মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখতে ভয় পাই । শেখ লুৎফর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ৪:১০ অপরাহ্ণ, | ১৫৯০ বার পঠিত
আজ দুপুরে রাশেদ রহমান ফোনে একটা গল্প চাইল। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমি পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে স্থির করলাম, লিখব। নদীর জলে আকাশ দেখার মতো মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দেখা একটা ঘটনা তখন আবছা আবছা দেখছি। রাশেদ ভাইয়ের কাছে এক সপ্তাহ সময় নিলাম। ফোনের লাইন কেটে দিতেই বুকটা ফাৎ করে ওঠল। আমার বস হাড়েমাংসে বিএনপি। গত দশ বছর তিনি যে বিশেষ ব্রাণ্ডের পারফিউম ব্যবহার করেছেন ড. কামাল হোসেনর ঐক্যফ্রন্ট ঐক্যফ্রন্ট রাগলহরীতে তা বদলে গেছে। বর্তমানেরটার ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগতেই আমার মনটা দমে যায়। অথচ পেছনের সেই কহতব্য দশ বছর তিনি শেখ হাসিনা অথবা বঙ্গবন্ধু… এই দুইটি শব্দ যখন যেখানে যেমন লাগে ঠিকঠিক তেমনি তেল-মবিল-গ্রীজ সহযোগে খাপের খাপ লোজ-টাইট ইত্যাদি, ইত্যাদি…, করেছেন নিপুন হাতে। সামনে একাদশ সংসদ নির্বাচন। কেউ কেউ ধরে নিয়েছে সরকার বদলের সম্ভাবনা এখন ফিফটি ফিফটি। তাই তিনি এই অঘ্রাণ মাসের শুরুতেই পাকা ধানের সুঘ্রাণে পায়রার মতো বাকুম বাকুম করছেন। আমাদের অফিসের কেরানি এক সময় শিবিরের কর্মি ছিলেন। মেলা আগে, শেখ হাসিনার নারী আইন সংসদে পাসের সময় রোজ রোজ তার সাথে আমার মুখকালাকালি হতো। বর্তমানে সে সৈনিক লীগের সদস্য! তার এক নম্বর অপছন্দের মানুষ আমি। সে-ও জানে আমি তাকে একটা শুয়র ছাড়া কিচ্ছু ভাবি না। বিখাউজের মতো এই সব জ্বলুন্তির সাথে আরেকটা বাজে অভিজ্ঞতা আছে আমার। গত তিন-চার বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের একটা গল্প লিখে বাংলা সাহিত্যের স্বঘোষিত এক মোগলকে আমি চটিয়ে রেখেছি। গল্পে এক রাজাকাররে পাছায় লাথি খাওয়াইছিলাম (হালুয়াঘাটের সত্য কাহিনী) তো তাতে ওনলাইন পত্রিকার সেই সম্পাদক ও মোড়ল মশায় সুযোগ পেলেই আমার গল্পটল্প বিষয়ে নেগেটিভ বুলি ঝাড়েন। কনকর্ড টাওয়ারে তার সাথে একবার দেখা হলে, তিনি তার কুটনৈতীক ভাষায় আমাকে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন যে,আমার গল্পটল্প কিচ্ছু হয় না। অর্ধেকটা সাপ অর্ধেকটা কুঁইচ্চ্যার মতো এইসব জটিল এবং বর্ণচোরা প্রাণীদের জন্য এখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেখা আমার কাছে রিস্কি রিস্কি। আমরা যারা শিশু-কিশোর বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখেছি তাদের লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প এই ডিজিটাল বাংলাদেশে কতটা বিশ্বাস যোগ্য?
