচ্যের চিত্রপদ্ধতি কিংবা অমানুষিক এক স্প্যানিয়ার্ডের হাতে আদিবাসী নিগ্রো ভাস্কর্য, এবং সে-বিবেচনায় হয়তো অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ ও বেঙ্গল ঘরানাকে, এবং, সাধারণীকরণের দ্রুত ও কিছুটা অন্যায় চাপে হয়তো, যামিনী রায়কে খারিজ করেন,—কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? রায় বোধ করেন, চিত্রশিল্পীর সাধনা রবীন্দ্রনাথের স্বধর্মে নেই, রবীন্দ্রনাথকে সুবিচারের সঙ্গে বোঝা এবং তাঁর দুর্লভ অন্তর্বিরোধের সংবাদের জন্য ছবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এক দুর্বোধ্য শক্তির উপস্থিতিতে এগুলো আলোড়িত করে, কিন্তু চিত্রশিল্পে রূপের দখল রবীন্দ্রনাথের সাধ্যের বাইরে, কৌতূহল হয় তাঁর—রবীন্দ্রনাথের পূর্ণচেতন চিত্রচর্চা কেমন হতে পারতো; রায়ের নির্ধারণ—
- এই ছবিগুলোর আড়ালে কোনো এক প্রবল এবং প্রাকচেতন অস্বস্তি যেন ওৎ পেতে আছে। প্লেটো দেখলে বলতেন এদের প্রলম্বিত সংসর্গ অস্বাস্থ্যকর, বুদ্ধির গোড়ায় পচ ধরতে পারে। সময়ের যে নগণ্য খণ্ডের নাম সভ্যতার ইতিহাস, এদের জগত তা থেকে প্রাচীন, এদের উদ্ভব মানবসত্তার প্রাকসাংস্কৃতিক স্তরের গভীরে। চৈতন্যের সাধনা হল এই গভীরকে আলোকিত করা, আমাদের অন্ধ জৈব বৃত্তিগুলিকে সুষমিত করে সত্তার সামগ্রিক বিকাশের মধ্যে মুক্তি দেওয়া। এ ছবিগুলিতে সে সাধনা শুধু অনুপস্থিত নয়, অস্বীকৃত।…তাঁর অধিকাংশ ছবিই প্রাণশক্তিতে প্রবল, কিন্তু সে প্রাবল্য মননের দ্বারা সংস্কৃত নয়। তাই তার প্রকাশ শুধু অন্ধ বিক্ষোভে।’ [দ্রষ্টব্য : কবির নির্বাসন ও স্রোতের বিরুদ্ধে, মডেল পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৯৮, ১২৫]
রবীন্দ্রনাথের ছবি-বিশ্লেষণে ঢোকা বর্তমান রচনার পক্ষে অপ্রয়োজনীয়, আপাতত শিবনারায়ণ রায়কে গ্রহণ করছি। এবং এ-সূত্রে মনে রাখতে চাই রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে এজরা পাউন্ডের বিদ্রƒপ,১ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনীহা,২ মুগ্ধতা-কৃতজ্ঞতার পরও রামকিঙ্করের বলা ‘হুইম্সিক্যাল’ কথাটিকে৩ (এবং রবীন্দ্রনাথের নিজেরই স্বীকারোক্তি : ‘আমার ছবি রচনায় দেখি অচিন্তার অতল থেকে হঠাৎ ভেসে ওঠে রেখার রূপ, সচিন্ত মন পরে তাকে দখল করে’, ‘আমি ছবি আঁকি দৈববশে’, ‘ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমি কোনো বিষয় ভেবে ছবি আঁকিনে’)। রনির ছবি সম্পর্কে ওই অধ্যাপক লিখেছেন, ÔLike the strange shapes of Rabindranath Tagore, the figures in Ronni’s paintings are an obsessive picturisation of some primal mystery or fear or awe or a combination of all these.’ [দ্র. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মিথোরনিয়া-র ক্যাটালগ] পড়ামাত্র এক নির্বিচার সংক্রমণের সম্ভাবনায় ভীত হয়ে ওঠি; কারণ, ‘নির্জনতম কবি’ ‘পল্লীকবি’ প্রভৃতি সমিল ছাপ্পার বদ-প্রতিভা ইতোমধ্যে অভিজ্ঞতাভুক্ত আমাদের। ওই অধ্যাপক, এরপর, ‘সেরেব্রাল’ ‘ইন্টালেকচুয়াল’ প্রভৃতি বলে বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়ার আভালান্সে যতোই টালমাটাল হয়ে উঠুন, সব এক নিরর্থক মিশ্রণে পর্যবসিত হয়।
ঐ উচ্চারণের পর রনিকে তাঁর মূল প্রকল্পেই চিহ্নিত করা কঠিন। এবং এ-কারণে, শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, চিত্রশিল্পের পুরো নির্জ্ঞানবাদী গোত্রের সঙ্গে যে-বিন্দুতে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠেন রনি, সেটিই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে তখন। বর্তমান রচনা মূলত সে-বিন্দুকে পরীক্ষা করতে ইচ্ছুক।
২.
