শূন্যতা আসে, আসে দীর্ঘশ্বাস । শামসুল কিবরিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ, | ১১৭২ বার পঠিত
সবাই রাস্তায় নেমে এলে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ইতোমধ্যে গার্মেন্টস শিল্পের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেটা তো অপর্যাপ্তই, এছাড়া অন্যান্য যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, মালিকরা কি সহজে সেসব দিতে চায়। শ্রমিকদের নেতারা নাকি মালিকদের সাথে অনেক কথা বলেছে এসব বিষয়ে। অবশ্য সাধারণ শ্রমিকরা এসব কথার কিছুই শুনতে পায়না। তাদের কাছে আসার আগেই সেগুলো হয়তো হাওয়ায় ভেসে চলে যায়। জেসমিন কিংবা জাহানারা কিংবা আমিনারা শুধু জানতে পারে কখন কোন নির্দেশ পালন করতে হবে।
সামষ্টিক চাহিদার সাথে ব্যক্তিগত চাহিদা মিলে গেলে এতে জোর থাকে বেশি। বেতন বাড়ানোর দাবিতে যখন রাস্তায় নামার ডাক এলো তখন অন্যান্য সময়ে নেতাদের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হলেও এবার আর ভিন্ন কিছু ভাবার অবকাশ আসেনি। কেননা সংসার চালানো এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বেতন বাড়ার প্রভাব নতুন কোন আঁচড় দিতে পারেনি। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য প্রকৃত মজুরি কমিয়ে দিয়েছে বরং। নইলে সে যা আয় করে এবং ইলেকট্রিকের কাজ করে তার স্বামী যা পায় তা দিয়ে মোটামুটি চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? তার সাথে কাজ করা জেসমিন কিংবা আমেনার অবস্থা যে ভালো তা অবশ্য নয়। কাজের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে আলাপের সময় একে অপরের অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেয়া যায়। তখন তাদের মুখ থেকেও হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের করুণ সুর বেরিয়ে আসে।
শ্রমের মজুরি বিষয়ে অর্থনীতিতে যে তত্ত্ব রয়েছে তার সাথে এদের হয়তো কোন পরিচিতি নেই। কেননা যে ক্লাসে পড়ালেখা করলে তারা এ বিষয়ে জানতে পারতো সে পর্যন্ত এদের কেউই যেতে পারেনি। যেমন পারেনি তাদের সহকর্মী অনেকেই। আর জানলেই বা কি হতো? জাহানারা কি পারতো তত্ত্ব মোতাবেক মজুরি নির্ধারণ করে দিতে? কিংবা পারতো জেসমিন বা আমিনা? এ ক্ষমতা থাকে তাদের জন্য অগম্য কোন স্থানে। সেখানে যাওয়ার মতো সুযোগ বা ক্ষমতা তাদের নেই। তাদেরকে তাই তাকিয়ে থাকতে হয় মালিকপক্ষ বা সরকারের দিকে; যদি তাদের অনুকূলে কোন ঘোষণা আসে!
