ক্ষুধার টান | পলি শাহীনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ, | ৪২০ বার পঠিত
‘ট্রাম্প নাকি বাইডেন? কে এবার ভোটে জিতবে?’
গত কয়েকদিন ধরে দিনের শুরুতে একই প্রশ্ন শুনছি সহকর্মী ইব্রাহিমের মুখ হতে। চেনা প্রশ্ন হলেও উত্তরটা তখনো আমার অজানা। আমি নিজেও জানি না এবারের নির্বাচনে কে জিতবে। কারণ, ভোট গণনা তখনো শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচন সন্দেহাতীতভাবে অন্যান্য বছরের নির্বাচনগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোভিডের কারণে প্রচুর পরিমাণে মানুষ ডাকযোগে ভোট পাঠিয়েছে। মুসা যখন প্রশ্নটি করছে তখনো ভোট গণনা চলছে। ফলতঃ, কে যে ভোটে জয়ী হবে, উত্তরটি আমারও অজানা।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগাল থেকে সদ্য আমেরিকায় আসা ইব্রাহিম, নতুন সহকর্মী হিসেবে কয়েক দিন আগে আমার সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। আমরা পরস্পরকে এখনো ভালোভাবে জানি না। ইব্রাহিমের মুখে প্রতিদিন একই প্রশ্ন শুনে এবং উত্তর দিতে না পেরে উল্টো ওকে প্রশ্ন করি,
—তুমি সংবাদ দেখো না?
—আমার ঘরে টেলিভিশন নেই। মোবাইলের নেট দূর্বল বলে সারাক্ষণ লোডিং দেখায়, তাই সংবাদ দেখা হয় না, জানাও হয় না।ইব্রাহিমের এমন উত্তর শুনে কিছুটা অবাক হই। ভুল শুনলাম কী না এই ভেবে ভ্রু কুঁচকে আবারও জানতে চাই,
—সত্যিই টেলিভিশন নেই?
গলায় পেঁচানো মাফলারের গিঁট বাঁধতে বাঁধতে চিমসে চেহারার ইব্রাহিম আমার দিকে ন্যাতানো চোখে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলতে থাকে,
—একজনের সঙ্গে ছোট্ট একটা রুম ভাগাভাগি করে বেসমেন্টে থাকি। ওই রুমে সম্বল বলতে মাথার ওপরে একটা ছাদ, আর কিছুই নেই। বাড়িওয়ালার গ্যাস মিটার ইন্সপেকশন করতে কন এডিসন হতে লোক আসবে বলে চুলাটাও তুলে নিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে উনুন জ্বালাতে পারছি না বলে রোজ পিজা কিনে খাই। টেলিভিশন, নেট তো দূরের কথা, কাজ শেষে যখন ওই বদ্ধ ঘরটিতে ফিরে যাই মনে হয় বাসা নয় কবরে ঢুকেছি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় কতকাল ধরে শুয়ে আছি কবরে, একা এবং নিঃসঙ্গ। গান শুনতে পছন্দ করতাম। আমার বউ প্রায়শই গান করতো গুনগুন করে, আপনমনে। আহা! কতদিন ওর গান শুনি না।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দীর্ঘশ্বাস টেনে ইব্রাহিম কাজে মন দেয়। তার অসহায় মুখোচ্ছবি, আবেগ মিশ্রিত কথাগুলো শুনে কিছু সময় আমি ঝিম মেরে থাকি। তবে আমার এই ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কাজের মহা সমুদ্রে আমিও ডুব দিই।
কাজের ফাঁকেও ইব্রাহিমের শোচনীয় দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপনের চিত্র আমার মনের অন্দরে বেদনার মতো বাজতে থাকে। নানান প্রশ্ন এসে ভর করে মস্তিষ্কে। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ আমেরিকা। আমেরিকার মতো দেশে ইব্রাহিম কেন এমন কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে? এদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এঁরাও তো সমান অংশীদার, তবে কেন এমন বৈষম্য? কাজের এক ফাঁকে ইব্রাহিমের কাছে জানতে চাই,
—কেমন করে এলে এদেশে? কবে এলে?
—বড় ভাইয়ের সাহায্যে এসেছি এদেশে।
—ভাই এখন কোথায়?