আমার গল্পের একটা দূর্বল দিক হলো, আমি যা দেখি, তা লিখি। তাই এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের যে সত্য ঘটনাটা মনে পড়ছে তা লিখলে আজকের পাঠক ও তরুণ লেখকরা কি তা সত্যি বলে মেনে নিবে? চিন্তাটা আমাকে মশার মতো কামড়ায়। আমি জানালা দিয়ে হাওরের দূর কিনারার দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝিমধরা দুপুরটা হিজল গাছের ডাল-পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু একটা পাখি একা একা ডাকছে। সম্ভবত সে ক্লান্ত দুপুরটাকে জাগিয়ে দেওয়ার তালে আছে। আমিও ফিরে ফিরে শোবার ঘরে আসি। গল্পটা বউ শোনে যদি সায় দেয় তাহলে বুঝব সার-টার কিছু আছে। কিন্তু শেষ দুপুরে সে ঘুমাতে ভালোবাসে। কদিন ধরেই মনে মনে রেগে আছি। বৈশ্বয়িক ও রাজনৈতীক দূষণের কবলে পড়ে এই মাঝ ডিসেম্বারেও শীত নেই। সব জান্লা-টাল্না খুলে, ফেন ছেড়ে লেপ গায়ে দিতে হয়! এইসব বালছালের অত্যাচারে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় বউকেই ধরে ঘন্টাখানেকের একটা লম্বা সান্টিং দিয়ে গতরের ঝালঝাড়ি। অবশ্য এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে ঘুমন্ত বউয়ের কানে কৈতরের পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলি, এত ঘুম ভালা না।
নিজের হাতে বানানো এককাপ চা আর সিগারেট-ম্যাচ নিয়ে বারান্দায় চলে আসি। মনে মনে ঠিক করেছি; গল্পটা আগে একবার নিজেকেই শুনাবো। চায়ে শেষ চুমুকের পর সিগারেট হাতে বাথরুমে ঢুকে যাই। প্রিয়াংকা চোপড়ার বিয়ের পর থেকে মনটা এমনিতেই খারাপ। স্নানাগারের নির্জনতায় আমি প্রিয়াংকাকে সামনে নিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে হাত মারি। সব শেষটেষ হলে বুকে একটা হারানো হারানো চিনচিনানি নিয়ে কম্পিটারের টেবিলে ফিরে আসি। চেয়ারে বসতেই আঙুলগুলো কীবোর্ডে নাচতে শুরু করে : বাবার পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। দু পাশে পাকা ধান ক্ষেত। বড় বড় ফড়িং উড়ছে। মাঠের বাতাসে মৌ মৌ মিষ্টি গন্ধ। পাশের ক্ষেতে এক জোড়া চখা-চখি উড়ছে। পাখি দুটো এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে উড়ছে আর চেঁচাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার মনে হলো ওরা যেন কাঁদছে। বুক ফাঁটা চিৎকারে প্রতিবাদ করছে। যেখানে পাখি দুটো উড়ছে আমি ধান গাছ বিলি কেটে সেদিকে যাই। আমাকে দেখে পাখি দুটো একটুও ভয় পায় না। বরং তাদের কান্না যেন আরও বেশি উচ্চ হয়। ক্ষেতের মাঝে জর্মনিকচুর বড়-সড় একটা ঢিবি। সেখানেই পাখি দুটো উড়ছে। আমি কাছে যেতেই দেখি একটা বিশাল গুঁইসাপ। গপ গপ করে পাখির নীল নীল ডিমগুলো গিলছে। তার চোয়ালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে হলুদ হলুদ কুসুম। আমাকে দেখে গুঁই তার চেহারাটা ফুলিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে সড়ে পড়ে। চখা-চখি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় নেমে আসে। কিন্তু তাদের একটি ডিমও নেই।
বিষয়টা বাবাকে বললে, ইনি একটু হেসে বললেন, জীবনটা এই রকমই; একজনকে মেরে আরেকজন…।
তার কিছুদিন পর বাবা অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। আমার যেন কি হারিয়ে গেলো। কিছুই ভালোলাগে না। বাবার কথা বললেই মা মন খারাপ করে। একদিন শেষ রাতে মা আমাকে ঘুম থেকে টনে তুললেন :
—জামা পড়ে নে, ঢাকায় যাবো।
মুহূর্তে আমার ঘুম পালিয়ে গেলো। বাবাকে দেখতে পাবো আর তার সাথে ঢাকাও দেখা হবে। স্বপ্নের এক শহর। ঢাকার কথা কেউ বললে আমার কেমন জানি আজব আজব লাগে। কল্পনারও সীমা আছে; আমার কছে ঢাকা যে সেই সীমার বাহির এক ঘটনা!