কাজ করতে করতে তোমরা ঘর্মাক্ত হয়ে যাও। ফ্যানের বাতাস তোমাদের ঘাম শুকিয়ে দেয়, তোমরা তারপর আবার ঘামো। ও জাহানারা, ও আমিনা, ও জেসমিন তোমরা কাজ করতে করতে আরো ঘামো; মাটি তো নেই এখানে, পাকা ফ্লোরে এ ঘাম ফোঁটায় ফোঁটায় পড়বে। যদি কিছু ফলে সেখান থেকে! ফলবেই তো, কিন্তু তোমরা সেটা দেখবেনা। তোমাদের চোখের সে জ্যেতি নেই। তোমরা শুধু ঘাম ফেলবে। আর কি দুর্গন্ধ এতে! সস্তায় যে পারফিউম তোমরা কিনে নাও মাঝে মাঝে তা তোমাদের ঘামের সাথে মিলে দুর্গন্ধকে আরো প্রকট করে তোলে। জীবাণুও আছে এতে। আর এ কারণেই হয়তো তোমাদের ঠিকানা বস্তির ঐ ঝুপড়ি ঘর কিংবা কলোনির কোন ছোট কোন রুম। তোমাদের ঘাম এবং মলমূত্রের জীবাণু এখানে বংশবৃদ্ধি করলেও কোন ক্ষতি নেই।
জাহানারাও কলোনির এরকম একটি ছোট রুমে ভাড়া থাকে। এখানে উঠার আগেই এ পাড়ার রাস্তার একবারে মাথায় থাকা ‘দি নিউ লেডিস টেইলার্স’এ কাজ নিয়েছে। হাত-পা অনেক চালু এখন তার। হবেইনা কেন? গার্মেন্টসে যেভাবে কাজ করেছে তাতে চালু না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। এখানে ঘট ঘট করে মেশিন চালিয়ে কাপড় সেলাই করে। শুধু মেশিন চালানোই নয়। টপাটপ বোতাম আঁটে কিংবা চেইন লাগায়। কাজের মান ভালো বলে খরিদ্দারের অভাব পড়েনা কোন সময়ে। তাই কাজ লেগেই থাকে। অবিরাম পরিশ্রম অনেক সময় বিরক্তি উৎপাদন করে। অসহনীয় হলেও বিরক্তি মাথায় রেখেই তবু হাত-পা চালিয়ে যেতে হয় হয়; যেন তা কাজেরই অংশ। এভাবে বিরক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে কাজ তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
জাহানারা, এই জাহানারা, চল চল, বাইরে যাইতে অইব-আমিনা তাকে প্রায় টেনে নিতে চাইছে। তাড়াতাড়ি চল, সবাই নাইমা যাইতাছে, শুনছ নাই নেতারা ডাক দিছে, বেতন না বাড়াইলে মেশিন বন্ধ থাকব- যেন জাহানারা কিছু জানেনা এমন করে আমিনা বলছে। উত্তেজনায় হয়তো তার স্মরণে আসছেইনা যে গতকালই তারা এ নিয়ে আলাপ করেছিল কিছু সময়। জাহানারা এখন আর সেদিকে না গিয়ে বরং আমিনার সাথে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে থাকে।
গ্রামে থাকতে বিটিভিতে শুক্রবারের সিনেমায় জাহানারা এরকম দৃশ্য অনেকবার দেখেছে যে, নায়কের ডাকে কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকরা মিছিলে যোগ দিচ্ছে। আর কি আশ্চযজনর্কভাবে সময়ের পরিক্রমায় এখন সে নিজেই এমন ঘটনার সাথে জড়িয়ে গেছে। এখানে কাজে না আসলে হয়তো কোনদিনই তার জানা হতো না নিজেদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আন্দোলনে নামার বাস্তব পরিস্থিতি কেমন। প্রথমবার যখন রাস্তায় নামে বকেয়া পরিশোধের দাবি নিয়ে তখন সিনেমাতেই যেন অভিনয় করছে বলে তার মনে হচ্ছিল। হায়, জীবন কি কখনো কখনো এভাবে সিনেমার মতো হয়ে যায়! জাহানারা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার অবসর পায়না। স্লোগান শুরু হয়ে গেছে। দ্রুত গিয়ে স্লোগানে গলা মিলাতে হবে।
