আনন্দধারা । সাদিক হোসেন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, | ৬৪২ বার পঠিত
ওরা যত এগিয়ে আসছিল, আমরা ততই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলাম। তবু কোথাও বুঝি বিশ্বাস ছিল ওরা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করবে না। এমনকি পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ওদের আগমনের খবর পাওয়া সত্ত্বেহ আমরা চুপচাপ ছিলাম। প্রতিদিনের মত কুলদেবতাকে স্মরণ করছিলাম। মহৎ ও মহান ব্যাক্তিদের উক্তি স্মরণ করে পরস্পরকে সম্বোধন করতাম। ক্রমশ এটি রীতিতে দাঁড়িয়ে গেল। হয়ত প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছি, সামনের লোকটিকে দেখেই বলে ফেলতাম – `সিভিলিজেশন`, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে–রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। লোকটিও আমার দিকে প্রথমে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাতেন। তারপর কোন্ মনীষীর কোন্ প্রবন্ধ থেকে কথাটি বলেছি তা অনুমান করবার চেষ্টা করতেন। প্রায় সময় তিনি নির্ভুল হতেন। খানিক চিন্তা করে, যেন কোটেশানে কোনো ভুল না হয়, সেই ভাবে ধীরে ধীরে প্রবন্ধটির পরবর্তী অংশটি উল্লেখ করতেন – আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈব্যবাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আমিও মন দিয়ে তাঁর কথা শুনতাম। বক্তব্য শেষ হলে আমরা পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে ফিরে যেতাম যে-যার বাসায়।
আমাদের বাসায় কুলদেবতা বাৎসরিক ফল ভক্ষণ করে। তখন শিউলি ফুল, পদ্ম, হলুদ বর্ণের অরীক্ষা প্রভৃতি ফুল দিয়ে তার নৈবেদ্য সাজাতে হয়। অজীরস, মধুরস, তমরূপ – এই তিন প্রকার মন্ত্রই আমাদের সম্বল। যদিও বর্তমানে সমাজতাত্ত্বিকরা এগুলিকে আর মন্ত্ররূপে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে এগুলি হল, অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিরোধের ভাষা – যথা মনসা তথা ওলাউঠা!
আমাদের সমর্পণ তাঁদের থিয়োরিতে নিবেদন। আমাদের আবেদন তাঁদের থিয়োরিতে বলিদান। ফলে আমাদের কুলদেবতা যথা কৌম তথা সৌমরূপে পরিবেশিত হচ্ছিল। যদিও আমাদের পরিচ্ছদ ও খাদ্যপ্রণালী নিয়ে তাঁরা এখনো অব্দি কোনো বিশুদ্ধ মত প্রকাশ করতে পারেননি।
গ্রীষ্মকালে গোধূলি নামে। গ্রীষ্মকালে গরু জাবর কাটে। গ্রীষ্মকালে আমাদের পুকুর শুকিয়ে যায়। শুকনো পুকুরে নামলে হাঁটু অব্দি পাঁক। সেই পাঁকে ট্যাঁওরা নামের মাছ সুড়ুত সুড়ুত করে পালায়। তাকে ধরতে পারে সাধ্যি কার। গায়ে আঁশ নেই, নাকের উপর দুটো শুঁড়, কাঁটা মারলে ঘণ্টা দুয়েক শরীর অবশ হয়ে থাকে।
দিদি মাছ ধরতে গেছিল। কাঁটা খেয়ে অবশ। দাওয়ায় যখন তাকে শোয়ানো হল তার গাল দিয়ে কষ নামছে। চোখ রক্তবর্ণ। ডানহাতটি কনুই অব্দি নীল।
কিছুদিন আগে হলে এসব ক্ষেত্রে তেঁতুলের বিচি পুড়িয়ে তা ক্ষতস্থানে ঘষে দেওয়া হত। তাতে কাজ না হলে চলত জিউলমাছির খোঁজ। জিউলমাছির হুল ফুটিয়ে চিকিৎসা করবার রেওয়াজ বহু পুরনো। বিষে বিষে বিষক্ষয় – এই ছিল ধারণা। কিন্তু ইদানিং আমাদের বিশ্বাস খানিক পাল্টে গেছে। আর বুজরুকিতে আস্থা রাখতে পারি না। ফলে সকলে মিলে ঠিক করা হল দেরি না করে দিদিকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই নিয়ে যাওয়া হবে।
