ভাষান্তরিত গুচ্ছ কবিতা । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০১৯, ১:২৬ অপরাহ্ণ, | ২৮৯৯ বার পঠিত
চিল
জয় হারজো
তোমার সবটুকু তুমিকে আমূল উন্মোচিত করো
নিজেকে যুক্ত করো আকাশের প্রাণে,
দুনিয়ার ভিতর, চন্দ্র আর সূর্যের দরবারে।
তোমার অন্তর্গত ষোলআনা কারবার খুলে ধরো
নিয়ত করো এভাবে- তুমি এবার প্রার্থনা করবে।
তোমার বোঝকে অন্তহীন করো—
কোথাও এমন কিছু আছে— যা তুমি দেখো না;
এমন আছে কিছু ধ্বনি— যা তুমি শোন না।
চোখের সামনে প্রকাশিত কিছু ছাড়াও এমন কিছু
অবগুণ্ঠনে আছে— যা তুমি বোঝো না,
হয়তোবা এক নিরবধি বহতা অন্তরাল।
অনেকটা বুঝি সল্ট রিভারের উপর উন্মুক্ত নীলে
উড়ন্ত চিলের পূতশ্রী ডানা এক নির্বাক চিল্লায়
আমাদের প্রাণ প্রসন্ন করে তোলে।
আমরা তোমাকে দেখি, তোমার স্রোতস্বিনী বনে
অবগাহন করি, এভাবে জানি—
জগতে যা-কিছু সামান্য ধুলিকণা— কপালে তিলক করি,
সকল প্রাণের কাছে দয়ার্দ্র হৃদয় বিছিয়ে দিই।
আমাদের জীবন বিধি ঋণের অনুকূল—
যা থাকে ভাণ্ডে তার সবই রয় আমারও অঙ্গে,
জগতের সামান্য ধুলিসংসার গ্রহণে এই দেহ তুলি
সমান আবর্তে দেহখানি রাখি!
আমাদের প্রাণের অতল নীলে
এক চিল ঘুরেঘুরে ডাকে— কাঁদে অন্তহীন
আর্তি আকুল— বহে সুন্দর, ওগো মাধুরী!
English Version : Eagle Poem
পথের নিশানা
জয় হারজো
যে দুনিয়া সামনের দিনগুলোতে আসবে
আমি তার জন্য একটা নকশা বানাতে চাই—
এই নকশা তাদের জন্য যারা আকাশের ধস বেয়ে
আরো উপরে উঠে যাবে!
আমার হাতে লোহালক্কড়, ইটকাঠের হাতুড়ি বাটাল নেই;
কেবল একটি ভাঙা বাসনা-ই আমার সম্বল— যা উঠে এসেছে
লণ্ডভণ্ড বিরান শস্যের মাঠ থেকে, শোবার চৌকি
আর রসুই ঘর থেকে।
কোটি নাঙা হাত, সরাসরি অযুত নিযুত পা—
যারা দিশাহীন এক আত্মার গতি।
এই ম্যাপের মূল উপকরণ বালু— খরখরে বালু,
চেনা আলো আর পরিচিত বাতির শিখায় তা পড়া যাবে না;
এই নকশার অন্তরাত্মায় থাকবে এক শরনার্থী আগুনের গোলক— যা পৌঁছাবে অনাগত এক আদিবাসী গ্রামে—
যেখানে এক ফুঁৎকারে জ্বলে উঠবে তাদের পূর্বপুরুষ।
লোককাহিনীর ঠাসবুননি এই ভাষার বুনিয়াদ,
আবার মাটির উপর পা গেঁথে দাঁড়াবার অনুমোদন;
নিজের পদচিহ্ন নিজেই চিনতে না পারার
দুর্দিন কেঁপেকেঁপে নড়ে উঠবে!
মায়ার বদলে, দয়ার জায়গায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ
গজিয়েছে দেখো— চোখধাঁধানো বিপনি-বিতান,
আর টাকা, টাকা, হুণ্ডির বেসাতি চারদিকে।
আমরা সব বেমালুম ভুলে গ্যাছি—
ভুলে যাবার ভুলগুলো হিসাবে আনো;
ঘুমের ঘোরে ছানিপড়া চোখে ঝিমুনির কালে
আমাদের শিশুরা নাই হয়ে গ্যাছে— চুরি করে
তারা হরণ করে নিয়ে গ্যাছে তাদের।
আমরা হাঁটুর নিচে মাথা গুঁজে বসেছিলাম,
সেই ফাঁকে বন ছেয়ে গ্যাছে তাতানো ফুলে
তল্লাট কি তল্লাট চলে গ্যাছে দৈত্যের দখলে
পরমাণু, পরমাণু, এতো পরমাণুর কীযে একাকী দাউদাউ!