—ভাই থাকেন নিউজার্সিতে। এদেশে আসার পর কয়েকমাস ভাইয়ের সঙ্গেই ছিলাম। পরে ভাই নিউইয়র্কে একটা কাজ যোগাড় করে পাঠিয়ে দেয়। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর রেস্তোরাঁর মালিক কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কাজ হারিয়ে বাসা ভাড়া দিতে না পারায় বাসস্থানও হারিয়ে ফেলি। দেশে বউ-বাচ্চা আছে। সপ্তাহান্তে বেতন পাওয়ার পর ওদের জন্য অর্থ পাঠাতে হতো বলে হাতে কোন বাড়তি অর্থ জমা ছিল না।
বুঝতে পারি অনেকটা ‘দিন আনে দিন খায়’-র মতো অবস্থা ইব্রাহিমের। ফোনের পিকচার গ্যালারি থেকে বের করে বউ-বাচ্চার ছবি দেখায় আমাকে। আমি একে একে সবার হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছবি দেখি। ছবি দেখানোর সময় ইব্রাহিমের চোখেমুখে মুগ্ধতা খেলে যায়। দৃশ্যটি আমার খুব ভালো লাগে।
বাসায় ইব্রাহিম রান্না করতে পারে না জানার পর থেকে মাঝেমধ্যে আমি তার জন্য খাবার নিয়ে যাই। আমার হাতের রান্না খেয়ে খুশি হয়, ধন্যবাদ জানায়। তার খুশিতে যারপরনাই আমিও আনন্দিত হই। যেদিন খাবার নিতাম না সেদিন লক্ষ্য করতাম ইব্রাহিম আমার হাতের খাবারের ব্যাগের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি অস্বস্তি বোধ করি। সাধারণত পোলাও-গোশত বা বিরিয়ানি রান্না করলে খাবার নিয়ে যেতাম, কিন্তু সবজি-ডাল এসব হলে নিতাম না। ভাবতাম আমার দেশীয় খাবারের তেল-ঝাল-স্বাদ তো আর তার ভালো লাগবে না। একদিন বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলি অস্বস্তি থেকে রক্ষা পেতে। উত্তরে ইব্রাহিম বলে, ‘পেটের ক্ষুধায় সব খাবার খাওয়া যায়, কোনো খাবার মন্দ লাগে না। তবে তুমি এ নিয়ে একদম ভেবো না। আমি ঠিক আছি।’
তার কথা শুনে খুব মায়া পড়ে যায়। পরের দিন কচুর লতি আর মুসুরের ডাল দিয়ে সাদা ভাত নিয়ে গেলাম৷ আমার সামনে বসেই ইব্রাহিমকে সে খাবারগুলো তৃপ্তিসহকারে খেতে দেখে আমি বিস্মিত হলাম। কারণ এত বছর ধরে আমেরিকায় থেকেও সব দেশের খাবারের সাথে আমি অভ্যস্ত নই, খেতেও পারি না।
‘ক্ষুধার কামড় বড় কামড়। ক্ষুধার তাপ আগুনের তাপের চেয়েও বেশি জ্বালায়। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ পাথর ভাঙে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ সততা, সভ্যতা, ধর্মীয় আচার ভুলে চুরি করে। বেঁচে থাকার প্রতি মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে। আর সে বেঁচে থাকার জন্য খাওয়াটা বড্ড জরুরি। দিনশেষে মানুষ খেতেই চায়। বেঁচে থাকার জন্য, খাওয়ার জন্য মানুষের এই দুর্গম পথে ছুটে চলা অনির্দিষ্ট এই জীবনচক্র।’
ইব্রাহিমকে লতি-ডাল-ভাত হাপুস-হুপুস খেতে দেখে বহু বছর আগে ছোটবেলায় আমার এক শিক্ষকের মুখে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে যায়।
হেমন্তের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যাবেলা। আকাশের গায়ে এলোমেলো মেঘ উড়ছে। বাতাসের শরীরজুড়ে হিম। শীতকালে বিকেল পাঁচটা বাজতেই এই শহরটিকে চারপাশ হতে অন্ধকার ঘিরে ধরে। যদিও নিয়নের ঝলসানো আলোয় ঘুটঘুটে অন্ধকারের দেখা তেমন মেলে না। এসময় পাশের ইটালিয়ান বেকারি থেকে আমি চা খাওয়ার সময় সাধারণত ইব্রাহিমের জন্যও চা নিয়ে আসি। চা নিয়ে কর্মস্থলে প্রবেশের মুখেই দেখি ইব্রাহিম আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর সঙ্গে গা ঘেঁষে অন্তরঙ্গ আলাপ করছে। তাদের আলাপচারিতা আমার কানে আসে। বাদামি কাগজের প্যাকেট থেকে বের করে আমি চা খাই, কিন্তু ইব্রাহিমকে চা দিতে ইচ্ছে হলো না। তরুণীটি বিদায় নেয়ার পর ইব্রাহিম আমার সামনে এসে নিচু স্বরে বললো,
