মোহরবানুর মূর্শিদাবাদ । জয়শ্রী সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ৯:২৭ অপরাহ্ণ, | ৩৭৫ বার পঠিত
ঘাটটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। তার মধ্যে কলার একটা বাকল উল্টা হয়ে পড়েছিল। ভজা সেখানেই ধুমমম করে পড়লো। আছাড়টা বেশ শক্তপোক্ত খেয়েছে। ব্যথা কোথায় লেগেছে তা দেখার আগে সে এদিক ওদিকে চেয়ে দেখে। চারদিকে সকলেই মহাব্যস্ত। কে আছাড় খেল, কে আচার খেল দেখার সময় নেই। তাছাড়া ভজার কান্না সকলের কাছে ডালভাত। তাই আহা-উহু করে দরদ দেখাবে দূরের কথা, কেউ কাছেই ঘেঁষলো না।
কেউ দেখে নাই নিশ্চিত হয়ে ভজার ব্যথাও যেনো কিছুটা প্রশমিত হলো। সে তড়িঘড়ি উঠতে যাবে এমন সময় চোখ পড়লো বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাছুরটার দিকে। বজ্জাত বাছুর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যস্ ভজার ব্যথা তিনগুণ বেড়ে গেল। সে শরীরটা আবার মাটিতে বিছিয়ে দিল। তারপর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে হাত-পা ছুড়ে কান্নার বান বইয়ে দিতে লাগলো।
কিছুক্ষণ আপন মনে কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুখানা যখন চিনচিন ব্যথা করা শুরু হলো তখন দ্রæতলয় থেকে মধ্য, মধ্য থেকে বিলম্বিত লয়ে এসে কান্নার ইতি ঘটলো। দীঘির ওপরে ভেসে থাকা ব্যাঙাচি আর পোনাদল কি বুঝতে পেল কে জানে! একটানা চিঁচিঁচিঁচোচোচো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করতেই লাগলো। ঘাটপাড়ের জাম্বুরা গাছ থেকে একটি পাকা জাম্বুরা টুপ করে জলে লাফিয়ে পড়লো। ছোট্ট পানকৌড়ি পাখিটা চুপচুপ করে ডুবছিল ভাসছিল। একটা সরপুঁটি মাছ প্রায় সে ধরেই ফেলেছিল কিন্তু জলের কাঁপুনিতে তা ফসকে গেল। একমুখ বিরক্তি নিয়ে পাখিটা বসে রইলো। কারো পাত্তা না পেয়ে ভজা নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ায়। এরপর প্যান্টে হাত ঘষতে ঘষতে লাল বাছুরটাকে চিমটি কাটতে চলে গেল।
একরত্তি জিরান নেই আজ কারো। শেষ রাত থেকেই ঘাট সরগরম। কখনো চাল, কখনো সবজি, কখনো ডাল, কখনো মাছ, কখনো এটা, কখনো ওটা ধোওয়ার লাইন লেগেই আছে। ইসমাইল কাঁধে করে কলাপাতার স্তুপ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে। এখন ঘাট হারুর দখলে। সে জলে দাঁড়িয়ে বালতি ভরে দিচ্ছে আর দুইজন পালা করে সে জল নিয়ে রেখে আসছে। রান্নার জল না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আপাতত ঘাটে নামা যাবে না। তাছাড়া রান্না হলে তবেই না কলাপাতার কাজ। তাই ইসমাইলকে অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যসময় হলে হারুকে এতক্ষণে কয়েকদফা চুবিয়ে নিত ইসমাইল। আজ সময় সুযোগ কোনোটাই নেই। তাছাড়া বাড়ি ভর্তি অতিথি। ঐদিকে রাঙাবাবুর হাঁকডাক তো লেগেই আছে। তিনিই ভোজের কর্তা। সকাল থেকে কাকের মত কা কা করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। এক ফাঁকে যে একটু গঞ্জি টেনে নিবে সে সুযোগ ইসমাইল পায়নি। এখনো পালকি সাজানো বাকি। যাত্রাদলের জলখাবার দেয়া বাকী। কখন কলাপাতা ধুয়ে নিয়ে যাবে! হারু বেটা যে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে তাতে জোরজবরদস্তি খাটবে না।
