লাফিং ইন্ডিয়া । সাদিক হোসেন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ, | ৩৬২ বার পঠিত
বাজারে নতুন অ্যাপ এসেছে—লাফিং ইন্ডিয়া। সেখানে হাসি-মস্করা-ইয়ার্কির ভিডিও আপলোড করলে টাকা মিলতে পারে। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এরকম হরেক অ্যাপ তো আছেই। কিন্তু এই অ্যাপের নতুনত্ব হলো—লকডাউন। লকডাউন সম্পর্কিত হাসির ভিডিও আপলোড করুন। প্রথম পাঁচ হাজার লাইক-এ কোনো টাকা নেই। কিন্তু তারপর প্রতি লাইক পিছু ১টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকবে।
জুলেখা ইউসুফকে খবরটা জানালে ইউসুফ বিশেষ পাত্তা দিল না। ইউসুফ এমনি। নতুন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। তাছাড়া টানা লকডাউনে সে বেশ চিন্তিত। ক্যুরিয়ার কোম্পানিতে কাজ করে। তার কাজে ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্ভব নয়। ফলে প্রথম মাসে কোম্পানি ২০০০ ধরিয়ে দিলেও এখন পুরো মিউট হয়ে গিয়েছে। কাল এরিয়া ম্যানেজারকে পাঁচ বার ফোন করেছিল। একবারও ফোন তোলেনি।
জুলেখা আর ইউসুফকে ঘাঁটাল না। সোজা ফোন করল সঞ্জুকে। সঞ্জু এইসব ব্যাপারে ওস্তাদ। নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখানে সে প্রাঙ্ক ভিডিও বানায়। প্রায় এক লাখ সাবস্ক্রাইবার।
সঞ্জু জুলেখার কথা শুনে হাসল, তুই করবি এইসব?
জুলেখা নাছোড়বান্দা, বারে আমি পারব না বুঝি?
—পারবি না কেন? কিন্তু তুই কি আগে কখনো এইসব বানিয়েছিস?
জুলেখা জানাল ইতিমধ্যে সে টিকটকে বেশ কয়েকটি ভিডিও বানিয়ে ফেলেছে। একটা তো বেশ পপুলারও হয়েছিল।
—বাঃ। সঞ্জু তাকে সাহস জুগিয়ে বলল, রিচ কত ছিল?
—ঐ ৫০০-র মতো।
৫০০ সংখ্যাটা নগণ্য। সঞ্জু খানিক চুপ থেকে বলল, তুই ট্রেন্ডগুলো দ্যাখ। আর মনে রাখবি প্রথম ভিডিওটাকে হিট করাতেই হবে। রাতে ফোন করব। এখন রাখছি রে।
সঞ্জু ভরসা জুগিয়ে বলল, আসলে এইটায় একজন মহিলাকে দরকার। তুই ছাড়া এই লকডাউনে আর পাবো কাকে? তোকে একটা লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। দেখ। কাল ফোন করব।
টাকা রোজগার করা সহজ ব্যাপার না। সহজ নয় বলেই যারা রোজগেরে তাদের এত দাম। এটাই স্বাভাবিক। জুলেখা জানে। তবু তার নিজের ওপর বিশ্বাস আছে। বিশ্বাস না করে উপায়ও তো নেই। ইউসুফ মুখে কিছু না বললেও, সে ঠিক বুঝতে পারে, বরের চাকরিটা লকডাউনের পর আদৌ থাকবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন তার কাছে দুটি পথ—হয় তিন বছরের মেয়েটাকে নিয়ে সারেন্ডার করো নয়তো লড়াই চালিয়ে যাও। জুলেখাকে যারা চেনে, তারা জানে, সে দ্বিতীয় রাস্তাটাই বেছে নেবে।
লড়াই ছেড়ে পালিয়ে যাবার মেয়ে সে নয়।
ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকটি জিনিস শিখে নিয়েছে। যেমন—শুধু পেঁয়াজের বেরেস্তা দিয়েও একথালা ভাত সাবাড় করা যায়।
ইউসুফ খেয়ে তো অবাক। আরে কী কাণ্ড মাইরি।
জুলেখা হাসল। তার ঝুড়িতে এমন অনেক ম্যাজিকই রয়েছে যা ইউসুফ এখনো জানে না। এইতো সেদিন মেয়ের মোমরং শেষ হয়ে গেল, খাতাও। এবার? মেয়েটা কি সারাদিন ফ্যালফ্যাল করে ঘুরবে? জুলেখা ইউটিউব দেখে অরিগ্যামি শিখতে সময় নিল না। খবরের কাগজ কেটে বানাল মুকুট, ব্যাগ, পেন-স্ট্যান্ড।
সন্ধেবেলা দরজায় টুংটাং।
কে?
