দোহার । রিমি মুৎসুদ্দি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ, | ৪৩৫ বার পঠিত
‘লকডাউনের পরে / বৌমা এল ঘরে’
পোস্টারটার দিকে একবার তাকিয়ে রূপালী একদলা থুথু ফেলল। উত্তুরে বাতাসের দাপটে ধুলো এসে ওর নাকে ঢুকেছে। রূপালী কাশছে। কাশতে কাশতেই হারুকে চিৎকার করে ডাকল।
খানকতক পোস্টার এখনও লাগানো বাকি হারুর। হাতের কাজটা চটপট সেরে নেবে সে উপায়ও নেই। রূপালী আবার দলে আসার পর থেকে হাঁকডাক করেই চলেছে। অধিকারী যে কী কারণে রূপালীকে আবার দলে নিল? হরি ভাবে, এমনিতেই এই ক’টা পেট চালানো দায়। রোজগার নেই। তা অধিকারীর ঘটে কি বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কিছু আছে?
ওদের কাজটাজ এতদিন বন্ধই ছিল।
—সেই বোশেখ মাস থেকে ঘরে বসে বসে রসদও তলানিতে। তায় আবার বড়তি লোক?
গাছে উঠে ব্যানারটা একটু ঠিক করতে হবে। কেমন একদিকে কাত হয়ে রয়েছে। হারু রূপালীর ডাকে পাত্তা দেয় না। একটু বিরক্ত মুখে গাছে উঠল।
কানাই চায়ের ভাঁড় হাতে ইস্কুল বাড়িটার দিকে যাচ্ছে। ওদিকে চায়ের আসর বসেছে। হারু তড়িঘড়ি কাজ সারতে থাকে। দেরী করলে আবার চা শেষ হয়ে যাবে। তখন ষ্টেশনে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
গাছের ওপর থেকেই দেখতে পায় রূপালী হাতের ইশারায় ওকে ডাকছে। হারু বিরক্ত হয়।
—আচ্ছা জ্বালালে তো?
উপর থেকে চিৎকার করে বলে,
—চা পাবে না এর পর গেলে। যাও ওদিকে চা এসেছে।
রূপালী দাঁড়িয়েই আছে।
হারু ভাবে রূপালী এমনিতে মন্দ নয়। তবে এই আকালে আবার একজনকে পুষতে খরচ আছে যে! লাভ তো আর কিছু বাড়বে না দলের।
অধিকারীর মেয়েমানুষের প্রয়োজন হলে কেতকী তো আছেই।
রূপালী ঠিক নতুন নয়। কেতকী আসার আগে রূপালীই ছিল সুবল অধিকারীর যাত্রাদলের একমাত্র মেয়ে। দল গড়ার সময় থেকেই হারু আছে অধিকারীর সঙ্গে। ফাই ফরমায়েশ খাটা থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব দায়িত্বই ওর।
রমেণ মিস্ত্রির অবর্তমানে মঞ্চে বাঁশিটাও হারু বাজিয়ে দিত এতদিন। এখন ফুসফুসে তেমন জোর পায় না। রমেণ অবশ্যি বলে,
—কাকা, তুমি বাঁশি বাজাও দিনি। বাঁশি বাজালে তোমার ফুসফুসের ব্যামো সেরে যাবে।
রাত্রে যাত্রা জমে গেল। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি। গা গেরামে মানুষ যেন উৎসব ছাড়া সব ছটফট করছিল। মুখে কাপড় বেঁধেই সবাই এসেছে। থানায় পয়সা দেওয়া আছে। কতজন লোকের জমায়েত তা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই।
হারু মুচকি হাসে। চেষ্টা কি ও করেনি? দলটা যতটা অধিকারীর ততটা হারুরও। দল বাঁধার ইচ্ছে থাকলেও হারুর হাতে টাকাপয়সা ছিল না। সুবলকে মনের মতো সঙ্গী পেয়েই নেশাটা ওর ওপরও চাগিয়ে দিল। পরিকল্পনা হারুর টাকা সুবলের।
এখন দল বড় হয়েছে, পুরনো হয়েছে। হারুও পুরনো হয়েছে। এখন সব ভাবনার অধিকার ও দায় সুবলেরই।
হারুর কাজ যে আসলে কি তা ভাবার মতোও সময় আজ ওর নেই। তড়িঘড়ি গাছ থেকে নেমে এল। রূপালী একভাবে দাঁড়িয়েই আছে।
—চা যে সব শেষ হয়ে যাবে রূপাদিদি। এখন পা চালাও দিকি। আমাদের জন্য আর পড়ে আছে না কেউ চোঁ চোঁ করে দু তিন কাপ মেরে দিল? বলার তো কেউই নেই। সুবলের যেমন ধারা! কোনোদিকে খেয়াল আছে? ওই কেতকী আসার পর থেকে তো আরও বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে ব্যাটার।
কথাটা বলে মুচকি হাসে হারু। আড়চোখে তাকায় রূপালীর দিকে। একটু জ্বালা ধরাতে পারলেও ওর সুখ।
বাঁশিটা গিয়ে অব্দি হারুর জীবনে আমোদ আহ্লাদ বলে তেমন কিছু নেই।
—তুমি আমার একটা কাজ করে দিবা?