গাছেদের ছাইভস্ম মুছে যেতে নারাজ।
যাদের উৎখাত করা হয়েছে— তাদের উচ্ছেদের দাগ খতিয়ান
তাদের সামনে এই মানচিত্রে আবারও হাজির।
কী কী নাম ছিল— আদিবাসী পাখিদের ইতিউতি নামগুলো
মনে পড়ে না।
একদা এই সহজিয়া অঙ্গনে সবার নাম জানা ছিল।
আমি যা বলছি— তা অনড়, পাকা খাঁটি কথা—
আমরা সেইসব দিন, সেইসব মধুক্ষরা ভুলে গ্যাছি;
তারা একরোখা, ধেয়ে আসে আমাদের পিছনপিছন।
বনের ভিতর সরু আলপথ, কুশিকাঁটা আর কালশিটে রক্ত।
আমাদের একটি ভুলেভালে ভরা ম্যাপ তৈরি করতে হবে,
ছোটখাটো— পথে নামার বিবরণ।
এ-এমন এক জায়গার দলিল পরসা
একটি সাগরের মুখ দিয়ে যেখানে ঢুকতে হবে,
যে-সাগর আদতে তোমার মায়ের তাজা খুনে ফুঁসেফুঁসে ওঠে;
তোমার বাবা নিজের পরিচয় আঁকড়ে ধরতে বারবার খাবি খেয়েছেন— তার নেহায়েত মৃত্যুপরিখা হবে আমাদের
প্রবেশের দরোজা।
এখানে সব কানামুখ— বেরুবার পথ নেই!
এই ম্যাপ বুঝতে হবে অভিজ্ঞতার অলিগলি জ্ঞানের পথে।
আমরা মরণের বিভেদ বেয়ে হেঁটে যাবো।
দেখবো— আমাদের কোন আত্মীয় রান্না করছে মাছ,
হরিণ আর কর্ণ স্যুপ— অচেনা থেকে ভেসে আসে চেনা
মশলার কাঁচা ঘ্রাণ।
ওই রাঁধুনিরা কোনদিন আমাদের ছেড়ে যায় নি
আমরা বিজ্ঞান প্রযুক্তির নামে তাদের সরিয়ে দিয়েছি।
আমাদের অনাগত জমানায় কোন নিষেধের দণ্ডবিধি রইবে না
শব্দে, কথায় ব্যাখ্যা করার কোন গাইড বই লাগবে না।
তোমার মা যে গান গাইতেন
সেই গানের বনালা সুর হবে তোমার পথের নির্ণয়—
তুমি কেবল নোতুন করে তার পুরনো গানে সুর বসিয়ে নিও।
ইতিহাসের রক্তছলকে ছাপানো এই ম্যাপ—
টাটকা বরাভয় ঝলসাবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তর,
এই ম্যাপ তোমায় পড়তে হবে সুকল্যাণ ধারায়,
সূর্য কিরণের ভাষায়।
কৃত্রিমতার দানু খেয়ে ফেলে সারল্যের নিরোগ হাওয়া
তোমাকে বিনাশ করতে হবে যা তোমাকে বিনাশ করেছিল।
দেখতে মইয়ের মত তোমরা দেখবে এক রক্তাক্ত খাড়া ঢালু
যা আসলে আমাদের হৃদয়।
মই বেয়ে ধ্বংসের অনন্ত অতল থেকে যখন একটি মানুষ
প্রথম তার মুখটি বাড়াবে— একটি সাদা হরিণ বলবে—
আমাদের ঘরে এসো হে সুন্দর।
এ-খাড়াই মনে করিয়ে দেবে
আমাদের উৎখাত করে ফেলার আদি ইতিহাস।
আমরা কখনোই ছিলাম না আঁটসাঁট নির্ভুল,
আমরা ছিলাম গার্হস্থ আলাভোলা।
বৈষয়িক নামতায় তা কেমন আমি জানি না—
ধরি তাতে ভুলত্রুটি ছিল।
আমরা জ্বলেছিলাম আকাশের তারা;
জানি নাগরিক বর্গে আমাদের যাত্রাপথে উনিশ-বিশ ছিল; নিশ্চয়ই কিছু ছিল ভ্রান্তির যোগফল।
আবার যখনই মাঠে নামবো—
আমরা ফের একই ভুল করে বসবো— আমি জানি।
শেষ নাহি যে শেষকথা কে বলবে—
কেবলই প্রবাহ, সামনের নিশানা
পথে এবার নামো সাথী— পথেই হবে পথ চেনা।।
English version : A map to the next world.
জয় হারজো— মৌলে কবি, ১৯৫১ সনের ৯ই মে যুক্তরাষ্ট্রে ওকলাহোমার তালসায় জন্মগ্রহণ করেন। নৃতাত্ত্বিকভাবে তিনি আদিবাসী মুসকোগী সম্প্রদায়ের মানুষ; এ-পরিচয়কে তিনি জীবনে মোক্ষম করেছেন, ফলে হারজো কাজে, স্বপ্নে, যুক্তিবাদিতা ও সৃষ্টিশীলতায় পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি হিসাবে নিষ্ঠাবতী থাকেন। এভাবেই তাঁর সমাজ ও শিল্পভাবনা এক প্রণিধানযোগ্য অভিজ্ঞান: তিনি বিশ্বাস করেন, কোন কাজ- তা হতে পারে একটি কবিতা, বা গান— যাকে মনে হতে পারে স্বয়ম্ভু, একা ও প্রাতিস্বিক, কিন্তু আসলে তা সামষ্টিক; জয় হারজো প্রতিটি কাজ উৎখাত হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষের মধ্য থেকে কুড়িয়ে তুলে স্বপ্নের দানা বাঁধিয়ে লেখেন; তাঁর কবিতা সহজ ও ন্যায়বিচারের একাগ্রতায় নিরাপোষ।
কবি
হেরমান হেস
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
নিশি আকাশের অগণন তারার ধুলা ঝরে পড়ে আমার ওপর
পাষাণ ভেঙে ছোটা জলের নহর আমাকে সুরের ইন্দ্রজালে বাঁধে— কেবল এই ভঙ্গুর ব্যথিত আমাকে!