জাহানারা তাল ঠিক রেখে কণ্ঠ মেলায়, আমিনা কণ্ঠ মেলায়, জেসমিন কণ্ঠ মেলায়, কণ্ঠ মেলায় জড়ো হওয়া সব শ্রমিক। জাহানারার কণ্ঠে মাকে অনেকদিন ধরে টাকা না দিতে পারার কষ্টও কি এসে ভিড় করে! সেই কবে মাকে কিছু টাকা দিয়েছিল একটা শাড়ি কেনার জন্য। শাড়ি কি আদৌ কেনা হয়েছিল, নাকি সংসারের কোন কাজে লেগে গিয়েছিল তা আর জানতে পারেনি সে। মাকে অবশ্য আর জিজ্ঞেসও করা হয়নি এ ব্যাপারে। প্রায়ই- কোন অবসরে কিংবা কাজের ফাঁকে মায়ের কাছে কিছু টাকা না পাঠাবার কষ্ট জেগে উঠে। মুখে কিছু না বললেও মা হয়তো অপেক্ষা করেন প্রতিনিয়ত। মায়ের মনের অবস্থা তাকেই বুঝে নিতে হয়। যেমন বুঝে নিতে হয় বাবার হাহাকার। কেননা তার চোখে ভেসে আসে চাল কিনে না আনতে পারার জন্য বাবার গ্লানি মাখা চেহারা আর মায়ের লুকানো কান্না। বাবার বয়স বাড়া আর বউ বাচ্চা নিয়ে ভাইদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে বিশেষত মা বাবার অবস্থা আগের চেয়ে যে ভালো হয়েছে এমন নয়। তাই তাদেরকে কিছু টাকা পাঠাবার ইচ্ছা প্রায়ই মনে জেগে উঠে। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা এই যে ইচ্ছার সাথে সাধ্যের সমন্বয় ঘটেনা। ঘর ভাড়াতেই চলে যায় বেতনের সিংহভাগ। তারপর খাওয়া-দাওয়া। বাজার যেভাবে চড়া- একটু সাধ মেটানো তো দূরের কথা , প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। মাকে তাই আর আগের মতো টাকা পাঠানো হয়না। কিন্তু বেতন তো আগের চেয়ে বেড়েছে- সরকার বলছে, মালিক বলছে, পত্রিকা বলছে, গাণিতিক হিসাবও তাই বলে। কিন্তু বেতন বাড়ার সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের সাংর্ঘষিক অবস্থার কারণে প্রত্যেকে তার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব মেলায় বা হিসাব না মেলাতে পারার কষ্ট অহর্নিশ ভোগ করে চলে।
শ্রমিকের বেতন না বাড়লেও পোশাক উৎপাদন থামেনা। আমেরিকার বাজারে পোশাক যায়, ইউরোপের বাজারে পোশাক যায়। সেখান থেকে অর্ডার আসে, পুঁজি আসে। এতো সস্তায় পৃথিবীর আর কোথাও শ্রম পাওয়া যায়না। জাহানারা, জেসমিন কিংবা আমিনাদের শ্রম কিনতে আরো বেশি অর্থ দিতে হয় । তাই চীন বা ভারত বা অন্য আরো কোন জায়গার চেয়ে ঢাকা বা চট্রগ্রামে উৎপাদন করলে খরচ অনেক কমে আসে। তাই পুঁজি ঢালতে লস নাই। পুঁজি লগ্নির তুলনায় আউটপুট বেশি। মাঝে মাঝে সংস্কারের যেসব আহ্বান আসে সেগুলোতো পুঁজির প্রবাহকে নির্বিঘ্ন করতেই।
আরে ভাই সমস্যা কোথায়? মেয়েরা তো এখন কাজ করছে। ঘরের বাইরে আসছে তো। সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? গার্মেন্টসের বড় ভূমিকা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আর কোন সেক্টর দেখান তো যেখানে এতো মেয়ে কাজ করছে? এরা কাজে না আসলে ঘরের ভেতর থেকে শুধু হাড়ি-পাতিল মাজতো, স্বামী আর সন্তানের কথা চিন্তা করতে করতে নিজেকে বেমালুম ভুলে যেত যেমন নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিল, ‘অমুকের মা’ ‘তমুকের মা’ বলে পরিচিত তাদের মা কিংবা খালা কিংবা দাদী-নানীরা।
কাজ পেয়ে খুশি হয়েছিল জাহানারা। কে না খুশি হয় আয়ের অবলম্বন পেলে? আমেনা, জেসমিন বা এখানে যারা কাজ করে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই হয়তো এমন। তবে এ আনন্দ ধীরে ধীরে মিইয়ে যায় মাস শেষে টান পরে গেলে। চাকরি পাওয়ার আগে যেমন চলতো, চাকরি পেয়েও দেখা যায় অবস্থা তথৈবচ। তাই বেতন বাড়ার প্রয়োজনীয়তা আরো অনেকের মতো সে-ও অনুভব করে তীব্রভাবে।
