বৈধতা । রুখসানা কাজল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১:৫২ পূর্বাহ্ণ, | ৩৫৬ বার পঠিত
তোমার দুধের ধারা
গোরখোদক রব্বানী শেখ সদ্য মৃত স্ত্রী পরিজাদির কবরের মাটি ঠিক করে দিচ্ছিল ।
ধবলী ছাগী আর তার শিশুদের সমস্বর আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে। নাহ্ দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই। জয়লক্ষ্মী জুয়েলার্সের কারিগর নরেন পোদ্দারের বউ এসেছে বুকের দুধ নামাতে। পনের দিন বয়েসি ছেলে মায়ের দুধ খেতে গিয়ে ভিজে নেয়ে হাঁপসে যাচ্ছে। অদম্য ঝর্ণাধারার মত ছেলের নাকে মুখে দুধ ঝরে পড়ছে। নরেনের বউয়ের একেবারে যা তা অবস্থা।
ধবলী বাঁধা আছে উঠোনের পাশে চালতাগাছে। দুধের ভারে ভাল করে হাঁটতেও পারে না। মাত্র সাতদিন আগে চার চারটা ছানা বিইয়েছে। এরই মধ্যে ছানাগুলো মায়ের ভরভরন্ত দুধে মুখ দিয়ে ভরপেট দুধ খেয়ে লাফাচ্ছে, ঝাপাচ্ছে, ছুটছে। কোনটা আবার পা ভেঙে ঢং দেখাচ্ছে। অন্য ছানাগুলো তার গায়ের উপর লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে খেলার চূড়ান্ত করে ছাড়ছে।
মাসখানেক আগে তিনদিনের জ্বরে পরিজাদী মরে গেছে। পনেরো দিন বয়স ছিল গ্যাদাটার। রব্বানী এখন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। ওর কেবলই মনে হয় ঘরে ফিরলে দেখতে পাবে উথলে ওঠা দুই বুকের দুধ চিপে হালকা নীলসাদা দুধ বের করে বাটিতে জমা করছে পরিজাদী। মুখে স্মিত হাসি। উদলা বুক। নিটোল পুষ্ট। স্ফিত পবিত্র। অসীম সুন্দরতার মায়া লেপে আছে দু-বুক জুড়ে।
লজ্জাহীন এক ধরণের তীব্র ভালবাসার কাজল কালো রঙ ধরেছে দুটি বৃন্তসহ গোলাকার পৃথিবীতে।
পরিজাদী দুধ ভর্তি সেই বাটি রব্বানীর হাতে দিয়ে সতর্ক গলায় বলত, শুনিচ্চো গো মিয়া, নিরিখ করি বড় কলাগাছটার গুড়ায় দুধটুকুন ঢালি দিবা। খুব ভাল ভাবি ঢালবা! নালি কিন্তুক আমাগের মাইয়েডার আলাই বালাই কোনো অমঙ্গল হতি পারে গো!
রব্বানী কখনও পরিজাদীর বলা নিয়মের ব্যতিক্রম করে নাই। মেয়ে ত তারও। তাই কাঁদি ভর্তি কলাগুলো পোক্ত হতে শুরু করেছে এমন একটি মা কলাগাছ খুঁজে নিয়েছিল। সে কলাগাছের লাল লাল ফোলা শরীর। গর্ভ অবস্থার শেষ দিকে পরিজাদীর শরীর যেমন ছেড়ে দিয়েছিল তেমনই আলুথালু চেহারা। তার গোড়ায় খুব সাবধানে দুধ ঢেলে খুশি মনেই সে ফিরে আসত।
তবু অমঙ্গল যা হওয়ার তাতো হয়েই গেলো।
পনেরো দিনের মেয়ে, অনুগত স্বামী, স্নেহময়ী শাশুড়ি, বাবামা এক বোন, গর্ভবতী ধবলী আর আত্মীয় স্বজন ঘরবাড়ি রেখে পরিজাদী হঠাৎ মরে গেল।
পরিজাদীর কবরে দুর্বা ঘাস লাগাতে লাগাতে রব্বানী দেখে তাজজাদী দুটি ছানা কোলে ঘরের দিকে যাচ্ছে। ধবলী এবার নিশ্চিন্তে রোদ্দুর পোহাচ্ছে কিন্তু অন্য ছানাগুলো গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। তাজজাদী ছানাগুলোকে ধমকে ধামকে ঘরে ঢুকে গেল। নরেন পোদ্দারের বউ এবার ছানাদুটোকে দুধ খাওয়াবে।
