বৃষ্টি ও পাতার গান । রিমঝিম আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ৯:১৭ অপরাহ্ণ, | ১৯৪ বার পঠিত
যে নদী বাঁকখালি
দেখেছি নাফনদী, গড়িয়ে আসে, কতদূর! সমুদ্র সন্তান সে। তারও আসে প্রতাপ, নুনজ্বর। পিতৃসূত্রে পেয়েছি বাঁকখালি।
আজন্ম কুয়াশা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। মাতামহী দিয়েছিল একথলি জোছনা। সন্ধ্যা হওয়ার আগে বাড়ি ফেরা নেই। বাড়িই আমার ভেতর চুপ মেরে থাকে। মানুষ মেলায় যায়, কুড়িয়ে আনে রঙ। আমি কয়েকশো ফানুশের ফাঁকে আঁধার দেখি। আমি বাঁকখালির কাছে যাই— তার টলটলে জল কেমন ভরভরতি যৌবন নিয়ে একা! এমন সবুজ শান্ত নদী বাবা কেন দিয়ে গেল?
ব্রিজের ধারে ছাতিমছায়া মেখে আমি দেখি বাঁকখালি, ঝিম মেরে থাকা জল। মানুষের উত্তরদক্ষিণ ছুঁয়ে আকাশকে টেনে নিয়ে যায় জন্মসূত্রে পাওয়া সমুদ্রের দিকে। দেখি বাবার নুনমাখা মুখ, চিরল বাঁক বেয়ে ঢুকে-পড়া নুনের প্লাবন। দেখি আমার পূর্বপুরুষের প্রতিচ্ছবি আর একজন্ম উপেক্ষা নিয়ে আমার ভেতর ঘুমিয়ে আছে জলপাইরঙ বাঁকখালি।
স্বাক্ষর
বনে বনে অনেক ফুল তো ফোটে।আমার কেবল বারান্দাতেই চলে।একটা দুটো ফুল কিংবা পাতা, তাদের সাথে দিব্যি ভালো আছি। ঘন সবুজ জানালা থেকে পাখি, গহন একটা দুপুর ছুঁড়ে দেয়। এতেই জাগে বিকেলবেলার নদী, এতেই আমার সরোদ ভালো বাজে। এতেইকুহক-বিভোর কেটে যায়, মরুপথে আগুনরাঙা আঁচে। বিষণ্ণ এক শস্যপোকা বিনাশপূর্বে অন্ধ হয়ে নাচে। আমি না-হয় পাখনা-কাটা মাছ। সারাটা দিন সাঁতার দেখে দেখে, ডানার নিচে লিখছি শরবন। রৌদ্র ধু ধু বালির ওপর কাটিয়ে দিই নিজস্ব জীবন। কোথাও যদি বন থাকলো, আমার না-হয় থাকুক একটু হাওয়া! শালিখজন্ম আমার হলো। জলার পাশে বন্ধুহীন এক ঘর। এই পৃথিবীর ঈর্ষারেখায় থাকল একটু অন্যেরও স্বাক্ষর!
বৃষ্টি ও পাতার গান
পাতা ভেসে যায়। ভেসে যায় কত পাতা
বৃষ্টি হচ্ছে ধ্বনি ও মর্ম ছুঁয়ে
আকাশে সজল ভারী মেঘ, আরও ভারী
মেঘমল্লার গেয়ে ওঠে কিন্নরীপেখম মেলেছে দূরে কার ভেজা প্রাণ
নৌকো ডুবেছে মাঝনদী জলে, আহা!
অলস দুলছে দেউড়িতে ভেজা শাড়ি
কে যে পাশে এসে ধরেছে মাথায় ছাতামন পোড়ে যার, তার মন তবু থাকে
আবার কখনো পুড়তে করে না দ্বিধা
পিঁড়ি পেতে বসে অবসাদ বারোয়ারি
সেগুনপাতায় জল লিখে তার গানবৃষ্টি হচ্ছে। ভেসে যায় যত পাতা
ডালে একা পাখি। পাখিটি ভীষণ একা
নীল নবঘনে শ্রাবণে একাকি বাড়ি
একা একা ভিজে। ভেজা মাঠে ছবি আঁকেভস্মাধার না কি অগ্নি
জল তবে অন্তর্যামী? ধুয়ে নেয় এ জন্মের ভার!