- আমি প্রস্তুত করি আমার ভাষা, রেখা, আঙ্গিক ও রঙ আমার প্রাথমিকতম বোধি থেকে। আমি বিশ্বাস করি জগৎ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি মহাকাব্যিক দৃষ্টির ও পৌরাণিক উদ্ভটত্বের। আমি বুনন করি মহাকাব্য, ছদ্ম-ব্যক্তিক পুরাণ ও এর টুকরাটাকরা। [দ্র. মিথোরনিয়া-র ক্যাটালগ,ইংরেজি থেকে অনূদিত ]
রনি এভাবে, এক ছদ্মধ্যানের আবহাওয়ায়, আলোচকদের জন্য ফাঁদ পাতেন। ‘মহাকাব্যিক’ ও ‘পৌরাণিক’ এই ভয়ঙ্কর ওজনময় শব্দ দুটো আলোচকরা দ্রুত গ্রহণ করেন তাঁর থেকে, তাতে জুড়তে থাকেন আরো পিচ্ছিল আর বিমূর্ত শব্দাবলি (যথা : ‘আধিবিদ্যক চৈতন্য’, ‘হেঁয়ালি’ ‘গ্রোটেস্ক’, ‘যৌথ অবচেতনা)। ‘মহাকাব্যিক’-কে, সম্প্রসারিত অর্থে, গ্রহণ করছি এমন কিছু হিসেবে যা ব্যাপ্ত গোষ্ঠীর অনুভূতি/অভিজ্ঞতার বহুতলকে আলোকিত ধৃত ও বিবেচ্য করে। তা যদি হয়, তবে তার পক্ষে ‘হেঁয়ালি’ হওয়া অসম্ভব। আর ‘পৌরাণিক’ বলতে কী বুঝবো? যে-অর্থে রামায়ণ কিংবা আল-কোরান মিথ (বা ধর্মীয় মিথ), সে-অর্থেই মিথিক্যাল? কিন্তু বাল্মীকি বা মুহম্মদ-এর ধরনে, একবিংশ শতকে, কোনো পুনরাবৃত্তি সম্ভব মনে হয় না। উত্তর ঔপনিবেশিক, অসমবিকশিত ধনতন্ত্রের খানাখন্দে সঙ্কুল বাস্তবে, ২০০৪ সালে, বিজ্ঞান ও যুক্তির ফর্শা, দুর্ধর্ষ রৌদ্রে কী তবে ভর করতে পারে রনির মাথায়? এটি কেমন মিথ? রনির ব্যাখ্যা :
- আমার গল্পগুলোতে এক ধরনের সভ্যতা পাওয়া যাবে যা উপরিতলে ঠিক পরিচিত ঠেকে না। কিন্তু এই অবাস্তব সভ্যতা বা জনবসতি প্রকাশ করে অবিকল সেই সংবাদই যেটি আমরা পাই বাস্তবের মোকাবিলায়। আমার চোখে মিলেমিশে যায় উদ্ভটত্ব, শ্লেষ, স্থূলতা, হিংস্রতা, ক্ষমতা, সম্পর্ক, নৈঃসঙ্গ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি। [দ্র. ঐ]
বুঝতে পারি, এ একদম ভিন্ন বংশের কিছু-একটা, ততো ভারি ও জটিল নয়, যেমনটি লেভিস্ত্রাউসের সাঙ্ঘাতিক চোখে, মিথ আর জিনঅণুর প্যাঁচ যাতে তুল্যমূল্য। রনির মিথ সংরচিত/প্রস্তুতকৃত মিথ,-ব্যক্তির, যৌথর নয়, এবং নয় নির্জ্ঞান-উদ্ভূত, বরং এর বুনন ঘটেছে-অন্তত ‘ক্ষমতা’, ‘সম্পর্ক’, ‘নৈঃসঙ্গ’, ‘বিজ্ঞান’, ‘প্রযুক্তি’ প্রভৃতি শব্দ উচ্চারিত হবার পর লুকোনো থাকে না-জাগ্রত বুদ্ধিতন্তুর সক্রিয়তায়। এই মিথে নিখিল মানবের মনোগঠনের উন্মোচন-চেষ্টায় শ্রম ঢালা বৃথা। রনি, শিল্পী হিসেবে, মিথ নামক রহস্যময় প্রপঞ্চ থেকে নির্জটিলভাবে নিষ্কাষণ করেছেন দুটি সম্ভাবনা : ‘গল্প’ এবং ‘অবাস্তবতা’ (তথা যুক্তিবিলোপ), গবেষণাগারের বাইরেও যে-দুই স্বভাবে প্রাচীন মিথ জীবন পায়, এবং আসঞ্জিত করেছেন এদের চিত্রক্ষেতের পৃথিবীকল্পে। এই ঋণের ফলে ভিন্নতর এক মিথেরই বুনন ঘটছে বলে ভাবেন তিনি, নাম দেন মিথোরনিয়া। এ-জাতের মিথকে কী চোখে দেখেন একজন পেশাদার মিথতাত্ত্বিক? বিল ময়ার্সের সঙ্গে মিথতাত্ত্বিক যোসেফ ক্যাম্পবেলের সাক্ষাৎকারের কৌতূহলকর একটি অংশ :
ক্যাম্পবেল : …পুরাণকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যাঁরা একে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন তাঁরা কোনো না কোনো প্রকারের শিল্পী। শিল্পীর কাজ হলো পরিবেশের এবং বিশ্বের পৌরাণিকীকরণ। ময়ার্স : আপনি তাহলে বলছেন যে আমাদের যুগে শিল্পীরাই পুরাণ স্রষ্টা?