একটি ছানাকে কোলে রেখে হাসি হাসি মুখ করে তাজজাদী অন্য ছানাটির দুধ খাওয়া দেখে। মানুষ মায়ের বুকের দুধ কিছুতেই খেতে রাজি নয় ছানাটি। মুখ থেকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে দুধের বৃন্ত। অস্থির রাগে আঘাত করছে নরেনের বৌয়ের ভরা বুকে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বউটি। চোখ ভিজে গেছে। তবু ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে। বুকে দুধ জমে গেলে সেও এক মহা জ্বালা। এত দুধ তার ছেলেশিশুটি খেয়ে শেষ করতে পারছে না। ভয় হয় দুধের ভারে যদি ছেলেটার দম আটকে যায় ! রাত বিরেতে ঘুমের ঘোরে কোনো অঘটন না ঘটে যায় তার সোনামানিকের।
আচমকা এরকম কত দুর্ঘটনাই তো ঘটে। দক্ষিণ পূর্ব বাংলার গ্রামগঞ্জে তাই সদ্যজাত ছাগল ছানাকে দিয়ে মানুষ মায়ের বাড়তি দুধ খাইয়ে দেওয়ার চলন রয়েছে।
ছাগল ছানাটির মুখ জোর করে দুধের বৃন্তে আবার গুঁজে দেওয়ার মুহূর্তে কেঁদে ওঠে পরিজাদীর মেয়ে। নরেনের বউয়ের বুক কেঁপে ওঠে আর হাত ফস্কে ছুটে যায় ধবলীর ছানাটি। শত সহস্র ধারায় নেমে আসছে দুধের স্রোত। ধরিত্রীর জোড়ামুখ থেকে মেঘরঙ নীল মায়া ঝরে পড়ছে নরেনের বউয়ের কোলে। সেখানে ফুটে উঠছে মায়াফুলের আল্পনা। মা মা সুগন্ধ।
নরেনের বউ দুই হাত বাড়িয়ে দেয়।
. . .
বৈধতা
আমার ইচ্ছাপূরণের বাস স্টপেজ এসেছি ঘুরতে। বহুদিনের ইচ্ছা ছিল লাল দোতলা বাসে চড়ে ঢাকার কোনো এক শেষ বাস স্টপেজে নামব। দেখে নেব শহরের আপাত শেষ কামড় খেয়ে কেমন আছে শহরতলির সবুজ মাটি, মানুষ আর প্রকৃতি। সঙ্গী হিসেবে সচিবের কাছাকাছি এক ছেলেবেলার বন্ধুকে ডেকে নিয়েছি।
পচা কুমড়োর মত মুখ করে বন্ধুটি জানায়, তুই এইসব ছাগলমার্কা সখ কোত্থেকে পাস বল্ তো! গেল আমার ছুটির দিনটা।
বাতাসে উড়িয়ে দিই ওর তেহাই। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবকিছুতে অসুখী হতে ভালোবাসে। এই বন্ধুটি তেমন এক অসুখী ড্রামাবাজ। আমরা অনেকেই জানি ছুটির দিনগুলো হলো ওর পরকীয়া দিবস। পুরো সপ্তাহের ব্যস্ততায় জমা শরীরের জট ভাঙে ওর নিত্য নতুন বান্ধবীদের ঘন গোপন সান্ন্যিধ্যে। কী করে যেন বাচ্চা বাচ্চা প্রেমিকা জুটিয়ে আনে। একটি ব্রান্ডের ব্যাগ, দামি সালোয়ার স্যুট কিম্বা ঘড়ি, স্মার্ট মোবাইলেই কাজ সেরে নেয় শয়তানটা। বেচারা আমার জন্যে গোমড়ামুখে সিগারেট খাচ্ছে বসে বসে।
ওকে পাত্তা না দিয়ে ছুটে ছুটে দেখি চারপাশ। কতদিন এমন আধা শহর দেখি না। একটি কাঁঠাল গাছ হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনচত্বরে। ছেলেবেলার মত লালচে পাতাগুলোর বোঁটায় আঙুল দিয়ে নাড়া দিতেই ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়ল পাতারা। কিছু দূরে মরিচজবার বেড়া দেওয়া একটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে। প্রশস্ত উঠোনের তারে উড়ছে হরেক রংয়ের ছোট-বড়ো জামা-কাপড়। একটি কালো সাইকেল জানালার পাশে হেলান দিয়ে রেখেছে কেউ। তার পাশে লেবু, করমচা, গন্ধরাজ আর কাঠগোলাপসহ কী এক ঝাঁকড়া গাছ বোঝা যাচ্ছে না। অবারিত আহবানে দুলছে কাঠের গেট। আমার ইচ্ছে করে একবার বাড়ির ভেতরে যেতে। এরকম বাড়িতে নিম, পেয়ারা, কৃষ্ণচূড়া আর হাসনুহেনা গাছের সাথে খুব মায়াময়ী একজন মা, দাদিমা বা চাচীম্মা থাকে। গেট পেরিয়ে উঠোনে পা রাখলেই তাদের কেউ বলে উঠে, ওমা কখন এলি তুই? ইস্যিরে একেবারে ঘেমে গেছিস দেখি। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে আয়। আমি শরবত বানিয়ে দিচ্ছি!