সেনবাড়ির সামনের মাঠে অনেকখানি জুুড়ে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। এই বাড়িতে আজ সাড়া গ্রামের নেমন্তন্ন। পাঁচপদের রান্না হচ্ছে। সোনামুগের ডাল, মিষ্টি কুমড়ার বড়া, বোয়াল মাছের কালিয়া, মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, চালতার টক ও মিষ্টান্ন। লাল-নীল কাগজ দিয়ে ঝালর বানানো চলছে। চালের গুঁড়ি দিয়ে আলপনা আঁকছে উঠানজুড়ে। ঢাক নিয়ে এসেছে বরুণ ঢুলি, এ অঞ্চলের তুখোর বাজিয়ে। বাবুদের পালপরবে তিনিই আসেন। শেখ আর সেনের বেটি একজন অন্যজনকে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে। পালকি সাজানো শেষ হলেই ওরা চরে বসতে পারতো। ভজাও দিদির সাথে পালকিতে চড়বে বলে ফুলবাবু সেজে ঘুরছে। সারাক্ষণ তার মুখটি নড়ছেই। এটা-ওটা খেতে খেতে সে বাড়িময় ঘুরছে। এখন ঢাকের সামনে দাঁড়িয়ে বকবক করছে। তার মধ্যে রাঙাবাবু তো আছেনই। তার হুমকি ধামকি মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে সকলের।
‘বলি, খাওয়াটা হবে কখন? এখনো পালকিটা সাজাতে পারলিনা! এই শেষবার। আর কোন কাজে তোরা আমাকে পাবি ভেবেছিস? আমি আর নাই। এই কান মললাম. . ..’ এই একই সংলাপ বাড়ির লোকজন বার ত্রিশেক শুনে ফেলেছে। অবশ্য এই তাড়া দেয়াটা যুক্তিপূর্ণ। সারাগাঁয়ে পালকি ভ্রমণ শেষ না হলে ভোজন শুরু হবে না।
রাঙাবাবুর বকবকানিতেই বংশী তার নকশা-কাটা বাঁশিতে ফুঁ দেয়। মিনতি ঝনঝন করে ঝাঁঝ বাজায়। বরুণ ঢাকি ঢোলের কাঠিতে বাদ্যি তোলে। বউ-ঝিয়েরা তেল-সিঁদুর নিয়ে পালকিতে পঞ্চফোঁটা দেয়। দুইবাড়ির মা মাসিরা সইপাতানির গীত গায়। উলু দেয়। শেখ বাড়ির বড়বিবি দোয়া পড়ে ফুঁ দেন নাতনিদের মাথায়। সাজুগুজু করে দুই কন্যা রানির মত পালকিতে চড়ে বসে। ভজা ঠেলেঠুলে ওদের মাঝখানে চড়ে বসেছে।
‘হুহুহুন্না হুহু হুন্না. . .’ মেঠোপথের আইল ধরে একটি পালকি ছুটে যায়। পালকির তালে তালে হেঁটে যায় সইপাতানির দল।
গাওজুড়ে নিমন্তন্ন খাওয়ার সাজসজ্জা চলছে। কেউ চুলে তেল মেখে বেণী গাঁথছে। কেউ সিঁথি তোলার জন্যে চিরুনিটা নিয়েছে। কেউ আলতা দেয়া শেষে শিশির ছিপি আটকাছে। কেউ মুখে পানটা গুজে চুনটা ঠোঁটে দিয়েছে মাত্র। কেউবা ঘরের শিকল তুলেই রওনা হচ্ছিল। এমন সময় গীত-হৈহৈ-ঢাকের বাদ্যি। ছোটরা এক ছুটে পালকির দিকে। বউ-ঝিয়েরা ঘোমটা টেনে উঠানে মাচার কোণে। অধিকাংশ পুরুষেরা আগেই বেরিয়েছিল। যারা বাড়িতে ছিল তারা জামাটা কাঁধে ফেলে বের হয়ে আসে। উপচে পড়া চাহনি তাকিয়ে থাকে পালকিবহরের দিকে। ছোটরা খুশিতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তালি বাজায়। পালকিতে বসে দুই সই কুটুরকুটুর হাসে। পালকিবহর গাঁয়ের আলপথ, দীঘি, ক্ষেতখামার পেরিয়ে সামনের দিকে ছোটে। পেছনে বরুণ ঢাকির বিশাল বাদ্যিদল।