- ক্যাম্পবেল : আদিকালের পুরাণ স্রষ্টারা আমাদের শিল্পীদের অনুপক্ষ ছিলেন।
- ময়ার্স : হ্যাঁ, জার্মান ভাষায় একটা পুরনো ধরনের রোম্যান্টিক কথা আছে—ওরা বলে des Volk dichtet অর্থাৎ সনাতন সংস্কৃতির ভাবনাচিন্তা, কাব্য সবই এসেছে গণজীবন থেকে। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। ওসব আসে বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতা থেকে-সেইসব লোকের অভিজ্ঞতা থেকে যারা প্রতিভাবান, যাদের শ্রবণেন্দ্রীয় উৎকর্ণ থাকে ব্রহ্মাণ্ডের সংগীতের জন্য। এঁরাই কথা বলেন জনগণের সঙ্গে এবং জনতাও উত্তর দেয়।…[দ্র. মিথের শক্তি, অনু. খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫, ১০৬]
ক্যাম্পবেল ভালবাসাসিক্ত এক স্নিগ্ধ ভাববাদী দৃষ্টিতে নেন জগতকে। গুপ্ত কোনো ঐক্যের অন্বেষায় ও অনুভবে, মগজ-হৃদয়ের যুগলবন্দিতে, অবাক মরমি তিনি। তিনি স্বীকার করেন, শিল্পীদের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাস্তর ভিড়ের তুলনায় তীক্ষ্ন, সম্প্রসারিত-এবং তাঁরাই স্পৃষ্ট হন সত্যের সে-দুর্লভ বিদ্যুতে যা যৌথর পরিবাহিতার বাইরে। শিল্পীর অযুক্তিপ্রতিভার উৎসাহকর সমর্থনও দেন ক্যাম্পবেল। কিন্তু তিনি উপকরণগত কিংবা অভিজ্ঞতা-পরিশোধনে যে-শ্রম ব্যয় করেন শিল্পকর্মী একে অর্থহীন করে দেন আদিম সংস্কৃতির শামানের সঙ্গে এ-কালের শিল্পকর্মীর তুলনায়। শামানরা, নারী বা পুরুষ, ছোটবেলায় বা প্রথম যৌবনে কোনো মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতায় অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে, তাদের অবচেতনা খুলে যায়, যেন অতিপ্রাকৃত কিছুর ভর হয় তাদের ওপর, কিছুটা সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্তের ধরনে দিব্যবাক্যের সক্ষমতা পায় তারা। ক্যাম্পবেল ন’বছর বয়েসী সিউক্স বালক ব্লাক এল্ক্-এর উদাহরণ দেন, শামানদের মতোই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার, আমেরিকান পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে নিজেদের গোত্রের সংঘর্ষের দুর্ভাগ্যময় পরিণতির ভবিষ্যদ্বানী করেছিল সে। তার দিব্যদৃষ্টি সম্পর্কে সে জানায়, ‘আমি দেখলাম আমি রয়েছি বিশ্বের কেন্দ্র-পর্বতে, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। তখনই আমার এক দিব্যদৃষ্টি লাভ হয় কারণ আমি দেখছিলাম বিশ্বের পবিত্রতম পদ্ধতিতে।’ মিথোরনিয়া-র শিল্পী, প্রতিতুলনায়, এক ‘মিলেমিশে যাওয়া’ জমাট যৌগ’র কথা বলেন, যার গঠন-উপাদন সমূহ : উদ্ভটত্ব, শ্লেষ, স্থূলতা, হিংস্রতা, ক্ষমতা, সম্পর্ক, নৈঃসঙ্গ, বিজ্ঞান,
প্রযুক্তি। এই তালিকার শেষার্ধ মারাত্মক আসত্তিশূন্য, এবং যে-কোনো দিব্যম-ের স্থিতাবস্থায় এরা নাশকতামূলক। ব্লাক এল্ক্-এর অপাপবিদ্ধ পদ্ধতি এদের ক্রিয়ায় রূঢ় অপবিত্রতায় বদলে যাওয়া স্বাভাবিক। লক্ষযোগ্য, রনি তাঁর ছদ্মধ্যানে ‘প্রাথমিকতম বোধি’-জাতীয় ক্লিশে উচ্চারণ করলেও, শিল্পী ব্লেকের ধরনে ÔI am under the direction of Messengers from Heaven, Daily and Nightly.’-এ জাতের গম্ভীর শামান-স্তোত্র অন্তত বলেন না; তাঁর নির্মাণ-পদ্ধতির ফ্লো-চার্ট :
উদ্ভটত্ব, শ্লেষ, বিজ্ঞান
বাস্তব…………….. সংবাদ…………….. অবাস্তব সভ্যতা/জনবসতি……….. গল্প
ক্ষমতা, হিংস্রতা, নৈঃসঙ্গ প্রভৃতি
এ-তত্ত্ব নতুন নয়;-যথাযথ বাস্তব অতিক্রমণের প্রকল্প সাধারণভাবে লভ্য সৃষ্টিশীলতার সব শাখায়, এবং চিত্রকলায় বারবার বিভিন্নমাত্রিক তোলপাড় হয়েছে এ-নিয়ে। পল ক্লীর সুপরিচিত প্রস্তাবেরই (যে, অনুকরণ নয়, দৃশ্যকে জন্ম দেয়া শিল্পীর দায়) বিশ্বস্ত বিবর্ধন যেন ঐ ফ্লো-চার্ট। কিন্তু মিথোরনিয়া শিশুর বিস্ময়ে ঐকিক অন্তর্বাস্তবে গ্রস্ত নয়; এটি বহির্বাস্তবের ক্রমশ মন্থনে ঢোকে অন্তর্বাস্তবে। ফলে, পরাবাস্তব স্বপ্নপ্রাপ্তি কি শামানের দিব্য অভিজ্ঞানের ছাপ্পায় একে বর্ণনা করা যায় না। রনি মাননিক, পার্থিব, আক্রান্ত, আক্রমণকারী। ক্যাম্পবেল-কথিত ‘ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গীত’ ধারণে এন্টেনা পাতেন না রনি; রনির ব্রহ্মা- অন্যরকম, তা ছোট, নিজ অক্ষে ঘুরতে অক্ষম সেটি, একটি করুণ চাকতির মতো, দুহাতে ঠেলতে ঠেলতে রনি বলেন : থেমো না, আহা ব্রহ্মা- আমার! [চিত্র-১], এবং এভাবে, স্থানের ধারণা মানবের চেতনায় কী পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, একি priori নাকি posteriori, অনুভববেদ্য না অনুভব-নিরপেক্ষ, কান্টের এ-জাতের সংকটকে পৃষ্ঠপ্রদর্শনের মাধ্যমে রনি লিপ্ত হন নিজের তুচ্ছ স্থান-বাস্তবে। [চিত্র-১-এর সূত্রে মার্কস সম্পর্কে রাসেলের এই বাক্যটি স্মর্তব্য : His purview is confined to this planet, and, within this planet, to Man.]।—নির্জ্ঞানের ছদ্মধ্যান সাঙ্গ করে রনি পা বাড়ান রাজনৈতিকতায়।
৩.
