পৃথিবীর বেড়ে ওঠা । রুখসানা কাজল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৫৫৮ বার পঠিত
এত অসহায় কখনো লাগেনি আলালের। ওর আব্বু যেদিন মারা গেল ও সেদিন কলোনির মাঠে ক্রিকেট খেলছিল বন্ধুদের সাথে। পাশের ফ্ল্যাটের ডাক্তার আন্টি তিনতলার বারান্দা থেকে চীৎকার করে ডেকে বলেছিল, লাল্লা এই লাল্লা। শিগগীর উপরে আয়। আয় বাবা। তোদের যে সর্বনাশ হয়ে গেছে রে লাল্লা। সেদিন মৃত আব্বুকে বার বার দেখে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ওরা ভেবেছিল, কিসের সর্বনাশ। আম্মু ত আছে। ভয় কি আর !
ঘোর কালো ওর গায়ের রঙ। সাথে বেমানান সাদা দাঁত আর চোখ। সেই সাদাচোখ লাল হয়ে উঠেছে কান্নার দমকে। বাঁশগাছের কঞ্চিকাঞ্চা ছড়ানো কাঁচারাস্তা বেয়ে চলে যাচ্ছে আলাল। আর ফিরবে না। ফিরতে চাইলেও, পারবে না। ফিরে আসার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে আম্মু। দুচোখ ভরে আসে কান্নায়। কাঁদতে কাঁদতেই পেছন তাকায়। মনে মনে খুব আশা করে, আম্মু যদি আবার ডেকে নেয় ওকে ! ব্যাগের বেল্ট জাপটে ধরে হতাশায়। লাল গেটের কালো পাল্লার কাছে আম্মু নেই। কেউ নেই। কেবল ফুলহীন মালতি লতাগুলো ঢিমে বাতাসে অল্প অল্প কাঁপছে।
তেরো বছরের বুকটা ফেটে যাচ্ছে । সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে ভয় লাগছে ওর, কোথায় যাবে সে এখন?
আব্বু মরে গেছে চার বছর আগে। দাদাদাদি, চাচাফুফু কেউ নেই ওদের। আছে এক নানুয়া। আম্মুর মা। তার অবস্থাও ভালো নয়। দুটো দোকানের ভাড়া, নারকেল সুপারির বাগান ভাড়া আর পুকুরের মাছ দিয়ে নানুয়া তার একার সংসার চালিয়ে নেয় । ওদেরকেও কিছু দেয়। কিন্তু সে তো অতি সামান্য। এ সবকিছু জানে আম্মু। জেনেও ওকে বের করে দিলো বাসা থেকে !
ও বড় হয়ে যাচ্ছে এটা কি ওর অপরাধ ? রাক্ষসের মত খিদে লাগে আজকাল। ভাত তরকারি, বিস্কিট, মুড়ি, ডিম ঘরে যেখানে যা পায় তাই খেয়ে ফেলে। মাঝে মধ্যে বাসার অন্যদের খাবারও খেয়ে ফেলে আলাল। প্রথম দিকে আম্মু কিছু বলত না। আঙ্কলও চুপ করে উঠে চলে যেত। তারপর কি যে হলো ! আঙ্কল হটপটের ঢাকনি খুলে হেসে হেসে বলত, সে কী ! লাল্লা দেখি ডেমিয়েন হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। এবার ত ও আমাদের খেয়ে ফেলবে দেখছি। তাই শুনে আম্মু রেগেমেগে সব খাবার সরিয়ে রাখতে শুরু করে ।
এমনকি আঙ্কলের সাথে টেবিলে খেতে পর্যন্ত ওকে ডাকত না আজকাল। আচ্ছা আব্বু বেঁচে থাকলে আম্মু কি পারত ওকে এভাবে বের করে দিতে ? তখনো ত ও এরকম হঠাত লম্বা হয়ে বড় হয়ে যেতো ! তখনো ত প্রচণ্ড খিদে পেত আলালের! আম্মু কি সাহস পেতো দুধ, চিনি, বিস্কিট এভাবে লুকিয়ে রাখাতে ?