—ওর নাম দানিশা, আমার গার্লফ্রেন্ড।
গোমড়া মুখে বললাম, কিছুদিন আগে তুমি বলেছো বউ-বাচ্চা নিয়ে আসার চেষ্টা করছো এদেশে। তোমার বউ-বাচ্চা জানে দানিশার কথা? কিছু সময় চুপ থেকে শীতল স্বরে ইব্রাহিম বলতে থাকে,
—আমার বৈধ কাগজ নেই আমেরিকায়। ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারি না, বুঝি না। বড় ভাই বলেছেন উনি আমার আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারবেন না। কয়েকমাস আগে চাকরি হারিয়ে, থাকা-খাওয়ার জায়গা হারিয়ে রাস্তায় থেকেছি। থাকার জন্য রাস্তা পেলেও ক্ষুধার যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। তখন পথে পথে বোতল কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেও দেশে বউ-বাচ্চার জন্য অর্থ পাঠাতে পারিনি। তারাও তখন দেশে ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে। দুনিয়ায় সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু ক্ষুধার কষ্ট দেখা যায় না। জগতে হাসি-কান্না সহ সবকিছুর শব্দ হলেও ক্ষুধার শব্দ শোনা যায় না। ক্ষুধার শব্দ হয় না, নীরবে আঘাত করে শুধু। ক্ষুধার কষ্ট শুধু ভুক্তভোগী জানে। এখন আমি যদি হাত-পা গুটিয়ে সভ্যতার দোহাই দিয়ে ভদ্রলোক সেজে বসে থাকি, আমি কষ্ট পাবো সঙ্গে বউ-বাচ্চাও কষ্ট পাবে। একজনের কষ্ট কভু অন্যজন বুঝে না। জীবনে ভালো থাকা, সুখে থাকার উপায় আমাকে আমেরিকা কিংবা এদেশের প্রশাসন কোনোদিন খুঁজে দিবে না। এ আমার ভালোমতো জানা হয়ে গেছে গত কয়েক মাসে। এভাবে চললে বউ-বাচ্চার সাথেও দেখা হবে না হয়তো কোনোদিন আর। এদেশে কষ্ট পাবো আমি, দেশে কষ্ট পাবে বউ-বাচ্চা। দানিশার সঙ্গে কথা হয়েছে—ও আমাকে এদেশে বৈধতা পেতে সাহায্য করবে। এছাড়া আমার অন্য কোনো উপায়ও নেই। সুখ বড় কঠিন জিনিস। সুখী হতে চাই। দু-হাত বাড়িয়ে সুখকে যত ছুঁতে চাই সুখ তত দূরে সরে যায়। কষ্টেসৃষ্টে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি। অর্ধাহারে, অনাহারে থাকলেও নিজ দেশে সম্মানের সঙ্গে ছিলাম। জীবনে সুখ ছাড়া অন্য কোন বিলাসিতার প্রতি আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমেরিকায় এসে আমার সে সহজ-সরল জীবনের হিসেব-নিকেশ সম্পূর্ণ বদলে গেলো। যা মন চায় তা করতে পারি না এদেশে। সুখের অংকটা কোনভাবেই যে মেলাতে পারছি না। অর্থ ছাড়া জীবন অচল এখানে। আমেরিকা স্বপ্নের দেশ, এদেশে শুনেছি অর্থের খনি আছে। এদেশে অর্থ উড়ে এটাও সত্য, কিন্তু সে অর্থ সবাই ধরতে পারে না। আমি সে হতভাগ্যদের একজন। এই করোনাকালে থাকা-খাওয়া নিয়ে কত যে কষ্ট করেছি, ভাবতেও পারবে না তুমি। দানিশার মাধ্যমে আমি যা করতে যাচ্ছি, আমার এই বাড়তি চাওয়ায় কোন পাপ নেই, আছে শুধু বেঁচে থাকার আকুতি। আছে শুধু মৌলিক চাওয়া, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার নিশ্চয়তা। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না। আমার এই চাওয়া বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের মতো প্রয়োজন। আমার এই চাওয়া জীবনের প্রতি ভালোবাসা।