ইউসুফ দরজা খুললে দেখল শালাবাবু। দুহাতে দুটো বাজারের থলি।
—এলি কীভাবে? ভাইকে দেখে জুলেখার আনন্দের সীমা নেই।
—চলে এলুম। বাইকে এসেছি তো। ভেতরের রাস্তাগুলোয় পুলিশ নেই।
শালাবাবু ঘরে ঢুকল না। দূর থেকে পাম্পিকে দেখে চলে গেল। পাম্পির মাথায় কাগজের মুকুটটি ছিল।
কী নেই থলিতে? আলু, পেঁয়াজ, আটা, বেসন, দু ক্রেট ডিম, চার প্যাকেট বিস্কুট! এছাড়া চকোলেট আর মাখনও রয়েছে।
জুলেখা আলুর জায়গায় আলু রাখছিল। বিস্কুটের কৌটোয় বিস্কুট। তার চোখ ছলছল করছিল। ইউসুফ দেখেছে।
রাত ১২টায় সঞ্জুর হোয়াটসঅ্যাপ—কল করব?
ইউসুফ ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে জড়িয়ে রয়েছে পাম্পি।
জুলেখাই রিং করল।—সঞ্জু বলল, টিকটকে তোর ভিডিওগুলো দেখলাম।
—কেমন হয়েছে রে?
—খারাপ না। ভালোই ট্রাই করেছিস। সে বিজ্ঞের সুরে বলল, তবে কিছু প্রবলেম রয়েছে।
— যেমন?
— আচ্ছা বলতো মানুষ কখন হাসে?
—কখন হাসে? জুলেখা অবাক। কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না।
সঞ্জুই উত্তরটা দিয়ে দিল, তুই যেটা এক্সপেক্ট করছিস না সেটা যদি হঠাৎ ঘটে যায়, দেখবি, তুই হেসে ফেলেছিস।
এই লকডাউনে তার একটি প্রাঙ্ক প্রায় পঞ্চাশ হাজার শেয়ার হয়েছে। সে ভিডিওটার উদাহরণ দিলো— মদের দোকান খুলতেই আমরা কী দেখলাম? না শ’য়ে শ’য়ে লোক লাইন দিয়ে মদ কিনছে। তখনি বুঝেছিলাম এইটাই হাইটাইম। করলাম কী, একটা ৭৫০-র বোতল সবাইকে দেখিয়ে প্যাকেটে ঢোকাতে গেলাম। প্যাকেটের নিচটা ছিল ফাঁকা। ব্যাস, যেই পুরোটা ঢুকিয়ে হাত ছেড়েছি, অমনি বোতলটা রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেল। বুঝলি কিছু?
হুম। জুলেখা গম্ভীর হয়ে গেছিল।
সঞ্জু বুঝতে পেরে বলল, মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। তুই কি আমার সঙ্গে কাজ করবি?
তোর সঙ্গে! জুলেখার হাতে চাঁদ।
সঞ্জু ভরসা জুগিয়ে বলল, আসলে এইটায় একজন মহিলাকে দরকার। তুই ছাড়া এই লকডাউনে আর পাবো কাকে? তোকে একটা লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। দেখ। কাল ফোন করব।
পারব আমি? জুলেখার মনে তখনো ভয় কাটেনি।
ধুর পাগলি! পারবি না কেন? সঞ্জু ফোনটা কেটে দিল।
লিঙ্কটা একটা খবরের। খবরটা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে। একজন মা ট্রলি ব্যাগ টেনে টেনে হাঁটছে। ট্রলি ব্যাগের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে পাম্পির বয়সী একটা বাচ্চা। মা আর হাঁটতে পারছে না। তাকে কয়েক হাজার মাইল এইভাবে হাঁটতে হবে। হাঁটতে পারলে তবে ঘরে ফিরতে পারবে। আর না পারলে ঘরে ফিরবে তার লাশ।
ভিডিওটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছিল জুলেখার। এই ঘটনা থেকে হাসি-মস্করা তৈরি হবে কীভাবে? সে ভেবে পাচ্ছিল না।
সঞ্জু প্রফেশনাল। দুপুরে ফোন করে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দিল।
জুলেখার মনে তখনো সন্দেহ। বোকা বোকা প্রশ্ন করে বসল, তুই আসবি কীভাবে?