ট্রেনের জানলা দিয়ে মা দেখালেন :
—এই দেখ কমলাপুর ইস্টিশান।
দূর থেকে দেখা যায় বিশাল একটা সাদা পাখি ডানা ঝাপটা দিয়ে নীল আকাশে উড়তে চাইছে!
ইট-কাঠের ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। মাঝে-মাঝে দুই-একটা তিন-চার তালা দালান। রাস্তায় দশ-কুড়িটা রিক্সা। হঠাৎ দুই-একটা মোটর গাড়ি। আজব চিড়িয়া। চোখের পাতি মারতে ভুলে গেছি। অতীতে শুনা সব রূপকথাই এই ঢাকা শহরের কাছে পান্তাভাত হয়ে গেলো। আমি যেন শ্বাস ফেলতেই ভুলে যাই। শহরে অজস্র পতিত জমি। মাঝে-মাঝে কাঁটা-ঝোঁপ-জংলা। হঠাৎ হঠাৎ অসংখ্য আমাজামকাঁঠালের নিবিড় বন। সবুজ আর সবুজ। হঠাৎ শহরের নীরবতা ভেঙে জাহাজের মতো বেরিয়ে এলো একটা ট্রাক। পেছনে বাঁধা নুহের কিস্তির মতো চাকাওয়ালা কাঠের একটা বিশাল নৌকা। নৌকায় বুঝি চড়ে বসেছে শহরের সমস্ত আদম। তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে :
—নৌকা মার্কায় দিলে ভোট
ভবিষ্যতে হবে সুখ।
কাতি মাসের এক বিকালে বড়শি দিয়ে নদীতে মাছ ধরছিলাম। পেছন থেকে কে একজন ডাক দিয়ে বললো :
—তর বাবা নাই। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।
আমি ছিপ আর দুটো টেংরা মাছ নিয়ে বাড়িতে গেলাম। দূর থেকে মায়ের বুক-ফাটা কান্না শুনছি। চোরের মতো আমার মাথা নুয়ে পড়েছে অনেক আগেই। টেংরা মাছ দুটো আর ছিপটা যে কোথায় রাখি?
একজন আমাকে ধরে বাবার কাছে নিয়ে গেলো। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি বাবাকে না-দেখে এক দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। সোজা মাঠের বড় জাম গাছটায় গিয়ে চড়ে বসি। পৃথিবীটা কত বড়! তিন মাইল দূরের রেলপথ আর রেল স্টেশন যেন হাতের কাছের জিনিস। একটা ট্রেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। সারাটা দিন গাছে বসে ভাবলাম : এখন আমাকে কে সাথে নিয়ে গিয়ে কীর্তন শোনাবে। আমি কার সাথে আখড়ায় যাবো, কে আমাকে নিয়ে যাবে গফুর বাদশা, কাজলরেখা আর রূপবানের পালাগান শুনাতে। বড় ভাইকে আমি ভয় পাই। সে শুধু মারে। যতই পড়ি আরও পড়তে বলে। তাকে ফাঁকি দিয়ে কত দিন বাবা আমাকে আখড়ায় নিয়ে গেছে কীর্তন শোনাতে।
ঘরের চেয়ে এখন বাইরে সময় কাটাতে আমার বেশি ভালোলাগে। ঘরে আসলেই দেখি মায়ের চোখে জল। আমার শরীর কেন জানি হিম হয়ে আসে। কোনো কিছুতেই আনন্দ পাইনা। তাই বাড়ির চেয়ে নদীরপাড়, বিলপাড় আর পালপাড়া অনেক স্বস্তির। চৈত্রমাস। খুব দ্রুত যেন আমার চারপাশ বদলে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ আউশ ধান আর পাটের বীজ বপনে মগ্ন। কিন্তু আমি দেখছিলাম অন্য জিনিস। মানুষের শত ব্যাস্ততার মাঝেও সবার মনে, আচরনে কেমন যেন একটা ভয় দানা বাঁধছে। কী যেন একটা রাহুর মতো হা-করে এগিয়ে আসছে। সন্ধা হলেই বাড়ির যুবা-বুড়ো সবাই রেডিও চালু করে গম্ভীর হয়ে বসে।
বসন্ত ঋতুটা খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো। মাঝে মাঝে আকাশে কালো কালো মেঘ আর শনশনে হাওয়া ছুটে। সেই রকম এক বিকালে আমরা বৌচি খেলছিলাম। দেখলাম গ্রামের সড়ক ধরে অচেনা মানুষের কাফেলা। ঢাকার শহরে যেন মড়ক লেগেছে; এমনি আতঙ্কে মানুষ-জন গ্রামের দিকে ছুটে আসছে।
সবখানে মানুষের মুখে দেশের কঠিন অবস্থার কথা। প্রতিদিন শহর ত্যাগি মানুষের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সাথে ছোট ছোট দলে ইপিয়ারের লোকজন। কারও গায়ে খাকি পোশাক, হাতে রাইফেল। পাড়ার তরুণরা ইপিয়ারের লোক পেলেই আটক করে :
—তোমরা অস্ত্র নিয়ে পালাচ্ছ কেন?