কথাগুলো বলতে বলতে ইব্রাহিমের চোখজোড়া ছলছল হয়ে উঠে। তার চোখে আমি বিশুদ্ধ জল দেখতে পাই।
ইব্রাহিমের গভীর আর্তি ভরা কথাগুলো আমার ব্রেনের কোষে কোষে অবিরত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সকলের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা নেই। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় এমন অসংখ্য মানুষ আছে ইব্রাহিমের মতো, যাঁরা বুকে যন্ত্রণা লুকিয়ে জীবনের জটিল ঘেরটোপে পড়ে সুখের অংক আর মেলাতে পারে না। তাঁদের জীবন যুদ্ধের কাছে মাথা নুয়ে আসে। খোলা চোখে দেখা প্রতিটি মুখের পেছনে গভীর, গোপন কত যে বেদনার গল্প থাকে। হৃদয় খুলে যে-গল্পের খবর আমরা কজন বা আর জানি, কিংবা রাখি। নমিত মস্তকে নীরবে ইব্রাহিমের দিকে ঠাণ্ডা চায়ের কাপ এগিয়ে দিই। আমাদের কর্মময় দিনশেষে চা হাতে ইব্রাহিম বিদায় নেয়।
শরতের আকাশের নিচে ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরে হাঁটছি। মনের অরণ্যে ইব্রাহিমের চোখের বিশুদ্ধ জল ঝরছে, নাকি হেমন্তের কুয়াশা—ঠিক বুঝতে পারি না। চাক চাক অন্ধকার সাঁতরে পা ফেলতে ফেলতে মনে পড়ে যায় লায়লার কথা। অনেক বছর আগের কথা হলেও গোটা দিন ইব্রাহিমের জীবন গাঁথা শুনে, মনের ঘরে হেমন্তের কুয়াশার মত লায়লার চিরকুটের কথাগুলো ঝরছে নিঃশব্দে। গাছের ফাঁকফোকর গলে টুপটাপ ঝরছে লায়লার স্মৃতি। শিশিরের শব্দের মত নীরবে ঝরছে কত শব্দ বুকের অরণ্যে। লায়লা স্বল্পভাষী এবং নরম মনের মানুষ ছিল। দুধসাদা রংয়ের লায়লাকে আমাদের হলের বড়ো-ছোট সকলে পছন্দ করতো। বলতে দ্বিধা নেই, হলের সিনিয়র আপাদের ওর প্রতি ভালোবাসা দেখে কখনো-সখনো আমার ইর্ষাও হতো।
লায়লা সবসময় নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে বন্দি করে রাখত। রুমমেটরা সকলে মিলে ছুটির বিকেলে যখন শহরের দামি রেস্তোরাঁয় খেতে যেত তখন লায়লা রুমে বসে হলুদ জামায় লাল রংয়ের সুতা দিয়ে গোলাপ ফুল তুলত। সবাই মিলে যখন সপ্তাহান্তে চড়ুইভাতির মেজাজে পোলাও, মাংসের আয়োজনে হৈ চৈ করত তখন লায়লা হোস্টেলের নির্ধারিত পাতলা ডাল, আলুভর্তা দিয়ে সাদা ভাত খেয়ে একাকী ডাইনিং রুমে বসে বিটিভিতে সিনেমা দেখত। ওর চমৎকার গানের গলা ছিল। পোলাও-মাংস খাওয়ার মহা ধুমধাম শেষে লায়লার গান শুনত সকলে মুগ্ধতায় ডুবে।
‘আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়,
পাড়ে লয়ে যাও আমায়।
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে-
আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে
দেখি না উপায়।
পাড়ে লয়ে যাও আমায়।’