ওসব তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু বরকে রাজি করিয়ে নিস।
কোন রাস্তায় ওরা ভিডিওটা তুলবে তা আগেই ঠিক করে রেখেছিল সঞ্জু। ঠিক সময়ে ওদের বাড়ি থেকে তুলে আনল। ইউসুফ বুঝতে পারছিল না এইসব করে কিভাবে টাকা আসবে। তবু আর কিছু উপায় না দেখে চলে এল।
জুলেখা কথা মত নীল পাড়ের গোলাপি শাড়িটা পরেছে। আলগা করে পরা। যাতে দৌড়তে গেলে শাড়িটা ঠিক সময়ে খুলে যায়। তবে তাতে লজ্জার কিছু নেই। শাড়ির নিচে জিন্স রয়েছে।
সমস্যা একটাই—পাম্পি। সে কিছুতেই ট্রলি ব্যাগটার উপর চুপচাপ শোবে না। জুলেখা ব্যাগটা টানতে শুরু করলেই হি-হি করে হেসে ওঠে। তার জন্য ললিপপ আনা হয়েছিল। সেটাও কাজে দিল না। এদিকে পুলিশ চলে এলে খামোকা গণ্ডগোল হতে পারে। মাস ছয়েক আগে সিটিসেন্টারে সঞ্জু অ্যারেস্ট হতে হতে কোনোরকমে বেঁচে গেছিল। সেবার একটা মেয়ে তার নামে কমপ্লেন করে দিয়েছিল সিকিউরিটির কাছে।
শেষপর্যন্ত বুদ্ধিটা দিল ইউসুফ। ওষুধের দোকান থেকে অ্যালজোলাম এল। সেটাকে আধখানা করে দুধে মেশানো হল। দুধটা কিছুতেই খাবে না পাম্পি। বলছে, তেঁতো। ছ্যা। জুলেখা তাকে টেডি বিয়ারের লোভ দেখিয়ে বুদ্ধু বানাল।
দুপুরের খরখরে রোদ। ট্রলি ব্যাগের উপর পাম্পি শুয়েছে। জুলেখা ঘোমটা টানল। তারপর ব্যাগের হাতলটা ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
পরিকল্পনা ছিল—জুলেখা এইভাবে হাঁটতে থাকবে। আর সঞ্জু কোথা থেকে ছুটে এসে একখানা টেডি বিয়ার ব্যাগের উপর রেখে পাম্পিকে নিয়ে পালাবে।
জুলেখা হাঁটছিল। পেছনে সঞ্জু। তার হাতে একখানা টেডি বিয়ার। তার হাঁটার ধরন দেখলে যে-কেউ হেসে ফেলবে।
ইউসুফের হাতে মোবাইল। সে পুরো ঘটনাকে রেকর্ড করছিল।
হঠাৎ ব্যাগে হ্যাঁচকা টান পড়ল। জুলেখা তখনো তাকাতে পারেনি। সঞ্জু কৌশলে টেডি বিয়ারটা ব্যাগের উপর রেখে পাম্পিকে তুলে নিয়েছে। জুলেখা তাকাতেই সে দৌড় লাগাল। জুলেখা দৌড়বে কী! দুপা এগোতেই তার শাড়ি খুলে একসা। ইউসুফ একবার জুলেখার সামনে, আবার একবার সঞ্জুর পেছনে মোবাইল নিয়ে ছুটল।
পুরো ভিডিওটা দেখবার পর সঞ্জু নিশ্চিত এটার রিচ পঞ্চাশ হাজার ছাড়াবেই। এখন শুধু এডিট করা বাকি। সেটা সে নিজেই করে নেবে। ইউসুফ অত কিছু বোঝে না। জুলেখা হিসেব করতে শুরু করেছিল পঞ্চাশ হাজার লাইক পড়লে সে আদতে কত পেতে পারে।
বিকেল হয়ে আসছিল। ফাঁকা কলকাতায় হাওয়া দিচ্ছিল। হাওয়াটা মিষ্টি। এবার তারা বাড়ি ফিরছে। বাইক চালাতে চালাতে সঞ্জু গান করছিল। জুলেখা মেয়েকে কোলে নিয়ে হাসছিল। ইউসুফের হাতে টেডি বিয়ার। সেও বুঝি সঞ্জুর সঙ্গে গুনগুন করল। পাম্পি তখনো ঘুমিয়ে। কখন জাগবে তা কেউ জানে না।
. . .