আমাকেই ডাকে বর্ণেবর্ণে রচিত মেঘেদের মুসাফির
আলগোছে উড়েউড়ে যায় খোয়াবের আঞ্চল।
বসতভিটা নেই, নেই খামার বাড়ি
আমি পাই নি অরণ্যের অধিকার— আমার হাতে না আছে
শিকারের বনভূমি— অন্তর্লোকে যা আছে আমার,
তা কেবলই আমার।
পাহাড়ের পৈথান থেকে ছুটে আসা স্রোতস্বিনী ঝরনা লহরি
উদ্যতসঙ্গীন সমুদ্র সফেন,
পাখির পাখায় মুদ্রিত কল্লোলিত শিশুকাল—
সবই আমার— অনুরক্ত সন্ধ্যার বিষন্ন বিলোড়ন।
আর হৃদয়পাত সবই আমার জন্য— যে দৃশ্যের গভীর গোপনে
প্রেমের সুবাস বুনেছি।
দেবতার মন্দির আমার, ফেলে আসা ললিত কানন—
সব আমারই জন্য— স্বর্গের মিম্বরখচিত অনাগত কাল
অবধারিতভাবে আমার ধাম।
আমিই নির্ধারণ করি, সম্মুখবাদী প্রাণের মিনতি ও উৎসার,
প্রেম আনে মানুষ নিধির গৃহীত অভিজ্ঞান।
সকলে হুল্লোড়ে, শোরগোলে মজে—
কৃষিজীবী, নিকারী ও সওদাগর,
নাবিক আর রাখাল, আর বাগানী মিলে আঁকে রংধনু পরাগ
উদযাপন করে তারা অনাগত তোরণ।
কবি এক জাগে— একা ব্যথা শিহরণ!
নীলকণ্ঠ উজাগর পাখি— নির্ঘুম টলমল
মেন্দি গাছের সবুজ পাতা ভিতরে অনল।
কবর ভরে যায় তার, ফুলে ওঠে পুষ্পের পদভারে
উপরে কলরব— নিচে বাগানবাড়ি ক্ষরণের সম্ভারে!
English version: The Poet.
ভার
হেরমান হেস
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
দিনগুলো কী-যে ভারী!
একটুকরো আগুন নাই যে আমাকে একটু উষ্ণতা দিতে পারে
আমার সঙ্গে একবার হেসে উঠবার সূর্যও নিখোঁজ।
সবই অসংস্কৃত ইটপাথর
যা-কিছু দেখি বেবাক নিষ্প্রাণ দয়াহীন,
যারে ভালবেসেছি সে-ও একই গর্তের শিয়াল;
আকাশের ঝিকমিক তারাও যেন তারা নয়— পোতানো মুড়ি।
যে-মুহূর্তে আমার মন বুঝে উঠতে পারে- ভালবাসা মরে
সেই ক্ষণ থেকেই চিত্রটি এমন স্থির।
English version: How heavy the days…
ঘাসের বিছানায়
হেরমান হেস
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
এই যে ঘাসের ঘটনা এভাবে ঘটছে—ঃ
সামনে হাওয়ার তবকে তবকে ছড়ানো ফুলের নির্ঘুম
কেমন এক ধুসরতা, স্নেহবতী নীল, নীলের প্রপাত
সে-কী কেবল দেবতার উৎসার- তার প্রাণের বয়ান?
দূর পাহাড়ে কী এক অভিমান
নীলের উঁচু সিথানে গরিমায় মাথা রেখে ঘুমায়—
এ-কী কেবলই শাসিত প্রকৃতির অন্তর্ঘাত, অচল গোঙানি?
আর কতো শত গ্লানি, কতো যে মালিন্য আকার
স্বপ্ন ছিনতাই, ক্ষরণ, ক্ষরণ— ভেঙে পড়া হৃদকৌটা।
ক্ষীণজীবী ঊনাকার সামান্য পোকার নৃত্য বৈঠক,
পাখির একাকী বিরহ ডাক তোমাকে দেয় শান্তির দুইদণ্ড
বাতাসের প্রসন্ন পালক তোমাকে ছোঁয়ায় আনমনা সুমধুর।
আমাকে একটু একা থাকতে দাও— একা।
আজ সব মাত্রাতিরিক, সীমা লঙ্ঘনকারী
দহন, অন্তর্দহন!