সেদিন ওগুলো খুঁজতেই ত আম্মুদের ঘরে গেছিল ও। তাতে কি ভয়ানক রেগে গেলো আঙ্কল আর আম্মু। পারলে তখনই ওকে বের করে দেয় ! বটগাছের শিকড়ে পা বেঁধে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয় আলাল। কে জানত আব্বু মরে যাবে ! কোয়ার্টারের বাসায় আব্বু আম্মুর বেডরুমে ত ওরা কতবার গেছে। আম্মু চাদরে বুক ঢেকে ধমক দিলেও আব্বু বলেছে, যাও ত বেবি দেখো বাচ্চারা কি চায়। কি হয়েছে রে লাল্লা ? দু বছরের ছোট চান্দার সাথে মারামারি করে কতবার ওরা ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে বিছানার উপর। আব্বু আম্মুর গায়ে, পায়ে, বুকে।
তখন ত হাহা করে হাসত আব্বু আম্মু ! বুক ভেঙে কান্না আসে আলালের। কাল রাতে পটাপট ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে আম্মু বলেছে, শোন লাল্লা, তুই তোর নানুর কাছে গিয়ে থাক। আমি টাকা পাঠাবো। কোনো অসুবিধে হবে না। ইশকুলে ভর্তি হয়ে যাস্। তুই ত আর ছোট নোস। সব বুঝিস। এখানে তোকে রাখা যাবে না।
চলে যা তুই। আমাকে আমার সংসার করতে দে বাবা। আলাল সব বুঝেও অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো, কিন্তু আম্মু তুমি ত বলেছিলে আমাদের সবসময় সাথে রাখবে। আঙ্কলও তাই বলেছিল। আম্মুর মুখটা কেমন রাগী হয়ে যায়, বললেই কি সব কথা রাখতে হবে ? তোমরাও তো বলেছিলে, আমাকে দুঃখ দিতে চাও না। তাহলে? আমি দুঃখ পাচ্ছি। তোমার আঙ্কল রাগ হচ্ছে। তুমি কি এসব কিছুই বোঝো না ?
আলাল বোঝে। খিদের চোটে ও আঙ্কলের জন্যে রাখা খাবার খেয়ে ফেলেছে কাল রাতে। প্রায় রাতে আঙ্কল ভাত খায় না। অনেক সময় প্যাকেট খাবারও নিয়ে আসে আঙ্কল। ল্যাপটপে কাজ করতে করতে তাই খেয়ে নেয়। ও ভেবেছিল জালির নীচে পড়ে আছে খাবারগুলো। রাতও অনেক হয়ে গেছে। আঙ্কল বোধহয় আর খাবে না। কে জানত আঙ্কল খাবার খেতে চাইবে !