ছুটির সময় ঘনিয়ে এলে বাসায় যাওয়ার টান পড়ে যায়। বাচ্চাদের জন্য মন উথালপাতাল করে উঠে। সারাদিনে বিভিন্ন সময়ে এদের কথা মনে হলেও যাওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে প্রবোধ দেয়া যায়। কিন্তু দিনশেষে মনকে আর কোনভাবে বুঝানো যায় না। তাই ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে পা কিভাবে চলে তা আর বুঝতে পারেনা। বিভিন্ন সময়ে শাশুড়ি বা ননদ বা আর কেউ এসে থেকেছে বাচ্চাদের দেখার জন্য। কিন্তু নিজেদের জগতের জন্য টান পরে গেলে তাদেরকেও চলে যেতে হয়। সাময়িক সময়ের জন্য চিন্তা লাঘব হলেও আবারো তাকে পড়তে হয় দুঃশ্চিন্তার বেড়াজালে।
তবে প্রতিদিন কি আর সময়মতো বের হওয়া যায়? মনকে চেপে ধরে সুপারভাইজারের নির্দেশমতো কাজ শেষ করে যেতে হয়। এমনিতেই তো একটু অমনোযোগিতা বা অসতর্কতার জন্য তাকে বা অন্য কাউকে অনেক সময় এসব কথা শুনতে হয় যে-কাজের জন্য তো মাস শেষে বেতন দেয়া হচ্ছে, তবে কেন কাজে গাফিলতি করা হবে? তাই কিছু বলতে চাইলেও তার রক্তচক্ষুর ভয়ে আর মুখ খোলার সাহস হয়না। তবু যদি এর জন্য নিয়মিত বাড়তি কিছু পাওয়া যেত! কাজে ঢুকেই ওভারটাইমের ব্যাপারে অনেক আলাপ আলোচনা শুনেছিল। এখনও হয়। তবে সেটা চাপা গুঞ্জনের মতোই। মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে কিছু পেলেও তা হয়তো তা শুধু নিয়মরক্ষার্থে দেয়া হয়। ন্যায্য পাওনার জন্যই তো অনেক সময় কাঠখড় পোড়াতে হয়। কোন ঈদ কি বাদ যায় যে ঈদে বোনাসের জন্য মাঠে না নামতে হয়। কোন না কোন ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা তাদের পাওনার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। পত্রিকায় পাতায় বাজার চড়া হওয়ার বা রাস্তাঘাট মেরামত না হওয়ার খবর প্রকাশের সাথে এসব খবরও ছাপা হয় যে কিছু ফ্যাক্টরির শ্রমিক রাস্তা বন্ধ রেখেছে তাদের বেতন বোনাসের দাবিতে।
রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে জনদুর্ভোগ বাড়ে, সন্দেহাতীতভাবে একথা সত্য। তবু শ্রমিকরা রাস্তা বন্ধ রাখে একারণে যে টাকা না পেলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভোগান্তি বেড়ে যায়। ঈদ করা হয়না। তাদের আর ঈদ কি? উৎসবের একটু আমেজ পাওয়া- এইতো। বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যায়-এটাই মূখ্য। জাহানারাও কয়েকবার বোনাস পেয়েছে ঈদের পরে। টাকার উপযোগিতা তখন নষ্ট না হলেও একটা খেদ থেকে যায় যা মনকে কিছুদিন ভার করে রাখে।
‘দি নিউ লেসি টেইলার্স’ এ কাজ করতে করতে গ্রামের কথা মনে পড়ে। সেখানে যাওয়া হয়না অনেকদিন। বিয়ের পর থেকেই যেন নিজের গ্রামটি পর হয়ে যাচ্ছে। স্বামী, সন্তান, চাকরি , হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস ইত্যাদির ভেতর দিয়ে নতুন বাস্তবতা রচিত হচ্ছে নিত্য। বিয়ে তো আর স্বচ্ছল কারো সাথে হয়নি যে বাবার সংসারে দেখা অভাব আর দারিদ্রকে অতীতের গহ্বরে ফেলে দিয়ে নতুন কোনদিকে জীবনের মোড় ঘোরাবে। জীবন এখানে আর সিনেমার মতো হয়নি। বড়লোকের কোন ছেলে শখে গ্রামে বেড়াতে এসে গরীব কোন তরুণীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করে শহরে নিয়ে গেলো-আহা, জীবন এতো সিনেমাটিক নয়।