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় চার ক্রোশ দূরে। সেখানে দিবারাত্রি ডাক্তার থাকেন। নার্স থাকেন। দিদিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে প্রায় বিকেল পেরিয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবু সব শুনে তার বামহাতে সূচ ফোটালেন। ব্যথা প্রায় তৎক্ষণাৎ কমে গেল। যদিও কনুই অব্দি নীল রঙ ফ্যাকাসে হতে সময় লেগেছিল বেশ কিছুদিন।
ডাক্তারবাবু দিদিকে ভারী কাজ করতে বারণ করেছেন। প্রতিদিন জল খেতে বলেছেন ৫ লিটার।
এখন ভোরেরবেলা আমার কাজ হল কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে আনা। সেই জলে শিউলি, পদ্ম আর অরীক্ষা ফুল ডুবিয়ে কুলদেবতাকে নিবেদন করা। আমাদের কুলদেবতা শান্ত ও সুশীল। তার লোভ নেই, চাহিদাও কম। তিনি কোনোদিন নিজস্ব ঘরের দাবি জানাননি। শোবার ঘরে, রান্নাঘরে, দাওয়ায়…যেখানে হোক তাকে রেখে দিলেই হল। শুধু সকালবেলা সুগন্ধি মিশ্রিত জল আর সন্ধেবেলা মিষ্টান্ন – এই তার ভোগ। মিষ্টান্ন যোগাড় করতে না পারলে চিনি তো আছেই – তা দিয়ে কুলদেবতা আহার সেরে নেবেন।
দিদি সাদা হয়ে গিয়েছে। সাদা হয়ে সে সুন্দর হয়েছে। আমি বাসার সামনের আমগাছটার তলায় একখানা জলচৌকি রেখে এসেছি। ও জলচৌকির উপর বসলে আমি বালতি বালতি জল ঢেলে স্নান করিয়ে দেবো। প্রতিদিন এইভাবে আমি দিদিকে স্নান করিয়ে দিই। তার তৈলাক্ত চামড়ার উপর জলকণা সরে সরে যায়। চামড়া তো নয়; যেন কচুপাতা। ভোরের জমা শিশির টুপ করে পড়ে গেলে আর গতরাতের চিহ্নটুকু কোথাও অবশিষ্ট থাকে না।
গ্রীষ্মকালে গরু জাবর কাটে। সন্ধেবেলা মৃদু হাওয়া বয়। ধুলো ওড়ে। ধুলোর রঙ লাল। অজীবৎ সজীবন হরফে উতলা/ নানাক্ষয় উড়ো চল অজীব সুফলা – এই হল আমাদের গান। কোথাও দূরে কোথাও কাছে এই গান ভেসে বেড়ায়। এখন গায়ক মাদকে আসক্ত। সুর ধরে রাখতে পারছে না। গলা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। তবু সন্ধেবেলা, গরু যখন জাবর কাটে, এই গান খরখরে জমির উপর দিয়ে অতি আদরের বৃষ্টির মত বয়ে চলে অবিরত।
আচমকা বৃষ্টি নামল সেদিন রাতে। বিদ্যুৎ চমকালো ঘনঘন। দিদি আমার কাছে চলে এসেছিল। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকলাম। অবশ্য মাঝে মাঝে ওকে জোর তুলে জল খাইয়েছিলাম। পরের দিন ন`বছরের মেয়েটার লাশ পাওয়া গেল আমাদের পল্লীতে।
আমাদের কুলদেবতা ভদ্র। তার ইচ্ছায় আমাদের গোষ্ঠীতে পড়াশোনার চল শুরু হয়েছে। মেয়েটির মৃত্যুর প্রসঙ্গে, যাঁরা আমাদের মধ্যে শিক্ষিত, তাঁরা পুনরায় মহান ব্যাক্তিদের উক্তি স্মরণ করলেন – পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটি–ই ভালো আছে, জ্ঞান। আর একটি–ই খারাপ আছে, অজ্ঞতা। আমরা সকলে মিলে মনীষীদের বক্তব্যগুলো শুনলাম। এই মহান মনীষীরা অনেক পুরনো। সাদাকালো। কিন্তু লম্বা। এঁদের চুল উস্কোখুস্কো থাকে। মুখভর্তি দাড়ি। এঁরা ওভারকোট গায়ে দিয়ে, খানিক ঝুঁকে, নিজেদের অবিস্মরণীয় কথাগুলি বলেছিলেন অনেকদিন আগে। সেইসব কথা প্রতি যুগে শিক্ষিত মানুষেরা সবসময় স্মরণ করে থাকেন। এই কথাগুলো ভুলে যাওয়া বিপদ। না বলতে পারলে পাপ!