চোখ ছেপে পানি চলে আসে। সেই কোন কিশোরীবেলা থেকে আমার মা নেই। অচেনা স্টেশনের নির্জনতায় মনে মনে মার ছবি বানিয়ে নিই। মার মুখে ভাষা দিয়ে অস্ফুটে বলে উঠি, এইত এলাম। মাগো বসন্তবরণ ফাংশনে কিন্তু সবুজপাড় হলুদশাড়ি কিনে দিতে হবে। মিস বলে দিয়েছে।
মেয়েটি কখন এলো দেখতে পাইনি। জিরো ফিগার। বুকের উপর লেপ্টে আছে শিশুটি। স্থলপদ্মের রংয়ে রাঙা শিশুটির দুই গাল। মায়ের কোলে অথই নিরাপত্তায় থেকে জুল জুল করে দেখে নিচ্ছে আমাদের। কি আদর আদর মুখ। ছুঁয়ে দেব ভেবে এগিয়ে যেতেই বন্ধুটি তীব্র থাবা দিয়ে টেনে আনে, উহুহুম ওরা রাতের মেয়ে। ইল্লিগ্যল!
বন্ধুর মুখে ঘৃণাময় তাচ্ছিল্য। নিত্য নতুন নারীসঙ্গ প্রিয় বন্ধুটি একবারের জন্যেও চোখে চেখে নেয় না মেয়েটির বুক, পেট, ঠোঁটের অনন্য ভাঁজ। অন্যসময় মেয়ে দেখলেই লালা ঝরে ওর। এখন বৈধতার আস্ফালনে উড়িয়ে দিচ্ছে ইললিগ্যলিতে পাওয়া দামি সিগ্রেটের ইললিগ্যল ধোঁয়া।
রেগে যাই। ছোবলে বিষ ঢেলে বলি, অহ রিয়েলি! তুই যে বউ ফেলে রোজ মেয়ে তুলিস তারা কোন বেলার লিগ্যাল মেয়ে রে? কী পাস তাদের কাছে? নিমের ঝোল? তখন তুই বৈধতার চুক্তিটা কোথায় রাখিস শূয়োর? তোর গল্পে, কবিতায় নাকি ইনবক্সে?
মেয়েটির মুখেও ফিনকি দিয়ে উঠে ফিরতি তাচ্ছিল্য। দুচোখে কখনও ঘৃণা, কখনও ঘন মেঘের কান্না, কখনওবা বক্রবিদ্যুতে মাখামাখি শ্লেষ। কিন্তু সব ছাপিয়ে মাতৃত্ব এসে মুছে দিচ্ছে মেয়েটির তেরিয়া ঘৃণাভাব। খুব চেনা লাগে এই মাতৃমুখ। বিপদে, সংঘাতে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে আমাদের মায়েরাও কি এমন খোলা তলোয়ারের মত মুখিয়ে উঠত না? সন্তানের জীবন রক্ষায় তাদের চোখেও কি জ্বলে উঠত না এমন ভয়াল আগুন? মুহূর্তে একটি ত্রিনয়নের উন্মোচন ঘটল কি মেয়েটির মধ্য কপালে? নাকি মাতা মরিয়মের মুখ ভেসে উঠল! শিশু যিশু কোলে ঝড় জল বরফগলা পথে হেঁটে চলেছেন একা একাকী এক নারী! সভ্যতার আলো দিতে এই শিশুকে যে বাঁচাতেই হবে। দুপায়ে দলে যাচ্ছেন হলুদ বিদ্রুপ, অশ্লীল বাক্যবাণ। চকিতে বদলে যায় সেই মুখ। এতো আদি জননী বিবি হাওয়া। জলপাই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শিশু কোলে। অনাবৃত বুকে তীব্র অহংকারে জমে আছে মাতৃত্বের জলঘন সবল উচ্চতা। দূরে জলপাই বনে খেলায় মেতেছে অন্য শিশুরা। ওই যে বার বার হোঁচট খেয়েও আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে যে নগ্ন উদোম শ্যামা শিশুটি সে তো আমি! বাবা আদম গেছে কাঠ কুড়াতে।
আচ্ছা কে বলতে পারবে জননী হাওয়ার সাথে বাবা আদমের বিয়ে কবে, কোথায় কোন স্বর্গ বা নরকে হয়েছিল? কে পড়িয়েছিল সেই বিয়ে? সে কি কোনো হুজুর নাকি কোনো সোনালিডানা ফিরিশ্তা? কারা ছিল সেই বিয়ের সাক্ষী? কত টাকার মোহরানা ছিল? বৈধতার চুক্তিপত্রটি কি আছে সযত্ন সমারোহে? নাকি আমরাও…
. . .