কালসন্ধ্যা । এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ অক্টোবর ২০১২, ৭:৫৬ অপরাহ্ণ, | ২৯৭০ বার পঠিত
কালসন্ধ্যা
তেঁতুলতলার একজনের উরুতে চুলকানি আছে, আপনাদের কারো নাই-তো? তবে ঠিক আছে। নিরঞ্জন, ডুগডুগি বাজাও।
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…
কিন্তু দাদামশায়রা আবার নাচতে শুরু করবেন না যেন। নিরঞ্জন…
ডুগডুগি বাজবে মাত্র পাঁচ মিনিট। তারপর শুরু হবে…নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…
ঠিক আছে, এবার তুমি থামো। পাঁচ মিনিট পূর্ণ হয়েছে আর পিনপতন নীরবতা নামছে। এবার আসুন সক্কলে মিলে তাকানো যাক অ-অ-ই দিকে। ঐদিকে মানে কোনদিকে বুঝতে পারছেন না-তো? এই-যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে অ-অ-অ-ই দিকে তেঁতুলগাছটা দেখতে পাচ্ছেন না দাদামশাইরা? নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
এবার আমাদের একটু একরোখা দৃষ্টিতে তাকাতেই হচ্ছে। তেঁতুলগাছটা পষ্ট হয়েছে তো? তার নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, তাই না? না না, একজন নয়। কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তাই না? ওদের নাম…আচ্ছা, আপনারা সব্বাই খেয়েদেয়ে এসেছেন তো? যাকগে, তেঁতুলতলায় যাদের দেখতে পাচ্ছেন, তাদের নাম নিখিল, অরুণ, সুধীর, পাচু, গোপাল, পরেশ, বিষু ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওদের বাপেরা আজীবন ঢোল বাজিয়েছে। বাপের বাপরাও ছিল ঢুলী। অর্থাৎ শব্দকর। পায়ের কাছে পড়ে রইল আজীবন। রা করলো না। শব্দকরের মুখে রা থাকে না। রা থাকে হাতে। হাতের চালে শব্দ কথা কয়। ঢাক্-কুড়-কুড়… তবে, ছেলেরা চালায় রিকশা। মরার আগে বিষুও চালাত। নিখিল চালায়। পরেশ চালায়। গোপেশ চালায় আর হয়েছে কী—পরেশের ছেলেটা যায় ইশকুলে। নিখিলেরটা যাবে। গেদুরটা বৌয়ের পেটে। পরেশের ছেলের হাতে আমার বাংলা বই প্রথম ভাগ আর সে বানান করে পড়ে-ক ল’য় আকার লা কলা…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
দাদামশাইরা, আপনারা খেয়েদেয়ে এসেছেন তো? নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
আসুন, শুরু করি। এর একটা নাম আপনারাই ঠিক করে নিন। আপাতত কিছু না পেলে তেঁতুলতলার থেটার টাইপের কোনো কিছু আপাতত ধরে নিতে অসুবিধা নাই।নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
ভাইজানেরা, এখন আপনাদের আরেক জায়গায় নিয়ে যাবো। হয়েছে কী, তেঁতুলতলার একজন, বিষু, কয়েকদিন আগে—তাদের বেলায় স্বাভাবিকভাবে যা হয় আর কী—মারা গেছে।
তার বাপ পুলিন ঢুলি মরল শনিবার। পরদিন বৌ কাতরাতে কাতরাতে ছেলের জন্ম দিল। একজোড়া ছেলে হলো বিষুর। পরদিন, সন্ধ্যালাগার আগেই প্রচ- জ্বর কাবু করে ফেলল তাকে। সে জ্বর থাকলো সাতদিন। মঙ্গলবার, সন্ধ্যালাগার আগমুহূর্তে প্রচ- খিঁচুনী, হাসপাতালের বেডে বমির সঙ্গে রক্ত…
বিষু মারা যাবার রাত থেকে এলাকায় শুরু হলো কুকুরের কান্না।
কুকুরের কান্না অশুভ, অমঙ্গল। তাই না ভাইজানেরা? আপনারা কী বলেন?