ওরা যত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, আমরা পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছিলাম। অশ্চর্যের বিষয় হল – দিদির ডানহাতটি পুনরায় নীলবর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। অথচ কোন ব্যথা নেই। তার কনুই অব্দি নীল রঙের চামড়া এতটাই স্বাভাবিক যে এটাকে তার শরীরের অংশ বলেই মনে হবে।
উনুনে কাঠ দিতে দিতে দিদি মস্করা করল, আস্তে আস্তে আমি ওদের দেবতার মতই পুরো নীল হয়ে যাব। এরপর ওরা যখন আমাদের গ্রামে ঢুকবে, আমাকে নিজেদের দেবতা ভেবে হকচকিয়ে যাবে। দেখিস, ভাগ্য ভালো থাকলে, আমাকে ওরা পুজোও করতে পারে।
দিদির মস্করায় আমার রাগ হয়ে গেল। মানুষ এমন অনুভূতিহীন হতে পারে কীভাবে? যে দেবতার নামে আমাদের গোষ্ঠীকে খতম করবার পরিকল্পনা করছে ওরা, আজ সেই দেবতার ভেক ধরে দিদি রেহাই পেতে চাইছে? ছিঃ
বছর পাঁচেক হল সরকার আমাদের গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি দিয়েছে। আমরা বাতি জ্বালাই, পাখা ঘোরাই। এই বাতি আর পাখাও সরকারের। ইলেক্ট্রিসিটির জন্য মাসে কোনো টাকা দিতে হয় না। একেবারে বিনামূল্যে আমরা এইসব উপভোগ করে থাকি। সরকার নাকি আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করতে চায়।
রাত্রি অনেক তখন। বুড়ো ভাম গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশপাশ নিঃশব্দ। দিদি বাতি নেভায়নি। বাতির নিচে দাঁড়িয়ে বলল, ধুর বোকা, তখন তো মিথ্যে বলছিলুম।
সে আমাকে কনুইটা দেখিয়ে বলল, এইটুকুই নীল। আর কিছু নীল হয়নি।
আমি তবু তার দিকে তাকাচ্ছিলাম না। এবার সে পেটিকোটটা খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, এই দেখ, বাকি কিচ্ছু নীল হয়নি।
দিদির বুকটা যা অনুমান করেছিলাম তার থেকে বড়। বগলে চুল। দুই পায়ের ফাঁকেও।
সেদিন রাতে গরু জাবর কাটছিল। বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। আমি জানালাটা খুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও প্রথমে আমার লিঙ্গটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে উপরনিচ করল। তারপর পুরোটা মুখে নিয়ে চুষতে থাকল। আমি কেঁপে উঠছিলাম। পিঠে ঠান্ডা হাওয়া লাগলেও কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছিল। দিদিকে বললাম, গালটা হাঁ কর। দিদি গাল হাঁ করলে আমি লিঙ্গটা বার করে আবার ওর মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। এটা করতে বেশ ভালো লাগছিল।
আমার হয়ে গেলে দিদি বলল, আয়।
আমরা একখানা মাদুর নিয়ে ঘরের বাইরে আমগাছটার তলায় চলে গেলাম। আকাশে পূর্ণ শশী নেই। ফুটফুটে তা্রারা যেন ছন্নছাড়া। দিদি মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। আমি ওর দুই উরুর মাঝখানে জিভ ছোঁয়াতেই সে দু-হাত দিয়ে আমার মাথাটা চেপে ধরল।