আর থামিও না— সবটুকু বিষ তাহলে মন্থিত হোক,
সবকিছু ভেঙে পড়ুক, যা-কিছু থাকে সবই ছিন্নভিন্ন হোক।
থাক, কেবল সামান্য ক্ষণের অতলটুকু থাক—
এই গ্রীস্মের সুমধুর একফালি ঘন্টা।
আসুক বৈঁচি ফুলের একচিলতে সুবাস।
না, নিও না—
আমার প্রাণের গহীনে আনন্দ মজমা তুলে নিও না!
English Version: Lying in grass
হেরমান হেস : —কথাসাহিত্যিক, কবি, চিত্রী হেরমান হেস জগদ্বিখ্যাত তাঁর সিদ্ধার্থ উপন্যাসের কল্যাণে, যদিও ডেমিয়ান, স্টেপেনউল্ফ, বিনেথ দি উইল, কিংবা তাঁর নার্সিসাস অ্যান্ড গোল্ডমান্ড-এর তুলনায় সিদ্ধার্থ অনেকটাই সোজাসাপটা একহারা গড়নের লেখা। তাঁর বাবা জোহানেস হেস-এর ভারতে ক্রিস্টিয়ান মিশনারিতে কাজের সুবাদে শৈশবেই হেরমান হেসের মধ্যে ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী অমীমাংসা একটি বড় ধরনের প্রভাব ও অন্বেষাবৃত্তি তৈরি করে। পরবর্তীতে ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞান প্রথার সঙ্গে তিনি মোকাবেলা করেন ব্যক্তির উন্মোচনের মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া। হেস ধর্মীয় বোধের সঙ্গে শিল্পচৈতন্যের একটি সুসমঞ্জস ভারসাম্য গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। তাঁর শিল্পজারণ ও নিজস্ব থিওলজিকেল ছটফটানির ফলিত রূপ তাঁর এই কবিতা ও চিত্রকর্ম।
হেরমান হেস ১৮৭৭ সনের ২রা জুলাই জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬২ সনের ৯ই আগস্ট সুইজারল্যাণ্ডে।
চট্টগ্রামের কাছিম মাজার
নাওমি শিহাব নাঈ
একচ্ছত্র ময়লা পানির উপরিভাগ বরাবর
নিরেট পিঠের ছাঁচ ভেসে ওঠে—
আর মনফকিরা মনগুলো তাঁর দিকে ছুঁড়ে দেয়
ভনরুটির টুকরা।
বক্ষ দুরুদুরু— যদি কচ্ছপ বাবার নেকনজরে পড়ে
তার ছুঁড়ে দেয়া খাবার টুকরো তবেই সারা,
দিলের মকসুদ পূর্ণ হবে শতভাগ!
এই ক্লেদ ময়লার তীব্র ভ্যাপসা গন্ধে হাঁসফাঁশ
করে উঠি; আমি বরং খাড়া বেয়ে উপরে উঠে যাই—
যেখানে বাঞ্চাশিকারীরা লাল-নীল সুতার রৌশনে
গাছের ডাল ভরিয়ে তোলে।
কোন সুদূরের বাসনা আমারও অন্তঃপুর বুঝি
ঝিলিকে ছুঁয়ে যায়।
অদূরে রিকশার ভিড়, আরো ভিড় টুংটাং ঘন্টাধ্বনি।
আমার পাশের বন্ধুটি কেমন মনমরা হয়ে থাকে,
আশা বুঝি পূর্ণ হলো না— আমার মনের বাসনা—
ছুঁড়ে দেয়া রুটি তার অনির্দিষ্ট, ভাসতে থাকে কাদাজল
পানির ওপর: রুটি তো ছুঁলো না দয়াল কাছিম।
আমি বলি, তারা খেয়েথুয়ে পেট পূরে আছে।
বন্ধুটি বলে, তা-ও ইনারা সবসময় আমারটা খায়!
আমি সহযাত্রীকে বলি, আমার রোমাঞ্চ লাগে—
তারা যে দোজখ থেকে আসে!
ওইদিন তার জন্মদিন ছিল।
আমরা সফেদ টেবিলের উপর গলদা চিংড়ির
নৈশভোজে মাতি।
এ-এমন এক ভূখণ্ড যেখানে প্রতিবছর গ্রামের পর গ্রাম
বানের তোড়ে ভাসে; তাতে কার কি-ইবা আসে যায়,
অন্যদুনিয়ায় কারো টিকিটাও নড়ে না।
এতোক্ষণে শিথিল ওয়েটার কাঁচা পয়সার গরমে
কিছুটা বুঝি নড়ে-চড়ে ওঠে।
সে রাতে আমার মশারিতে দেখি একখানা ছিদ্র!
আর যায় কোথা, আমি সারারাত বেইজবলের পিচ করি।
তবুও দীর্ঘ রজনী তলিয়ে যাচ্ছিলাম স্বপ্নে- গলে যাচ্ছিলাম,
যদি ধরতে পারি কিছু দৃশ্যমান খাবার, কিছু
সত্যিকার আহার!