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
রাতবিরেতে কুকুরের কান্না শোনে লোকজন ভাবে দুষ্কালের কথা। মুখে ই বচ্ছর আর ভাত জুটবে না রে। বাজারে দোকানে দোকানে চালের পসরা সাজিয়ে লোকজন বসে থাকবে অথচ কেউ নাগাল পাবে না সেই চালের। হাত দিলেই সাধের চালে টের পাবে আগুন। লোকজন সেই আগুনের দিকে ভীত-সন্ত্রস্ত তাকিয়ে থাকবে। ভয়ের তাপে সেদ্ধ চালের ভাত হবে। ভাতের ফেন চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামবে। মুখের কষ বেয়ে সেই ফেন মুখের ভেতর ঢুকে পড়বে। তখন নিজের কান্না খেতে থাকবে মানুষ। কুকুরের কান্না তাই অমঙ্গলের বার্তা।
লোকজন ঘুমের ঘোরে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কাঁথার ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠে নবজাতক। উরুর গলিপথে ঢুকতে যাওয়া ক্ষুধার্ত লিঙ্গগুলো হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। বয়োবৃদ্ধ নারী বা পুরুষ আসন্ন মৃত্যুকে অবগুণ্ঠনে ঢেকে দিতে চায়—ও আল্লা। ও ভগবান।
ভাইজান এবং দাদামশাইরা, এখানে আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কথাটা হচ্ছে রাতবিরেতে কুকুরের কান্না শুনে গব্ববতীর পেটের ভেতরটাতেও কান্নার রোল পড়ে যায়! এমনই এক দুষ্কালের সংকেত এটা কী আর বলবো!
রাতবিরেতে কুকুরের কান্না তাই অশুভ।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে পেশ করি, বিষুর মা বোবা। সে সারারাত চিৎকার করে কাঁদে। বোবা মানুষের অ-ধরা ভাষা চিৎকারের রূপ নিলে সেটা রাত-বিরেতে কুকুরের কান্নার মতো শোনায়।
রাতবিরেতে সে হাউমাউ করে কাঁদে। ভাষাহীন বোবা এক মা চিৎকার করে উঠলে লোকজনের কানে তা পৌঁছে কুকুরের কান্না হয়ে। জনপদ এই কান্নায় সন্ত্রস্ত হয়ে বসে থাকে। মানুষের জন্য মাঝরাত তখন মৃত্যু আর মন্বন্তরের। বাংলার দুর্ভিক্ষ আর মন্বন্তরের কথা কেউ ভুলে না দাদামশাইরা। ভোলা যায় না। মন্বন্তর মোদের রক্তের সাথে মিশে আছে গো। এমনই তাজ্জব ব্যাপার।
বাসুর মা’র কান্না শুরু হলে গ্রামদেশের গুটিসুটি মারা কুকুরগুলো খুব সন্তর্পণে জেগে ওঠে। খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না দাদামশাইরা? লাগলেও শুনুন : কুকুরগুলো কান খাড়া
করে বুঝতে চায় কোনো সতর্কতা সংকেত ভূগর্ভের শিলার ভেতর গুঞ্জরিত হচ্ছে কি না। তখন তারা নখ দিয়ে মাটি খামচায়। সামনের পা দুটো লম্বা করে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙে আর জলবায়ুর গন্ধ নেয়। বোবা মানুষের কান্নার মানে ধরতে পারে কী পারে না, সেটা তখন আর বড়ো বিষয় নয়—একযোগে কুকুরগুলো বিষুর মা’র কান্নার সাথে সঙ্গত দেয়। কুকুরের সমবেত চিৎকারে বাসুর মার কান্নাকে আর আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না। এ কান্নায় তাই মানুষ-কুকুর ভেদ নেই। একাকার। এক সময় বিষুর মা নেতিয়ে পড়ে। বেঁচেবর্তে থাকার ক্লান্তি গো দাদামশাইরা! তার কান্না থেমে যায় বটে, কুকুরের থামে না। মরা বিষুর সহোদর-সহোদরা হয়ে তারা রাতভর বিলাপ করতে থাকে। বন্ধু নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…দাদামশাইরা, এখানে একটু থামতে হচ্ছে। বিষুর মা পুত্রশোকে কাঁদতে থাকুক, চলুন আপনাদের নিয়ে যাই সেই তেঁতুলতলার কাছে। কত বচ্ছর বয়েস হবে গাছটার? ঠিক কতো বচ্ছর বয়েস হলে একটা গাছকে বৃক্ষ বলা যায়? এই গাছটার বয়েস শতবচ্ছরের ওপর। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এই এতো বচ্ছর ধরে একটা গাছ এখনও টিকে আছে কী করে! দুনিয়া এতো আজব? এতো দিনে তো গাছটা ব্যবহার হয়ে যেতো আসবাবপত্র হিসেবে। হ্যাঁ, তেঁতুলতলায় এখন কিছু ঘটছে বলে মনে হয়। কেউ কেউ সেখানে কথাবার্তা বলছে বলে মনে হয়। নিখিল, যাকে দূর থেকে বেশ লিকলিকে বলেই দেখে নেয়া যাচ্ছে, কী দেখতে পারছেন? চোখ খুলুন। ঘুম পেলে চলবে কেন? কুকুরগুলোর মতো আপনারাও আড়মোড়া ভাঙুন, দৃষ্টিকে একরোখা করুন আর কানকে নিয়ে আসুন সন্তর্পণের এমন এক দরোজায়, পিনপতনের শব্দও যাতে ফস্কে না যায়…
নিখিল অরুণকে বলে—বাসু মরল আসপাতাল, মুই কেমনে মরমু জানস? বিষ খাইয়া। পেট ভরিয়া খাইমু। কি সুখর বাচা রে! থুঃ।
অরুণ তার দাদভর্তি উরু চুলকাতে শুরু করে। খরখরে একটা আওয়াজ পাচ্ছেন তো?