আমি জিভ চালাচ্ছিলাম। ও মৃদু মৃদু শব্দ করছিল। আমাদের মাথার উপর একটা বাদুড় পাক খাচ্ছিল। দিদি কিছুতেই ওখানে আঙুলটা ঢোকাতে দিল না। বলল, আজকে সারারাত ধরে আমাকে চেটে দে। আমি ওর কথামতই কাজ করছিলাম। ভোরের দিকে ওর দুধ খাচ্ছিলাম – মনে আছে, একবার বুঝি ভুলবশতঃ কামড়ে ফেলেছিলাম। তাতে ওর ব্যথা লেগেছিল।
নিমগাছ স্বাস্থ্যের প্রতীক। তার উপর চাঁদের আলো এসে পড়লে ব্যথার উপশম হয়। ব্যথা ভালো। শরীরকে কষ্ট দেওয়ার হরেক উপযোগিতার কথা বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন সময়ে বলে গিয়েছেন। এখনো কোনো কোনো গোষ্ঠী বিশ্বাস করে শারীরিক কষ্টের মাধ্যমে মোক্ষলাভ সম্ভব। সেইকারণে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরকে যাতনার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। অনশন সেইরকমই এক পদ্ধতি।
ন-বছরের মেয়েটির মৃত্যু নিয়ে প্রথমে আমরা বিশেষ কিছু ভাবিনি। কারণ মেয়েটি আমাদের গোষ্টীর নয়। ওরা মেষপালক। কিন্তু কিছুদিন পর আমাদের টনক নড়ল। দেখা গেল, রাজপথে একটি বিজয় মিছিল বার করেছে ওরা। সরকারের তরফ থেকে একটা ময়ূরপঙ্খী রথ দেওয়া হয়েছে। সেই রথে বসে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ। তিনিই মেয়েটির হত্যাকারী।
আমাদের ভয় মেয়েটির মৃত্যুর জন্য নয়। ওরা যাযাবর মেষপালক। ওদের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম মিছিলটিকে দেখে। এই মিছিল প্রমাণ করল ওরা যেকোনো মুহুর্তে আমাদের গ্রামে প্রবেশ করবে এবার।
আমারা কীভাবে ওদের রুখব? গ্রামের শিক্ষিতমণ্ডলীরা আলোচনা শুরু করলেন। পুনরায় মনীষীদের বিভিন্ন উক্তি স্মরণ করা হল। দুজন শাস্ত্রজ্ঞ তর্ক জুড়লেন। মোক্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণার উল্লেখ করা হল। কিছু ধারনা শুধু যে পরস্পরের বিপরীত তা-ই নয়; তারা পরস্পরকে নাকচও করে।
এইভাবে প্রথম চারটি অধিবেশনে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলাম না। তবে যারা জ্ঞানপিপাসু তাদের কাছে এই অধিবেশনগুলো হয়ে উঠেছিল অতীব চমৎকার। জ্ঞানের কোনো জাত নেই। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। অসীম ও অনন্তের বোধ যেন আমাদের মাথার ভেতর চক্কর দিতে শুরু করল। শেষপর্যন্ত পঞ্চম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল – মোক্ষ একটি দ্বৈত স্বত্তা। তবে পদ্ধতি ও প্রণালী সম্পর্কে তখনো কোনো মিমাংসায় আসা গেল না। একপক্ষ অনশনে বসার সিদ্ধান্ত নিল। অন্যপক্ষ ঠিক করল, শাস্ত্রমতে পাপাচারের নিয়মাবলীগুলি নিয়ে তারা একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবে। এই প্রদর্শনীটির নাম দেওয়া হল – চলমান প্রতিবাদী প্রদর্শনী। তারা কথামত নিজেদের গলায় এইসব নিয়মাবলীগুলো লিখে রাজপথে ও গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