বাঁশবনের পেছনের ঘরগুলো দেখে আলাল। ঘুমঘোরে এখনো ঘুমাচ্ছে সবাই। ভোর গড়িমসি করছে জাগতে। এ সময় আলাল লাইট জ্বেলে পড়তে বসে। পড়তে ওর কি যে ভালো লাগে। আব্বু বলত, ভোরে ওঠে পড়তে বসবি লাল্লা। এ সময় প্রকৃতি আর মানুষের ব্রেন একদম তাজা আর ঠান্ডা থাকে।
কিন্তু আম্মু আঙ্কলের ঘুমের অসুবিধা হয়। আম্মু সেদিন সকালে টুথপেস্ট ছুঁড়ে মেরেছে চান্দাকে। ক্ষ্যাপার মত বলেছে, এত সকালে ফ্রিজ খুলেছ যে ! এত খিদে পায় কেনো তোমাদের ? জানো না সামান্য শব্দে তোমার আঙ্কলের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়! এখন সারাদিন মাথা ব্যাথা করবে বেচারার। কত কাজ করতে হয় তোমার আঙ্কলকে তা বোঝো ! মোড় ঘোরার আগে আবার পেছন ফেরে আলাল। নাহ কেউ দাঁড়িয়ে নেই। চান্দাকে দেখেছে ভয়ে বিছানার এক কোণে বসে থাকতে। আম্মুকে যমের মত ভয় পায় চান্দা।
আর ছিল এই বরকতচাচার দোকান। ও আর চান্দা এখনো এই দোকানে এসে খেয়ে যায়। বরকত মিয়া নানুর দেশের লোক। নানু বলে গেছে , মিয়া আমার নাতিরা তোমার হোটেলে খাবে। পাই পয়সার হিসাব রাখবা। সব দিয়ে দেবো। কিন্তু কোনোদিনও না বলো না যেনো। এতিমদের কষ্ট দিলে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না এটা মনে রেখো বরকত মিয়া। আম্মুরা এ দোকানে আসে না।
লঞ্চঘাট না গিয়ে ভাইভাই রেস্তোরায় ঢুকে বসে থাকে ও। এ পথ দিয়ে আম্মু আঙ্কল অফিসে যাবে। তার একটু পরেই চান্দা যাবে ইশকুলে। চান্দাকে কিছু বলা হয়নি। বলা দরকার। বড় একটা পাউরুটি টেবিলে দিয়ে চুলো ধরায় বরকত মিয়া, এত ভোরে আইলা যে নাতি। পরীক্ষা আছে বুঝি ! পড় পড়। ভাল কইরা পইড়া বাপের মত অফিসার হও দেখি ! কিছু বলে না আলাল। ইংলিশ বই বের করে ডিসিপ্লিন ইন লাইফ এসেটা মুখস্থ করতে থাকে। অই যে তোমার আম্মারা আসতিছে। পড়া বন্ধ করে আলাল দেখে আঙ্কলের হোন্ডা স্লো হয়ে থেমে গেলো ঝুরি নামা বটপাকুড়ের পাশে। এবার ওরা বাটার এন্ড বাটার রেস্টুরেন্টে নাস্তা করবে ।
আম্মু খুব সেজেছে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে। কেমন আহ্লাদী ভাব। চঞ্চল। মিষ্টি। ছোট্ট মেয়েদের মত আঙ্কলের হাত না ধরে একটা সিঁড়িও পার হতে পারে না আজকাল। আঙ্কলেরও নায়ক নায়ক ভাব। দুজনেই ফিল্মস্টারদের মত পরিপাটি থাকে। দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সেই পুরনো আম্মুকে কিছুতেই এই সুন্দর আম্মুর সাথে মেলানো যায় না।
তিন বছর আগে আঙ্কলকে বিয়ে করবে জেনে নানুয়া খুব আপত্তি করেছিল। মেয়েকে বলেছিল, বাচ্চাদের কথা ভেবেছ ? আনম্যারেড ছেলে। তায় তিন চার বছরের ছোট তোমার চেয়ে। তোমার ছেলেমেয়েরাও কিন্তু শিশু নয়। এদের মানাতে পারবে বলে তোমার মনে হয় ? আম্মু ক্ষেপে গেছিল নানুয়ার উপর। —আমার কথাটা একবার ভেবেছো কেউ ? কি নিয়ে থাকব আমি? বালিশ কামড়ে সারাজীবন একা কাটাতে পারবো না। কিছুতেই না । সে সময় সারাক্ষণ রেগে থাকত আম্মু। গজরাতো। সামান্য সামান্য কারণে ওদের মারধোর করত। কোয়ার্টার বাসা থরথর কাঁপত আম্মুর ভয়ে। আঙ্কল এলেই দরোজা বন্ধ করে বলত, আমাকে ডাকবে না খবর্দার। তোমাদের যা খুশি কর। খাও, পড়, খেলো, না খেলো । ইচ্ছা হলে নানুবাড়ি চলে যাও।