রনির ছবির রাজনৈতিকতা অধিকাংশত আন্তর, তা ভিড়কে সুসমাচার দেয় না, সমাধান কিংবা চিকিৎসা দেয় না। রনির প্রস্তাব নেই, ঐকিক মহাপ্রস্তাবসমূহে অনাস্থা রয়েছে হয়তো। তবে অনাস্থাও গহ্বরময় এক প্রস্তাবই। গহ্বর,-কেননা এখানে লোপাট হয়ে যায় সমস্ত একমাত্রিক জ্যামিতি, পষ্টাপষ্টি গণিত, কিংবা ফেননিভ শ্লোক,-বিনিময়ে হকিং-আভার বিকিরণ প্রায় শূন্যের সূচকে। কিন্তু রনির সংলিপ্ততা এবং সক্রিয়তা স্পষ্টত জানায় জীবন বা যন্ত্রণা-যাপনে তাঁর স্বীকৃতি,-জঙলাগা আঁধার-সূর্যের খাদ্যপ্রাণে, ক্রোমিয়নদের পায়ের দাগে, নারীর জরায়ুভূমে তাঁর বিশ্বাস আর প্রেম;-এটিই তাঁকে দাঁড় করায় সৎ মানবিকদের ধারাক্রমে।
রনিকে ‘গ্রোটেস্ক’, ‘আধিবিদ্যক’, ‘হেঁয়ালি’ প্রভৃতি মারাত্মক বিমূর্ত অভিধার কুয়াশায় ঢেকে ফেলা সহজ (এবং নিরাপদ)। তবু, রনির ছবির দাঁত-নখ-চিৎকার ঢাকা পড়ে না মোটে। আঘাত করে সে নিজের প্রজাতি ও নিজেকে, সে কাঁদে ও গোঙ্গায় যাকে আমাদের বোধহয় হাবা যুবকের হাসিমস্করা, সে গায়ে চাপায় আদি শামানের আলখাল্লা যদিও হৃদয়ে-মগজে তার ক্রিয়মান-কোনো অবচেতনার তন্ত্রমন্ত্র নয়-সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্রাবলী।
রনি পুরোপুরি সচেতন তাঁর স্থানিক বাস্তবতায়, যা হয় আক্রান্ত একটি ছোট গ্রহ, পৃথিবী, এবং-আরো নির্দিষ্টভাবে-পৃথিবীর প্রান্তিক বর্জিত এক উপনিবেশ। বিংশ শতকের শেষ তিন দশক তাঁর অভিজ্ঞতার কাল। এই বাস্তবতার সচেতন ও প্রথাবর্জক কোনো শিল্পী সম্পর্কে ‘নির্জ্ঞান’ বললে কিছুই বলা হয় না। প্রকৃতপক্ষে রনির বাস্তবতায় ‘জ্ঞান’-ই তর্কসাপেক্ষ, সন্দেহজনক। কান্ট ব্যাখ্যায় রাসেল, বহিঃপৃথিবী কীভাবে ঢোকে আমাদের চেতনায় সে-প্রশ্নে, উদাহরণ দিয়েছিলেন নীলচশমার। উপনিবেশের বাস্তবে জ্ঞানের ইতিহাস সাধারণত হয় নীলচশমার ইতিহাস, হতে বাধ্য [চিত্র-২]। কোনো সৌভাগ্যশীল জাগ্রত চশমাহীন মুহূর্তে টের পাবো, ‘জ্ঞান’ হয়েছে নির্বোধের নিরর্থক ‘নির্জ্ঞান’,-যা দূষিত, এবং করুণ। ফ্রয়েডের সুদূর ডুবোমৎস্যের অপ্রতিহত চাষ এই বাস্তবে আত্মবিরোধিতা। রনির সৌভাগ্য, চিত্রকলার ইতিহাসে নির্জ্ঞানসাধক মাতাল গোত্রের নবতর বিশ্বস্ত সদস্য তিনি নন। উত্তরঔপনিবেশিক বাস্তবে রনি বিরল ও জাগ্রত জীব। উপকরণস্তরে তাঁকে বোধ হয় পশ্চিমের দাদা ও পরাবাস্তববাদীদের আত্মীয়, কিন্তু আর্থস্তরে তিনি উদ্দেশ্যমূলক অষ্টাবক্র, হানা দেন দর্শনের সফেদ মোকামে, অধিবিদ্যার ধাঁধাকে কর্কশ ঘষে দেন, শোপেনহাওয়ার-বিজ্ঞাপিত নির্বেদ অংশত নেন মর্মে, রাজনীতির বিজ্ঞানসূত্র তাঁকে দেন মার্কস-এঙ্গেলস, তিনি এগোন-নিজের কাল ও স্থানবাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, সাধ্যমত-মারাত্মক বহির্বাস্তবের পানে, এবং ক্রমশ ঢোকেন-সুধীন্দ্রনাথকে বদলে বলা যায়-সমুদ্যত মানবিক দুর্বিপাকে।