তবে আরেকটি মত উঠে আসছিল তৃতীয় একটি পক্ষের থেকে। তারা দৃশ্য ও দ্রষ্টব্যের মধ্যেকার সম্পর্ক কতটুকু গোষ্ঠীনির্ভর তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করল। তাদের বক্তব্য মোক্ষের মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। কারণ, মোক্ষলাভ সম্পূর্ন হলে তা আবার অন্য একটি মোক্ষের দিকে ধাবমান হবে। এবং আমরা এইভাবে এক অনন্ত বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকব। এর শুরু নেই। এর শেষ নেই। কিন্তু যার শুরু ও শেষ নেই – তার মায়া আছে। আবার শাস্ত্রমতে যে কার্য্য বা পদ্ধতি মায়ার উদ্রেক করতে পারে তা সর্বদাই মোক্ষের বিপরীত। এই তৃতীয় পক্ষটি মোক্ষলাভের পরিবর্তে মোক্ষযোগ কথাটি উপস্থাপন করল।
পাখির নাম হরিতক। পাখির নাম কুহু। পাখির নাম রত্নাবলী, ঘুঙুর। একটা পাখি গেরুয়া, মাথায় সবুজ রঙের টোপর। এই পাখিটা মাছ শিকারি। ডালে চুপচাপ বসে থাকে। সুযোগ পেলেই ডুব দিয়ে ধরে আনে কুহিতো মাছ। কিন্তু বর্যাকালে কুহিতো শিকারে বিধিনিষেধ আছে। তাই গেরুয়া পাখিটিকে পুকুরের আশেপাশে দেখলেই বাচ্চারা ঢিল মেরে পাখিটাকে তাড়িয়ে দেয়।
বর্ষাকালে গ্রাম ধুয়ে গেল। নদীর জল এসে পড়ল চাষাবাদের জমিতে। মেষপালকেরা ফিরে গেছে অন্যত্র। গরু আর কী করে, জাবর কাটছে ছাউনির তলায়। তার চোখ ঢুলুঢুলু। বাইরে জল তমতম করছে। সেই সুযোগে বাজনা বাজিয়ে ওরা আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ল।
আমাদের কুলদেবতা সুশীল। একদিন রাতে আচমকা বর্ষার মেঘ কেটে গেল। দেখা গেল পূর্ণ শশী উদিত হয়েছে আকাশে। সাদা ও ঝকঝকে। নিমগাছ আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এই সাদা ও অপূর্ব চাঁদকে গোরাচাঁদ বলা যেতে পারে।
দিদি বলল, আয়।
আমরা থালা বাসন বাজাতে বাজাতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমরা কাদামাটিতে লেপ্টে যাচ্ছিলাম। আমাদের গায়ের উপর বিষধর সাপ চড়ে বেড়াচ্ছিল। দিদি একখানা মরা কুহিতো মাছ সঙ্গে করে এনেছে। আমাকে অবাক করে সে পুরো মাছটাকেই নিজের ভেতর ঢুকিয়ে নিল। শুধু লেজের খানিক অংশ বাইরে। আমাকে বলল, তুই মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে বার কর।
আমি ওর নির্দেশমত কাজ করে যাচ্ছিলাম। ও গোঙাচ্ছিল। আমাদের দেখে শিক্ষিতমণ্ডলীরা লজ্জা পেয়েছিল নিশ্চিত। তারা পাপাচারের নিয়মাবলী নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছিল। কেউ একজন বলছিল – `সিভিলিজেশন`, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে–রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। এই নিয়মগুলির সম্বন্ধে প্রাচীনকালে যে ধারণা ছিল সেও একটি ভূগোলখন্ডের মধ্যে বদ্ধ। সরস্বতী ও দৃশদবতী নদীর মধ্যবর্তী যেদেশ ব্রহ্মাবর্ত নামে বিখ্যাত ছিল সেই দেশে যে আচার পারম্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলে সদাচার। অর্থাৎ, এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত – তার মধ্যে যত নিষ্ঠুরতা, যত অবিচারই থাক। এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচারব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে অপহরণ করেছিল। লোকটিকে আমি চিনি। এঁর সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণকালে একবার আমার দেখা হয়েছিল।