—কী কাজ? আমার এখন মেলা কাজ।
—একটা নতুন পালা?
হারু অবাক হল।
—কিন্তু আমাদের তো পালার সব কাজ রেডি। এখন তো আর নতুন করে কিছু হবে না।
হারুর গলার ঝাঁঝ টের পায় রূপালী। নাকের ভেতর ধুলো অস্বস্তি দিচ্ছে। একটু হাঁচতে পারলে আরাম পেতো। এখন আবার হাঁচি কাশী মানেই বিপদ। লোকে সন্দেহ করবে। তাড়িয়ে দিতে পারে দল থেকে। এমনিতেই দলের কারুরই ইচ্ছে নয় রূপালী আবার এসে জুড়ুক।
—এই লকডাউনে তো কাজকাম ছিলই না। আমি ফিরে আসায় তোমাদের মনে হচ্ছে একটা পেট এসে তোমাদের ভাত মারবে?
হারু কোনো উত্তর দেয় না। হনহন করে হাঁটে। হারুর সঙ্গে প্রায় তালমিলিয়ে রূপালীও জোরে পা চালায়। জোরে হাঁটার কারণে রূপালী হাঁপায়।
—এখন মেলাগুলো সব আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছে। বড় বড় মেলাতেও যাত্রাপালার অনুমতি দেবে। আমাকে নাহয় তাড়িয়েই দিও। কিন্তু একটা বুদ্ধি ছিল। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। অধিকারীকেই বলতাম। কিন্তু তুমি দলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। তাই তোমাকেই কথাগুলো বলছি কাকা।
হারুর মনটা নরম হয়। রূপালী যে ওদের দলে সেই প্রথম থেকেই ছিল সেকথা এবার বুঝি ওর মনে পড়ে।
—তা, দল তো তোমারও। তাছাড়া, আমি তাড়ানোর কে? কিন্তু বোঝোই তো দিদি। এতগুলো পেট চালানো কি মুখের কথা? সুবলের তাও বাপের ধানিজমি আছে। তবে এবার তো ধানের দামও নাকি তেমন পায়নি। চাষের জমিতে বন্যার জল ঢুকে একসার। কারোর হাতে পয়সা নেই। হাতে কাজ নেই। লকডাউনের পর এই আমাদের প্রথম পালা।
—কিন্তু এটা একটা পালা হারু কাকা?
হারুকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে রূপালী।
—তা খারাপ কী? পালাখান তো ভালোই লিখেছে অধিকারী। নামটাও বেশ আধুনিক।
‘আধুনিক’ শব্দটা বলে হারু চোখ সরু করে হাসে।
—‘লকডাউনের পরে/ বৌমা এল ঘরে’ বেড়ে নামখান দিয়েছে অধিকারী। তা বৌমাই তো এল। অধিকারীর ঘরেই। তবে বৌমা নয় বৌ এল ঘরে।
হারু খিকখিক করে হাসে আর রূপালীর দিকে তাকায়। তারপর গলা অকারণেই নামিয়ে বলে,
—তোমার অধিকারী যে কেতকীকে বিয়া করবে গো রূপাদিদি। অধিকারী কী বলে জানো? বলে, “জীবনে এই প্রথম অবিবাহিত একটা কচি মেয়ে এল। এতদিন তো সব বিয়াআলাগো নিয়াই কামকাজ করলাম। একে আর ছাড়ছিনে। এক্কেরে বিয়া করেই ঘরে রাখব।”
রূপালী কিন্তু এই ঠাট্টা বিদ্রূপ গায়ে মাখে না। বলে,
—তা বেশ। অধিকারীর বিয়েতে আমি বেনারসি পড়ব আর কবজি ডুবিয়ে খাসির মাংস খাবো। কদ্দিন খাসির মাংস খাই না?
রূপালী যেন মাংস খাওয়ার স্বপ্নে ভরপুর।
হারু অবাক হয়। সুবলের জন্যই ঘর ছেড়েছে রূপালী। স্বামী সন্তান ছেড়ে সুবলের সঙ্গে দল গড়েছে। দলের জন্য একবার নিজের কানের মাকড়ি পর্যন্ত দিয়েছিল সুবলকে। হারু এসবই জানে। নিজের মনেই বলে,
—ব্যাটাছেলের পরাণগুলো সব লোহার। কেতকীর ফরসাপানা মুখ ডাগর দুটো চোখ দেখে সুবল নাহয় ভুলেছে। বয়সেও কেতকী রূপালীর চেয়ে অনেক ছোটো। তবে ও নিজে কী বলে মেয়েটার প্রতি এত নিষ্ঠুর হচ্ছে? সেই কোনকালে, সুবল যে হারুর চেয়েও রূপালীর কথাকেই দলের সবকিছু মনে করত? সেই পুরনো হিংসে?
হারু নিজেকে ছি ছি করে। রূপালীর সরু দুটো চোখ আর মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। মেয়েটা আসা ইস্তক হারু ওকে আকারে ইঙ্গিতে তাচ্ছিল্য বিদ্রূপ করে আসছে। সে কেবল হিংসার কারণে নয়। এই ক’টা টাকা আরও একভাগ হলে কী পড়ে থাকবে ? এও বড় ভাবনার।
কথা বলতে বলতে ওরা ইস্কুল বাড়িতে এসে গেছে। রূপালী বলল,
—চলো অধিকারীর ঘরেই চা খাওয়া যাক। কেতকী ঘুম থেকে উঠলে ভালো। নাহলে ওকেও ডেকে নিই। সবার সঙ্গেই আলোচনা প্রয়োজন।
অধিকারীর ঘরে মোটামুটি সবাই আছে। রূপালী কথা বলছে,
—এই পালা নিয়ে আমার কোনও কথা নেই। কিন্তু এরপর আমাদের নিমন্ত্রণ শিমুলখালি গ্রামে। সেখানে পালাটার পরিবর্তন হোক।
পালা বদলের কথা শুনে সকলের মুখেই অসন্তোষ। এখন নতুন পালা লেখা, পার্ট ঠিক করা, পোশাক ওসব খুবই হ্যাঁপা।
কথাটা কে যেন বলল।
রূপালী তৈরিই ছিল।
—না। নতুন পালা নয়। পুরনো পালার কথাই বলছি। এই লকডাউনে মানুষ ঘরে থেকে থেকে ক্লান্ত। আবার লকডাউনের কথাই যাত্রাতেও ওরা শুনতে চায় না। প্রেমের গল্প হলেও না। বরং পুরানো দিনের প্রেমের গল্পগাঁথা মানুষের ভালো লাগবে। আমরা আরও ডাক পাবো।
হারু কিছু বলতে যাচ্ছিল। সুবল থামিয়ে রূপালীকে জিজ্ঞেস করে, কী পুরোনো পালার কথা তোমার মনে আসছে?