রনি আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের সমান বয়েসী (জন্ম : ১৯৭১)। ফলে, রনির অবর্ণনীয় বহির্বাস্তব তাঁকে রনবী বা শিশির ভট্টাচার্যর ধরনে বহির্তলী প্রতিবাদ-শিল্পের দিকে প্রতারিত করতে পারতো, নয়তো সর্বাত্মক হানায় নিক্ষেপ করতে পারতো পলায়নশীল অপস্মারে। কিন্তু ঘটেনি কোনোটাই। রনি বেছে নিয়েছেন সুবিধাজনক ও অভাবনীয় এক পদ্ধতি : শামানের আলখাল্লার ভিতর ঢুকে-পড়া গুপ্তলড়াকু তিনি। অবশ্য, তাঁর সাধ্য তর্কসাপেক্ষ। পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত বাস্তবে ব্যক্তির অসহায়তা-নৈঃসঙ্গ-বিচ্ছিন্নতা তাঁরও নিয়তি। ব্যক্তি এখানে হতে বাধ্য অক্রিয়,-নিখিল যন্ত্রদানবের রজ্জু-নিয়ন্ত্রণে অসহায় ও একলা পাপেট। তার আত্মবিরোধী যন্ত্রনাচ চলে অনবরত, তুঙ্গ নাচে প্রকৃতিস্থতা হারায় সে, স্বপ্নে-বাস্তবে অর্জন করে যন্ত্রের ঝনৎকার, এমনকি হারায় স্বপ্নের-বাস্তবের দাস-মনিবের মন-মননের তথা সার্বত্রিক বোধ। এই বাস্তবের ভিতরে বাস করেও মনোবিকলনহীন বাঁচা, সোঁতের শেওলা হয়ে ভাইস্যা বেড়ালেও নিম্নতর জলকীটদের তুলনায় ইঙ্গিতময় সবুজ থাকা, নাচের কেন্দ্রে নাচশূন্য থাকা লড়াই হয়ে উঠতে পারে কারো কারো।
রনির বিশাল ক্যানভাসের ছবি দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদের পর জনাব বেকেটের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি [চিত্র-৩] কৌতূহলী করে, কে দ্যায় এই লড়াইয়ের রসদ? এর তদন্ত-পদ্ধতি কেমন? এর ভিতরে ইশারা কি নির্জ্ঞানের, না নৈঃসঙ্গের/বিচ্ছিন্নতার বাস্তবের মুখোমুখিতায় রক্তপাতের? বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতার দৈব, অর্থাৎ নির্মানবিক, ব্যাকরণ প্রস্তাবিত হয়েছে বহু আগে, কান্টের দর্শনে। কান্ট thing-in-itself (বা স্বস্থিত সত্তা)-কে শনাক্ত করেছিলেন মানুষের মধ্যেও, যা হয় মানুষের অধরা প্রকৃত রূপ, যা উঁচু ও ঐশ্বরিক, ‘মানুষরতন’, যা তার noumenal form । পার্থিব-অভ্যাসসমূহে-জড়িত মানুষ ক্রমশ দূরত্ব ঘটায় তার আন্তর ঈশ্বরচুম্বী বৈদূর্যখ- হতে, phenomenal form -এ ক্রমাগত নিজেকে তার লাগে অচেনা, এবং জনমভর এক হারিয়ে-ফেলা সত্তার টানে চলে আত্মখনন। যোগাযোগের উপায়হীন সেতু তখন নৈতিকতার কঠোরতম নিষ্ঠা।
কিন্তু কান্টের এই প্রকল্প মর্মত নৈতিকতাঘটিত এক আত্মপীড়ন (বা স্বৈরতা) ডেকে আনে, মানবের জন্যে মুক্তি নয়, অভিনব (যদিও মহৎ) দাস্যকে করে নিয়তি। এমনকি মানব সম্পর্কে স্বভাব-উন্মাদনার বিকল্পনাও এখানে চোখ এড়ায় না। হেগেল অবশ্য অংশত অপনোদন করেন এর। কান্টপূর্ব অভিজ্ঞতাবাদীরা জন্মকালীন মানুষের মনকে ভাবতেন tabula rasa বা সাদা কাগজের মতো ফাঁকা, দাগহীন,-ক্রমাগত ইন্দ্রিয়-সংগৃহীত সংবেদন/তথ্য বিকশিত করে একে। হেগেল শূন্য tabula rasa -কে, কান্টের মধ্যস্থতায়, বিশাল অর্থময়তায় পরিবর্তিত ও বিস্তৃত করে দিলেন, প্রতিস্থাপিত করলেন ইতিহাস-জারিত সত্তা আর যুক্তি (Geist এবং ldee) দিয়ে। পরম অভিব্যক্তিময় এক সত্তা (বা ঈশ্বর) নিজেকে খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন ও স্থিত করেছে মানুষ-প্রকৃতি-জড় প্রভৃতি জাগতিক বাস্তবে। ইতিহাসের অগ্রমানতায় সে-সত্তাই ক্রমশ নিজেকে সংগ্রন্থিত, পূর্ণ, পুনরুৎপাদিত করতে থাকে। মানবের যন্ত্রণার, নৈঃসঙ্গঘটিত অসুখী চৈতন্য’র জন্ম এই পুনরুৎপাদন পদ্ধতির মধ্যেই। কারণ সাড়াহীন, ভাষাহীন জড় কিংবা প্রকৃতিকে জ্ঞানে সংযুক্তি স্বাভাবিকত আয়াস-সঙ্কুল।