পাঁচ টাকা ছ টাকা দামের কতো কৌটা মলম আপসে খরচ হয়ে গেল, দাদের বিস্তার তবু কমে না। নখে রক্ত লাগার আগ পর্যন্ত তাই আর নিস্তার নেই। একবার চুলকানো শুরু হলে চোখ বন্ধ করে আঙুল চালাও। নখের ডগায় রক্ত দেখো। তার উপর শালার দেমাগও দেড়গুণ। উরুতে আছিস, ভাল কথা থাক। কিন্তু একজায়গায় থেমে থাকা দাদের ধাতে নেই। সে বিস্তারিত হয়। উরুর ফাঁকে যে একটা মরকুটে লিঙ্গ থাকে মানুষের, একদিন সেটাতেও চাকা চাকা দাদ ফুটতে শুরু করে আর সে কি চুলকানিরে বাপ! এই নিয়ে রাতদিন বৌয়ের অকথ্য গালাগাল! বৌ’টাও চুলকানির হাত থেকে রেহাই পায়নি। সেও সংক্রমিত হয়েছে। দুই উরু লাল লাল চাকায় ভর্তি হয়ে আছে। তাকেও সংসারের জরুরি অনেক কাজ ফেলে উরু চুলকাতে হয়।
: বিষুর মায়ে খালি কান্দে রে। খালি কান্দে আর অইছে কিতা, মানষে কান্দে না কুত্তায় কান্দে তাও বুঝি না। হক্কলতা এক। চিনা যায় না…এ অরুণ! হুনরেনি কিতা কই? নিখিলের কথায় অরুনের কোনো সাড়া নেই।
: কিতা অইছেরে? তরে দেখি ভুতর লাখান লাগের!
: মর জ্বর উটছিল। হারা রাইত জ্বরর ঠেলায় খালি কু কু করছি, বমি করছি চাইর পাচ বার, বিয়ানে দেখি থুরা ভালা লাগের, হেষে মায় কয় বাজারো যা। মার কথায় বার অইছি—কথাগুলো একটানা বলে অরুণ হাঁপায়। টের পায় পেটের ভেতর খিদার বজ্জাত কামড়। খিদার কামড়ে মাথাটা একটু যেন এদিক-ওদিক দুলছে। খা খা রোদে পুড়তে পুড়তে, জীবনের শেষ আশ্বাসটুকুতেও চোতমাসের আগুনমুখা দিন যেন তার করাল কামড় বসিয়েছে। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে খুব দ্রুত—
: পেসিনজারে দশটেকার জেগাত পাচটেকা ভাড়া দেয়।
: পেসিনজার যুদি শুওরর চুদা অয়…
পরের কথা আর বলতে পারে না নিখিল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। ঝাপসা চোখে কতোগুলো মুখ যেন খাবি খেতে শুরু করেছে। ক্ষুব্ধ। বুভুক্ষু। নিখিলের কোনো কিছু কি মনে পড়ে যাচ্ছে? কী বলেন দাদাভাইরা, ভাইজানরা? আপনার কিছু আঁচ করতে পারছেন? নিখিলের বুঝি ঘরের কথা মনে পড়ল!