সোনামুগের গন্ধে পাড়া উজার। দলে দলে অতিথি সেবা চলছে। দূর-দূরান্ত থেকে পাখিরাও যেন মহাভোজেই এসেছে। ঘাটের এককোণে যেখানে এঁটো কলাপাতার তোপ সেখানে মাছভাত খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফুরুৎ-ফুরুৎ করে উড়ছে সবাই। চারদিকে মহাধুমধাম। মহাভোজ খেয়ে সকলে ধন্যিধন্যি করছে।
দুই সখি বসে আছে পিঁড়িতে। সামনে দুধের নাড়–, ধানদুব্বা মিষ্টান্ন। ভজা খঞ্চা থেকে একটা দুধের নাড়– তুলে নেয়। খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করে, ‘ও দিদি সইপাতালে কি হয়রে?’
মঞ্চের সামনে হারিকেনের মত দেখতে বেশ বড় একখানা আলোর কুÐলী। মঞ্চসহ অনেকখানি জুড়ে তার ছায়া পড়েছে। ঝাঁকরা চুল দুলিয়ে বিবেক এসে ঢুকছে। পরনে গেরোয়া জামা, হাতে খঞ্জনি। কি তার সুর! নেচে দুলে সে গাইছে। সামনের সারিতে মহোৎসবের সইযুগল। সমগ্রদিন শেষে ওদের চোখে ক্লান্তি প্রসন্ন।
সারাদিনে এইকথা কম করে হলেও সে জোড়া কুঁড়িবার জিজ্ঞাসা করেছে। তাই দিদিরা ঠোঁট উল্টে ভেঙচি কাটে। ভজা খাওয়ায় মন দেয়। সে আরো একটা নাড়– নিয়ে বাবলা গাছের দিকে চলে যায়। লাল বাছুরটার লেজ ধরে দোল খেতে খেতে নাড়– খায় আর ভাবে সইপাতালে কি মজা! আজ বাড়িতে যাত্রাগানও হবে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে চাঁদটা কেনো এখনো উঠছে না। চাঁদ উঠলে তবেই না রাত। রাত নামলে শুরু হবে গান।
মঞ্চের সামনে হারিকেনের মত দেখতে বেশ বড় একখানা আলোর কুÐলী। মঞ্চসহ অনেকখানি জুড়ে তার ছায়া পড়েছে। ঝাঁকরা চুল দুলিয়ে বিবেক এসে ঢুকছে। পরনে গেরোয়া জামা, হাতে খঞ্জনি। কি তার সুর! নেচে দুলে সে গাইছে। সামনের সারিতে মহোৎসবের সইযুগল। সমগ্রদিন শেষে ওদের চোখে ক্লান্তি প্রসন্ন। বড়দের চোখে মুখে বিপুল আনন্দের ঢেউ। বিবেকের ঠুমরীর সুরে চমকে চমকে উঠছে। রাত বয়ে যায়। ছোটরা ঘুমে ঢুলে পরে। বড়রা তন্ময় হয়ে শুনছে।
‘উপরে তোর বান বইছে
ঘিরিছে কালিয়ার বিষে, জীবন জুড়াবে কিসে।
নীলকণ্ঠ বনে বাঁচবি কিসে
মগজে বিষ উঠেছে।
আমার পরান কাঁদিছে।
পর কোনোদিন হয়না আপন মন জেনেছে
তবে কেনো সখী পরের লাগি আমার পরান কাঁদিছে
আমার হৃদমাঝারের পোষাপাখি
আমায় ফাঁকি দিয়েছে।’
হঠাৎ মোহরবানু উড়ে যাচ্ছে। পদ্মার পাড়ের ঐ বটগাছে একটি ধনেশ পাখি ওকে জাপটে ধরেছে। যমুনা কানছে আর ডাকছে। ‘সইলো ও সই, কোথায় তুই’। নদীয়া থেকে আসা সুদর্শন বাউলের গানের সুরের ভাঁজে মোহরবানুর আর্তনাদ হারিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে মোহরবানু চাপাকান্নায় ডুকরে ওঠে। সালাউদ্দিন উঠে দাদীকে ডেকে তোলে। মোহরবানু স্বপ্নভেঙ্গে উঠে বসে। অন্ধকারে নাতির মুখ ধরে ঠাওর করার চেষ্টা করে কই আছে? সঙ্গে থাকা ছেলেটি কে!
