আড়ষ্টতা, সুরা ও জাদুমোহ । জওয়াহের হোসেন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০২২, ৭:৪৫ পূর্বাহ্ণ, | ৪০২ বার পঠিত
সুরা ও জাদুমোহ
১
আমার সর্বস্ব নিয়ে যে আগুন জ্বলছে তা নিভিয়ো না, ওই ছাইটুকু আমি
২
পানপাত্রে অহর্নিশ তোমাকে দেখি, চোখ অন্ধ হয়ে গেছে জাদুর স্নিগ্ধ-মধুরিমায়
৩
একা একা সফরে চলেছি আমি, জেনে রাখো এই পথই আমার প্রাণদায়ী-আশ্রয়
৪
আমি তো সুরায় মাতাল হইনি কখনও, তোমার রূপের প্রজ্জ্বলতায় ছিলাম চির-মাতাল
৫
যে-দহন আবৃত করে আছে জন্মাবধি, আমি সেই আত্মঘাতী বিনাশ
৬
যে-মদিরার নেশায় হয়েছি মাতোয়ারা, আমার বৈরাগ্য ওই সুগন্ধি সরোবর
৭
পেয়ালায় বেহুঁশ, আমায় শান্ত করো-হে আত্মার বাগান
৮
তুমি পাতালে ঘুমিয়ে আছ আর আকাশেও এক অবিনশ্বর
৯
পরবাসী মেঘ, হীম পাতালের ঘুম ভেঙে এসো তোমার নামে আমার চির-ধ্যানমগ্ন জিকির
১০
স্বর্গে যেতে চাই না, তোমার মধ্যে বেহেশত, আমার সমাধি
প্রবাহিতা
সে-ও বিপৎসংকুল খুব প্লাবন সহে…
গেছ রক্তে ও জলে-এমন ইচ্ছে আজ বৃথা আর চূর্ণ
ফেনিল—
আমার দুচোখ ভরে শুধু জলতোড় স্নানের স্ফূর্তিমান
উৎসব—
অথচ দেখে ফেলি নগ্নিকার দিনলিপি
ফের পৌঁছে গেছে ঘূর্ণিরত পথে
ক্ষোভ আর ক্লান্তি নিয়ে পরিচিত রাত্রির পিছনে
আড়ষ্টতা
বন্ধ্যা-বৃষ্টিতে সেঁকে নিই সুরার আগুন
কতটা সিঁদুর-রাঙানো মুগ্ধতায় আক্রান্ত রাত্রিবাসে
কতটা বিষের দামে অঝোর জলে তোমার অভিসার
কতবার মনে রেখে ভাবি দ্বন্দ্ব ও ভয়!
কামনার আয়ুতে ঝুলে থাকে ত্রস্ত শয্যা
আরশে ঋণী হয়ে যায় প্রাপ্তির ফসিল
কুয়াশাবিদ্যুৎ
কুয়াশায় যে-ঘোর জমে আছে দূর পথের আদলে
তা দিয়ে রচি ধাঁধার জগৎ
গন্তব্যে রাত্রিজাগা গুটিপোকাদের নির্জন খেলা
পুরো গ্রাম লুটিয়ে পড়েছে
বিদগ্ধ বিহারে—
জমি খুঁড়ে খুঁড়ে এঁকে নিচ্ছি অবসর
অনুভূতিহীন ভস্ম দিনকূলে
জলমথিত
জল বুনতে বুনতে দেখি সময়—
নিস্ফল এতটা উপহাসমুখর
ধুলোবার্তায় ভরে আছে দীর্ঘ পথ
আমি এই ভ্রমণশূন্য যাত্রার নিকটে
ভীতু পথিকের ন্যায় খুব নিরুপায়
জলবিহার
বৃথাই লুটিয়ে পড়েছিলাম—তোমার স্নানসিক্ত শরীরে