তার বিয়ে হয় নাসিরের সাথে। অভাবে জর্জরিত বাবা মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারলে দায়মুক্ত হবেন বলে পাত্র খোঁজা শুরু করলে নাসিরের আলাপ আসে। বাবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিয়ে হয়ে গেলে নাসিরের আচরণে অর্থাৎ তার প্রতি যে দায়িত্ববোধ থাকা দরকার তা প্রকাশ পেতে থাকলে জাহানারা বুঝতে পারে ঠিক পথেই বাবা হেঁটেছেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও নাসির অনেককিছু করতে পারেনা। বিয়ের আগেই ঢাকা চলে এলেও রোজগারের অবস্থা তেমন নয়। বিয়ের কয়েকমাস পর জাহানারাকে নিয়ে আসলে খরচ আরো বেড়ে যায়। তাই জাহানারার জন্য একটি কাজের খোঁজ করতে থাকে। পরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ পেয়ে গেলে দুজনে অনেক স্বপ্ন দেখে। কল্পনায় ভাসতে থাকে অনাগত দিনের রঙিন বুদবুদ। এটা করবে সেটা করবে মনে করে করে স্তরে স্তরে সাজাতে থাকে ভবিষ্যৎকে। কি আর করা কল্পনাকে তো আর লাগাম টেনে আটকানো যায়না। একটার গা বেয়ে আরেকটা উঠতে থাকে কেবল। তাদের এই যৌথ স্বপ্ন দেখা চলে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ফাঁক গলে। তবে সময় কিছু এগিয়ে গেলে বিভিন্ন ফাঁকি সামনে এসে দাঁড়ায়। আর এতে করে তারা নিজেদের দিনানিপাতের জটিল হিসেব নিকেষে জড়িয়ে যায়।
ইউরোপ বা আমেরিকার বাজারে কিভাবে আরো বেশি পোশাক পাঠানো যায়, চীন , ভারত বা ভিয়েতনামের সাথে কিভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায় এ নিয়ে নিশ্চয় গভীর আলোচনা হয় ব্যবসায়ীদের সংগঠনে বা মন্ত্রণালয়ে বা কোন তারকাচিহ্নিত হোটেলে। বিনিয়োগ বাড়ানোর বিভিন্ন পন্থা নিয়েও হয়তো সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ হয়। জাহানারা, জেসমিন বা আমিনার সেগুলো শুনার কোন সুযোগ নেই। তারা হয়তো এ নিয়ে ভাবেওনা কেননা মুনাফা বাড়ানোর বা কেন্দ্রিয় ব্যাংকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য কোন মাথাব্যাথা তাদের নেই। নিজেদের বর্তমানকে কোনভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য তারা সর্বদা চিন্তামগ্ন থাকে। নিজেদের হাসি, কান্না , রাগ বা অভিমানের সাথে নিত্য বসবাসের একঘেঁয়েমিও হয়তো তাদেরকে ভিন্ন কিছু ভাবা থেকে বিরত রাখে।
বেতন বাড়ানোর দাবিতে কাজ বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে আসা তাই অযৌক্তিক ছিলনা। এর আগেও তাকে এভাবে রাস্তায় নামতে হয়েছে দাবী আদায়ের নিমিত্তে। সেসব স্মৃতি ধূসর হয়নি এখনো। সবসময় যে দাবী আদায় হয়েছে এমন নয়। তবে এগুলো উদ্দীপনা যোগায়। আমিনার সাথে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় দু একটি স্মৃতি এসে তাকে সামনে ঠেলে দেয়। জমায়েত হওয়া শ্রমিকদের সাথে সে-ও মিশে যায়। ভবিষ্যৎ সুখের আশায় হাত তুলে স্লোগানে গলা মেলায়। তার কণ্ঠনিঃসৃত স্বর কোথায় গিয়ে মেলায় এটা বুঝতে না পারলেও কিছুদিন পর জানতে পারে যে সে ব্ল্যাকলিস্টেড।
