একটা লোক অনেকগুলো মানুষ । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ, | ৬৭৮ বার পঠিত
তোমার গতিবিধি সন্দেহজনক।
পুলিশ ভাই, একটা কম্বল হবে? বঙ্গবন্ধুর চুরি যাওয়া কম্বলটা হলে বেশি ভালো হয়।
মশকরা মারাও? আমার হাতের ডাণ্ডা দেখছস?
ভাই, ভাই, স্যার, পুলিশ ভাই— এইডা কী কন! বড় ঠাণ্ডা, হাড়কাঁপানি শীত— হাড্ডির ভিতর কনকন করে স্যার।
এখানে তাপমাত্রা ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমে আমার পাছা ফাটে, আর এই ফাজিল কয় ঠাণ্ডা লাগে। ডলা দিলেই গরম লাগবে। একটু সবুর কর। স্যার উপরে কথা বলতেছে। ইয়েস স্যার, ফরমান দেন স্যার। ডলা দিই স্যার।
ঠাণ্ডা লাগে তো পুলিশ স্যার— ঠাণ্ডা লাগলে কেমনে কই— গরম লাগে? জানি, জানি আপনার কেন গরম লাগে— পকেটে তেজপাতা পড়ছে- হিক হিক, হি হি, বুঝছি পুলিশ ভাই স্যার।
চুপ, একদম চুপ হারামজাদা, বেশি বাড় বাড়ছস। আরেকটু সবুর কর— দিবো, মলম দিবো, একটু সবুর কর।
ও স্যার, ভাইসাব, কথা তো মিছা কই নাই— শান্তিনিকেতন থেকে বিশ্বকবির নোবেল প্রাইজ চুরি গেল, সাড়ে সাতকোটি কম্বল থেকে বঙ্গবন্ধুর কম্বলও নাই হইলো। কথা সত্যি। কী বলেন— সত্যি না?
কবিগুরুর নোবেল প্রাইজ চুরি গেল, বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের কম্বলটাও পান নাই— তার বিহিত আমি কী করবো?
কী বলেন, আপনাদের কত ক্ষেমতা পুলিশ রাষ্ট্র ভাই। একবার যদি বঙ্গবন্ধুর কম্বলখানা বের করে দিতেন স্যার। ইশ, একবার গায়ে দিয়া মরতাম।
চুপ, একদম চুপ। আমার শরীর কিন্তু কটমট কটমট করে, বাপের নাম ভুলাবো শুয়োর, একটু সবুর কর। আগে ক- থানার ভিত্রে উঁকি দিলে কেন?
মনে নাই ভাইজান।
বায়োস্কোপের সিনেমার মত কারবার। কতোদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম— তা আর মনে পড়ে না। কতো জায়গায় গ্যাছি, কতো মানুষের সাথে দেখা হয়েছে— কাকে রেখে কার কথা বলবো? ধরেন, আপনি একটি দলের ফেনাকে জিজ্ঞেস করছেন— ফেনা, ও জলের উপর ভাসমান মুসাফির ফেনা, বলো তো এবার বাছা, তোমার লাইফ হিস্ট্রিটা বলো।
এতোগুলি কনস্টেবল— থানার গেইটের দুইপাশে, সিঁড়ির গোড়ায়, লেট্রিনের পিছনে, বড় সাবের অফিসের দরজায়, রাস্তার মোড়ে, বড়সাবের মেমসাহেবের পিছেপিছে— কনস্টেবল, পুলিশ, সেকেন্ড অফিসার।
আমি জানি না ভাইসাব। ক্ষুধার্ত ছিলাম? বুঝি নাই। লেংটা ছিলাম? দেখি নাই। এংরি ছিলাম? মালুম নাই। হাত মুষ্ঠি করা ছিল? হুঁশ নাই। হেঁটে হেঁটে গেচিলাম? মনে নাই। দৌড়ে দৌড়ে গেচিলাম? ভুলে গ্যাচি।
হ্যাঁ, তুমি দৌড়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে থানার দিকে আসো। আমরা বলি— হল্ট। হল্ট। হল্ট। থামো। থামো। গুলি করবো। আমরা চিৎকার করি- স্যার ফায়ার করবো ফায়ার? পরিস্থিতি বেসামাল স্যার, স্যার। কিছুতেই কাজ হয় না। থানার ভিতরে ঢুকে বড়ই অদ্ভুত, বড়ই রহস্যজনকভাবে কেবল বলো— স্যার, মোকসেদ আসচে এখানে? আমার মোকসেদকে পাওয়া দরকার। হে বড় দাগী আসামী, কার্লপ্রিট— পালাইচে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বলেন— মোকসেদ কোথায়।
আচ্ছা বলো তো, এতো হাঙ্গামা যারে নিয়া, যার জন্য এখন তোমার জিন্দেগি বরবাদ হবে— সেই মোকসেদটা কে? মোকসেদের জন্য কেন তুমি এমন উতলা হও?