নৈঃসঙ্গ-বিবরণে কান্ট বা হেগেলের প্রস্তাবে যথেষ্ট পরিবাহী নয় রনির চিত্রক্ষেত, বরং বিরূপ সাড়া দেয় কোনোকোনোটি [যথা : চিত্র-১, চিত্র-৪]। রনির চরিত্রাবলী এসব অধিবিদ্যাপ্রতিম প্রকল্প থেকে, পজিটিভ সিজোফ্রেনিয়া৪ থেকে ছিন্নবস্ত্রে বেমালুম বেরিয়ে পড়েছে মনে হয়। এতোই পরিচয় আর পরমতাশূন্য এই দঙ্গল যে চিনতে পর্যন্ত কষ্ট হয়,-কিম্ভূত জানোয়ার,
নাকি মোচড়ানো মলপি- এরা, নাকি অমৃতস্য পুত্রেরই পাল! কোনো পরমসত্তার আঙুলের পক্ষে
অস্পৃশ্য হবার কথা এদের। চিত্র-৩-এ সমগ্র অস্ত্রানানির পরও বোধ করা যায় পেছনের ক্রিয়াশীল বিষণœ চেতনাটিকে, অসংশোধনীয়রূপে যা মানবিক, মাননিকতার শব্দার্থ যেখানে মানবিকতা। রনি ‘alter’-এর শ্লোগানকার নন, কিন্তু ভাবুকদের ঐতিহ্যময় নিরীহ-নৈর্ব্যক্তিক সন্ধান-এর রটনায় উষ্মা ও অবিশ্বাস তাঁর (ÔThe question whether objective truth belongs to human thinking is not a question of theory, but a practical question. The truth, i.e. the reality and power, of thought must be demonstrated in practice. The contest as to the reality or non-reality of a thought which is isolated from practice, is a purely scholastic question…philosophers have only interpreted the world in various ways, but the real task is to alter it.Õ-Karl marx, Eleven Theses on Feuerbach)। [এ-সূত্রে রনির চিত্র-৪ বিশেষ দ্রষ্টব্য]।
হেগেলের পর, মার্কসে পৌঁছার আগে, ফয়েরবাখে এসে পরম সত্তা/ঈশ্বররহিত হয়ে ওঠে দর্শন। ফয়েরবাখ মানবের পা প্রোথিত করে দেন পরিচিত পৃথিবীর ভূমিতেই, এবং জানান, হেগেলীয় সত্তার বিচ্ছিন্নতা মানুষেরই বোধের অপস্মারমাত্র। দর্শনের কেন্দ্রীয় কুশিলব কোনো থিওলজির পরমসত্তা নন, মানুষ। আকাশরহিতির জরুরি ঘটনার ধারাক্রমে একলা মানবের অসহায় বাস্তবের অভূতপূর্ব মর্মোদ্ঘাটন এরপর ঘটে মার্কসের প্রকল্পে। রনির চিত্রক্ষেত কোনো অন্তিম সংজ্ঞায় নিভে যেতে নারাজ, এ কথা মনে রেখেও বোধ করছি, এর বিভিন্ন প্রতীক ও
প্রতীকসমূহের বিন্যাস, এবং পেছনের বিন্যাসকারী জাগ্রত সেরেব্রাম গুরুত্বপূর্ণ সাড়া দিতে প্রস্তুত কেবল মানবকেন্দ্রিক প্রকল্পেই, যা হবে ধাঁধা কিংবা হেলোবিহীন, সক্ষমরূপে বহুগামী, এবং বিজ্ঞানময়। মার্কসকে সাক্ষী করলে চিত্র-৩-এর জঙ্গমের বাস্তবে কোনো ‘বিন্যাস’ কি ‘শৃঙ্খলা’ নয়, মিলবে ভীতিকর এবং পরাক্রমী ‘শৃঙ্খল’। মার্কস একে অনুভব করেছিলেন বিরল সহমর্মিতায়, এবং তা-ই তাঁর মাননিকতায় জরুরি যুগলবন্দি, যাতে অভাবনীয় যৌথতায় আস্রবণ ঘটে দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের,-এবং প্রস্তাবিত হয় বহুতলময় ও সভ্যতার ইতিহাসে তুলনারহিত মানবমুক্তির প্রকল্পটি। চিত্র-৩-এর আর্থ জঙ্গমকে চিনতে বহুউচ্চারিত সেই শ্রমবিভাজন, ব্যক্তিমালিকানা, শ্রেণী বৈষম্য, শোষণ, পুঁজি প্রভৃতি ধাঁধাহীন চাবিশব্দের শরণই, হয়তো, সবচেয়ে সুবিচারমূলক।