কি ঘিঞ্জি পরিবেশ এটা! এখানে কিভাবে কাজ করা সম্ভব- প্রথমদিককার ভাবনা ছিল এসব। গ্রামের মুক্ত পরিবেশ থেকে এসে শহরটাকেই মনে হতো কারাগারের মতো। নতুন কর্মস্থলকে মনে হয়েছে আরো সংকীর্ণ কারাগার। যদিও কারাগার আসলে কেমন তা কখনো সে দেখেনি- বন্দীত্বের যে ধারণা মানুষ স্বভাবত ধারণ করে এ থেকেই হয়তো সে এমন করে ভেবে নিয়েছে। তবে দিনে দিনে তাকে সবকিছুর সাথেই মানিয়ে নিতে হয়েছে। কেননা এছাড়া বিকল্প কিছু তার হাতে নেই। আর বিভিন্ন্ অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়া তো জীবনেরই অংশ। মানিয়ে নিতে নিতেই মানুষ সামনে এগিয়ে যায়। পরিবর্তীত বাস্তবতার সাথে নিজেকে পুনঃস্থাপন না করতে পারলে মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হত। এই পর্যন্ত আসতে আসতে তাকে অনেককিছুর সাথেই মানিয়ে আসতে হয়েছে। জীবন এমনই, হ্যাঁ জাহানারার জীবন এমনই, জেসমিনের জীবন এমনই, আমিনার জীবনও এমনই।
‘দি নিউ লেডিস টেইলার্স’ এ কাজ করতে জাহানারা ফ্যাক্টরির মতো মানসিক চাপ অনুভব করেনা। এখানে তার সাথে কাজ করে রাফিয়া আর আম্বিয়া। আর তাদের সাথে প্রায় সর্বক্ষণ থাকেন এটির মালিক রাহেলা খাতুন। কাজ করতে গিয়ে বা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোন সময় একটু লেগে গেলেও পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। একটা রুমের ভেতর কতক্ষণ আর মুখ না খুলে থাকা যায়? তাই সালোয়ার, কামিজ, ম্যাক্সি, ব্লাউজ ইত্যাদি কাটার ফাঁকে ফাঁকে তাদের মধ্যে একটি আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। এখানেও কাজে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। তবে যে সূক্ষ নজরদারি গার্মেন্টেস এ থাকতো সে অবস্থা এখানে নেই। কাজে কোন ত্ররটি হলে কাস্টমারকে বুঝিয়ে সেটা ঠিক করে দেয়া যায়। সেখানে ভুল করার কোন সুযোগ ছিলনা। কেননা যে কোন মূল্যেই হোক কোয়ালিটি মেইন্টেন করতে হবে। একটু এদিক সেদিক হলেই পুরো লট রিজেক্ট হয়ে যায়। মালিক কি এটা মানবে? কোনভাবেই না। বায়ারের চাহিদামতো সবকিছু করে দিতে হবে।
তাহলে কেন সংর্ঘষে লিপ্ত হতে হয় তাদেরকে? পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে? এমনকি নিজেদের দাবী আদায়ের জন্য মানুষের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, নিজের প্রাণটাকেও খোঁয়াতে হয়েছে অনেককে। জাহানারা এসবের জীবন্ত স্বাক্ষী। তার চোখের সামনে কতকিছু ঘটে গেছে। আফসার ভাইয়ের কথা মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে। তার সাথে যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন নয়। দেখা হলে কথা হতো- এই যা। তবে লোকটি কথা বলতো আন্তরিকতার সাথে। খুব আপন মনে হতো কথা বলার সময়। সে-ও একটা হাঙ্গামার সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ব্যাপারটি শুধু তাদের ফ্যাক্টরির ছিলনা। সাধারণ স্বার্থে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে শ্রমিকরা বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়াতে সে দাবী পুরণ হয়নি উল্টো একটা তাজা প্রাণকে ঝরে যেতে হয়েছে। ঘটনা তদন্তের জন্য বরাবরের মতোই একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। তদন্ত আদৌ হয়েছিল কিনা বা হলেও কতদূর এগিয়েছিল তা আর জানা যায়নি। যদি হয়েও থাকে তাহলে হয়তো অতীতের আরো অনেক তদন্ত কমিটির রিপোর্টের মতো হাওয়ায় উড়ে কোন অজানায় পারি দিয়েছে। কেননা গুলিনিক্ষেপকারী কাউকে সে তদন্তের মাধ্যমে বের করা যায়নি।