আপনি আমার ভাইডি। যদি মন গোল করে শোনেন, চব্বিশ—পঁচিশ না করেন, ফাতরামি ইতরামি না দেখি, কাউয়ার ঠ্যাঙ বগার ঠ্যাঙ না বলেন— তাইলে রেললাইনের মতন সোজা কথাটা আপনারে বলি— কান বিছাইয়া শোনেন কাকু।
হেই। মুখ সামলে কথা বল। গাছের ডালে লটকাইয়া নিচে আগুন ধরাইয়া দিমু খান্নাস। চুপ কর। এমন চেঙ্গি দিমু হালার পো- বাপের নাম ভুলে যাবি।
আচ্ছা, আচ্ছা বলছি। চেইতেন না। ভয় পাই স্যার। ডর লাগে। ইশ, শীত, কী-যে ঠাণ্ডা, কম্বল তো দেন না। উফ বরফ। বরফ।
একজন কনস্টেবল এসে বলে— স্যারে আপনারে তলব করে। উপরের ঘরে। তলবে যান।
উপস্থিত স্যার। তলবে আসি। তলবে যাই। ইয়েস স্যার। তোফাজ্জল, তুমি নজর রাখো। ইন্টারোগেশন চালিয়ে যাও। সে বড় ফাজিল, ফাজিলের কঞ্চি, ফাজিলের চোঙ্গা। সাবধানে পাহারা দাও। পাহারা। প্রয়োজনে চেঙ্গি জায়েজ।
জি সিনিয়র। ইয়েস স্যার। বল। মোকসেদ পর্ব আবার শুরু কর। মোকসেদকে খোঁজায় তোর এতো আগ্রহ কেন?
ঠিকাছে জনাব। বলছি তাহলে শোনেন। বায়োস্কোপের সিনেমার মত কারবার। কতোদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম— তা আর মনে পড়ে না। কতো জায়গায় গ্যাছি, কতো মানুষের সাথে দেখা হয়েছে— কাকে রেখে কার কথা বলবো? ধরেন, আপনি একটি দলের ফেনাকে জিজ্ঞেস করছেন— ফেনা, ও জলের উপর ভাসমান মুসাফির ফেনা, বলো তো এবার বাছা, তোমার লাইফ হিস্ট্রিটা বলো।
আমি ফেনার কথা জিজ্ঞেস করিনি, তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি।
জানি, জানি বুঝতে পেরেছি— আপনাকে সাক্ষাৎ বোঝাবার জন্য এই ইতিকাহিনীর সূত্রপাত করেছি মাত্র।
ঠিকাছে বল। এটুকু বুঝতে পারছি— তুই সেয়ানা রাঘব বোয়াল, বড় পেজগি মাল। বল, আগ বাড়া।
জানি না স্যার— ব্যাপারটা কীভাবে বোঝাই। ধরেন, কুকুরে লেজ নাড়ে— এটিই দুনিয়ার নিয়ম, কিন্তু হঠাৎ যদি এমন হয় যে— কুকুর লেজকে নয়, লেজই কুকুরকে নাড়াচ্ছে- তাহলে কী মুশকিল বলেন তো! এর ব্যাখ্যা কিভাবে দিই। একটু সময় দেন স্যার বিলাপ করে কেঁদে নিই। ও, ও ভাই গো!
আমি কই কী— আর আমার সারিন্দা কয় কী।
কীভাবে বাড়ি থেকে বার হয়ে এসছি— বলতে তো পারি না। আবার কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ মনে পড়ে— আমার কী কখনও বাড়ি ছিল? বাড়ি থাকলে তো বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার প্রশ্ন। আসলে কী জানেন ভাই- বাড়িই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমিই আদতে বাড়ি খুঁজছিলাম— লেজ যেমন কখনও কখনও কুকুরকে নাড়ে, ওইরকম আর কী!
যতোই ধূলা উড়াও সোনার চান, ভেবো না আমাদের চোখ কানা করতে পারবা। ভাইরে, ঠিকই বুঝবা— একটু বাদেই বুঝবা— আমাদের চোখ চোখ না— বল্লমের আগা। টিপের উপর ওষুধ নাই। হা হা। তোমার টিপ লাগবে।
একটা কথা বলি? আমি জানি আমাকে মারবেন, ডলা দিবেন, আপনার চোখ দেখেই বুঝি। আমি জানি না— জানি না সাব— সবটা মানুষের কথা জানি না। একটা মানুষের জীবনে কতো ভাগ— চোখের সামনে চাক্ষুষ যেইসব ঘটনার ভিতর দিয়া যে যায় সে একটা মানুষ, চোখের আড়ালে যাদের সঙ্গে মুসাবিদা করে— সেই মানুষ অন্য আরেকটা মানুষ।
আমারে মানুষতত্ত্ব শিখাও। গাঞ্জা পার্টি। ঠিকাছে, সামনে পিছনে দুইদিক দিয়াই ধোঁয়া বের হবে দার্শনিক সাহেব। খানিক সবুর করো।
ঢাকা শহরে আসচি কয়েকবার, কিন্তু এর এমন একটা জুংলা প্যাঁচ— কোনদিন জট খুলতে পারিনি। একটা দালানের ছাদের দিকে যদি চাই— মনে হয় উড়োজাহাজ এর মাথায় বাড়ি খাবে, চক্কর দ্যা এরোপ্লেন ভূমিতে নিপতিত হবে। আর ঢাকা শহরের মেয়েমানুষ- মনে কয়, এগুলো মানুষ না— সরিষার তেলের বোতল- যত শক্ত করেই মুখ লাগাও— কিছু তেল বাইরে বাইয়া পড়ে। আল্লাহ মাবুদ, আমারে গুনাহ দেও। হা হা। ভাইজান!