লায়লার সুরের ইন্দ্রজালে সকলে যখন চোখ বুঁজে থাকত তখন আমি ওর চোখে হীরের কুঁচির মতো অশ্রুজল ঝিকঝিক করতে দেখেছি বিকেলের শেষ আলোয়। রুমের জানালার পাশে বসে অসীম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে লায়লা যখন আবুল হোসেনের (*কবি ও সরকারি আমলা আবুল হোসেন বাংলাদেশের কবিতাপাঠকদের মাঝে সুপরিচিত ছিলেন এক সময়। বাংলা একাডেমী ও একুশে পদকও পেয়েছিলেন। জীবদ্দশায় নিয়মিত লিখেছেন। একাধিক কাব্যগ্রন্থেরও জনক এই কবি। যদিও সর্বসাধারণ পাঠক মহল তাঁকে কতটা চিনতেন বা পাঠ করেছেন এই ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তাঁর নাম এখন আর কাউকে স্মরণ করতে দেখি না। লেখক যদি তাঁকে বুঝিয়ে থাকেন তাহলে ঠিক আছে। তবে কেন জানি মনে হলো তিনি আবুল হোসেন নয় বরং বিখ্যাত কবি আবুল হাসানকে বোঝাতে চাইছেন। যদি জানার উপায় থাকে তবে জেনে নিয়েন। না জানলেও ক্ষতি নেই। হতেও পারে কাহিনির লায়লা হয়তো আবুল হোসেনর কবিতাই পাঠ করে থাকবেন।) কবিতা আবৃত্তি করত তখন ওর চোখেমুখে একটা অসহায়ত্ব তীব্রভাবে ফুটে উঠত, ঠিক ইব্রাহিমের মতো। মাঝেমধ্যে আমার খুব ইচ্ছে হতো ওর ফ্যাকাসে, মলিন মুখের মর্মার্থ জানার, কিন্তু জিজ্ঞেস করাটা যদি সমীচীন না হয় এমন দ্বিধায় কখনো জানতে চাইনি।
আমাদের রুমে লায়লা সহ আমরা চারজন থাকতাম। একই বর্ষের আমি এবং লায়লা একই বেডে থাকতাম। অন্য দুজন সিনিয়র আপা আলাদা দুটো বেডে থাকতেন। সিনিয়র পুষ্প আপা ছিল ধনী বাবার একমাত্র কন্যা। তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তা, বেশভূষায় প্রবল অহংকার ছিল। দু’হাতে টাকা খরচ করতো। সকালবেলা দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে, ডাইনিং-এ খাবার আনতে না গেলে, বুয়া তাঁর খাবার রুমে রেখে যেত। রাখবে না কেন? শুনেছি বুয়াকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। প্রবাদে আছে, অর্থ থাকলে বাঘের দুধও মিলে। একই রুমে আমরা চারজন মানুষ বাস করলেও পুষ্প’র সঙ্গে অন্যদের বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাই যখন একটা কিংবা দুটো কলেজ ইউনিফর্ম দিয়ে পুরো সপ্তাহ শেষ করতো, পুষ্প তখন ছয়দিনে আলাদা ছয়টি ড্রেস পরতো। হোস্টেলে যেদিন খুব সাধারণ সবজি, ডাল, ভাত হতো, সেদিন পুষ্প আলাদাভাবে পোলাও, মাংস খেতো। বেশিরভাগ সময় তাঁর বাড়ি হতে খাবার আসতো। বাড়ি থেকে খাবার না এলে কাজের লোক দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে আনত। সকলের সামনে পুষ্প সেসব খাবার বেশ আয়েস করে খেতো। ওঁর মধ্যে কখনো কোনো সংকোচও দেখিনি। পড়ার টেবিল ভর্তি হরেক পদের শুকনো খাবারও দেখা যেত। খুব কম মানুষ দেখেছি জীবনে, একসঙ্গে বিত্তশালী এবং মানবিক কিংবা সামাজিক হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
রুমে সকলের ঘুমের সময় ছিল উম্মুক্ত। পড়াশোনা শেষে যে যার মতো করে ঘুমিয়ে যেত। বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী লায়লা অনেক রাত অবধি জেগে পড়তো। ও এতটাই নিভৃতচারী যে ওকে বুঝা যেত না কোনোভাবেই। ছোটবেলায় মানুষ যেভাবে প্রিয় খেলনা লুকিয়ে রাখে কিংবা কিশোর বয়সে এসে প্রেমের চিঠি লুকিয়ে রাখে খুব যত্নে, তেমনিভাবে লায়লা পারিপার্শ্বিক সকল অবস্থা থেকে ওকে লুকিয়ে রাখতো। জড়োসড়ো ওর জন্য সবসময় আমার মায়া হতো। ওকে আমি অন্তর হতে ভালোবাসতাম।
একদিন ক্লাস শেষে রুমে এসে দেখি লায়লা নেই। ওর কোনো জিনিসপত্র নেই। রুম জুড়ে অন্যরকম একটা থমথমে ভাব বইছে। সিনিয়র দুই আপার মুখে একপ্রস্থ অন্ধকার লেপ্টে আছে।
—লায়লা বিছানাপত্র নিয়ে কোথায় গেলো? অন্য কোনো রুমে?