আমি একটি যোগসূত্রে আকুল হাতড়াতে থাকি—
বলার জন্য কাতরাতে থাকি;
এখানে জল, জল— ওদিকে কোথায় স্থলভাগ, শুকনো মাটি!
English version: The turtle shrine near Chittagong
বাতেনী
নাওমি শিহাব নাঈ
ধরো যে তুমি একটি কচি চারার কিশলয়
একটা পাথরের নিচে রেখে এসেছো,
পরদিন তাকে খুঁজেই পাবে না;
মনে হতে পারে—
পাথর বুঝি এ-কে গিলে খেয়েছে!
ধরো যে তোমার প্রাণের ধন—
তার নাম জিভের নিচে রেখে দিয়েছো
আর নামটি বলো নি— নামটি জপো নি;
আরো দিন যেতে যেতে এ-নাম
অগোচরে রক্তের সঙ্গে মিশে যাবে।
আমাদের দীর্ঘশ্বাসও এমনই একটা ব্যাপার:
নিজের মধ্যে শুষে নেওয়া বাতাসের কণা
তোমার কথাদের নিচে
আপনমনে দীর্ঘশ্বাসে দানা বাঁধে।
কেউই তার ধাত্রীমাকে দেখে না—
যে তাকে দুধে বোধে তুষ্ট করে রাখে।
English version: Hidden
নাওমি শিহাব নাঈ : বাবা ফিলিস্তিনি, মা এমেরিকান— জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫২ সনের ১২ মার্চ মিজৌরির সেইন্ট লুইসে। তিনি দেশের ভিতর, ও দেশের বাইরে প্রায়শই ঘুরে বেড়ান। তাঁর ঘুরে বেড়ানোটা জাতিসংঘের ভালোমানুষি চাতুর্য্য নয়, কী নয় সরকারি আমলার নিরাপদ জৌলুশ, বরং তার উলটো; নাঈ দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়ান, আর অন্বেষা করেন ধুলায় গড়ানো শিরস্ত্রানের নানা টুকরো, তিনি দুনিয়াজোড়া উদিত রঙধনুর দলিত রঙ তাঁর কবিতায় শব্দের ব্রাশে বিন্যস্ত করেন। ফলে তাঁর কবিতায় থাকে স্যান আন্টোনিও শহরের রাস্তায় ম্যাক্সিকান কিশোরী মেয়েটির পায়ের আওয়াজ, আবার একইসঙ্গে ইজরাইল ফিলিস্তিন সীমান্তে গুলির ধাতব ধ্বনি; আবার কখনো বায়জিদ বোস্তামির মাজারে ববকাট মাথার আকারে পানির উপর ভেসে থাকে মাজেজা কাছিম। নাওমি শিহাব নাঈ- এর কাজের পরিধি ছড়ানো ছিটানো: লেখালেখির প্রায় সব মাধ্যমেই তাঁর ফসল আছে— যেমন আছে জনপ্রিয় শিশুতোষ বই, আছে নাটক, উপন্যাসও বাদ পড়ে নি, আর কবিতা তো রইলোই। সম্পাদনার কাজও করেছেন— তাঁর সম্পাদিত সীমানাডিঙানো কবিতা সংকলনের নাম দিস সেইম স্কাই- যেখানে ৬৮ দেশের কবিতা এক মলাটের ভিতর জায়গা নিয়েছে।
ফলে নাওমি শিহাব নাঈ কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে যুক্তিনন্দনভাবে বলেন, সবাই চেঁচিয়ে ওঠেন— অনুবাদের ভিতর দিয়ে কবিতার প্রাণভোমরাটাই ছটফটিয়ে অক্কা পেলো রে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কতোকিছু পাওয়া গেলো আহা- তা তো কেউ কহে না!
মন্দিরের ইতিহাস
মেরি ওলিভার
এমন অনেককিছু আছে যেখানে তুমি পৌঁছাতে পারো না
কেবল তার কাছ ঘেঁষে বসতে পারো— চাই কী সারাদিন থাকতেও পারো।
বাতাসে ভর করে পাখি উড়ে চলে যায়
দূর, বহুদূর— তার মাজেজা কেবল উপরওয়ালা জানে।
তুমি নির্ণিমেষ ভাবো, ভাবো আর ধান্ধা খেয়ে রও,
মন করে আন্মন!