এখন যে মানুষটার কথা বলছি— সে আমিই, কিন্তু সম্পূর্ণ আমি না। জানেন স্যার, পথে-ঘাটে অলিতে—গলিতে ঘুরি, খালি ঘুরি— কিন্তু কোথাও বাড়ি নাই, আমার বাড়ি নাই। তখন কেমন জানি গায়েবি একটা মানুষ আমার ভিতর থেকে সিদ্ধান্ত নিল— সে বাড়ির খোঁজে মাটির উপরে নয়— পানির তলে যাবে- খোয়াজ খিজিরের কাছে যাবে— সে যদি একখান বাড়ি দেয়!
গাঁজাখোর কয় কী! ক ক, মনের আশ মিটাইয়া ক।
হ স্যার, যেই কথা সেই কাজ। আমি পানির তলে ডুব দিই। পানির নিচে আচানক দুনিয়া। পানির নিচে কতোক্ষণ আর থাকা যায়- দম বন্ধ লাগে, শ্বাসকষ্ট হয়। মাছের দুনিয়া, কাছিমের জগৎ। পানির নিচে বালুর উপর বেলে মাছ তাপসী রাবেয়া— পানি বুঝি আলো আর লালনীল ফিতার ইশকুল, পাটেশ্বাড়ি মাছ লালনীল শাড়িপরা কলসি কাঁখে রাধা। পানির নিচে আমি খোয়াজ খিজিরকে তালাশ করি। মনের অজান্তে মন্ত্র বলি৷ আয়াত পড়ি, মনে হয় মনের ভুলে মুখে যা আসে তাই বলি— আশারানা কুতুবান্নি তাক্কিলা উতু বনা লিকা চান্তানি লা ফুয়াজ্জা নিবা লাইলাকা। কিন্তু কোনদিক দিয়ে আমি এক আলিশান বোয়ালমাছের হা-এর সামনে এসে পড়ি। বোয়ালমাছ আমারে ক্ষেতে আসে, আমি প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করি, আহা, ভাইরে জীবনের মায়া এমন মায়া আগে জানি না৷ মানুষ আর পানির তলার রাক্ষুসে জানোয়ারের লড়াই, আমি চিৎকার করি— খোয়াজ খিজির৷ ও খোয়াজ খিজির। আমারে বাঁচাও বাবা খোয়াজ খিজির, আমারে পানির তলে বাড়িতে বসাও। কিন্তু হায়, যেই কী সেই৷ আমি আবার পানির উপরে দুনিয়ার মধ্যে ভাসতে থাকি ভাই, কোনরকম আধমরা চুরি ফেনা বিদিশায় গোত্তা খাই৷ ভাসতে থাকি। এক গেলাস পানি দেন অফিসার ভাই।
কী মোর জ্বালারে বাবা। স্যার৷ ইয়েস স্যার জলদি রিপোর্ট পাঠান। অধৈর্য লাগে৷ হেরে পোঁচ দিতে হাত কামড়ায় স্যার। ইয়েস স্যার।
পানির নিচ থেকে ওঠার পর আমি সবার আমি রাস্তায় নামি৷ ধূলাবালুর মত উড়তে থাকি৷ ঘুরতে থাকি। আপনার কী মনে হয় পুলিশ ভাই, আমি কী তখনও একই মানুষ। একই তো৷ আবার মনে হয়, এক না, এক হতে পারে না। কতদিন পর, দিন মাস বছর- পরে বাসে এসে গুলিস্তানে নামি। আমার নিজেরই মনে হয় না— ওই লোকটা আমি, আপনারও মনে হবে না— এটা আমি। আমি জীবিত না মৃত তা-ও মনে নাই। গুলিস্তানে নামামত্রই মনে হয়, এ অন্য আরেক দুনিয়া, ঠিক আমার চেনা জগৎ নয়। কত মানুষ, কত চিৎকার, কত ব্যস্ত সবাই, কিন্তু সবাই যে আসলে স্থবির৷ মহাস্থবির— চোখে চোখে দেখে কিন্তু দেখা হয় না৷ গায়ে গায়ে লাগে কিন্তু অনুভূতি নাই, কত মানুষ কাঁদে কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায় না, কেউ বা হাসে, কিন্তু কারো আনন্দ নাই তাতে, ফুর্তি হয় না মোটে। কিন্তু আপনার কী হলো পুলিশ ভাই— এতো তটস্থ কেন? ভাই এতো ভয় পাচ্ছো কেন তুমি? একটা লাঠি এনে দেবো? আমাকে একটু সাইজ করো- সাহস ফিরে আসবে।
চুপ। একদম চুপ। আমি উপরে যাচ্ছি। আমাদের সবার জরুরি তলব হয়েছে। দরজা বন্ধ করে যাচ্ছি। গেইট বন্ধ করে যাচ্ছি। পালাবার চেষ্টা করছিস তো এনকাউন্টার। যান, যান আমি একচুলও নড়বো না।
একঠাঁই ঘরে বসে থাকবি। কোন নড়নচড়ন নাই।
কী হলো! বাতি নিভে গেল কেন? এখানে কী ভূমিকম্প হচ্ছে? সব এমন কাঁপছে কেন? কে আছেন? কে আছেন এখানে? কেউ কী আছেন?
