শিকড়ের ডানা । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৯:৫৮ অপরাহ্ণ, | ৬৬৯ বার পঠিত
নির্বিকার বিন্দুটি
কৃষ্ণ মাত্র ১৬বছর বয়সে বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেন। তিনি যখনই বোঝেন রাধার মন তমাল গাছের একটি পাতা বুঝি কেঁপে উঠেছে, তখনই বাঁশিটি রাধার হাতে তুলে দিয়ে একটি দূরত্বের রঙে লুকিয়ে যান। এভাবেই লীলাবান কৃষ্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে রূপান্তর লাভ করেন।
আবদুল হাই বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে জলের ঢেউয়ে মিশে মৃগেল মাছের চোখের মণিতে সিদ্ধ হন; মৃত্যুকে পরিধান করে আবদুল হাই মেঘের ধামে বিদ্যুতের পদ্মহেমে লোকান্তরে মেশেন। রঙমালা বেগম প্রতিদিন গণক ডেকে দিশা গুণিয়ে দেখেন- কবে আহা, তার সাধু হাই বাড়ি ফিরবেন! চুলার আগুন একাএকা তরকারি পুড়ে ফেলে, কিন্তু তার আঁচ তাকে ঘুনাক্ষরে স্পর্শও করে না। এভাবে রঙমালা একটি স্থিরবিন্দু, নির্বিকার ঈশ্বর হয়ে ওঠেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে ঢালুতে নামতেই প্রতিদিন নিরুপমা পিসিমার জ্যোৎস্নার ডালি সাজাতে ইচ্ছা করে। দুধেদুধে অন্ধ দুনিয়া দেখতে নিরুপমা পিসিমা ঝামায় কাসার থালাটি ঘষেন- ফলে থালা ঝকমক করে ওঠে। কাহার তরে জানি মায়াপাত্রে জ্যোৎস্না তুলতে দরজার দিকে যান। পিসিমা ভুলে যান, কবেই ওই দরজা আদিঅন্ত কালের জন্য বন্ধ হয়ে গ্যাছে!
পিসিমা নির্বিকার। নিরুপমা পিসিমা এভাবেই ভগবান হয়ে ওঠেন।
আল আরাফ
নারী এখন আর নারী নয়, কারণ সে নারী; পুরুষ আর পুরুষ নয়, কেননা সে পুরুষ!
আমি মাঝামাঝি একটা জায়গা খুঁজি, অথবা একটাই মোকাম খালি কাজের সুবিধার জন্য দুইটা নাম। হঠাৎ মনে পড়লো, এডগার এলান পো হয়তো এমন একটা জায়গার সন্ধান দিতে পারবে।
আমি এলান পো-রে জিগাই, ভাই তুমি তো আল আরাফ লিখচো: বেহেস্ত আর দোযখের মাঝামাঝি না-স্বর্গ না-নরক; অথবা কিছুটা জান্নাত খানিকটা জাহান্নাম; পো, ব্যাপারটা আমাকে একটু গুছিয়ে বলো দেখি! এডগার এলান পো পরিস্কার বলতে পারেনি।
এডগার এলান পো এডগার এলান পো নয়, কেননা সে এডগার এলান পো!
রাবেয়া বসরীর পলাপলি খেলা
সেইসময় রাবেয়া বসরীর নামে একটা গল্প চাউর ছিল : লোকে দেখে তাঁর এক হাতে আগুন আরেক হাতে পানি নিয়ে বেজান দৌড়ে যাচ্ছেন। এই আগুন আর জল দিয়ে রাবেয়া কী করবেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- পানি ঢেলে দোযখের আগুন নিভাবেন, আর আগুন দিয়ে বেহেস্ত জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবেন।
তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতাটিও তিনি তখনই লেখেন : জান্নাত মিসমার করে দেয়া হোক, যেন মনে না হয় আমি বেহেশতের লোভে তোমার পায়রোবি করি; জাহান্নাম তুলে দাও যাতে তুমি না ভাবো- দোযখের ভয়ে আমি তোমার ভজনা ইন্তেজামে নামি!