ঘর! যখন বৃষ্টি-বাদলা হয়, তখর ঘরের ভেতর কাউকে ছাতা মাথায় বসে থাকতে দেখেছেন? নিখিলকে দিতে হয়। অরুণকে দিতে হয়। যামিনী ঢুলির হাড়জিড়জিড়ে মাকে ছাতার তলায় ঢোকাতে হয়। পুলিন ভাঙা পা টেনে টেনে ঢুকে পড়ে চৌকির তলায়। বাইরে বাতাসের মাতম। কিন্তু ভেতরে? সেই একই। যা বাহির, তাই ভেতর। ফারাক নাই। বাইরের আর ভেতরের যোগফল এক। ঐ যেমন রাতবিরেতে বিষুর মায়ের কান্নার সাথে কুকুরের সঙ্গত। মানুষের কান্নাকে আলাদা করে চেনার উপায়ই থাকে না, তেমন আর কী। যেদিন কালো আকাশ জনপদের ওপর ভেঙে পড়ে তুমুল দাপানি তুলে, নিখিল-অরুণ-সুধীর-পাচু-গোপাল-পরেশ ঢুলিপাড়ার সক্কলে তখন ঘরের কথা ভুলে যায়। ঘর দুলতে থাকে, ভাঙতে থাকে, পড়তে থাকে…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
আচ্ছা, কাহিনী এখন একটু বন্ধ থাকুক। ভাইজানদের সাথে ইট্টু কথা বলি। ভাবনা চিন্তা শেয়ার করি। দাদামশাইরা, এক জাগায় পড়েছি যে, মরণ আর ঘুম পরস্পর যমজ ভাই। কথাটাকে বিশ্বাসও করে ফেলেছি। আপনারা এ ব্যাপারে কিছু বলবেন? কিছু কি বলার আছে আপনাদের? নিরঞ্জন…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
…আরেক জাগায় পড়েছি, মানুষের জীবন নাকি সূর্যের মতো। সূর্যের কী তেজ, তাই না ভাইজানেরা? কত্তো শক্তি। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ব্যাটা একবারে শ্যাষ। মরা। সারারাত তার আর পাত্তা নাই… ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
লিকলিকে নিখিল খ্যাপের আশায় তেঁতুলতলা আপাতত ছেড়েছে আর দেখুন ভাইজানরা, অরুণ পেচ্ছাব করছে। সরসর, সরসর শব্দের পেচ্ছাব। তেঁতুলগাছটার ডালপাতার দঙ্গলে পেচ্ছাবের সরসর শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে শিরশির শব্দলহরী ঢেউ ভাঙে। তার চোখ ঝাপসা। ছানিপড়ার মতো। সেখানে একটা ঝাপসা লাশ। হাওয়ার মৃদু ধাক্কায় বাড়ির পাশের ধানক্ষেত দুলছে আর ধানক্ষেতের ভেতর মালতির লাশ। আধন্যাংটো…জমাট বাঁধা রক্তের কালচে ধারা। লাশটার স্তব্ধ চোখের কোণায় জীবনের নুন না কান্না লেগে আছে, অরুণ তা ধরতে পারে না; পারে কেবল ভেতরে ভেতরে চিৎকারে ফেটে যেতে-তরে খুন করমুরে খানকিচুদরা শুওর। মর বেবুঝ বইন্রে তুই…কিন্তু লাশের কানে অরুনের আক্রোশ আর পৌঁছোয় না। আধন্যাংটো লাশটা মনের ধানক্ষেতের দোলখাওয়া দেখতে থাকে। যে ধানক্ষেত জীবনভর মানুষকে খাওয়ায়, সেটা কীভাবে শশ্মানে পরিণত হল, অরুণ সেটা বুঝে না…
রাতের আন্ধারকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না কোনোভাবে। রাত্রে সূর্যটা মরা। তখন, বাপের ফালাফালা বুকের নদীনালাখালে রক্ত উপচে ওঠে। লাল রক্ত। টকটকে লাল। যক্ষা। মায়ের বিলাপ বুক ঝাঁজরা করে দেয়। বোনগুলোও মায়ের সাথে সহবিলাপে মাতে। দিঘল আন্ধার রাতটাকে একটা বিষধর সাপ যেন প্যাঁচ মেরে ধরে আছে!
অ দা, অ অরুণদা…পাচুর ডাকে তার ঘোর ভাঙে আর সাথে সাথে মা-বোনের বিলাপ বন্ধ হয়ে যায়। নুনু বেয়ে অবশিষ্ট পেচ্ছাব দ্রুত বেগে নামতে থাকে। এতোক্ষণ সে নুনু ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। নুনু পেচ্ছাব করছিল না। লাশ দেখছিল। পাচুর আচমকা ডাকে ঘোর ভাঙে। বোনের লাশটা উধাও হয়ে যায়। পাঁজরের ভেতর জীবনটা ফের ধুকপুক করে।
পাচু বিড়ি ধরিয়েছিল। আধ-খাওয়া বিড়ি সে অরুনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে অ দা, মুই অখন যাই, পেটোত অখনও কুন্তা পড়ছেনা। ঘরো গিয়া দুইটা দানা মুখো দেওয়া লাগে। তিশটেকার টিব একটা মারলাম। আর একটা মারতে পারলে থুরা চাউল…নিরঞ্জন?