লোকগুলো বোবার মতো তাকিয়ে থাকে। সহজে মুখে কথা ফুটে না। ভয়ে কবুতরের মতো কেঁপে-কেঁপে বলে, -এই নেন রাইফেল, আফনেরাই লড়াই করেন। ঢাকা এখন কারবালার ময়দান। পাঞ্জাবিরা বাঙালি ইপিয়ারদেরে মাইরা সাফ করছে।
এক বিকালে আমরা চষা জমিনে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম। পুব দিকে টানা ঘ্রুম-ঘ্রুম শব্দে আমরা সবাই ভড়কে গেলাম। সে দিকে রেল সড়ক। ট্রেন গেলে,কয়েকটা গ্রামের ফোক্কর দিয়ে আবছা দেখা যায়। ঘ্রুম-ঘ্রুম শব্দটা ক্রমশঃ বাড়ছেই। ভয়-বিহবলতা কাটিয়ে আমরা পুবের আকাশ, গ্রামের কালচে-বিষন্ন রেখার দিকে তাকালাম। সবই ঠিক-ঠাক। তবু কোত্থেকে হাজার দানবের হুঁঙ্কার ভেসে আসছে! সেই যান্ত্রিক উন্মাদনার ভাষার সাথে তখনও আমরা অপরিচিত। একটু পরেই টের পেলাম, রেল-রাস্তার দিক থেকে শব্দগুলো আসছে। ঐ দিকের লোকালয় থেকে ততক্ষণে শত-শত আদমেরা যেন উড়ে আসছে আমাদের গ্রামের দিকে। তাদের মরণ-চিৎকারে বিকালের চকচকে দিগন্ত-রেখা তচনচ হয়ে গেছে।
শিক্ষিত-বড়দের মুখ থেকে জানা গেলো : পাক-সেনারা দেশ দখল করে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরের জেলা শহরের দিকে। সূর্যের বিধুর মুখটা পচ্চিমে ডুবে গেলে আবহমান বাংলার শীতল গ্রামগুলো বিচ্ছিরি এক অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। খেটে-খাওয়া ক্লান্ত মানুষেরা ভয়ার্ত চোখে ফিরে যায় আপন-আপন ঢেরায়।
বিভিন্ন স্টেশনে, সেতু-কালভার্ডে পাকিস্তানি সেনারা কিছু কিছু সৈন্য রেখে গেলো। যারা একটু পর পর অবিরাম গুলি বর্ষণ করে ভেঙে-পড়া বোবা গ্রামগুলোতে কলেরার মতো আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
পরবর্তী দিনগুলো যেন শুরু হয় জল্লাাদের ইস্তেহার দিয়ে।
কোনো পরিবারের লোকজন হয়তো খেতে বসেছে, হঠাৎ অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ, গুলির শব্দ আর ছুটাছুটিতে পাশের গায়ে তান্ডব শুরু হয়ে গেলো : দেখা-দেখি এ দিকেও চিৎকার ওঠে; পালাও পালাও। ভেড়ার পালের মতো জ্ঞানশূন্য অসহায় মানুষেরা পাতের ভাত ফেলে ছুটতে শুরু করে। বিকালে খবর আসে : ছআনি গ্রামে লাশ ফেলে, বাড়ি পুড়িয়ে, গরু ও নারী নিয়ে পাক-সেনারা রেল-সেতুর বাংকারে ফিরে গেছে। হুলোস্থুল, ছুটাছুটি, গুলিতে এফোঁড়ওফোঁড় তড়তাজা লাশ, মুহূর্তে ভস্ম-হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের অঙ্গার দেখে-দেখে বাংলার কোমলপ্রাণ মানুষগুলোর অনেকেই ভয়ানক ভাবে বদলে গেলো! দূরে কোথাও হঠাৎ জ্বলে ওঠা দাউদাউ বাড়িটির দিকে একটু তাকিয়ে, পরক্ষণেই পানসে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। যে কোনো জীবন্ত সর্বনাশ এখন আর তাদের রক্তকে আলোড়িত করে না।