ওদের সম্পর্কে পার্শবর্তী এলাকা থেকে যেসব খবর পাওয়া গিয়েছিল তার অধিকাংশই গুজব। আমরা ক্রমে স্বীকার করছিলাম ওরা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। ওদেরও কুলদেবতা রয়েছে। সেটির রঙ নীল।
ওরা হত্যায় বিশ্বাসী নয়। ওরা সহিষ্ণু। ওদের কুলদেবতা এতটাই জাগ্রত যে খড়া অঞ্চলেও তাঁর ইচ্ছায় বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। আবার বৃষ্টিবিঘ্নিত অঞ্চলকে মুহুর্তে চাষাবাদে পরিণত হতে চোখের সামনেই দেখেছে অনেকেই।
ওরা আমাদের অতি উন্নতমানের ফসলের বীজ দিচ্ছিল। একেবারে বিনামূল্যে। এই ফসল চাষ করতে জল লাগে কম। উপরন্তু পোকামকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল নষ্ট হবার ভয়ও থাকে না।
ওরা আমাদের উপদেশ দিয়েছিল প্রতিটি ঘরের সামনে একটি করে তুলসী গাছ রোপণ করতে। তুলসী গাছ ভালো। তুলসীপাতার বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। আমরা প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে একটি করে পাতা চিবিয়ে নিতাম। এমন ঝাঁঝালো স্বাদ এর আগে আমাদের জিভ পায়নি। আমাদের সারাটা দিন ভালো কাটত।
প্রতি বুধবার সন্ধেবেলা আমরা মিলিত হতাম। সেই সন্ধ্যায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হত না। গাছের ডালে ডালে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে উৎসবের আয়োজন হত। কেউ বাঁশি বাজাত, কেউ সেতার, আমাদের টেরিনিম নামক বাদ্যযন্ত্রটি ওদের খুব প্রিয় ছিল – সেটির দ্রিমিদ্রিমি আওয়াজে আকাশেবাতাসে আনন্দধারা বয়ে বেড়াত।
বস্তুত ওদের মালিকানা স্বীকার করে নেওয়াতে আমাদের প্রায় কিছুই অসুবিধে হচ্ছিল না। আমাদের কুলদেবতা ভাবুক – তাঁর অপর নাম চিন্তামণি। তিনি আমাদের সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।
শুধু একটি ব্যাপারে কিছু মজার ঘটনা ঘটেছিল। যে ফুলের নাম অরীক্ষা ছিল – সেটি এখন সতীরূপ। যে নদীর নাম জিঞ্জিরা ছিল – সেটি এখন সরুযু।
ওরা আমাদের বিভিন্ন জিনিসের নাম পাল্টে দিচ্ছিল। পাল্টে যাওয়া নতুন নামের সঙ্গে মানিয়ে চলা কঠিন। প্রায় সময় আমাদের দিকভুল হয়ে যেত। নিশানা হারিয়ে ফেলতাম। হয়ত যেতে চাইছিলাম এনায়েতনগর; পৌঁছে গেলাম স্বর্ণপুর। হায়াতপুরে যেতে গিয়ে কতবার আমি নিজেই বিশল্যবাজারে পৌঁছে গেছি। এটি যেকোনো খেলার মতই মজার। আমরা সারাদিন ওদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় মেতে থাকতাম। ওরা খেলা ভালবাসত।
খেলার পর ক্লান্তি নেমে আসে। আজকাল প্রায় রাতে দিদি বাসায় ফেরেনা। জিজ্ঞেস করলে বলে – কী করব, শেখবাজারে গিয়ে দেখি সেটা এখন ঠাকুরনগর। সেইখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাহুচক, পঞ্চসাগর, হরিপুর…কোথায় যে হারিয়ে গেছিলাম!