পালক ভিজিয়ে রেখে পাখিটি বিরহ গাঁথে চোখে—
ঠোঁটে বুঝি বৃষ্টিবীজ, ঘূর্ণাবর্ত জলের মেলোডি?
আমার ক্লান্তির পাশে বাজে গান নতুন বর্ষার!বিরহও মন্দ নয়, একা পোড়া পাখির কাহিনি
রাত্রির অনিদ্রাগুচ্ছ শিয়রে শিউলি হয়ে ঝরে
পাশ ফিরে ঘ্রাণ পাই, সুষুম্নায় বেঁচে-থাকা জাগে
রোদের আলোর মতো— বৃষ্টি শেষে, আমি তাকে চিনিআমি তাকে চিনি। আর, মনে হয়, সে চেনে আমাকে!
আমাদের বোঝাপড়া মেঘে-মেঘে, পাতায়-পাতায়
স্নানান্তের ভেজা চুলে কথা বলে পুরনো দুপুর
ঘাসে লেখা বর্ণমালা, দিনমান জন্মান্তর আঁকে।জলের কীর্তনে বনে মুখরিত সেগুন পরাগ
বিরহ সে মন্দ নয়, মুছে দেয় মরিচার দাগইছামতী
হরফ ভাঙার পর চিঠিটা অচেনা হয়ে যায়
থাকে শুধু হাহাকার, মূক ও বধির শব্দমালা
অনিচ্ছেয় কি ইচ্ছেয় যে-কথা বোঝোনি কোনওদিন
পাখিদের ঘাড়ে চেপে উড়ে গেছে দূরে তার দায়ছায়ার সংসার পেতে আকাশ অঘোর ঘুমিয়েছে
এইবেলা পাল তোলো, ইছামতী, তোমার নৌকোয়
ল্যান্টানা ফুলের গুচ্ছ অযতনে ফুটেছে বৃথাই
আমার শরীরে বসে কেউ যেন ঘাপটি মেরেছে!আত্মার চেয়েও কেউ অধিক পূজিত হতে নেই
অনিবার্য বৃষ্টিভারে নিজেকে পতিত হতে হয়
মানুষের মুখগুলো পাথরের মূর্তি মেনে নিয়ে
চোখ টেনে নিয়ে যায় কুহকের দিকে নিমিষেইনিজেকে লুকিয়ে রাখে নিজেরই আড়ালে এক মুঠি
মাটির পুতুল সেজে সোনার সিন্দুকে বেড়ে উঠিস্বপুরাণ
নিজেই নিজের বুকে গান হয়ে বাজি
নিজেই তরণী আমি নিজে হই মাঝি
অন্তরে বিরাজ করে সদা-মন্দ্র ভোর
নিজেই নিজের চোখে হয়ে যাই ঘোরনিজেই অতল দিঘি পাতাভাসা জলে
নিজের উদ্ভিদ নিজে হাসি ফুলে-ফলে
জীবন বিরাগ হলে মুক্ত করি মন
নিজের নিকটে নিজে থাকি সারাক্ষণনিজেরই উঠোন জুড়ে নিজে হই পাতা
নিজেকে প্রসব ক’রে নিজেই বিমাতা
অনেকেই কাছে আসে ফের চলে যায়
নিজে রয়ে যাই শুধু নিজেরই ছায়ায়নিজের কাঁধেই তাই নিজে রাখি হাত
নিজেরই ঝরনাতলে নিজেই প্রপাত
নিজেই নিজের মনে আলো জ্বেলে রাখি
নিজের আকাশ জুড়ে নিজে হই পাখি—