কৃষক তার নাঙল-কোদাল ছুঁয়েও দেখে না। নিজের চাষের জমিটা অবলিলায় পতিত পরে থাকে। তাদের ভেতরের নিরাসক্ত বৈরাগ্যটি কিন্তু বেশি দিন টিকে না। তরুণেরা গ্রাম থেকে দলে দলে হাওয়া হয়ে যেতে থাকে। মারাত্মক প্রশিক্ষণের জন্য পাড়ি দেয় ভারতে। বয়স নির্বিশেষে কিছু ক্ষুদ্র-মনের মানুষ মেতে ওঠে জঘন্য আদিমতায়। ব্যক্তিগত রেশারেশির জের ধরে শুরু হয় খুন-ডাকাতি-ধর্ষণ। রেল সেতুর বাংকার থেকে গুলির শব্দ না-এলে এখন মানুষের শরীর নিশপিশ করে। এলএমজির তেরতেরানি না-শুনলে রাতের ঘুমটা তাদের জমে ওঠে না। এক দানবীয় উত্তেজনায় বাংলার প্রতিটি মুহূর্ত যেন জ্বলতে থাকে। বেঁচে আছি এরচে’ আর বেশি কী? মারো-কাটো-খাও। পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেড়া শেষ হলে কুষক তার পুত্রেরচে’ প্রিয় হালের বলদটি ধরে আনে। সবাই মিলে জবাই কর। খাও। কাল-তো বেঁচে না-ও থাকতে পারি। আজরাইল কোন ছার? বাংকারের নাদুসনুদুস রাজাকারের রাইফেলটাই তো…।
রাত হলে অঘ্রাণের লক্ষীর মতো পিল-পিল পায়ে গ্রামে এখন মুক্তিযুদ্ধারা হাঁটে। মা আমার কান্না ভুলে গেছে। চারপাশে এতো বর্বরতা, মৃত্যু আর বেওয়া-বিধবার হাহাকার তাতে নিজের একান্ত কান্নাটুকু নিজের কাছেই যেন বেমানান লাগে। বিকালের ম্লান আলোয় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মা আমাদেরকে ডেকে নিয়ে ঘরে তুলে। মায়ের আলুনি চেহারা আর কণ্ঠের বিষাদে আমার হৃদয়টা দুমড়ে ওঠে। ঘরের ঝাপসা গুমোটে মা আমাদেরকে পাখির ছানার মতন বুকে নিয়ে বসে থাকে। অজানা কষ্টে আমার দু’চোখ জলে ভরে ওঠে। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে মাঠের জামগাছটার মগডালে চড়ে বসি।
কোনো কোনো দিন গভীর রাতে কারা যেন বড় ভাইকে ডেকে তুলে। ফিসফিস করে কথা বলে। ভাই ঘরে এসে চিড়া-মুড়ির টিন আর গুড়ের দলা নিয়ে ফিরে যায়। মায়ের চোখ দুটো অপার স্নেহে ছলছল করে। টুপ করে বিছানা ছেড়ে ভাত রাঁধতে বসে যায়। পাশের ঘরে ফিসফিস করে আলাপ চলছে। আমি টিনের ছেদা দিয়ে দেখি : কয়েকজন বিধ্বস্ত চেহারার ক্ষুধার্ত তরুণ। তাদের মাথায় লম্বালম্বা, এলোমেলো চুল, পাশে রাইফেল, তারা হাত না-ধুয়েই গপগপ করে খাবার গিলছে। তাদের ঝলঝলে চোখের আগুন পেটের আগুনকেও যেন হার মানায়!