আমি জানি দিদি মিথ্যে বলছিল। ও আর আগের মত আমাকে সামনে দিয়ে করতে দেয় না। আমার লিঙ্গ শক্ত হয়ে গেলে সে বেশীরভাগ সময় সেটাকে নেড়েচেড়ে ঠান্ডা করে। দুএকবার উপুড় হয়ে শুয়ে আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে বলেছে। আমার এই পদ্ধতিটা ভালো লাগে না।
শীতকালে গরু জাবর কাটে। শীতকালে গরু বিবাগী হয়ে ওঠে। যদিও আমাদের পল্লিগ্রামে শীতকালীন অধিবেশনটি খুব কম সময়ের জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই অধিবেশনে আমরা রূপ ও রস নিয়ে আলোচলা করেছিলাম। রূপ ও রস কি মানবনির্ভর? – এই ছিল তর্কের বিষয়! অধিবেশন শেষে আমরা প্রত্যেকেই তুলসী মিশ্রিত চা পান করেছিলাম।
দিদির কনুই-এর নীল রঙ স্থায়ী হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে তার কী গর্ব। এখন সে প্রকাশ্যেই ডানহাতটা দেখিয়ে বলে – এটাই আমাদের রক্ষাকবচ। আমারও তাকে মাঝে মাঝে মনে হয় সে আসলেই একজন উদ্ধারকারী। কিন্তু কার কাছ থেকে সে আমাদের উদ্ধার করতে চায়?
দিদি বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী সংগ্রহ করছিল। চিনামাটির পেয়ালা, ষোড়শ শতাব্দীর কার্পেট, হরিণের শিং দিয়ে বানানো ঝর্ণাকলম, প্রাচীন ভূ-পর্যাটকদের পুঁথি…
একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কোথা থেকে পাচ্ছিস? সেদিন সে ঘুঙুরপাখির মাংস রেঁধেছিল। স্বাভাবিকভাবেই খুশি। বলল, ওরা আমাকে দিয়েছে।
– বিনামূল্যে?
– দিদি হাসল। কোনো উত্তর দিল না।
পক্ষীপঞ্চমীর রাতে সে ঘরে ফিরল শরীরে প্রবল ব্যথা নিয়ে। আমাকে জাগিয়ে দিয়ে দু-পা ফাঁক করে শুয়ে পড়ল। বাতি জ্বালালে দেখতে পেলাম তার দুই পায়ের ফাঁকে একখানা বোতলের মুখ দেখা যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে বোতলটাকে টেনে বার করছিলাম। ও যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠছিল। নিজেই মুখে বালিশ চেপে ধরেছিল। তবু বলছিল, সাবধান। যেন ভেঙে না যায়।
তারপর বোতলটা দেখিয়ে বলল, এটা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর। পবিত্র গ্রন্থে এই বোতলটার উল্লেখ রয়েছে।আমরা বোতলটাকে আমাদের কুলদেবতার পাশে পরম যত্নে রেখে দিলাম।
এইভাবে আমাদের বাসা বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন শিল্পসামগ্রীতে ভরে উঠছিল। এখন এটিকে বাসা না বলে প্রদর্শশালা বলা যেতে পারে।
দিদির শরীর ভেঙে যাচ্ছিল। সেদিন রাতে শ্বেতপাথরে তৈরি হাতির মুর্তিটি বার করবার সময় রক্তপাত শুরু হল। যেন লাল জলের ধারা। থামছেই না। আমাদের মাদুর, মেঝে, রান্নাঘরে রাখা বাসনকোসন সব রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।
এর শেষ কোথায়?
এর কোনো শেষ নেই।
এটা শুরু হয়েছিল কবে?