সম্বন্ধীর পোলা, গাই গরুর মত চিল্লাচিল্লি করতাচোস কিল্লাই! এদিকে আয়, এদিকে।
কোনদিকে?
এদিকে, সোজা আয়, তারপর একটু বামে।
কে আপনি, কাউকে তো দেখছি না। কে আপনি?
চোদনা, আমি তোর বাপ। এদিকে আয়। লক আপের কাছে আয়।
কি! কি কন?
আমি এখানে, লক আপে। আমি নিভস্বা। লক আপের তালা খুলে দে। আমি পালাবো।
কী কন? আমি কী আবার কবরখানায় ঢুকে গ্যাছি?
চোদনা এটা থানার লক আপ।
একবার এক অমাবস্যার রাতে কবরের ভিতর ঢুকে গেচিলাম। আমাদের গ্রামের উত্তর মাথায় জরিনাদের বাড়ি। জরিনা জামাইর ঘর করে নাই, জরিনা জামাইর বাড়িতে জানালার শিকের সাথে কথা কয়। বাড়ি থেকে পালাইয়া আসে জরিনা। কিন্তু পারে না, জরিনা বাপের বাড়ি এসে পৌঁছাতে পারে না। ভাঙাপুলের কাছে দুমড়ানো গামছার মত জরিনার মৃতদেহ পাওয়া যায়।
থানা হয় পুলিশ হয়, জরিনার দেহ ময়নাতদন্তে আবার ছিঁড়া হয়৷ ফাড়া হয়। কবর দেবার পর গুটগুটে ভয়াল রাতে আমি কবর খুঁড়ে জরিনার পাশে যাই। ভাবি, আমি ভাবি— আমি ফেরেশতাকে বলবো- জরিনা আমপাতার মত একটা মেয়ে। ওকে মুগুরে মেরো না, আঘাত করো না— আমি জানি আমার গ্রামের মেয়েটি কত দুঃখী, কত যে নিরপরাধ। ওকে শাস্তি দিও না ভাই ফেরেশতা, কবরের বোবা বধির ফেরেশতা! ওই শালা খুনী নিভস্বা, একটা কথা বলবে না। আমার আবার দমবন্ধ লাগে। আমি মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসি শজারু, হিংস্র শিয়াল।
মনে থাকবে সম্বন্ধীর পোত, তুমি সুযোগ পাবার পরও আমার তালা খুলে দাও নাই। একদিন তোরে খুলবো আমি। সাপের যেমন চামড়া খোলে।
আচ্ছা খুলিস। আসছে আসছে, এই তো আলো আসছে। আমিও কবরের বাইরে আসছি, হা।
এটেনশন। হল্ট।
কী কন স্যার। আমি তো কোথাও যাই নাই। নড়িও নাই। ঝামেলার পর ঝামেলা। তলবের পর তলব। উপরের ফোন। বড়সাবের হাত কাঁপে, আমাদের ঠ্যাং কাঁপে।
তুই এখানে কেমনে ঢুকলি? আপদের পর আপদ। তোর স্টেটমেন্ট দে। উপরের নথি আসছে। তোরে গোল করবো, চাকতি বানাবো।
আচ্ছা স্যার। জি স্যার। ওই যে আথারেপাথারে ঘুরে, খালবিল পার হয়ে, সাত তবক আসমান ডিঙায়ে কোনদিক দিয়ে যে আমি গুলিস্তান এসে নামি তার কিছুই মনে নাই আর। খালি মনে পড়ে মানুষ, চাকতি, আওয়াজ, হুল্লোড়, হর্ণ, ক্রিংক্রিং।
আমারে গুলিস্তান চিনাইতে আইসো না, আমি পুরান ঢাকার মাল।
জলদি করেন, জলদি করেন, সক্কাল সক্কাল আসেন। সিট খালি সিট খালি সিট খালি। নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। শর্টকাট, শর্টকাট, শর্টকাট। সূত্রাপুর ওভারব্রিজ পার হলেই একধাক্কায় নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম। গম আছে, গম আছে, গম আছে চাটগাঁ, চাটগাঁ, চাটগাঁ। রড খালি, রড খালি, রড খালি। অর্ধেক পথ গেলেই সিট খালি, সিট খালি, সিট খালি। জমিদারি ভাব, তালুকদারি সার্ভিস। চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম।
গাড়ির হর্ন, রিক্সার ক্রিংক্রিং বেল, বাসের দুমড়ানো পেটে বাস কন্ডাকটরের বেদম থাবড়ানি, আর দইঅলা, সাইবেরিয়ান পাখিওয়ালা, গরম ডিমওয়ালা, ফুটপাতের শার্ট-প্যান্ট বিক্রেতার চিৎকার।
আসেন ভাই আসেন, নতুন চালান, নতুন চালান৷ ক্লিনটনের শার্ট, জর্জ বুশের আন্ডারওয়্যার। আন্ডারওয়্যার এক হালি দুইশ টাকা, দুইশ টাকা, দুইশ টাকা। ক্লিনটনের শার্ট একজোড়া চারশ টাকা, চারশ টাকা, চারশ টাকা।
তারপর কী হলো সেটা বল। থানায় গোত্তা দিলে কেন?