চিত্র-৩-এর নামকরণ স্পষ্টত বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো-র স্মরণে। রনি দীর্ঘকাল সাম্রাজ্যবাদের হাঙরঢেউয়ে নিজ প্রজাতির শ্বাসরুদ্ধকর লুটোপুটির অভিজ্ঞতার হিম অনুবাদ ঘটিয়েছেন এ-ছবিতে। ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন, ওয়েটিং ফর গডো-র অন্তিম দৃশ্যে, গডোর নিরর্থক অপেক্ষা ছেড়ে চলে যাবার কথা বলেছিল, কিন্তু নড়েনি এক পা-ও। মঞ্চের শনাক্তিশূন্য জটিল এক বাস্তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, যখন জন্মান্ধ পুঁজির সীমানাহননের দিনও হয়ে ওঠেছে বহু- পুরনো ও স্বাভাবিক, এরাই কি রনির চিত্রক্ষেতে জাতিস্মর ও প্রকৃতিস্থতারহিত অবর্ণনীয় তিন কেন্দ্রীয় স্তম্ভের ইশারা হয়ে ওঠলো? পোজো-র ক্রূর প্রেতাত্মাকে যেন দেখছি চিত্রক্ষেতের অন্ধকার কেন্দ্রে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার বিকাশের তুঙ্গ পর্যায়ে যখন হিংস্র সাম্রাজ্যবাদীতায় পাল্টেছে, রনি তখন চিত্রক্ষেতে ওয়েটিং ফর গডো-র-ই প্রতীকগুলোর বিবর্ধিত মাত্রায়ন করেছেন যেন। বিভিন্ন প্রকরণে লাকিরই প্রজননে উদ্ভূত ভিড় চিত্রক্ষেত-জুড়ে,-বাদুরঝোলা, চিৎপটাং, দড়িবদ্ধ ও দড়িহীন, চ্যাংদোলা, পল্টিখাওয়া-পিতৃরক্তের ধারায় নির্ভুল বিক্রীড়িত। এরাও সঙ্গম ও মলত্যাগ করবে, নাচ করবে, গান করবে, লাথি আর চাবুকের শাসনের নিচে, লাকির মতোই, ‘চিন্তা কর, শুয়ার!’ আদেশ করলে চিন্তাও করবে! মানবের মিলিত কান্না, চিৎকার, আকাশশূন্যতার সত্যের আমর্ম পেষণ, প্রজাতির নষ্টভাগ্য অস্তিত্বের গুপ্ত ও নিষিদ্ধ সত্যসমূহ এতো মর্মান্তিক আঙুলে রঙ-রেখায় ধৃত হয়েছে এ-ছবিতে যে, সহৃদয়হৃদয়সংবাদী প্রত্যেক দর্শককে এটি লোভায় দীর্ঘতম কথাবিস্তারে, সেই কথনে/অতিকথনে কবিতার পঙ্ক্তিমালা থাকবে, দর্শন ও ইতিহাসের বিবিধ স্মৃতি থাকবে, কান্নাময় বহু গল্প থাকবে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ঢুকে পড়বে সেখানে, থাকবে ভয়ংকর অন্ধকার এবং প্রত্যহের স্বাস্থ্যকর সূর্যোদয়ের স্মৃতি, এবং আরো অসংখ্য মানবসংশ্লিষ্ট বিষয়আশয়। যদিও নির্মানবিকীকরণকৃত বিভিন্ন প্রতীক শামানীয় আলখাল্লার দায়িত্বটা যথার্থই পালন করে, এবং অনেক নির্জ্ঞানবাদীকেই ওঝার মন্ত্রের মতো পূর্বাপরহীন উদ্ভট কীর্তন শুনিয়ে তৃপ্ত করে দেয়।
রনি যেভাবে উপকরণ ও আর্থ উভয় স্তরে ভাববাদের ঐতিহ্যকে বর্জন ও আক্রমণ, উত্তরঔপনিবেশিক দুভার্গ্যময় বাস্তবের যন্ত্রণার উন্মোচন, চিত্রক্ষেতের প্রতীকী যন্ত্রখ-সমূহের ক্রীড়ার ভিতর দিয়ে এগোন, তাতে তাঁর চিন্তার ভঙ্গি অনেকাংশেই ঝোঁকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের ভাবনাপদ্ধতির দিকে। তবে গত শতকের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে না-রেখে উপায় নেই। কিন্তু অনিবার্য এই জিজ্ঞাসা : আদ্যোপান্ত পাঠ চলতে পারে মার্কসের প্রকল্পের, ব্যক্তিমালিকানার বিলোপ-ই ঐকিক সমাধান নয় এ-সংবাদ সত্য হতে পারে, তরুণ মার্কসের বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বের তদন্ত চলতে পারে, কিন্তু উপর্যুক্ত বাস্তবের পক্ষে গ্রহণীয় কী বিকল্প উপস্থিত যে সমস্ত মহাআখ্যান ধ্বংসের আত্মঘাতী কোলাহলে হল্লা করে ওঠবো?