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…
দাদাভাইরা, এক জায়গায় পড়েছি যে জীবনটা হলো গিয়ে সাপ, সেই জীবনটা যেন এখনই ফণা তুলে দাঁড়াবে এমন গলায় পাচু বললো-পেটোত বড় ভুখ গো দাদা।
অরুণ বিড়িতে টান দিয়ে বলে-তুই অখন ঘরত যা। হিনানপানি করিয়া ঘুম দে, হাইঞ্জার সময় আইছ।
ভাইজানরা তেঁতুলতলার থেটারে আবার লিকলিকে লোকটা প্রবেশ করেছে। আরে মশাই, নিখিলকে ভুলে গেলেন! আর আপনাদের বলে রাখি দাদামশাইরা, এখন আমাদের একটু সরে দাঁড়াতে হবে। চলুন, ঐ টং দোকানের পাশে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়াই। আমাদের এখনও কিছু বলা বাকী রয়ে গেছে। তাছাড়া, ইস্টিশনের ব্যস্ততা এখন খানিকটা বেড়ে যাবে। ট্রেন আসছে। লোকাল ট্রেনটা মাত্র পাঁচ মিনিট থামবে। তারপর ঝামেলা মিটে যাবে। তারপর না হয় আবার আগের জাগায় ফিরে যাওয়া যাবে। তাহলে চলুন, ফের তেঁতুলতলার দিকে তাকান যাক। পেচ্ছাব সেরে অরুণ তার রিকশার সিটে গিয়ে বসেছে। তার উরুর দাদ চড়চড় করছে। আঙুলগুলো খাবি খাচ্ছে চুলকানোর জন্য। নিখিল অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে—
‘অই হালা, দিনরাইত খালি ঝিম মারি পড়ি থাকলে অইবনি? টেইন আইবার টাইম অইগেছে। কপালো থাকলে ভাড়া পাইমু।
অরুণ কিন্তু অনড়। নড়াচড়া নেই। ভাবান্তর নেই। নিখিলের কথা তার কানে ঢুকে না। রিকশার সিটে কাত হয়ে থাকে। তার চোখের ডহরে চিমসানো, খিটখিটে, সিকনিলাগা একেকটা মুখ। তাদের ঘিরে এখন জটিল হিসাবনিকাশ। মরাবাঁচার লেদদেন। সেও মরে যাচ্ছে। সে রিকশার সিটে টানটান হয়ে থাকে। লুঙ্গি কোমরের কাছে টেনে তুলে দাদ চুলকায়। পচা মাংসের গন্ধে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে।
নিখিল আর কী করে—রিকশার সিটের তলায় রাখা গামছা বের করে চোখ-মুখের ঘাম মুছে আকবর হোটেলের পিচ্চির উদ্দেশ্যে বুকের জ্বালা-যন্ত্রণার কামড়াকামড়ি উগরে দেয় ‘দুই সিঙ্গুল চা দিতে তর কতদিন লাগবরে চেয়ারম্যান? কুন সময় কইছলাম মনো আছেনি? লগে দু’খান বিস্কুট আর এক গল্লাস জল দিস।’ হোটেলের পিচ্চিটাকে তারা চেয়ারম্যান বলে ডাকে। এ হলো রিকশাজীবীর ঘামশেষের মউজ। পিচ্চি চেয়ারম্যান কোমর দুলিয়ে চা নিয়ে আসবে নিখিলের আদেশে! পিচ্চি চেয়ারম্যান গান গাইবে—রসের ফুল ফুইটাছে গো প্রেমের বাগানে…
নিখিলের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো আকবর হোটেলের চেয়ারম্যানের কানে পৌঁছবার আগেই তেঁতুলগাছের ঘনঘোট জটিলতায় ভারি ও প্রলম্বিত শব্দ ওঠে ‘ভোঁ-ও-ও-ও-ও’। আখাউরাগামী লোকাল কুশিয়ারা এক্সপ্রেস হাতপাচোখকানমুখনাক মাল আর মানুষে বোঝাই হয়ে শমসেরনগর ইস্টিশনে ঢুকে পড়ে। ইঞ্জিনের ফোঁসফোঁসানিতে তৎপর হয়ে নিখিল অরুণের উদ্দেশে বাঁজখাই গলায় চেঁচায়—‘টেইন আইছেরে, পুটকিমারা থইয়া অখন রুজিত চল। দিনরাইত খালি ঝিম মারি থাকলে বাল রুজি করবায়। হালা তর কপালো বহুত দুখ আছে কইলাম।’
অরুণ নড়ে না। তার চোখের ডহরে কতো কতো মুখ। এতো মুখের ভিড় ছাপিয়ে নিখিলের কথাগুলো তার কানে ঠাঁই-ই পায় না।