সাপ চলে রয়েসয়ে ধীর পায়ে, মাছ লাফিয়ে কাঁপে,
ছোট ভ্যাটের ফুল চমকায় জলের উপর
গোত্তা খেয়ে ডুবে ফের জলের আড়াল,
সোনালি ফিঙে ওই গাছের মাথায় টিকলি—
গান করে আপন সনে।
আমি দেখি— সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখি,
আমার এ-দেখা বিরাম না জানে।
দেখা কেবল চেয়ে থাকা নয়,
কিছু গ্রহণের বাঞ্চায় প্রসারিত হাত পেতে রাখা।
আর আশা করে থাকা—
কিছু না কিছু তোমার করপুটে এসে জমবে—
হতে পারে বাতাসের প্রাণভরা রাঙতা
বোধি বৃক্ষের গুটি কয় পাতাও হতে পারে বা,
সবাই জমায়েত হয়ে বসেছে এ খেলায়।
এবার আমি তোমাকে আদত কথাটি বলি—
এই জগৎ-সংসারে সবকিছু আসে।
দিব্যি দিয়ে বলি— নিদেনপক্ষে তার কাছাকাছি আসে,
বড়ো মায়া নিয়ে বসে।
যেমন খুঁটেখুঁটে খাওয়া দানাপানি, পিঙ্গলাবৎ মাছের চোখ,
যেভাবে সাপ আলগোছে তার খোলে দলাপ্যাঁচ,
যে-মত গান করে ওঠে ফিঙে— ওগো সোনার পুতুল—
আকাশের কিনারায় পলকা ওড়ে,
এভাবে ঈশ্বর থেকে আসে লীলুয়া বাতাসের নীলাভ লীলা!
English version: Where does the temple begin, where does it end?
মরণ মম
মেরি ওলিভার
মৃত্যু দোরগোড়ায় নামে
বুঝি এক ক্ষুধার্ত ভল্লুক পড়ে হেমন্তের নিরালায়
আমাকে কিনবে বলে এক লহমায় তার খতি খুলে বের করে চকচকে সিকি আধুলি;
তাৎক্ষণিক সশব্দ বন্ধ করে তার পেটরা,
মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ে যেন গুটি বসন্ত;
মরণ এসে বসে সটান ঘাড়ের নিচে
ঠাণ্ডা হিম ভারী বরফের চাঁই।
আমার মনে হয় দরজা অবধি যাই, বলি— স্বাগতম:
আমি নয়া অভিবাসী ওই কাজলকালো আখড়ায়?
আমি কেমন ভুতগ্রস্তের মতো সবকিছু দেখি
ভাবি জীবন আমার বোন, কাজ আমার ভাই,
আমি সময়কে বোধে আনি প্রবাহের নামে
ভাবি, অসীমতা আমার প্রসন্ন নবায়ন;
চিন্তামনি আমায় কহে জীবন এক ফুলের নিরিখ
খোলা ময়দানে আপনি সই অলকানন্দা ফোটে,
প্রতিটি নাম মুখে মুখে ঘোরে সুরের পানচিনি
মিলাতে ব্যাকুল উপত্যকায় নীরবতা রূপায়নী।
প্রতিটি দেহঘড়ি— সিংহের ভয়াতীত ঘরবাড়ি
অমূল্য রতন এই দুনিয়ার গিরস্থালির হাটে।
আমার কিসসার বটবৃক্ষ মোড়াবে যেদিন শেষে—
জানবো আমি বিবাহিত ছিলাম উৎসবের সনে
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে তবকের পর তবকে।
সমস্ত মেলার শেষে আমি খুলবো না জমা-খরচের খাতা
মিলাবো না— কী ছিল ভুল, কী বা হলো পাওয়া না পাওয়া?
কক্ষনো আমি এমন অনুযোগ করবো না—
আইলাম আর গেলাম ভবে দাগ তো ফেললাম না!
English version: When death comes
নাচের ইতিহাস
মেরি ওলিভার
কেবল এ-টুকু বলে দিলেই চলবে না যে—
দুনিয়া ভারি মনকাড়া জায়গা।
এ শুধু তা’ নয়— যেমন মৃদুমন্দ বাতাস একটু
হাওয়া দিয়ে যায়,
তার থেকে বেশি কিছু— অনেক তার প্রস্তুতি
বলবার ও করবার।
ধাঁই করে বিজলি চমকানোকে মোটের উপর
ভালো বা মন্দ বলে দিলেই শেষ হলো না—
অবিচল বৃক্ষটি পুড়ে খানখান- বুঝিবা দাঁড়িয়ে থাকে
সোনার পিলার।
নীল বৃষ্টির পরাগ দেখো কেমন লুকিয়ে যায়
গাছেদের নির্মল পায়ের নিচে—
উপরে তার ডালপালার বিস্তার।
বাতাস কী নির্বিকার একদিকে বয়— না ঘুরেঘুরে আসে—
আর গড়ে তোলে অলিখিত নাচের মুদ্রা?
ফুলদের কী আমরা বলবো না— ভিতরেভিতরে
কতোটা পরিযায়ী— যারা এশিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে
কুসুমিত হয়েছে আমাদের বাড়ির পিছনের চত্বরে?
এককথায় বলে দিও না—
জগৎসংসার এক বিবৃতি- কী এক বয়ান মাত্র!
সুফী দরবেশ যে ঘুরেঘুরে নাচে—
তারা কি পাহাড়ের উঁচু শিরের দিকে খোঁজে আলোর গোলক?
না তারা দেখে ব্রহ্মাণ্ডের একান্ত নাভিমূল—
যেখানে আছে অঙ্কুরোদগমের সঙ্কেত, বীজানু পরাগ
একহারা, একান্নবর্তী বিনত প্রেমাকুল তৃষ্ণার কাছে?