তার আগেও ঢাকা শহরে আসচি কয়েকবার, কিন্তু এর এমন একটা জুংলা প্যাঁচ— কোনদিন জট খুলতে পারিনি। একটা দালানের ছাদের দিকে যদি চাই— মনে হয় উড়োজাহাজ এর মাথায় বাড়ি খাবে, চক্কর দ্যা এরোপ্লেন ভূমিতে নিপতিত হবে। আর ঢাকা শহরের মেয়েমানুষ— মনে কয়, এগুলো মানুষ না- সরিষার তেলের বোতল— যত শক্ত করেই মুখ লাগাও— কিছু তেল বাইরে বাইয়া পড়ে। আল্লাহ মাবুদ, আমারে গুনাহ দেও। হা হা। ভাইজান!
এই সম্বন্ধীর পোলা, তাইরে নাইরে করো, বিটলামি করো— এমন টাইট দিমু। বল থানায় হামলা দিলি কেন?
স্যার, স্যার, মারবেন না। থানায় হামলা দিই নাই। ভয়ে এসে থানায় ঢুকচি। গুলিস্তান বাস থেকে নেমে হাঁটি পশ্চিম দিক, পশ্চিম দিক আমারে এনে ফেলে উসমানী উদ্যান, উসমানী উদ্যান বাঁয়ে রাখি, ডানপাশে পীরজঙ্গি মাজার, পীরজঙ্গী মাজার মাজারকে বলি— পীরসাহেব এখন পিছনে থাকো, মাথানষ্ট, কোথা যাই কী খাই, নাই তার হুঁশ, রাস্তার পাশের হোটেল থেকে বোরহানির গন্ধ আসে৷ পেটে চক্কর দেয়, মনে হয় নাড়িভুড়ি একমোচড়ে জিরোপয়েন্টের চক্করে বের হয়ে আসবে, ক্ষুধা, ক্ষুধা- ক্ষুধা গণ্ডার ভাই- কানা গণ্ডার- চোক্ষে দেখে না, কথা শোনে না৷ ক্ষুধা অন্ধ, ক্ষুধা বোবা, ক্ষুধা ভূমিকম্প গো ভাই, ক্ষুধা ব্লেইড।
কনস্টেবল মকবুল তুমি যাও। আমি হাজির। তোমার কর্তব্যকাজ সমাপ্ত। তুমি যাও। আমি খাড়াই। কী এবারত? দূর থেকে শুনলাম— তুমি টাঙ্কি মারো। তুমি নাকি থানায় হামলা দিতে আসছো? দেখি— কত ওলানে কত দুধ, কত ধানে কত চাল, কত পিঠে কত চামড়া!
এগুলির খবর আমি জানি না মুরুব্বি। আমি খালি পায়ে ঘুরি— পায়ে একজোড়া স্যান্ডেলও নাই— জেট বিমানের খবর দিয়া আমি কী করবো?
কথার ভাঁজ ভালো। ওস্তাদি বোঝো তাইলে। বড় সাবের ফাইল আসছে। আরেকটু সবুর করো- চুলকানি দেওয়া হবে। বাঘের চুলকানি।
কোনদিক দিয়া যে কী হইলো— তেমন কিছু ইয়াদ নাই স্যার। তোপখানা রোড মোড়ে মাথাটা বড় চক্কর দেয়। মাথা চক্কর দিলে মানুষ মাটিতে পড়ে— জনম ভর এমনই দেখে আসছি। কিন্তু আমার জন্য কেমন একটা আজব ঘটনা ঘটলো- যেই মাথাটা চক্কর দেয় মনে হইলো বড় বড় অফিসারদের অফিসের পায়ের নিচেই পড়ে যাবো— ভাবলাম— কত বড় কপাল আমার— দেশের বড় বড় মাথা যারা তাদের পায়ের নিচে তাহলে আমি মারা যাবো— শাহ কপাল আমার। কিন্তু আল্লার কী কুদরত লাঠির ভিত্রে শরবত- আমি মাটিতে পড়ি নাই, মরি নাই। মরি তো না-ই, বরং মনে হয় আমি বুঝি এক তাজ্জএব ঘোড়ার পিঠে উড়ে যাই, উড়ে উড়ে আমিও মিরাজযাত্রা করি। কেশর দুলায়ে ঘোড়া প্রেসক্লাব পার হয়, প্রেসক্লাবের পরেই ডানে মোড় নেয় ঘোড়া, সেগুনবাগিচা মোড়ে দাখিল হবার আগেই কেমন একটা শোরগোল শুনি- কান খাড়া করে রাখি।