মুই গেলামরে…নিখিল চলে গেলে নিঃসঙ্গ তেঁতুলগাছটা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমায়। অরুণের টুঁটি চেপে ধরতে চায়। গাছতলার ঝিমধরা বুনোগন্ধের ভেতর নিঃসঙ্গতা যেন উথালপাথাল ঢেউ খেলছে আর কতো কতো মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষুর মায়ের মুখ। মরা বিষুর মুখ। দিনেশের মুখ। যার বিয়া ঠিক হয়েছিল। বাজারসদাই করার পরদিন সক্কলের ঘুম ভাঙলেও দিনেশের ঘুম ভাঙেনি। বাপের যক্ষা। মায়ের পেটে আলসারের কামড়াকামড়ি। বিধবা পাগল বোন অর্চনা রাণি। একসাথে দুটি ভাই জলে ডুবে মরে গেল। চৌধুরী বাড়ির দিঘির জলে দুই ভাই একসঙ্গে ভেসে উঠলো। খুব লিকলিকে ছিল ভাই দুটি। খেয়ে না খেয়ে লিকলিকে হয়েছিল খুব। দিঘির জলে দুই ভাই একসঙ্গে ভেসে ওঠে যেন দিঘির জলে পদ্ম ফুটেছে। আরেক বোন মালতী মরলো ফাঁস লেগে। তার পেট হয়েছিল। নারী সবকিছু লুকোতে পারে, কিন্তু গব্ব লুকোবে কোথায়? চোখ তাই দেখে ফেলে। কানাকানি। ফিসফিস। একদিন মালতি লাশ হয়ে ধানক্ষেতের দোল খাওয়া দেখে। চোখ তার পলকহীন।
…আর দাদামশাইরা, রাতদিনের মুখর মরণকূপে দানবের হুল্লোড় তুলে যায় শেষ রাতের ট্রেন, তখন পাঁজরে মুখ-লুকিয়ে-থাকা প্রাণের ভেতর কী তুমুল হিসহিসানি যে জাগে! রাতভর যক্ষায় ক্ষয়ে যাওয়া বাপের লগে যমের একরোখা টানাটানি চলে আর আর উঠানে শিরীষগাছের ডালপাতার ভেতর থেকে মৃত্যুপাখির হিম ডাক সামাল দিতে না পেরে মায়ের গলা অসহায় রোদন করে চলে ‘যমে তর বাপরে আইজ নিলরে…
খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো এই মিনতি রাইতের স্তব্ধতায় ভগবানের পায়ের কাছে মাথাকুটে মরে। অসহায় পাখি ঝড়ের তোড়ে কোথা থেকে কোথায় উড়ে চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে অবুঝ শাবক। মরে যায়। কী মা, কী ছানা কেউ-ই বাঁচে না। অন্ধকারের ঝুলকালি লেপ্টানো রাত তখন নুনতা জলে থৈ থৈ।
বাপের শ্বাসটানার হাঁসফাঁস তাকে দুমড়ায়, মুচড়ায়। মায়ের বিলাপ মৃত্যুপাখির হু হু ডাকের সমান্তরালে মিশে যায় যেন একই দুঃখে পুরো পৃথিবী কাঁদছে। নিরঞ্জন, ডুগডুগি বাজাও।
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…পাচু চলে যেতেই ফের ঝাপসা চোখে মুখগুলো ভিড় জমায়। খুনে দৃষ্টি মেলে মুখগুলো অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়া বাপ, বাপের বয়স্ক ফুসফুসের অন্তিম প্রতিশোধ নিতে বুক-ফাটানো কাশি আর কান্না আর রক্ত আর মায়ের বিলাপ উন্মাতাল রোষে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। মালতিকে বুকে নিয়ে ধানক্ষেত শশ্মান…হয়তো পৃথিবীর কোথাও ঝড় ওঠে। একটা দূরগামী ট্রেন অনেক লোকজন আর তাদের অনেক অনেক আশাস্বপ্নকল্পনার দোলাচল নিয়ে ইস্টিশনের বুক ফুটো করে দিয়ে দ্রুত চলে যায়।
বন্ধক রাখা ভিটেমাটির ওপর কোনোমতে টিকে থাকা সংসারে নিত্যদিন তার বাপ যক্ষায় আর মা পেটের ব্যাথায় কাতরাচ্ছে…প্যাডেলে চাপ দিয়ে ইস্টিশনের গেট পেরিয়ে, বাজারের মিটমিটে আলোটুকু পেরিয়ে এছাড়া আর কোথায় যাওয়া যায়? তাই প্যাসেঞ্জার নিয়ে বা না নিয়ে প্যাডেলে পায়ের শক্ত চাপ আজীবন…উরুর চুলকানি খুব বেড়ে যায়। এক সামান্য রিকশাওয়ালা সে। সামান্য। এই জটিল মহারণ্যের কিছুই সে বোঝে না। ভাইজানেরা, আমরা কতোভাবে যে জীবনটাকে যাপন করি। গাদাগাদি বাসের ভেতর সিটের আরামে বসে বাইরের দৃশ্যের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকি। বাইরের