একগুচ্ছ শ্মশান ও পেরেক কবিতা । বিনেন্দু ভৌমিক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০২২, ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ, | ৪৮৬ বার পঠিত
অজাতশত্রু
নির্বাক হলেই যে অজাতশত্রু হয়ে বেঁচে থাকা যাবে বহুকাল,
একথা সঠিক নয়,
গাছেদের মধ্যে থেকে আমারে জানিয়ে গেলো
সেগুন আর শাল।
শ্যাওলা
শ্যাওলাকে ভালোবাসলে খরস্রোতা হতে নেই। আমি তাই পুকুর হয়েছিলাম। বছর দশেক হলো, সে পুকুর ভরাট করে দশতলা বাড়ি উঠেছে।
ও বাড়ির পেছনের দেয়ালটা নোনাধরা। কিছুদিন হয়, ওই দেয়ালের কোল ঘেঁষে শ্যাওলা জমেছে। কাছে গিয়ে দেখি, তার শরীরে আমার পুকুরেরই ঘ্রাণ। এখন বুঝি, শ্যাওলাকে ভালোবাসলে সব সময় পুকুরও হতে নেই।
পথ
আসার পথটা একই সবার, যাওয়ার পথটা ভিন্ন,
মধ্যিখানে উল বোনে কেউ, কেউ করে তা ছিন্ন।
ঝরাপাতা গো…
যে পাতাটা গাছের জন্য সব চে বেশি করে,
সেই পাতাটাই কুঁকড়ে গিয়ে সবার আগে ঝরে।
শ্মশান
এত গ্রহ, এত তারা, কোনখানে আছে বলো প্রাণ,
আমরা খুঁজছি রোজই, পৃথিবীকে বানিয়ে শ্মশান।
ধান
যখন পাকে রে ধান, ধান গাছ আনমনে ভাবে,
কদিন বাদেই তার মাথা কাটা যাবে!
দাগ
গনক-ঠাকুর পাথরটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা ‘বেলেঘাটা’ থেকে আনিয়েছি। স্যাকরার দোকান থেকে ভালোমতন একটা আংটি গড়িয়ে নেবেন খাঁটি সোনা দিয়ে। মঙ্গলবার সন্ধ্যবেলা মায়ের পুজো দিয়ে পরে নেবেন ‘দুগ্গা, দুগ্গা’ বলে। তারপর দেখবেন, আপনার সিন্দুকে মা লক্ষ্মী এই আবাস গাড়লেন বলে!
প্রথম যেদিন আংটিটা পরি, সে কী উত্তেজনা আমার। ইনিয়েবিনিয়ে দেখি, আড়চোখে চাই, আলতো করে ছুঁই। এ যে আমার আলাদীনের চেরাগ। ধনে-দৌলতে ভরে উঠবে আমার চাঁদসওদাগরের ‘সপ্তডিঙ্গা’। রোজগার শুরুও হলো। আর, যখনই রোজগার করি, ভাবি এটা আমার আংটিরই ফল। আমার ভাঁড়ারে লক্ষ্মী ঠিক আসন পেতে বসলেন যেন।
একবার লক্ষটাকা লোকসানও হলো। জন্মদিনের বেলুন যেমন হঠাৎ চুপসে যায়, তেমনি আংটিটাকে সব দোষ দিয়ে আমি মিইয়ে গেলাম যেন।
এরপর কত চড়াই-উৎড়াই পেরুলাম। আংটির কথা আর তেমন করে মাথায়ই রইলো না।
এভাবেই কেটে গেল বছরকুড়ি। আজ হঠাৎ দেখি আংটিটা কড়ে আঙুলের গোড়ায় আর নেই। যেখানটাতে আংটিটা ছিল, ঠিক সেখানে হালকা সাদা রঙের একটা দাগ।
তুমি আর আংটি, সারাটাজীবন কেবল দাগই ফেলে গেলে।
আতরদানি
যতই খোদাই করা থাকুক আতরদানী,
সাজাও যতই নানা সাজে—
আতর ফুরিয়ে গেলে কে তারে যতন করে
রাখে গো দেরাজে।
ওথেলো
পাথরগুলো ভোতাই থাকে, টুকরো যে তার ধার,
বৃত্তচাপের ভেতর থাকে কোনের অহংকার।
হৃদয় আমার পাথর বলে ভাবছো হয়তো— খেলো,
ভাবো, কিন্তু ভেঙো না হে, ভাঙলে সে ‘ওথেলো’!
বইয়ের ভেতর পাপড়ি
বইয়ের ভেতর ‘পাপড়ি’ ছিল, পাপড়ি মানে ‘জুঁই’,
জুঁই মানে তো ‘জুঁই’ ছিল না, জুঁই মানে তো ‘তুই’,
তুই মানে তো ‘তুই’ ছিলি কি? তুই মানে তো ‘ফুল’,
ফুলের ভেতর আততায়ীর ছদ্মবেশে→’ভুল’।
ভুল মানে তো ‘ভুল’ ছিল না, ভুল মানে তো ‘প্রেম’,
ভুল প্রেমেই যে বসত গাড়ে রাইয়ের সঙ্গে শ্যাম।
এই বসতি দিন কয়েকের, ক্ষণস্থায়ী, আহ্!
বইয়ের ভেতর পাপড়ি মানেই, মিলন হবে না।
অশ্রু
আগুন জ্বলছে, আগুন; কেউ নাই রে দেবে জল—
গড়িয়ে এসে অশ্রু বলে, আমায় নিয়ে চল।
প্রভু…
নিজের দেহের থেকে বেশি ভার নিতে যদি হবে,
পিপড়ের ঘরে কেন জন্ম দিলে না ‘প্রভু’ তবে?
পেরেক
হৃদয়টাকে পেরেক বানিয়ে সোজা দেয়ালে ঠুকে দিয়েছি। ওতে এখন বৃন্দাবন থেকে কেনা কৃষ্ণমূর্তি ঝুলছে।
ভালোবাসা পেলি না যখন, যা, এখন ইষ্টনাম জপ কর গে।