—কেন? ‘বেহুলা লক্ষীন্দর’।
কথাটা বলেই কেতকীর দিকে তাকায়। তারপর নরম করে বলে,
—এই তো আমাদের বেহুলা। এখন লখাই…
হারু এবার জোরে হেসে ওঠে।
—অধকারী তোমাকে কিন্তু বেহুলার পাশে লখাই মানাবে না। বরং তুমি শ্বশুর চাঁদসদাগর হও। আর রূপালী মনসা।
হারুকে রসিকতায় পেয়েছে।
—মনসার পাশে চাঁদ ব্যানাকে দারুণ মানাবে কিন্তু। বেহুলাকে লখাই দেখে দিতে হবে খালি।
ইচ্ছে করেই পরিবেশটাকে উত্তপ্ত করতে চায় হারু। রূপালীর পরিকল্পনা ও বুঝেছে। আসলে এই পালায় রূপালীর কোনও রোল নেই। তাই নিজের দিকে মঞ্চের আকর্ষণ টানতেই এই প্রস্তাব।
—পেটে পেটে এত?
একটু আগে রূপালীর প্রতি যে সামান্য মায়াটুকুও ওর মনে উদয় হয়েছিল এখন আর তা বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
হারুকে অবাক করে দিয়ে সুবল বলল,
—কথাটা মন্দ নয়। আমিও একই কথা ভেবেছি। প্রতিটা পালাতে দর্শকের হাততালির মধ্যে দিয়ে আমি বুঝতে চেষ্টা করি। কতটা মুগ্ধতা দিতে পারলাম ওদের? এই পালাতে তেমন সাড়া পেলাম না। এ আমিও বুঝেছি।
হারু থামে না।
—সে কি? কথাটা তুমি ঠিক বললে না। কেতুদিদি যখন মঞ্চে এসে তোমার গলা জড়িয়ে গাইল ‘পরাণ আমার…’, কত সিটি যে পড়ছিল! তুমি শোননি?
—সিটি আর মুগ্ধতা এক নয় হারু কাকা। ওসবের আয়ু কতক্ষণ? মুগ্ধতা থেকে যায়। সামনের বছর তার পরের বছর আরও অনেক বছর মুগ্ধতা থেকে যায়। হয়ত আমরা এলাম না এখানে, অন্য দল এল। তখনও কেউ কেউ বলবে, পালা করেছিল বটে সুবল অধিকারীর দল।
—আমারে বোঝাও তুমি অধিকারী? শিল্পীকে মঞ্চে দর্শকের মুগ্ধতার মায়া কাটাতে হয়। নাহলে সে চরিত্রে ঢুকতে পারে না। অভিনয় সার্থক হয় না। মুগ্ধতারও আয়ু কয়দিনের?
নিজের কথার স্বপক্ষে হারু বলে,
—এক সময় ছবি আঁকতাম। আমার ওস্তাদ বলেছিল, ছবি আঁকতে গেলে রঙের মায়া কাটাতে হয়। রঙের নেশা সর্বনাশী! তোমাকেও মুগ্ধতার নেশায় পেয়েছে অধিকারী।
হারু আর উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সুবল হারুকে সম্মান করে। দলে প্রচুর কাজ করে বলে নয়, যাত্রাদলের এই নেশা তো হারুকাকাই ধরিয়েছে সুবলকে। সেই অর্থে হারুই সুবলের গুরু।
চোখের ইশারায় কেতকীকে কিছু বলে। কিছুক্ষণ পরে হারু কেতকীর সঙ্গে আবার ফিরে আসে।
এইবার সুবল বলে, পালার নাম আমি দেব ‘জয় বিষহরি।’
হারুর মুখে অপ্রসন্নতা।
—আবার ঠাকুর দেবতা নিয়ে কেন?