ও নাচ, ও নৃত্যকী,
কী যে তুমি ধুলার সংসারে এমন বাগানে শীতলপাটি।
English version: Where does the dance begin, where does it end?
মেরি ওলিভার: প্রকৃতির নানা মাত্রা, বিন্যাস ও ধ্যানে ঢোকার জন্য মেরি ওলিভারের কবিতা এক পথদেখানিয়া প্রশ্রয়। অন্যান্য অনেক কবির মতোই ওলিভারের কবিজীবন শুরু হয় প্রকৃতির বন্দনা আর তার সহজ সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ক্রমান্বয়ে তিনি কবিতা ও প্রকৃতির অন্দরমহলে ঢোকেন: তিনি প্রকৃতির অনুকম্পার ভিতর তুলে আনেন ব্যক্তিমানসের আনন্দ, বেদনা ও এক তীব্র স্পর্শকাতরতা। আরেক নিসর্গমগ্ন কবি অ্যাডনা ভিনসেন্ট ম্যালয়-এর সঙ্গে মেরি ওলিভারের সখ্য তাঁর কবিতার মনস্তত্ত্বে একটি প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে। অন্যদিকে ওলিভার যে জলের ধৈর্য বর্ণনা করেন সে জলাধার স্থির কিন্তু তাঁর মনে জাগে সংবেদনশীলতার উতালপাতাল, এভাবে তাকে মনে হয় যেন এক মার্কিনী হাইকু কবি— যিনি হাইকুর আঁটসাঁট বন্ধনের বাইরে এসে মুক্তছন্দে লেখেন।
মেরি ওলিভার জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের মেইপল হাইটসে ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ সনে, ফ্লোরিডার হাব সাউণ্ডে ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮ সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আমার দাগ খতিয়ান
শ্রী চিন্ময়
শেষমেশ আমি আমার নাম শনাক্ত করি
আমার নাম ঈশ্বরের লীলারঙিন তরী
শেষমেশ আমি আমার নাম শনাক্ত করি।
অবশেষে আমার বয়স কত দাঁড়ালো তা চিনি
আমার বয়স আদিঅন্তহীন বহতা স্রোতস্বিনী
অবশেষে আমার বয়স কত দাঁড়ালো তা চিনি।
দিনশেষে আমি পৌঁছাই আমার পর্ণ কুটির
যেখানে একফোঁটা আগুনের লুক্কা তিরতির
দিনশেষে আমি পৌঁছাই আমার পর্ণ কুটির।
English version: My name, my age
পরমতত্ত্ব
শ্রী চিন্ময়
মন নয়— এমন কিছু যা মনের অধিক,
কোন আকারে নেই— আকার ছাড়ানো
রূপের অরূপে আমি আছি।
আমি আছি প্রকৃতির নৃত্যের বীজানু মূলে
আমি আছি আকুতির দলিল।
উদ্ভাসে নয়, নয় জানার সসীম
আর অজানার অসীমে— কারণহীন আমি আছি।
যে জানার তৃষ্ণায় ডুবুরি, আর যিনি জ্ঞানের অভিজ্ঞান—
আমি এই দান-প্রতিদানের বাইরের কেউ।
শেষাবধি আমি তাকে পাওয়ার
নিরাকার আনন্দ উদযাপন করি— যে একচ্ছত্র,
যে স্বয়ম্ভু একা।
আমি জীবনের আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে এসেছি,
আমি অবশেষে ধ্রুব বাড়ির বাৎসল্যে হাজির
আমি আর আমি নই, আমি সে হয়ে গ্যাছি।
আমি আসন্ন দূরত্বের নৈঃশব্দ্যে
সূর্যের আলোকনে সীমাহীন সীমা।
আমি অতঃপর আর পথিক নই— আমি পথ,
আমি আর হারজিত নই— কেবলই খেলা।
English version : The Absolute
শ্রী চিন্ময়: চিন্ময়কুমার ঘোষ— আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত শ্রী চিন্ময় কবিখ্যাতির জন্য কবিতা লেখেন নি, তাঁর পদ আশ্রয় ও নিরাশ্রয়ের কল্লোল, নিরাশ্রয় থেকে শুরু- আশ্রয়ে এসে বসত, বা আশ্রয় থেকে যাত্রা করে নিরাশ্রয়ের অপার ভরসায় নোঙর ফেলে। তাঁর কবিতা কেবলই এক ধ্যানমন্ত্র- সচরাচর কবিতাদুনিয়ার সঙ্গে এর কোন প্রতিপক্ষতা বা বোঝাপড়া নেই; তাঁর কবিতা যা দেখা যায় তার এক অদেখা রূপ, যা কোনদিন পাওয়া যায় না— তা পাবার অশান্তি, শ্রী চিন্ময়ের কবিতা নিজেকে অযুতনিযুত খণ্ডে ভাগ করে এক সামগ্রিক ঐক্যবিন্দু তৈরি করার সাংগঠনিকতা ও বিলয় পাথার।
শ্রী চিন্ময় ১৯৩১ সনের ২৭শে আগস্ট বাঙলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, দেহ রাখেন ২০০৭ সনের ১১ই অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
এভোকেডো
গ্যারি স্নাইডার
এভোকেডোর সঙ্গে ধর্মের খুব মিল।
এর কিছু অংশ একেবারে তুলতুলে পাকা
কিন্তু নষ্ট নয়, ভালো।
আবার কিছু অংশ একদম শক্ত আর ঝিমঝিমে সবুজ
কিন্তু ফেলনা নয়— কেউ কেউ এদিকটাও পছন্দ করে—
যারা অতিসিদ্ধ ডিম শখ করে খায়— তারা এভোকেডোর
শক্ত দিকে খুশি হয়।
মিহি বাকলের নিচে
কোমল— পোক্ত এভোকেডোর মাঝ বরাবর
নির্ণিমেষ গোলাকার বীজ—
ঠিক যেন তোমার অকৃত্রিম নির্মোহ স্বভাব
নির্ভেজাল আর মসৃণ,
এক নিরিবিলি বীজ— কেউ একে ফাটিয়ে আরো
ভিতরে তাকিয়ে দেখে না।
দেখতে কিন্তু বেশ লাগে—
গোলাকার, মসৃণ, আর পিচ্ছিল; মনে হবে
মাটিতে রুয়ে চারা তুলি না কেন!