যেন কোনও অবাধ্যেও ঘোরলাগা পরাস্ত প্রহর
মৃদু সাহসে কম্পসমুদ্দুরে জীবন উদ্বাস্তু করে
বিরহ আবর্তে বহুকাল
ঘর বেঁধেছিলাম বিলুপ্ত সমুদ্রে একা
শব
শব ও রক্ত পুড়ছে, আশ্লেষে ঘন কুয়াশাশূন্য
আর্দ্রশীত লাল শির বেয়ে সিক্ত বেদনা নিয়ে
পলাতক নির্জনতার অশ্রুপাশে দীর্ঘ দেবদারু গাছ
শাখাহীন শব্দহীন ফেলে গেছে কেউ
একাকী নীলহাওয়া
অতৃপ্তসন্ধ্যা
দেহভর্তি ঋতুমোহ, এই দেহ
ছুঁতে গেছে এক নেশাতুর তীব্র মাতাল
উষ্ণ বাহুবন্ধে লাল চোখ
অতিশয় দেহ ঘিরে থাকে ভীষণ আনমনা
বৃষ্টির উনুন ঘিরে থাকে নিদ্রাগ্রস্ত প্রলাপ
দীর্ঘ সফরে ভাসিয়ে দিচ্ছে অতৃপ্ত-সন্ধ্যা
আমি তার একমাত্র নটরাজ
ভাবছি সংগোপনে শস্যভরা পৃথিবীতে
ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে হেঁটে যাব
মুর্শিদার নৈকট্যে
মার্জনা
কিছু ভ্রান্ত কল্পবিন্যাশ ক্রমশ বিস্তৃত
তন্দ্রার জলজ রাত্রিরা জানে
দাহ উবে গেছে কাল
আমাকে হ্রস্ব করে বহুরূপী জল
ফটিকস্বচ্ছ দূর দ্রৌপদীর মতো
লবণের স্বাধ নিয়ে যাচ্ছে এই নগরে অনন্ত ক্ষমায়
অগ্নিগহ্বর
শুধু জমে আছে ছাই, ম্লানকাতরতা
আমি একা খুব এই পিছু পিছু হেঁটে আসা
অন্ধ পিপাসায় ঘোর উন্মাদ—
সেই অগ্নি, চিতাগ্নি দেহের দিকে, অন্ধকারের দিকে, মিশে যেতে থাকে বিরহে
এ জীবন খুবই বিদ্রƒপ প্ররোচনার নীরবতাময় অশ্রুপাতের
মানুষের ভিতরে শস্যদানার মতো জমে থাকে দহন
পড়ে থাকে অবহেলায় খুব
তার রক্তের ভিতরে, সত্তার মধ্যে,
সন্ধ্যার ভিতরে
এই আগত শীতে বনভূমির বিমূঢ় ছায়ায় একথা ভেবেছি
ধুলো ও সন্ধ্যায়
আমার সংশয় উপলব্ধি বিষণ্ন বিস্তারে
আজ আমারই মুখাপেক্ষী এই সূর্যাস্তে সবকিছু উচ্ছিষ্ট মনে হয়
আমি সে রাত্রিভর বিষাদ লিখছি ধূপগন্ধের আড়ালে মগ্ন হয়ে
আয়নাদর্শন
গোটা রাত্রির গভীরে ফুঁসে-ওঠা বিস্ময় আত্মার প্রসাদে,
পরস্পর নানারূপ স্পর্শে এতটা মগ্ন, এতটা বৈভব,
ওই হিম বরফ উপত্যকায়
নিষ্ফল স্থির তৃষ্ণায় জমে আছে জল, ভিন্ন আবর্তে
দেহের চারপাশে শুধু ধোঁয়া বাষ্পভরতি ঝড় আর রক্ত
অগ্নিগর্ভ গুহার নিকটে কেউ কি জেনেছে গুহাযুগের আদিঅন্ত?