বুজরুকি রাখ ফাজিল কোথাকার। সে এতোক্ষণে ঘোড়ার কাহিনী জুড়িল, ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।
সত্যি বলি হাজিরানে মজলিশ, ঘোড়ায় চড়ে যে যাচ্ছি আমি— আমিও বুঝতে পারছি— এটা ঠিক আমি না, আমি বুঝি আমি না, ফকিন্নির পোলাও বুঝি শাহজাহান বাদশা— তাজমহল বানায়, যার দুটি পা নাই, সে-ও বুঝি ঘোড়ার কেশর ধরে মিরাজের দিকে যায়। আমাকে কেউ দেখে না— কিন্তু আমি সবারে দেখি, বেশ খানিকটা দূর থেকে কড়ুইগাছের নিচ থেকেই শোরগোলের আওয়াজ শুনি।
এ কী! এটা কী! এ তো দেখি পোস্টার— এতো বড় পোস্টার কিল্লাই, এতো পোস্টার না— বিলবোর্ড, এ তো বিলবোর্ড না- কিয়ামত। লেখার তো কোন ভাবগতি বুঝি না, হেইডা কী— এ তো দেহি ইংরেজি, খাম্বার মত বড় বড় হরফে ইংরেজি লেখা— এ মিসিং মেন, সাথেই দেখি সমানে সমান হিন্দি বাত— লাপাত্তা আদমি, কেউ তো বাজারে হারাই গেচে মনে করি। বাংলা কথা কোনহানে? এই তো এক্কেরে ছোড ছোড কথা— হেরে তো মাইট্টা হাফে কামড় দেসে। ও ম্যাডাম, ও স্যার, জলদি নিচে নামেন, জলদি করেন। দেখেন, দেখেন, একবার নিজ চোক্ষে দেখেন— ম্যাডাম দেখেন, স্যার দেখেন— আমাদের দুনিয়াভি মাতৃবুলি ইনস্টিটিউট-এর মূল ফটকে কার এত্তোবড় বুকের পাটা— হারানো বিজ্ঞপ্তি। হারানো বিজ্ঞপ্তি। মোকসেদের হারানো বিজ্ঞপ্তি।
মুহূর্তের মধ্যে ওই অফিসের নানা পদের কর্মচারী, কর্মকর্তা, তাদের ড্রাইভার, খাবার সরবরাহকারী, রাস্তার লোক অফিসের বড় গেইটের সামনে জটলা করে। অফিসারসহ মাঝারি, নিম্নমাঝারি, ফুট সাইজ ও ইঞ্চিসাইজ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আমার কাছে মনে হয় একটি পুতুলনাচের দল— ব্রাহ্মনবাড়িয়া কাউয়াখালি পুতুল নাচ।
কী, ব্যাপার কী— এমন রগড় করে কথা বলছো কেন? তোমরা জানো না— পরিবেশের জন্য শব্দদূষণ কতোটা প্রলয়ঙ্কারী, ভয়ঙ্কর। আমরা তো তা করতে পারি না। আমি বিদেশে আফ্রিকান একটি দেশের সঙ্গে দূরালাপনিতে সংযুক্ত ছিলাম, আবার খানিক অন্তর ন্যাদারল্যান্ডসে জুম করতে হবে। আমাদের কতো কাজ সে ধারনা আছে তোমাদের?
সে আমরা জানি। কিন্তু এখানে যে নিজেদের ইজ্জতকা মামলা।
কেন, কী হয়েছে? গলা খাঁকারি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পরিচ্ছন্নভাবে মনের ভাব প্রকাশ করো।
দেখুন, দেখুন একবার ফটকে দৃকপাত করে দেখুন।
কী দেখবো? এ তো ফটক। প্রতিদিনের একই তোরণ।
না, না। এক নয়। দেখুন, কে বা কারা কতোবড় দেয়ালসম এক পোস্টার সেঁটে দিয়েছে।
তাতে কী?