দৃশ্য তখন খুব মনোরম লাগে। খুব কি মনোরম দাদামশাইরা? হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় শহরের এক্কেবারে বুকের ওপর দাঁড়ানো কারখানাগুলির চিমনি দিয়ে গলগলিয়ে মিশকালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে, যেন এই চিমনি চাঁদের দিকে পরম মমতায় চুম্বন ছুঁড়ে মারছে। ফ্লাইং কিস। অথচ, বুড়ি চাঁদ শুনতে পাচ্ছে বুকের ধুক্পুক। যাকগে, আমরা ফের তেঁতুলতলার থেটারে ফিরা আসি। নিরঞ্জন, বাজাও।
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…বিষুর মায়ের কান্না থামে না। উঠোনে উপুড় হয়ে পড়ে সে কাঁদে। বোবা মানুষের কান্নার সাথে সঙ্গত দেয় এলাকার কুকুরগুলো। রাতবিরেতে কুকুরের কান্না শুনে লোকজন ভাবে দুষ্কালের কথা। মুখে ই বচ্ছর আর ভাত জুটবে না রে। ভাইজানরা, শুধু এই বাজারেই নয় বিশ্ববাজারেই চালের দাম নাকি খুব চড়েছে। কী জানি হয়তো বিশ্ববাজারেও এতোদিনে বিষুর মায়ের কান্না কুকুরের কান্না হয়ে পৌঁছে গেছে।
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…
শহরের কুকুরগুলোর কথা একটু আলাদা। সারাদিন ডাস্টবিনে একটু উচ্ছিষ্ট পায় না তারা। এমনই দুষ্কাল। না পেয়ে ভয় পায়। প্রাণ যাবার ভয়। তখন অতি সন্তর্পণ হয়ে যায় তাদের চলাচল। তারা রা করে না। তারা এমনভাবে দলবেঁধে দৌড়ায় যেন সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে : লেফটরাইট লেফটরাইট।
এমন কেন হয়? বন্ধু নিরঞ্জন? তুমি কি কিছুই বলবে না? শুধু কি বাজিয়েই যাবে আজীবন?
সাইরেন শুনছো? শুনতে পাচ্ছেন দাদাভাইরা? না। এটা এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ নয়। মরণাপন্ন রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। এই সাইরেন রাষ্ট্রীয়। পুলিশের গাড়ি আসছে। র্যাবের গাড়ি আসছে। রাইফেল তাক করে সেনাবাহিনীর শকট আসছে। সবার হাতেই অস্ত্র ভাইজানরা। অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্রীয় লোকজন। আসুন, স্যালুটের কায়দায় লাইন ধরে দাঁড়াই। কেউ যেন আমাদের সন্দেহ না করে যে আমরা কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত। আসুন, কুচকাওয়াজ করি। এক-আধটু প্র্যাকটিস থাকা ভালো। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ অথচ পা শক্ত করে ঠিকমতো স্যালুট দিতে পারো না, লেফরাইট করতে জানো না তা কী করে হয়? দেখুন দেখুন, সাইরেন শুনে কতো মজার ঘটনা ঘটছে। চালের দাম, মাছের দাম, চিনির দাম, কাপড়ের দাম, সারের বস্তার দাম, কেরোসিনের দাম নেমে যাচ্ছে। শুধু সাইরেন শুনে অল্প সময়ের জন্য একসাথে এতো পণ্যের দাম নামার ঘটনা এদেশে খুব বিরল। দেখুন দেখুন…কী চমৎকার দেখা গেলো…
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ…
নিখিল দু কেজি চাল কিনে ফেলে। সাইরেন আসায় দু কেজিতে চারটাকা বেঁচে গেছে। ভগোমান, যদি আরেকটু দয়া করতে, তাহলে সে আরো দু কেজি চাল কিনতে পারতো…ভাইজানরা, বিষুর মায়ের কান্না কি তবে থেমে গেলো? তবে, সব্বাইকে আশ্চর্য করলো একটা কুকুর। একটা উদভ্রান্ত কুকুর। সে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে একটা দোকানে ঢুকে পড়ে। খপ্ করে বস্তায় মুখ ডুবিয়ে একমুখ চাল নিয়েই ভোঁ!