সালাউদ্দিনের ঘুমটা লেগেছিল মাত্র। এখন বাকিরাত বসে দাদীমার সইপাতানির ইতিহাস শুনতে হবে। একই কিচ্ছা। পদ্মার ঐপাড়ে মুর্শিদাবাদে তাদের বাড়ি। ওগাঁয়ের সকলেই জানে কত বড় করেই যমুনার সাথে তার সইপাতানো হয়েছিল। কি জানি কি হয়েছিল ঠিকঠাক সে বুঝে উঠতে পারেনি। সই কোথায় গেল, সেই কোথায় এলো! আবার সইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কোন দূরের গাঁয়ে, তাই সে খবর নিতে পারেনা বলে যুক্তি খÐাবে। যেখানেই থাকুক তাদের আত্মার সম্পর্ক। শুধু তাই না। পাতানো সই মরলে অশৌচ খেতে হয় তাদের গাঁয়ে।
এই একই প্যাঁচাল শুনে শুনে সালাউদ্দিনের কান তিতা হয়ে গেছে। বাকিরাত এমনিতেই যাবে। সালাউদ্দিন পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করে। মোহরবানু একমনে স্মৃতি আওরে যায়। ‘বুঝলিরে সালু, তুই তো যাসনি মুর্শিদাবাদ। একবার যাব তোরে নিয়ে। বাংলা বিহার উড়িশ্যার রাজধানী দেখে আসবি। দেখবি কি সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি। কত সুখ ছড়িয়ে আছে আমাদের উঠানে। আরে সিরাজদৌল্লাহ্র পড়শি আমিরে। নদীয়া থেকে একতারা নিয়ে বাউল আসে আমাদের গাঁয়ে। কি সুন্দরই না তার চেহারা। সে কি সুর।’ বলেই মোহরবানু গুনগুন গান গায়।
‘ওপাড়ে কাঁদিছ বন্ধু
আমি এপাড়ে কাঁদি
দুইজনাই একঘর বাঁধিতাম না থাকলে নদী
সালুরে নিয়া যাবি একবার? মুর্শিদাবাদে আমার জন্মরে। দ্বারকা নদীর পাড়ে এখনো আব্বা আম্মা ঘুমায়। হারু চাচা, রাঙা কাকাবাবু ঘুমায়। ঐদেশেই আমার সই থাকে। তোর দাদাজিরে কত বলেছি। নিল না!
সালুরে, ও সালু,. . . .’
সালাউদ্দিনের নাক ডাকার শব্দ মোহরবানুকে কষ্ট দেয়।
‘বলি, ঘুমাস কেনো এত! যাবি একবার আমারে নিয়া?’ এই বলে সে নাতিকে ডাকে। সালু আধোঘুমে বলে,
‘হুম। দিবে তোমারে যাইতে ঐ দেশে? ’
‘সালু, মাঝিরা তো যায়? শ্যাওলাতো ভাসতে ভাসতে সারা নদীজুড়েই ঘুরে। পাখিরা যায়, মেঘেরা যায়! ওদের কেউ বান্ধে না। আমার কেন আটকাবে? আমারে দিবেনে যাইতে! আরে আমার তো ভিটা। আমার দেশ! মুর্শিদাবাদের শেখ বাড়ির মেয়ে আমি। সেন বাবু আমার জ্যাঠা হয়। যমুনা আমার সই। আমাদের সই পাতানির দিন কত্তকত্ত মানুষ নেমন্তন্ন খেল। ওরা জানলে নৌকা পাঠাবেরে। তুই চিনিস না তাদের.. . . .!