—লায়লা হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছে।
—ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে, না বলে হোস্টেল ছাড়লো কেন?
আমার ক্রমাগত জিজ্ঞাসা, হা-পিত্যেষের জবাবে পুষ্প আমার হাতে লায়লার রেখে যাওয়া চিরকুট তুলে দেয়। আমি পড়তে থাকি :
প্রিয় পুষ্প আপা,
আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিও। ছোটবেলা হতে লেখালেখিতে ভালো হলেও আজ হলসুপার ম্যাডামের রুম হতে এসে অনেকক্ষণ কলম হাতে সাদা কাগজের সামনে নিশ্চুপ বসে আছি। যা লিখতে চাই তোমাকে, গুছিয়ে কিছুই লিখতে পারছি না। পুষ্প আপা, কতটা দহনে মানুষের চোখের পানি শুকিয়ে যায়, জানো কি? নিরীহ মানুষের চাপা কান্না, ক্ষুধার্ত মানুষের গলা অবধি নীরব কান্না, কখনো শুনেছ? কিংবা দেখেছো? জীবনের মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত মানুষ দেখেছো? তাঁদের আহাজারি শুনেছো? জীবনে একটি রাতও ক্ষুধার্ত কাটিয়েছ? গভীর রাতে নৈঃশব্দ যখন পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরে তখন ক্ষুধার্ত মানুষের পেটে ঝড় উঠে। তোমরা যখন ছুটির দিনে পোলাও, মাংস খেতে, সন্ধ্যাবেলায় গরম চায়ের সঙ্গে ডালপুরি খেতে, তখন আমি নাকেমুখে কাপড় গুঁজে দিতাম, যেন খাবারের ঘ্রাণ এসে নাকে না লাগে। তোমাদের খাবারের ঘ্রাণ আমার পেটে ক্ষুধার আগুন ধরিয়ে দিত। আমার ক্ষুধার্ত আত্মা ক্ষুধার যন্ত্রণায় যখন ছটফট করতো, তখন আমি গলা ছেড়ে গান গাইতাম, তোমাদের আনন্দ দিতাম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা যখন মারা যায় তখন তাঁর কন্যাটির জীবনের সমস্ত ছন্দও মরে যায়। আমার জীবনে কোন বিলাসিতা মানায় না বলে নিজেকে সদা গুটিয়ে রেখেছি। আমার মৃত বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর আদুরে মেয়ে ডাক্তার হবে। ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে, মানবতার আলো জ্বালাবে। আলো জ্বলুক বললেই তো আর আলো জ্বলে না। তেলহীন হারিকেন নিভে যায়। প্রজ্জ্বলিত হওয়ার জন্য যত চেষ্টা করেছি ততই তেলের অভাবে আমি নিভে গিয়েছি। যতই নিজেকে নির্মাণ করতে চেয়েছি ততই অর্থের অভাবে ভেঙে পড়েছি। ক্ষুধার তাণ্ডবের কাছে পরাজিত হয়ে, সভ্যতা ভুলে, তোমাকে না বলে এক টুকরো পাউরুটি খেয়েছি, এর কর্মফল পেয়েছি। এজন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। কর্মের ফল তো ভোগ করতেই হবে। হলসুপার ম্যাডামের কাছে তোমার নালিশের বিষয়টি জানার পর যেন আমার দৃষ্টিশক্তি, বাকশক্তি হারিয়ে যায়। তোমার, তোমাদের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি হারিয়েছি। শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন রেখে যেতে চাই—পেটের অসহ্য ক্ষুধা নিভানোর জন্য নিরুপায় হয়ে যে-মানুষটা এক টুকরো পাউরুটি খায়, সে কি অসভ্য? নাকি জীবনের পূজারী?