কিন্তু গোলাকৃতি আর পিচ্ছিল বলে কোনদিক দিয়ে যে আঙুল গলিয়ে বাইরে ফসকে যায়!
English version: Avocado
দাদিমাচরিত প্রকৃতি
গ্যারি স্নাইডার
বুড়ি দাদিমা প্রকৃতি
কোণা কামচায় গুঁজে রেখেছে
কিঞ্চিৎ দানা, ছোটছোট অনুমান, হাসির কণা
কোথাও দহলিজ ভরে আছে স্মৃতির টুংটাং সোনা!
গাছেদের ফোকরে এলোমেলো চিকুর,
কুড়িয়ে রেখেছে সে-যে
মোলায়েম উড়ে যাওয়া শ্বেত পাতা জমা আছে তা-ও।
ধূর্ত শিয়াল দৌড়ে পালায় নোংরা ঢিবির দিকে
তার দাঁতে ধরা তখনও শিকারের পালক,
স্রোতস্বিনীর আয়তনে একটি কথার ঝিলিক।
বিড়াল কুড়মুড় করে চিবোয় ইঁদুরের মস্তক
তোলে তৃপ্তির ঢেঁকুর, এগুতে থাকে মুষিকের লেজের পানে।
লক্ষ্মী বুড়ি দাদিমা ঠাণ্ডা চাঁদের আলোয়
আঁচলে ভরে যত লাকড়ি ডালপালা, ঝরা পাতা।
দাদিমা নিসর্গের শত খুচরো আধুলির সঞ্চয়ে
এবার শেষ কুড়িয়ে তোলা মণি— একআনি।
আঁৎকে ওঠো না— যদি দেখো এবার তোমার পালা!
English version: Old Woman Nature
নির্মোক
গ্যারি স্নাইডার
প্রকৃতির
নৈঃশব্দ্য
অন্তর্গত।
শক্তির প্রাণ
শক্তি।
নির্মোক।
পথ
যা বয়ে চলে
ঠিকানাহীন।
গন্তব্য
সহজ
প্রাণময়।
আরোগ্য,
না রেখো কথন।
গীতিকথা
অকৃত্রিম।
এ-গান প্রাণের গোড়াপত্তন।
English version: Without.
যে-দিক থেকেই গ্যারি স্নাইডার সম্পর্কে বলা হোক, তা বোধ করি শতভাগ হবে না, কেননা তাঁর কাজ ও প্রকল্পের পরিধি এতোটাই বিস্তৃত; জগৎখ্যাত বিট জেনারেশনের তিনিও একজন সক্রিয় কর্মকার, এমনকী অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে অনেক সখ্য, বোঝাপড়া, পত্র লেনদেনের মুদ্রিত রূপও পাওয়া যায়। বহুদিন জাপানে ছিলেন, এবং প্রায় এককভাবে গ্যারি স্নাইডার বুদ্ধ দর্শনের জেন ঘরানা পশ্চিমা দুনিয়ায় রোপনও বিস্তার করেন। যদি কোন কবিকে নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতিনিষ্ঠ বলতে হয়— তিনি হবেন গ্যারি স্নাইডার, প্রকৃতির জন্য গ্যারি রূপকথার প্রাণভোমরার সামিল, তাঁর নিরিখে একলা দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছটি কেবল গাছগাছালি নয় একজন ব্যক্তি, ছোটমোটো ঝিঁঝি পোকাটি, কী আফ্রিকার জঙ্গলের দোর্দণ্ডশাসন সিংহজি খালি পোকা বা প্রাণিমাত্র নয় একেকজন বোধি প্রতিষ্ঠান। গ্যারি স্নাইডার কবি, গদ্যকার, সর্বোপরি অ্যাক্টিভিস্ট— জন্মেছিলেন ১৯৩০ সনের ৮ই মে, স্যান ফ্রেনসিসকো, ক্যালিফোর্নিয়ায়।