…নিখিল রিকশার প্যাডেলে আরো জোরে চাপ লাগায়। তাকে আজ খুব দ্রুত ছুটতে হবে। দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিটের তলায় মাত্র দু কেজি চাল। তার চার কেজি না হলে দিন চলে না। মুখের সারি গুমগুম করছে : আরো ভাত দে…ছাবালের মুখে আর কোনো রা নেই আর পচা দেখে ইট্টু মাছ কিনতে হবে। পচা হোক, পাতে এট্টু আঁশটে গন্ধ তো পাওয়া যাবে…সাইরেন এলে সন্তর্পণ হয়ে যায় কুকুরের চলাচল। তারা রা করে না। ঘেউঘেউ ভুলে যায়। হয়তো নিজেকে তখন তারা আর কুকুর ভাবতে পারে না। জন্মের মহত্ত্বের কথা ভুলে যায় তারা। দিন কিন্তুক থেমে থাকে না ভাইজানরা। বিষু মারা যাবার আগে একজোড়া ছেলে জন্ম দিয়েছিল, মনে আছে? তাদের বয়েস এখন তিনমাস। মায়ের দুই কাঁখে বসে তারা হাসছে। তাদের মুখে দুধের গন্ধ। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা এখন হাসতে পারে। বেশিদিন বাকি নাই, তারাও বানান করে পড়তে পারবে—ক ল’য় আকার লা কলা…কাঁচকলা, কাঁচকলা। বন্ধু নিরঞ্জন?
ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ।
দাদামশাইরা, থেটারের কুশিলব ফিরে এসেছে। মানে নিখিল এখন চালের ব্যাগ রিকশার সিটের তলায় ঢুকিয়ে রাখছে। তার আর দু কেজি চাল লাগবে। সংসারে ছয়টা মুখ। এদিকে অরুণ দুহাতের আঙুলে খড়কড়িয়ে খুঁড়ে চলেছে উরুর দাদ। নখের মুখে পচা মাংস উঠে আসছে। দুর্গন্ধে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। খামচে খামচে উরুর মাংস খুবলে আনছে অরুণ। রিকশার সিটের তলার একমুঠো চালও জমেনি, তার বদলে উরুর মাংস খুবলে খুবলে…তার দৃষ্টি ফের ঝাপসা হয়ে যায়, তখন একটা আধন্যাংটো লাশ বাতাসের ধাক্কায় ডাইনে বায়ে দুলে…তার বোন মালতির মৃতদেহ।
রিকশার পা-দানিতে রক্ত আর খুবলে আনা পচা মাংস। অরুণ ক্ষিপ্র হাতে উরু খুঁড়ছে।
জড়ানো গলায় অরুণ নিখিলকে ডাকে। নিখিল সাড়া দেয়।
: মালতির কথা তোর মনো অয়নি?
নিখিল থুম মেরে যায়। কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে।
: মালতিরে তোর মনো আছেনিরে…কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারছে।
: মালতিরে তোর… কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারছে।
ভাষাহীন এক নৈঃশব্দ্যের জগতে ঢুকে পড়ে নিখিল। অরুণ তাকে আজ এ কোন বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। দুনিয়ার তাবৎ কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে দিতে চাইছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। চাঁদের বুড়ি মিশকালো ধোঁয়ায় হঠাৎ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিখিলের অসাড় শরীর মাটিতে ধসে পড়ে। একেবারে অরুণের পায়ের কাছে তার মুখ। সে ভাঙাচোরা গলায় বলতে থাকে—মালতিরে মুই মারছিরে অরুণ। আমার মালতিরে…কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে দিতে থাকে! অরুণ দু হাতের খামচায় উরুর মাংস খুবলাতে থাকে।
কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে। মিশকালো ধোঁয়ার আন্ধারে খুব সন্তর্পণে অরুণের কাছে উপস্থিত হয় মালতি। দাদা…ও দাদা। ছোট্টবেলায় লুকোচুরি খেলার সঙ্গীর মতো অরুণ বোনের হাত ধরে টানে। মালতি কাঁদছে। মাথায় খুব রুক্ষ এলোমেলো চুল।
অরুণের উরু বেয়ে রক্ত পড়ছে।
শতাব্দী-পুরান তেঁতুলগাছটার দস্যুর মতো ডালপাতার বুনো গন্ধ চুঁয়ে বহু মানুষের ফিসফিসানি আর আক্রোশ ছাপচিত্রে ঝুলে আছে গো দাদামশাইরা আর কারখানার আকাশমুখী চিমনিগুলো মিশকালো ধোঁয়া ছুঁড়ে দিচ্ছে চাঁদের বুড়ির দিকে।
নিরঞ্জন, কোথায় তুমি?…
লেখাটি প্রকাশিত হয়