এই পরিবার, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই পৃথিবীর অসমতার ফাঁদে আটকে পড়া মানুষ আমি। এ ফাঁদ যদি টপকাতে পারি, আশা রাখি সেদিন হয়ত এ হোস্টেলে নয়, অন্য কোথাও আমাদের দেখা হবে। ভালো থেকো তুমি, তোমরা সকলে।
ইতি, লায়লা।
চিরকুট পড়া শেষে আমি অশ্রুজলে ভেসে যেতে থাকি। মানুষ যেমন জ্যান্ত পুড়ে যায়, সেরকম কোন চিতায়ও পোড়ে না বোধ করি। লায়লার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। লোকে বলে, সময় মানুষকে বদলে দেয়। আমার মনে হয়, মানুষ সময়কে বদলে দেয়। লায়লা নিশ্চয়ই ওর সময়কে বদলে দিয়েছে। কি জানি! বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া লায়লার কথা এত বছর পর আজ ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেলো। এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের কী অদ্ভুত মিল! মানুষের সুখানুভব ভিন্ন হলেও কষ্টের রং একইরকম।
ইব্রাহিম এবং লায়লার অসহায় মুখজোড়া যেন আমার স্নায়ুর উপর হামলা চালাতে শুরু করে। মনে হয় ওদের কষ্টের কারণ হয়তো আমি নিজেও। পৃথিবীতে যখন এত সম্পদ রয়েছে তখন দারিদ্র্যতা মানবতার বিরুদ্ধে এক অপরাধ। একই স্রষ্টার পৃথিবীতে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের কেন এত বৈষম্য? মাথাটা কেমন ধরে আসে। নজিম হিকমতের ‘প্রিয়তমা’ কবিতার প্রথম লাইন,—‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর একবছর।’ জানি না, ইব্রাহিম এবং লায়লার কষ্ট কতদিন আমাকে পোড়াবে?
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘন মেঘের ঠাসাঠাসি। মনে হচ্ছে, এখনই বৃষ্টি নামবে। এ-শহরে আবহাওয়ার কোনো ঠিক নেই। চোখে পড়ে পথের ধারে একটা বাড়ির বর্ধিত অংশের ওপরে, ময়লা ভারি লাল জ্যাকেট গায়ে কানটুপি পরা এক লোক আলোর নিচে বসে কাগজের ব্যাগ হতে খাবার খাচ্ছে। তাঁর চারপাশে ব্যাগভর্তি উঁকি দেয়া জিনিসপত্র বলে দিচ্ছে সে হোমলেস। আমি অপলক তাঁর খাওয়ার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। এরমধ্যেই বৃষ্টির ফোঁটা এসে গায়ে পড়ে। এমন কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, বৃষ্টির মধ্যে লোকটি খাবার খেয়ে পরম তৃপ্তিতে প্রকাণ্ড বাড়িটার দেয়ালে গুটিসুটি মেরে, বাংলা বর্ণ ‘দ’-র মতো করে দুই হাঁটু ভাঁজ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সভ্য মানুষের মতো লোকটির আপন গৃহ নেই বটে, কিন্তু ভরা পেটে সে একজন সুখি মানুষ। পেটভরা মানুষটার চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ উপচে পড়ছে। তাঁর মুখাবয়ব যেন বলছে, জগতে সভ্যতার চেয়ে ক্ষুধার বয়স বেশি। ক্ষুধার্ত পেটের ক্ষুধা নিবারণ ছাড়া জগতের কোন সৌন্দর্যে মন বসে না। মনে পড়ে সুকান্তের কবিতার লাইনটি, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’
বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে ভাবনার জগৎ হতে জেগে উঠে আমি দ্রুত পায়ে ঘরের পথে হাঁটতে থাকি।