দেখুন, ওখানে কত বড় করে ইংরেজি লেখা। তার সমান আকৃতির হিন্দি লেখা, ডানদিকে আরবী। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু বাংলা এই এত্তোটুকু— সুজাতার গালের তিলের সমান বাংলায় লেখা- মোকসেদ। মোকসেদ হারিয়ে গ্যাছে। লম্বা ৫ফিট ২ইঞ্চি। গাত্রবর্ণ- ফর্সাচে শ্যামলা। মোকসেদ। যে মোকসেদকে নিম্নঠিকানায় পৌঁছে দেবে তার জন্য পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা।
অ্যাঁ! বলছো কী তোমরা— আমার অফিসের তোরণে এতো বড় হারানো বিজ্ঞপ্তির মধ্যে বাংলা নেই, বলছো কী তোমরা! ২০১৮ সনে ইউনেস্কো পৃথিবীর ৬৪০টি ভাষাকে বিপন্ন ঘোষণা করেছে, তাদের মধ্যে অতিবিপন্ন ৫৭৭খানা ভাষা। আমরা সবার অস্তিত্ব ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
ক্রিং ক্রিং সাইকেলের বেল বাজানোই আমার কাজ। সরেন, সরেন রাস্তা ক্লিয়ার করেন। দেখুন, আমি আমার জীবন যৌবন ভূতভবিষ্যৎ সবকিছু বাংলার জন্য বিলিয়ে দিয়েছি, আপনারা হয়তো আমার নামও শুনে থাকতে পারেন— পলান সরকার। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের জন্য বাংলা বই পৌঁছে দিই। আমি জানি, আমি জানি- কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে— বাংলা বলার, বাংলা বই পড়ার মানুষ কমে যাচ্ছে। ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে।
ভিড় কমান, ভিড় কমান, লম্বা লম্বা কথা রাখেন— স্পেনের উপকূলবর্তী লাগোমেরা অঞ্চলের একটি বিপন্ন ভাষা সিলবো গোমেরো ভাষার কোন কথা নাই, বর্ণমালা নাই— ভাষাভাষীরা কথা বলে কেবল হুইসেলের মাধ্যমে— আমার কথাও আপনারা কেউ বুঝতে পারছেন না— আমার সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ ছাড়া আপনাদের আমার আর কিছু বলার নাই। সরেন, সরেন, পথ খালি করেন।
ভাই, আমি আরেকটা পরামর্শ দিই— বিনা পয়সায়, সাক্ষাৎ মাগনায়। আমার জন্য একটা গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেন স্যার— ধরেন, আমিই মারা গ্যাচি, কিন্তু আমার লাশ পাওয়া যায় নাই— আমার জন্যই জানাজা— আমিও সেই জানাজায় শরিক হবো। একটা আস্ত জীবন স্যার, পার করলাম নো ম্যানস ল্যান্ডে। মরার পরে যে একটা জানাজা পাবো— তারই গ্যারান্টি কী! সবাই তো ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডা লৈয়া ব্যস্ত, ব্যাংকের টাকা সরানো লৈয়া ব্যস্ত— আমাদের মত মানুষ কোনদিক দিয়া জন্মায়, কোনদিক দিয়া মরে— কে তার খোঁজ রাখে কন?
আমি সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি, শোরগোল কিচ্ছু শুনিনি। কেবল শুনেছি মোকসেদ। আর ৫০হাজার টাকা। কেবল মন বলছিল- নামটা কেমন চেনা চেনা৷ উচ্চতা জানা জানা, চোখ দুটি টানাটানা। মনে হচ্ছিল— আমি মোকসেদের গন্ধ পাচ্ছিলাম- আমিই মোকসেদকে নিম্নঠিকানায় পৌঁছে দেবো। পাবো ৫০হাজার টাকা।
তোর কেন মনে হলো কেউ না, আর কেউ না— কেবল তুই-ই মোকসেদকে খুঁজে পাবি?
উত্তর জানা নাই ভাই। তারপর আর কিছু মনে নাই— আমি একটা দৈত্য হয়ে যাই, কিসসার জানোয়ার— জানোয়ারের মত গোঁৎ গোঁৎ করতে থাকি। মনে হয়, অনেকগুলো মানুষও আমার পায়ের নিচে পড়ে মারা যায়।
পুরা রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। একটা অপরাধ, একটা অপকর্মও ফাঁকি দিতে পারবা না। তারপর পিটাইয়া তোরে তরমুজ বানাবো। তোর ফাঁসিও হইতে পারে।
হোক, আমার ফাঁসি হোক। আর কোন খায়েশ নাই৷ আপত্তি। আমার মানবজনম সফল।
তোর হবে দ্বীপান্তর। আর তুই বলিস— তোর জনম সার্থক। রে খোদা, আর কি শুনবো। রেডি হ বাঞ্চোত।
বেহেশতে ঘুরতে যাবি। হা হা।
হ। সত্যি। এমন কোনদিন হয় নাই আমার। ৫০হাজার টাকার কথা যে-ই মাথায় আসে, আমার পাগল বোনটা কেমন করে হাসে, আমার সামনে আসে৷ এমন ঘনঘোর বর্ষা— দ্রিমদ্রিম বৃষ্টি নামে, শাড়িপরা তামাম দুনিয়া কদমফুলের নিচে ভিজতে থাকে, মোরগের ঝুঁটির মত ব্যথা কেঁপে কেঁপে ওঠে— আমার একটা বোন মেঘের পাখের নিচে বনবাদাড়ে অগুণতি ময়ূর হয়ে নাচে- আমার একটা পাগল বোন স্যার; আর বলে— আমার লাগি শফিপুর বাজার থেকে সুতি প্রিন্টের শাড়ি আনো ভাই। প্রিন্টের শাড়ি। আমার বোন আমার কাছে কোনদিন কিছু চায় নাই। আমার পাগল বোন। স্যার, আমার মনে হইলো— আমি বুঝি আর আমি না— ১০টা আমি একসাথ হইসে।
তারপর কী করছোস জানোস?
না, আর কিছু মনে নাই। কোনদিক দিয়া জানি— থানার ভিতরে ঢুকে গ্যাচি। ৩দিন ধরে আমি থানায় আছি, তাই না? আশ্চর্য কী জানো ভাই, আমার কোন ক্ষুধা নাই।
ক্ষুধা নাই, কারণ তোরে আমরা খাবার দিচি। মরে গেলে আঁচড় দিবো কারে?