ততদিনে নদী দিয়ে লাশ আসতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম গুনাগুন্তি। আমরা খবর পেয়ে নদীর দিকে দলবেঁধে ছুটি। অর্ধগলা লাশের চারপাশে ছোট মাছের ঝাঁক। খুলিহীন মস্তকে বসে কাকেরা কা-কা আমুদে আত্মহারা। এসব দেখে বয়স্ক মানুষের চোখের আলোটুকুও দপ করে নিভে যায়। এত আগুন, গুলি, লাশ, ধর্ষণ; এরই মাঝে স্রেফ বেঁচে থাকার ভরসায় ডুবন্ত মানুষেরা শূন্য বুক হাতড়ে-হাতড়ে নদীপার থেকে বাড়ি ফিরে।
দিন’কয় বাদেই অল্প-অল্প লাশের চমক তলিয়ে যায় অসংখ্য মৃতদেহের উপচে-পড়া স্রোতে। অনুভূতিশূন্য এক আদিম নেশায় কর্মহীন মানুষেরা নদী-পারে দাঁড়িয়ে থাকে। বিড়ি টানে, নিচুগলায় আলাপ করে। রূপার গহনায় হীরে-মানিকের বুটির মতো পাক-সেনাদেরও দু’একটি করে লাশ আসতে শুরু করলে সবার মনে সাহস বাড়তে থাকে। একদিন দুপুরে দেখি, সর্বস্বান্ত চেহারার এক মাঝবয়েসী পুরুষ নদীর বাঁক ধরে পানির পাশাপাশি হেঁটে আসছে। তার সমান্তরালে নদীতেও একটা লাশ স্রোতের ঘা খেয়ে-খেয়ে আসছে। শরীরে আলবদরের কালো কাবুলি সেট। লাশটা একদম তাজা হলেও কাকে একটা চোখ তুলে নিয়ে গেছে। পাড় থেকে নুয়ে-পড়া একটা বাঁশে এসে লাশটা আটকে যায়। পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া মানুষটাও নদীর চাতালে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটু ভাবে। তার চোখ দুটো জ্বলে ওঠলো কী!
লোকটা নদীর বুক সমান জলে নেমে যায়। লাশটার পা ধরে টেনে টেনে পারে নিয়ে আসে। মুখটা উল্টিয়ে সনাক্ত করে। চিনতে পেড়ে পাগলের মতো হাসে আর বলে :
—কই যাইবে? আগে কঅ আমার মেয়ে কই, আমেনার মা কই? খুব রাজাকার হইছিলে ?
লোকটা পকেট থেকে একটা চাকু বের করে। বাজের মতো খাবলা দিয়ে রাজাকারের লিঙ্গটা কেটে এনে মরা রাজাকারের হা-করা মুখেই ঢুকিয়ে দেয়। এই লোকটাই তার মেয়ে-বউকে বুকে রাইফেল ধরে রেলব্রীজের বাংঙ্কারে নিয়ে গিয়েছিল।
অনেক অনেক পরে জল-কাদায় মাখামাখি মানুষটা নদী থেকে ওঠে আসে। তার মাথার উপর চকচক করছিল সাদা-কালো খ- খ— আকাশ, ছুঁরির মতো ধারালো রোদ। এইসব দেখতে দেখতে লোকটা একটা ঝোঁপের সামনে বসে পেশাব করে। তাবাদে একটা বিড়ি ধরাতেই বঙ্গবন্ধুর কথা তার মনে পড়ে। মানুষটার বুক ধককরে ওঠে। বিষাদ মাখা ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে ভাবে, শেখ মুজিব অহন কই?
তাবাদে লোকটা উত্তরপাড়ার দিকে হাঁটতে থাকে। সেদিকে মুক্তিবাহিনী-ক্যাম্প। সেখানে সে নাম লেখাবে আজ। সে মুক্তি হবে।
মাথার ওপরের খ-খ- আকাশের দিকে তাকিয়ে লোকটা বিড়বিড় করে বলে, মুজিব ভাই তুমি অহন কই? তারপর লোকটা মুক্তি-ক্যাম্পের দিকে হনহন করে হাঁটতে থাকে। কৈলাশ পালের বাড়ির পাশের ছোট নালাটা সে এক লাফে পেরিয়ে যেতে যেতে ভাবে, বঙ্গবন্ধু তুমি যেহানেই থাহো , বাঁইচা থাইকু। তুমি না-বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবো না।