এই ট্রাজিক হল্লার চিত্রায়নও রনিতে মিলবে। ছবিটির নাম খাঁচাবদ্ধ দোস্তের দঙ্গল রয়েছেন মহাসুখে, এবং গাইছেন লালন শাহ [চিত্র-৫] । এক আলোচক জানাচ্ছেন এটি ‘লালনের ভক্তকূল নিয়ে আঁকা’। কিন্তু এতো বহিঃস্তরে থেকে লঘুরম্যতায় নিঃশেষ হয় না এ-ছবি। নির্মানবিকীকরণকৃত প্রতীক/রূপকসমূহ এবং রঙ-উদ্ভূত আবহাওয়া একে শিশির ভট্টাচার্যপ্রতিম রঙ্গ-এর স্তর থেকে নেয় অনেক বিষণ্ণ গভীরে, এবং দর্শক আক্রান্ত হয় সহসাই, ক্রমে নিক্ষিপ্ত টাল-খাওয়া ও নিরন্তর গড়ানোর অনুভবে জাগে কোনো বদ্ধ অন্ধকার খাদের ভিতর। ঔপনিবেশিক/উত্তরঔপনিবেশিক বাস্তবে বাঙালির ভাবুকতার ইতিহাসের বিষাদময় সারাংশ এ-ছবি। এবং রনি এখানে গোত্রের আর্তনাদে নিজেও লিপ্ত। ভারতভূখণ্ডে পশ্চিমের কর্তাদের আগমনের পর, পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতে, ১৮ শতকের শেষ দিক (কিংবা ১৯ শতক) থেকে পুরনো পণ্ডিতসমাজ ভেঙে, মূলত পশ্চিমের আখ্যানসমূহের পুষ্টিতে, জন্ম নেয় যে-নতুন বিদ্বানসমাজ, তার বিকাশ-বিবর্তনে-রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মতো বিরল ব্যতিক্রম বাদে-যথার্থ আত্তীকরণের কোনো উৎকৃষ্ট নজির নেই। নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বোঝাপড়ার দিকে যাননি ভাবুকবৃন্দ, মৌলিকতায় দরিদ্র তাঁরা, পশ্চিম মগজে থেকেছে উদ্ধৃতি হয়ে;-পাদ্রী ডাফ-এর এই সপ্রশংস বর্ণনা আয়রনি হয়ে ওঠেছে : ‘সভার সদস্যরা যখন বক্তৃতা দিতেন তখন ইংরেজ লেখকদের প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা নিজেদের মতামত জোরালো করে শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরতেন। আলোচ্য বিষয় ঐতিহাসিক হলে রবার্টসন ও গিবন উদ্ধৃত করা হত। রাজনৈতিক বিষয় হলে অ্যাডাম স্মিথ ও জেরিমি বেন্থাম, বৈজ্ঞানিক বিষয় হলে নিউটন ও ডেভি, ধর্মবিষয় হলে হিউম ও টম পেইন, দার্শনিক বিষয় হলে লক্, রীড, স্টিউয়ার্ট ও ব্রাউন প্রমুখের রচনা থেকে প্রচুর পরিমাণে আবৃত্তি করা হত। বক্তৃতাটিকে সাহিত্যিক মাধুর্যে জীবন্ত করে তোলার জন্য ইংরেজ কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা থেকে ভাল-ভাল অংশ তাঁরা উদ্ধৃত করতেন। তার মধ্যে ওয়াল্টার স্কট ও বায়রন থেকেই বেশি বলা হত, মধ্যে মধ্যে রবার্ট বার্নসের কাব্যাংশও আবৃত্তি করতে শোনা যেত…’। [দ্র. বাংলার বিদ্বৎসমাজ, বিনয় ঘোষ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা, ২০০০, ৮০] প্রতিতুলনায় চরম পশ্চিম-বিমুখ ও হিন্দু-ঐতিহ্যপন্থীদের একটি গোষ্ঠীও থাকে সক্রিয়, যাদের মনে হতো, শাস্ত্রে রয়েছে সব, শাস্ত্রে যা নেই তা অপ্রয়োজনীয়। মর্যাদাচ্যুত, বিক্ষুব্ধ মুসলমানসমাজ যুক্তই হয়নি এই নব্য ভাবুকবৃত্তে। আর সুভাষিত ‘রেনেসাঁ’ তার পঙ্গু ও অস্বাভাবিক বিবর্ধন সাঙ্গ করে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু রিভাইভ্যাল-এ। শিল্পকলায়ও, বাংলা কবিতার ইতিহাস যদি বিবেচ্য করি, এই অস্বাভাবিকতা স্পষ্ট। তিরিশিদের দানকে অস্বীকার করা অবিচার, কিন্তু তাঁদের অ-ক্ষমনীয় পাপের ধারাবাহিকতা থেকে এখনো পুরো মুক্ত হতে পারেনি বাংলা কবিতা। বরং, সম্প্রতিকালে, তা আরেক পশ্চিমা প্রেতপ্রস্তাবের দাপটে অব্যবস্থিত। তার আদ্যোপান্ত এখানে অপ্রাসঙ্গিক, শুধু প্রয়োজনীয় বার্তাটুকু ফরহাদ মজহারের জবানিতে শোনা যায় : ‘ত্রিশ দশকের কেরানিদের মানসিকতাই এখানে কাজ করছে। পশ্চিমে এইসব নিয়ে হৈ হল্লা হচ্ছে, অতএব সাহেবদের মতো আমরা নাচানাচি না করলে কেমন হয়!
এইতো ব্যাপার? কবিতায় উত্তর আধুনিকতা আমার কাছে রীতিমতো তামাশা মনে হয়।…পোস্ট মডার্নিজম সম্পর্কে যে যাই বুঝুক ঘটনাটা আমাদের বাস্তবতার মধ্যে নয়, ঘটেছে অন্যত্র। শিল্পোন্নত দেশে।…সেই সকল দেশে ঘটেছে যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, ব্যক্তির উদয় ও বিকাশ একটা স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে, রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছে এই অনুমানে যে ব্যক্তি সার্বভৌম, সংবিধান ও আইনের উৎস হচ্ছে ব্যক্তি, ব্যক্তির ইচ্ছাই সর্বময়। অর্থাৎ কর্তাময় সভ্যতার মধ্যে পোস্টমডার্নিজমের আবির্ভাব। কার দ্বারা? সেই কর্তাদের (লেখক, দার্শনিক, শিল্পী ইত্যাদি) দ্বারাই যাঁরা নিজেরা আবার কর্তার (ঝঁনলবপঃ) বিলয় ঘোষণা করলেন। স্ববিরোধী, কিন্তু মজার ব্যাপার নয় কি?’ [দ্র. সামনাসামনি, সম্পাদিত; সূচীপত্র, ঢাকা, ২০০৪, ২৭-২৮] এই মন্তব্যের সূত্রে রনির ছবিটির দিকে [চিত্র-৫] দিকে তাকাবো পুনর্বার। মজা নয়, স্থির বিষাদ এই : হল্লার প্ররোচক এবং খাঁচার ভয়ংকর কারিগর দুইই সেই কর্তা, করুণার আধার।
চলবে…