—আরে শোনো না কাকা। এবারের পালাতে আরও একটু যোগ করেছি।
—এখন আজকের পালাটা তো হোক। তারপর শুনব।
রাত্রে যাত্রা জমে গেল। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি। গা গেরামে মানুষ যেন উৎসব ছাড়া সব ছটফট করছিল। মুখে কাপড় বেঁধেই সবাই এসেছে। থানায় পয়সা দেওয়া আছে। কতজন লোকের জমায়েত তা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই।
নতুন জায়গায় নতুন পালা। সুবলের ইচ্ছে অনুযায়ী ক্ষেমানন্দের জীবনেতিহাস সামান্য যোগ হয়েছে এবারের পালায়। ক্ষেমানন্দের ভূমিকায় সুবল মঞ্চে এসেছে। বঁড়শি হাতে দুটো ছেলে মঞ্চে এল। সুবল মানে ক্ষেমানন্দ ছেলেগুলোকে বলল,
—দে দুটা মাছ দে আমায়?
ছেলেগুলো সুবলের কথা যেন শুনতেই পেল না। নিবিষ্ট মনে বঁড়শি হাতে মাছ ধরছে। ক্ষেমানন্দ আবার বলল,
—আচ্ছা, একটা বঁড়শি অন্তত দে? আমি নিজেই নাহয় ক’টা মাছ ধরি? খড় কাটতে এসে মাছ নিয়ে গেলে মা কত খুশি হবে। দে না ভাই?
ছেলে দুটো এইবার কথা বলল,
—না। দেব না। তুই যা এখান থেকে।
ক্ষেমানন্দ প্রচণ্ড রেগে গেল। ছেলেগুলোর বঁড়শি কেড়ে নিল। তারপর দুজনকে মেরে তাড়িয়ে দিল। ছেলেগুলো কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে চলে গেল।
ক্ষেমানন্দের মুখে হাসি। তখুনি মঞ্চের আলো নিভে গেল। যেন খুব ঝড় উঠেছে এমন শব্দ। আবছা দুটো হ্যারিকেনের আলো কে যেন চুপচাপ মঞ্চে রেখে গেল। ওইটুকু আলোতে মঞ্চ আলোকিত হল না। অন্ধকার ভাবটাই রইল।
কোরা শাড়ি পরে একটা মেয়ে মঞ্চে এল। পিঠে তার একরাশ কালোচুল। শাড়িটাও খুব অদ্ভুতভাবে পরেছে। হাঁটুর নীচের একটুখানি অংশ বাদে বাকিটা অনাবৃত।
মেয়েটা ক্ষেমানন্দকে বললে,
—দুটো পয়সা দাওনা আমাকে? আমার কাপড় নেই। দেখো কত খাটো একটা কাপড় পরেছি? কাপড় কিনব। দুটো পয়সা দেবে?
ক্ষেমানন্দ উচ্চস্বরে বললে,
—কে রে তুই ছল করিস আমার সাথে?
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। ক্ষেমানন্দ চিৎকার করল,
—আঃ আঃ আঃ
মঞ্চ থেকে মেয়েটা চলে গেল। ক্ষেমানন্দ মঞ্চে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে আরও দুটো হ্যারিকেন আলো মঞ্চে জ্বলে উঠল। এইবার মেয়েটা মঞ্চে ফিরে এল। ক্ষেমানন্দ তখনও শুয়ে।
মেয়েটা বলল,
—‘উঠ পুত্র ক্ষেমানন্দ/আমার এ রূপ না করিয়ো প্রকাশ’
ক্ষেমানন্দ কোনও উত্তর দিল না। মঞ্চে মনসারূপী রূপালী বলল,
—‘আমার মঙ্গল গীত গাও। বুল, জয় বিষহরির জয়।’
ক্ষেমানন্দের কোনও সাড়াই পাওয়া গেল না। রূপালী চিৎকার করে উঠল।
বিষে সুবলের সমস্ত শরীর নীল হয়ে গেছে। দর্শকদের মধ্যে গদাই ওঝা ছিল। ছুটে মঞ্চে এল,
—‘এ তো কাল কেউটের কাজ! এখানে এল কী করে?’
যাত্রাদলের সবার মাথা নীচু। এ বুদ্ধি সুবলেরই। বেহুলা স্বগগে নাচ দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে মনসার কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষে করবে। সত্যিকারের সাপ নিয়ে মনসারূপী রূপালী মঞ্চে প্রবেশ করবে। সত্যিকারের সাপ দেখে দর্শকরা হতবাক হয়ে যাবে। ভয়ে বিস্ময়ে এই পালাটার জয়গান গাইবে।
আর সাপটাকেও বিষ কামিয়েই আনা হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি তো মঞ্চে সাপের আসার কথাই নয়। ঝুড়ি থেকে সাপটা বার করল কে? আর বিষ?