কয়েকদিন রাস্তা কাঁপিয়ে শ্রমিকদের আবার ফিরে আসতে হয়েছিল ফ্যাক্টরিতে। জাহানারা ভাবে, আফসার ভাইয়ের মতো অবস্থা তো আমার হতে পারত। কি হতো তাহলে তার সন্তানদের তখন? আফসার ভাইয়ের সন্তানরা না জানি কি করছে এখন! তারা কি খুব বিপদগ্রস্থ এখন নাকি কোন অবলম্বন পেয়ে চলতে পারছে। তার সন্তানরা কি করতো? মন ভারী হয়ে আসে ভাবতে ভাবতে। ঘটনার পর বেশ কিছুদিন সে এ নিয়ে ভোগেছে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে আতংকের ভাবটি কেটে যায়। দিনযাপনের বিবিধ কৌশলের ভেতর আফসার ভাই মাঝে মাঝে এসে উঁকি দিলেও মন আর আগের মতো ভারী হয়না। শুধু অতীতের একটা স্মৃতির মতো সে ঘটনা মানসপটে উঠে আসে।
এ-ও জাহানারার মাঝে মাঝে মনে হয় যে এমনও তো হতে পারতো যে তাদের ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে গেল। তাহলে কি যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতো! ভাবলেই গা শিউরে উঠে। একটি গেটই খোলা থাকে কর্মঘণ্টা শুরু হলে। সেটা দিয়ে কজন নেমে আসতে পারতো? তাদের এখানে অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা সঠিক আছে কিনা তা তার জানা নেই। কয়টা ফ্যাক্টরিতেই বা আছে এ ব্যবস্থা? আগুন লাগলে যে কি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় তা তো অজানা নয়। পুড়ে মরে গেলে কিছু আর্থিক সাহায্য পায় পরিবার। আহত হলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ হয়না। সামনে ঝুলে থাকে কেবল শংকাযুক্ত ভবিষ্যৎ। জাহানারা ভাবে, চাকরি গেছে যাক বেঁচে আছি এইতো অনেককিছু।
জাহানারা ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে বাদ পড়ল চাকরি থেকে। আমিনার পরিণতিও তাই হলো। বাদ পড়েছে কামাল, লিটন সহ মোট দশজন। এরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেছে কাজ ফিরে পাওয়ার। মৌখিক, লিখিত কোন পথই বাকি রাখেনি। কিন্তু কোন ফলাফল না পেয়ে একে পর্যায়ে হতোদ্যম হয়ে সরে আসতে হয় এবং বিকল্প খোঁজায় মন দিতে হয়।
আমিনা কি পরে কোন কাজ পেয়েছিল? লিটন বা কামালের অবস্থাই বা কি – জাহানারা কিছুই জানেনা এসবের আর। কিছুদিন যোগাযোগ থাকলেও পরে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো নিজেদের টলোমলো অবস্থাকে স্থির করার ব্যস্ততা প্রয়োজনহীন সম্পর্ককে শিথিল করে দেয়। জাহানারা পরে আর এসব নিয়ে ভাবেনি। তাদের মধ্যে গড়ে উঠা কৃত্রিম সম্পর্ক শুধু মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর করতো- এই যা।
চাকরি চলে গেছে বেশ দিন হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস পেয়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যায়। আশ্বাসমতো মজুরি বাড়েও। তবু জাহানারা দেখে, সাথে আমরাও দেখি হঠাৎ করেই কখনো পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠে। কাজ ফেলে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়। কোন সমস্যারই টেকসই কোন সমাধান না হওয়াই হয়তো এর কারণ। কেন যে হয়না জাহানারা তা আর জানেনা। কেননা বিভিন্ন গোপন সভায় কি কি আলোচনা হয় তা কোন পত্রিকা বা টেলিভিশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালে আসেনা। জেনেও কোন কাজ নেই নেই বলেই হয়তো সে এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং জীবনের হিসাব মেলানোর জন্য ‘দি নিউ লেডিস টেইলার্স’ এ কাপড় কাটে, সেলাই করে , বা বোতাম আর চেইন লাগিয়ে যেতে থাকে।