ওইসময়ে সুদূর মদিনা থেকে সৈনিক বেশে আসা হাসান ইয়াসার বসরীও পরম ও রাবেয়ার বাঁকা দুই চোখের নেশায় বসরা নগরীতে আটকা পড়েন। একদিন তারা দুজনে পলাপলি খেলায় মাতে। প্রথম পালা আসে হাসানের- তিনি নানা জায়গা ঘুরেটুরে অতিদূর এক কোণায় লুকান। কিন্তু রাবেয়া বসরীর হাসান বসরীকে খুঁজে পেতে তেমন সময় লাগেনি- সাত আসমানের ভাঁজের আড়াল থেকে রাবেয়া তাঁকে একলহমায় বের করে আনেন।
এবার আসে রাবেয়া বসরীর পালা- চকিতে রাবেয়া লুকান। হাসান বসরী তক্কেতক্কে নানা জায়গায় তালাশ করেন, ডানে-বাঁয়ে, উত্তরে- দক্ষিণে,পুবে-পশ্চিমে, আকাশে- পাতালে, স্বর্গে-মর্ত্যে- হেথায় খোঁজে, হোথায় খোঁজে তামাম বিশ্বজুড়ে; কিন্তু কোথাও রাবেয়া বসরী নেই।
হাসান বসরী হার মেনে চোখ বন্ধ করলে রাবেয়া পলকে বেরিয়ে এসে- আমাদের ঘরের এক কবি বুঝি বলেন- এতো দূরে দূরে কেন খোঁজো- আমি একদম কাছে, তোমার বুকের ভিতর গায়েব হয়ে ছিলাম- তোমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলাম- দেখতে আমায় পাওনি!
আনার দানা
তামাম দুনিয়া বুঝি একটা আনার ফল, হঠাৎ ফেটে গিয়ে আকাশ ভরে ফুটে উঠেছে তারা- আনার ফলের দানা।
এতো তারার ঝিলমিল নীরবতার নিচে, নক্ষত্রখচিত কোটি শিশুর মহল্লায় ঘোর লাগে- নিজের বুকের ভিতর সাত তবক আসমানের শিবনাথ ইশকুলে কখন যে অনূদিত হয় সরিষাপুর গ্রাম, ঢাকা শাহবাগ উপন্যাসের মোড়, আর ফিলাডেলফিয়া লিবার্টি বেল অঞ্চলে তুমুল জেনট্রিফিকেশনের উন্নয়ন উচ্ছেদ।
এতো হৈ-হুল্লোড়, ঝকমারির ভিতর আমার ভুবনপুরে এসে ছাউনির ঘর তোলে আমার নানু- সূর্যের মা- একাত্তরের যুদ্ধ থেকে যার ছেলে আর কোনদিন ফিরে আসেনি; কৌরালের সঙ্গে তার রাত্রিদিন জেগে থাকা সংসার- ঘুম নাই, জমজমের পানি নাই : জীবন বুঝি পলিথিনের ব্যাগ- কান্নায় গলে না, অপমানে টলে না।
নির্ঘুম নানুকে দেখি- কী অপার মমতায় জায়নামাজের পাটি ভাঁজ করে রাখে; মনে হয়- যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া তার ছেলে মিজু বুঝি জায়নামাজের ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে!
নানু কী আমার উপর এসে ভর করে? না হয় আমিও কেন পালা কেটে কেটে জমা রাখি লাটিমের ঘুন্নি, উষ্ণা বাড়ির পিছনে খালের করচনা ঢালুতে পড়ে থাকা ভূতলবাসী হামিদের বুকে জমাট রক্তজবা, সেই খালের ঢালুর উপরেই হঠাৎ দুইবেণী কিশোরী এক আমার ইনসমনিয়ার ভাঁজে ভাঁজে আজও ফুটে থাকে!
এতোদিন পর আমি হই আম্বিয়া খালা- ভাসতে থাকি আশার জাজিমে; আমারও চারপাশে স্তুপ হয়ে জমে ওঠে ইসিমের দানা- রইন্না গুডা, বুড়ি দাদী আয়নার মা’র এক প্যাঁইচ্চা শাড়ি- মৌলাধুনিক এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম; ও আমার অন্তর কানা, আকাশভরা সূর্য-তারা, আনার দানা।
কবি ও সাধক
একজন সাধক তাঁর সৃষ্টিশীল সজ্ঞার ঝলকটি গোপন করেন, কেননা তিনি ঝিনুকের মুক্তাটি নিজের ভিতরে ধারণ করে থাকেন; কিন্তু একজন কবি তাঁর সজ্ঞা কৃষকের স্বভাবে চাষ করে যান – যাতে তার ফসল গোলায় উঠতে পারে। ফলে বড় পার্থক্য হয়: সাধক গোপন করার পক্ষে, আর কবি তা প্রকাশ করেন।
সাধক তাঁর সঙ্গীত, চিত্র ও চিত্রকল্পের স্পর্শ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একটি চূড়ান্ত বাতিঘর প্রাপ্তির আশায় বাতিটি নিভিয়ে দেন; কবি একটি একটি করে তাঁর সঙ্গীত, চিত্র ও চিত্রকল্পের স্পর্শ একেকটি বাতির শিখায় জ্বালিয়ে ধরেন – তাঁর প্রকল্প সবগুলো আলো জ্বালিয়ে ফেলার পর একটি চূড়ান্ত ফলবতী তমসা বিনির্মাণ।
সাধক নিরন্তর একজন গর্ভবতী নারী; কবি একজন জননী।