সালাউদ্দিনের সাড়া দেয়না। মোহরবানু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মনে হয় নদীর ওপারে সই দাঁড়ালো এসে। অন্ধকারে মোহরবানু উঠে বসে। জানালার খিড়কি খুলে দেয়। বিশাল পাঁচিলে বাঁশরী ফুলের লতার ঝোপ অস্পষ্ট। অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে মোহরবানুর দৃষ্টি গিয়ে পদ্মার পাড়ে থামে। সে ভেবে পায় না, তাকে যেতে দেবে না কেন! মুর্শিদাবাদ ছেড়ে সে কেনোইবা রাজশাহীতে! অন্ধকারে বাঁশরী ফুলের রঙ দেখা যায়না অথচ সইয়ের মুখ সে স্পষ্ট দেখতে পায়। মোহরবানু বুকটা টনটন করে উঠে। সমস্ত অভিমান গিয়ে পড়ে ঐ মাটির পাঁচিলটার উপর। তার নিজের পেটের ছেলে তাকে এই আঘাতটা দিলে।
ছেলে সুলতান হাজির উপর মেহেরবানুর অনেক ক্ষোভ। সেই বাড়ির চারপাশ ঘিরে নতুন মাটির পাঁচিল তুলেছে। ফলে বাড়ি আর নদীর মধ্যে আগে ঐ ছোট্ট জংলাটা ছিল। গাছগাছালির বাঁকের ফাঁকে মোহরবানু ঠাওর করতে পারতেন। মাঝেমাঝে একে ওকে ডেকে বলতেন নদীর ওপাড়ে তিনি কী দেখছেন। নদী পেরিয়ে ঐ পথের কতটা গেলে তার বাড়িতে পৌঁছানো যেতে পারে। পাঁচিলটা সেই পথে কাঁটা দিয়েছে। এই পাঁচিলের জন্যই সইয়ের সাথে সে হুটহাট কথা বলতে পারছেনা। ওপাড়ে সে এল কিনা তা বোঝাও যাচ্ছেনা। কখনো সখনো বুঝলেও সইয়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। নানাকষ্টে মনটা হু হু করে ওঠে। সে আবার নাতিকে ডাকে। ঢাকা যাওয়ার আগে যেন বাপকে বলে ঐ পাঁচিলটি ভেঙ্গে রেখে যায় মিনতি করে।
এরপর, শিউয়ের কাছে পড়ে থাকা কুশিকাটাটা দেখিয়ে আপন মনে বকে যায়। ঢাকা থেকে ফেরত আসার সময় যেন দুই গুটি সুতা নিয়ে আসে। সুতার অভাবে সে জাম্পারটা বুনতে পারছে না। এতবছর পর খালি হাতে সইয়ের বাড়িতে কেমন করে যাবে; সে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। ভজাটা যে খেতে ভালোবাসে কিছু একটা খাবারও সে নিতে চায়। ঢাকাতে তো অনেক ভালোমন্দ খেতে পাওয়া যায় যেন সে নিয়ে আসে। কিন্তু কোন কথাতেই নাতির সায় পায় না। রাগে মোহরবানু ঠোঁট উল্টে দিয়ে নাতির গায়ে ধাক্কা দিয়ে জোরে ডাকে।
‘সালু, ও সালু এইবার তুই আমায় মূর্শিদাবাদ নিয়ে যাবি তো সত্যি? আর পাঁচিলটার কথা তোর বাপেরে. . . .’সালাউদ্দিন এবার খেঁকিয়ে উঠে।
‘বুড়ি একটু থাম না। সকালে সব কইরা দিয়াই যাব। এখন একটু ঘুমাইতে দে।’