সব স্তব্ধ করে প্রাণের অতি সন্নিকটে কোন সম্প্রদায়
আয়না খুলে দেখে
শত শতাব্দীর যাত্রা
মনস্তাত্ত্বিক
অনন্ত অস্তের দিকে ঝরে যায় জীয়ে ওঠা বিষদর্প…
তোমার কাঁপা কাঁপা দেহের মতো রাত্রিকে উজাড় করছে
প্রতীক্ষাহীন অজ্ঞাত দর্শক
আমি দেখতে পেলাম ভূতগ্রস্ত ফ্রয়েড মহাশয়
ওই রূপ মরীচিকার নেশায় খুব বিষণœ, একাকী জীবন-জিজ্ঞাসার
ভিতর স্রেফ অন্ধ-দার্শনিক,
উগ্র রাত্রিতে অস্থির একা
ছলনা
একা লাগছে আর তোমাকে ভেবে শীত আসছে
তুমি অদূরেই আছ, নাকি নেই… চোখের পলক পাইনি তো
কেউ জানে না, ওই অপস্রিমাণ ছায়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে
যায় দিন মৃত্যু ও জরায়
শ্রীমুখ
তপ্ত ও ভেজা স্তন ছুঁয়ে এমন গ্রীষ্মরাতে
অনিদ্রায় ফেটেছে শরীর—
ওই দেহভার সব শূন্য, সব কুৎসিত,
অস্থির আবর্তে উত্তাপে গলে যায়—
দ্বন্দ্বে জলহীন ফেনায়
এমন নিঃসঙ্গ রমণীর কাছে আমার বাসনা
কেবল মিথ্যে মনে হয়—
তবু শ্রীমুখ নিরুত্তর অতৃপ্ত বুদ্বুদে
ক্ষতরাত্রি
আমার সমস্ত ধ্যানদর্প সত্তায় জ্বলছে রাশি রাশি রাত্রির আকাশ—
নিজেকে খুব ক্ষুদ্র ভাবি এই হিমসন্ধ্যায়,
আজও নিঃসঙ্গ স্মৃতি ঘোর বিস্মরণে
পথে পথে ঝরাপাতা, পথে পথে মৃদু জল
তবু বেলা পড়ে আসে নিরাসক্ত আশ্বিনে
আর রক্তের অভিশপ্ত খরস্রোত বয়ে যায়—
কুয়াশাধূসর জ্বলে জ্বলে স্বর্গের দরোজায়
নিভৃতজল
এই নীরবতা বুঝি বোবাদর্শনে জেগে উঠছে মহাপৃথিবীর পথে
শুকনো পাতাদেহ জর্জরে ভীতি ও বিলাপে
তোমাকে চিনে রাখে পথ ও ধুলো, চিনে রাখে মেঘ
তুমি কি জানো শেষরাত্রি কতটুকু দূরে রেখে, মদ-মাংসে
পুড়েছি একা দীর্ঘ রাত্রিবেলায়
আজ তোমাকে জড়িয়ে আকুল হচ্ছে
শ্রাবণ দিনের জমে থাকা ঘনজল
ঈশ্বরী
আমার দেহতত্ত্বে এসে ঢুকে পড়ছে এক উল্কা
আমি মানুষের ভিতর ক্রোধে জ্বলে উঠি অন্তর্বেদনায়
টের পাই অজ্ঞাত জাদুতে
আমার বন্ধ দরজার সামনে আজ
উবু হয়ে বসে আছে মেধাবী এক ব্যামো লাজুক ঈশ্বরী
ভ্রমঘোর
বৃথাই জলে ফিরছি ঠান্ডা মাঘের হাওয়ায়,
তৃষ্ণা নেই স্বপ্নশিহরনে—
তবুও সে শূন্যতার মতো ঠায়, লেপটে থাকে
এমন কুয়াশাভোরে—
আমি ওই ঝরনাচূড়ার পাশে আমার দহন ভিজিয়ে দিই
রাত্রিআকাক্সক্ষায়
আর্তশরীর
খুব কেঁদেছিলে আর ঈর্ষায় গ্রীবা বাড়িয়ে ভয়ে ভরা চোখে তুমি চিরদুঃখী
জানি মেঘ ওই গুপ্ত হিমদানা নির্জন অসুখ নিয়ে তুমি উদাসিনী
আমিও তো আকুল বাতাসে কতবার ভিজতে ভিজতে পেরিয়েছি দীর্ঘ জলধারা—
নিঃস্ব হয়ে ফিরে গেছি রাত শেষে এক নিষ্ঠুর ঝড়ের দাপটে
এই ঋতুবদলের দিনে কাঁপছে আর্তশরীর আর ঘোর মহুয়ার বন
তবু অসহায় অন্ধকার অপ্রেমে আজীবন কলঙ্ক নিয়ে আছি দুঃসহ দুর্দিনে