এইসব প্রশ্নে তোলপাড় হচ্ছে যাত্রাদলের অনেকেই। গদাই ওঝা ওদের আশ্বাস দিয়েছে। ঠিক মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ বার করবেই। রূপালী আর সহ্য করতে পারল না। চিৎকার করে ওঝাকে বললে,
—রাখো। তোমার ঝুটা কেরামতি রাখো। এইবার হাসপাতালে নিয়ে যাবোই।
কে যেন বলল, পুলিশ আসছে। সাপ নিয়ে খেলা দেখানো বারণ।
পুলিশের কথা শুনে অনেকেই পালিয়েছে। হারু আর রুপালী সুবলকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। হারু রূপালীকে বারণ করেছিল। তবুও ও এসেছে সঙ্গে। বিষে সুবলের সমস্ত শরীর নীল। শ্বাস আর একটুও অবশিষ্ট আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রূপালী সুবলের বুকের কাছে কান নিয়ে এসে শোনার চেষ্টা করল। তারপর ওই বুকের ওপর মাথা রাখল।
অন্ধকার রাত। গাড়ি চলেছে সদর হাসপাতালের দিকে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আন্টিভেনাম নেই। রূপালীর মাথা রাখা সুবলের বুকে।
হারু রূপালীর মাথায় হাত রেখে বললে,
—বিষটা তুই কামাতে দিলি না কেন? আমি জানি। অধিকারী একটা বিষ কামানো সাপ চেয়েছিল। তুই গদাইকে পয়সা দিয়েছিস। বল মাগী? কেন তুই বিষটা কামাতে দিলি না?
দশবছর ধরে বিয়ে না করেও অধিকারীর সঙ্গে সংসার করছিলি। এখন এই লকডাউনে তুই দুটো পয়সার জন্য নিজের গেরামে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেতুকে ধরে আনলে। তাই হিংসায় একাজ করলি? অধিকারীকেই মারলি?
রূপালী মাথা না তুলেই বলে,
—আমাকে গেরামে অধিকারীই পাঠিয়েছিল। ওই যে অধিকারীর বাপের জমি থেকে এবার একটা টাকাও এল না। আমার বাপের দেওয়া ক’গাছা চুরি নিয়ে আসতেই অধিকারী আমাকে পাঠালে। তারপর যেই নতুন মেয়ে পেলে, রূপালী বাদ।
আর তুমি কি করেছ আমি জানিনা কাকা? আমি তো সাপটা কেতুর ওপর ছাড়তাম। তুমি ওই প্রথম দৃশ্যে অকারণেই হ্যারিকেন রাখতে এসে ঝাঁপিটা উপুড় করে দিয়ে গেলে। আমি যে সবই দেখলাম। নিজের জালে এমন জড়িয়েছি যে বাঁচাতে পারলাম না। কেন করলে এই কাজ কাকা? কেন আমার দোহার হলে?
-ব্যাটা কিচ্ছু জানে না। বলে কিনা দর্শকের চোখে মুগ্ধতা, ভয়! ও শিল্পের কী বোঝে? হাততালি ছাড়া আর কিছু জানে? তুমিও কিছু জানো রূপালী? আমার কোনও কথা সুবল শুনত? আমি কি কেবলই চাকরবাকর? এই পালাটাই করতে বারণ করেছিলাম। নতুন দুটো পালাও আমি লিখলাম। কিচ্ছু মনে ধরল না? মঞ্চে সাপ আনতে বারণ করলাম। শুনলে? আমাকে তোমার দাস করে রাখলে?
অথচ এই দলটা তো আমারই…
ওরা দুজনেই কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছে ওরা।
আকাশে অজস্র তারা যেন অন্ধকার ফুঁড়ে এক নতুন মেলার আয়োজন।