আমাদের তা মনে নেই।
পুনরায় দিদি বেরিয়ে গেছিল। ফিরল বেশ কয়েকদিন পর। ওকে দেখে চিনতেই পারিনি। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। যন্ত্রণায় সে আক্ষরিক অর্থে নীল হয়ে উঠেছে।
বৈদ্যুতিক বাতিগুলো নিভিয়ে একখানা হ্যারিকেন টাঙানো হল আমগাছটার তলায়। ওর কথামত থালাবাসন বাজিয়ে আমি লোকজন জড়ো করতে শুরু করলাম। জনা-কুড়ি লোক জড়ো হলে ও সবার সামনে পেটিকোটটা খুলে ফেলল। আমাকে একটা পেন্সিল ব্যাটারির টর্চ দিয়ে ওর ভেতরটায় উঁকি দিতে বলল।
ভেতরটা অন্ধকার। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। আমি হাত ঢোকাতে গেছিলাম। কিন্তু কব্জির কাছে গিয়ে আটকে গেল। সকলের পরামর্শে নারকেল তেল মেখে হাতটাকে পিছল করা হল। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে হাতটাকে ভেতরে ঢোকাতে শুরু করলাম।
দিদি চেঁচাচ্ছিল। আমি থেমে যেতেই সে আবার আমাকে রাগ দেখাতে শুরু করল। বলল, কিছু পাচ্ছিস? পাচ্ছিস কিছু।
আমি দুদিকে মাথা নাড়ালাম। সকলে আমার দিকে তাকিয়ে। দিদি কোমরটা খানিক উঁচু করে বলল, এবার দেখ।
আমি পাঁচটা আঙুল দিয়ে তার ভেতরের কলকব্জাগুলো খুঁজছিলাম। দিদি গোঙাচ্ছিল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া পুরনো জনবসতিগুলোকে স্মরণ করছিলামঃ এনায়েতপুর, হায়াতনগর, শেখবাজার, মেমানপুর, আলিনগর, মোল্লাপাড়া, কয়ালপাড়া…আমি তার প্রতিটা শিরাউপশিরার মধ্যে এই অঞ্চল, বসতি, পাড়াগুলোর স্পর্শ পাচ্ছিলাম। যেন তবরেজ, যেন সওকত, যেন আখলাখ, আসিফা, আক্রাম, আয়ুব, শামিউদ্দিন…এইখানে রয়েছে…দিদির শরীরের ভেতর…থলির ভেতর…যেন সুযোগ পেলে তারা এখুনি বেরিয়ে আসবে…এনায়েতপুর, হায়াতনগর, শেখবাজার, মেমানপুর, আলিনগর, মোল্লাপাড়া, কয়ালপাড়া…তবরেজ, সওকত, আখলাখ, আসিফা, আক্রাম, আয়ুব, শামিউদ্দিন…এনায়েতপুর, হায়াতনগর, শেখবাজার, মেমানপুর, আলিনগর, মোল্লাপাড়া, কয়ালপাড়া…তবরেজ, সওকত, আখলাখ, আসিফা, আক্রাম, আয়ুব, শামিউদ্দিন…এনায়েতপুর, হায়াতনগর, শেখবাজার, মেমানপুর, আলিনগর, মোল্লাপাড়া, কয়ালপাড়া…তবরেজ, সওকত, আখলাখ, আসিফা, আক্রাম, আয়ুব, শামিউদ্দিন…এনায়েতপুর, হায়াতনগর, শেখবাজার, মেমানপুর, আলিনগর, মোল্লাপাড়া, কয়ালপাড়া…তবরেজ, সওকত, আখলাখ, আসিফা, আক্রাম, আয়ুব, শামিউদ্দিন…
আমাদের কুলদেবতা শান্তির কথা বলে। সৌহার্দের কথা বলে। আমাদের কুলদেবতা সুশীল, ভদ্র, বুদ্ধিজীবী। আমরা তার কথামত দিদিকে আমগাছটার তলায় পুঁতে দেওয়া মনস্থির করলাম।
এখন সাদা ও শুভ্র পোষাক পরেছি। গর্তের ভেতর দিদিকে শুইয়ে দিয়ে ঝুরঝুরে মাটি ফেলছি। দিদির মুখ ঢেকে যাচ্ছে। বুক ঢেকে যাচ্ছে। গর্ত ক্রমশ বুজে আসছে।
আমরা গুনগুন করে মন্ত্র উচ্চারণ করছি – মিলহা খালাক না কুম/ওয়া ফি হা নুয়িদু কুম/ওয়া মিনহা নুখরেজু কুম/তারায়াতান উখারা
আমাদের আকাশেবাতাসে আনন্দধারা বয়ে চলেছে অবিরত…