আপনি দেখি, নয়া সাব, ভিন অফিসার, আপনার হাতের নিশানা কেমন?
তোমার সব রিপোর্ট আমাদের হাতে আসছে। ওষুধ যা লাগে সবই দেওয়া হবে, তুই আসলে কে, কোন মতলবে আইনের ঘরে ঢোকো তার নাড়িনক্ষত্র বের করা হবে, আর কে কে সাথে আছে, তোমাদের কী নীলনকশা— সব খুঁজে বের করা হবে। বগিজগি করবা না। একতিল মিথ্যা বলছো- কী ফোঁটা মিথ্যা পাকস্থলীতে জমা করছো তো নাড়িভুড়ি সুদ্ধা এই পাক্কা ফ্লোরের উপর বের করা হবে।
কোন মিথ্যা নাই স্যার, কোন মতলব নাই, কিছু মনেও নাই।
যা যা জিজ্ঞাস করি— ঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর দিবি-— একচুল আগে না৷ এককদম পিছেও না।
দুনিয়াভি মাতৃবুলি ইনস্টিটিউটের গেইটে এক আলিশান হারানো বিজ্ঞপ্তি।
জি স্যার।
গায়ের রঙ সাদাচে শ্যামলা। তোর রঙ কী?
আমি তো জানি না। মেঘের গুরুগুরু ডাক আর ময়ূরের নাচ ছাড়া আর কিছু দেখি না স্যার। আঁটা লেগে গ্যাচে।
কাঁচাপাকা চুল। ইঞ্চি দুই লম্বা। তোর চুল কেমন?
আমি জানি না, আপনিই কন।
বামপায়ের কানিআঙ্গুল জটা— ২টা কানিআঙ্গুল। বাম পা বাড়া।
এই যে ভাই, আমার বাম পা।
এইটা কী? বলেই রাইফেলের বাটে তীব্র আঘাত করে।
আহ। আহ।
এটা বিসমিল্লাহ মাত্র। তোর শার্ট উপরে তোল।
কেন স্যার?
গেঞ্জি উপরে তোল।
নাভির মধ্যে সাইবালি ফকিরের একটা তাবিজ গাঁথা আছে। এটা কী?
একটা তাবিজ।
ধরা পড়ে গ্যাছো সোনার চান। তোর বাড়ি মনিকান্দা গ্রাম, থানা ওয়ালি ইকরামপুর, ডিস্ট্রিক্ট জিন্দাশি। তোর নাম মোকসেদ।
কী বলেন স্যার! আমি তো মোকসেদরে।
সব দুরভিসন্ধি ধরা পড়ে গ্যাছে। রেডি হইয়া যাও।
বিশ্বাস করেন স্যার— ক্ষুধা আর স্মৃতিবিভ্রম ছাড়া আমার আর কোন দুরভিসন্ধি নাই। রাতের জন্য রেডি হও মোকসেদ মিয়া।
আমি মোকসেদ— আমিই মোকসেদ! হাহ। আমি জানি— আমার দিন শেষ, তাই থানায় আইসা ঢুকচি- ভাবলাম থানায় অন্তত আমারে হিসাবে আনা হবে। একটা মানুষ হিসাবে ধইরা তারপর টর্চার করা হবে, তা-ও কম কী স্যার। কতদিন রাস্তায় ফেউফেউ করে ঘুরচি। আমার শরীর নোংরা, গায়ে দুর্গন্ধ, কতদিন গোসল করি নাই। কোন কথা নাই, বার্তা নাই— এমনিই আমারে মারে, লাত্থি দেয়, ঘুষি মারে, আমার মুখ দিয়া গলগল রক্ত বেরোয়। আর আমি হাসি, ঠাসঠাস করে হাসি। আমারে ডলা দেন স্যার।
ভাই, আমি আরেকটা পরামর্শ দিই— বিনা পয়সায়, সাক্ষাৎ মাগনায়। আমার জন্য একটা গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেন স্যার- ধরেন, আমিই মারা গ্যাচি, কিন্তু আমার লাশ পাওয়া যায় নাই— আমার জন্যই জানাজা— আমিও সেই জানাজায় শরিক হবো। একটা আস্ত জীবন স্যার, পার করলাম নো ম্যানস ল্যান্ডে। মরার পরে যে একটা জানাজা পাবো— তারই গ্যারান্টি কী! সবাই তো ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডা লৈয়া ব্যস্ত, ব্যাংকের টাকা সরানো লৈয়া ব্যস্ত— আমাদের মত মানুষ কোনদিক দিয়া জন্মায়, কোনদিক দিয়া মরে— কে তার খোঁজ রাখে কন?
থানায় একটা ঘন্টা বাজাইতে কন স্যার।
কেন, থানায় ঘন্টা বাজাবে কেন?
এমনিই এমনিই স্যার— আওয়াজই তো সৃষ্টিকর্তা, মরার আগে উপরওয়ালারে শুনাইয়া যাই— আমারও জন্ম হইচিল, তার কুদরতি দুনিয়ায় জন্মাইচিলাম আমি— মোকসেদ।
দূরে তীব্র ঘন্টা বাজে— ঢং, ঢং।।