আমাকে বিরক্ত করবে না একবারও। ভয়ে ওরাই তখন বলেছিল, আম্মু আম্মু তুমি আঙ্কলকে বিয়ে করো। কিন্তু আমাদের ছেড়ে যেওনা আম্মু ! প্লিজ! প্লিজ আঙ্কল। প্লিজ। আঙ্কল তখন আদর করে দুহাঁটুর উপর দুজনকে বসিয়ে বলেছিল, তোমাদের কোথাও যেতে দেবো না সোনা। আমাদের সাথে থাকবে। এখন তোমরাই ত আমার ছেলেমেয়ে। ওরা আঙ্কলের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু নানু যখন জানলো তখন ছুটে এসে শুধু বলেছিল, বুঝলি না রে ফেলি, বুঝবি দিন গেলি। আম্মু ঠোঁট উলটে নানুয়াকে বলেছিল, আমার কিছু বোঝার নেই।
আমার জীবন আমার। আমি পারব না শুধু বাচ্চাদের মা হয়ে জীবন কাটাতে। ওদেরকে ত আর ফেলে দিচ্ছি না। নানুয়া ওদের কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেছিল, সব ভালো যার শেষ ভালো তার। কখনো ওদের ফেলতে হলে, একেবারে ফেলে দিও না। আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। এখনো ত মরে যাইনি। আম্মু আর নানুয়া সেদিন খুব কেঁদেছিল। রান্না করতে আম্মু ভালোবাসত না। আব্বু বেঁচে থাকতে রান্নার লোক রেখে দিয়েছিল।
আর ছিল এই বরকতচাচার দোকান। ও আর চান্দা এখনো এই দোকানে এসে খেয়ে যায়। বরকত মিয়া নানুর দেশের লোক। নানু বলে গেছে , মিয়া আমার নাতিরা তোমার হোটেলে খাবে। পাই পয়সার হিসাব রাখবা। সব দিয়ে দেবো। কিন্তু কোনোদিনও না বলো না যেনো। এতিমদের কষ্ট দিলে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না এটা মনে রেখো বরকত মিয়া। আম্মুরা এ দোকানে আসে না।
গরীবরাই বেশি আসে। রোজ সকালে বাটার এন্ড বাটার থেকে নাস্তা করে ওরা দুজন চলে যায় যে যার অফিসে। সন্ধ্যায় কোনোদিন ফেরে। কোনদিন ফেরে না। চান্দা আটার সাথে পেয়াঁজ মরিচ রসুন মিশিয়ে মোটা করে চাপাটি ভেজে আনে কখনো মিষ্টি পিঠা, খা ভাইয়া।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। চান্দা আসছে। আলাল ওঠে ডাক দেয়। দুবছরের ছোট চান্দা আলালকে দেখে কেঁদে ফেলে, ভাইয়া আমাকেও নিয়ে যা। আম্মু বলেছে এখানে থাকতে গেলে রান্না করে রাখতে হবে। ওরা আর হোটেলের খাবার খাবে না। আঙ্কলের পেটে ব্যাথা হচ্ছে। আলাল চান্দার হাত ধরে, সেই ভালো হবে রে চান্দা। চল তুইও চল। কি ভেবে চান্দা এগিয়ে গিয়েও থেমে যায়, নানুর কি অত টাকা আছে ? নানু তো গরীব ভাইয়া ! আলাল বোনের ব্যাগ হাতে নিয়ে তাড়া দেয়, ঘর ত আছে। আর নানুয়া তো বলেছেই, কষ্ট পেলে চলে আসিস নানুভাই। তুই চল । তাড়াতাড়ি চল্। লঞ্চ ছেড়ে দেবে এখুনি।
আয় চান্দা। ওরা ছোটে। নয়টার লঞ্চে চড়লে দুই ঘন্টার নদী পথ। তারপর ছুটতে ছুটতে সেই পুরনো মায়াবাড়ি। শিরিষের ডাল ছুঁয়ে আছে কৃষ্ণচূড়ার পাতা। পেয়ারা গাছ বেয়ে শশা চিচিঙ্গা ফুলের হলুদ বিস্তার। নারকেল গাছগুলো ঝুঁকে চেয়ে আছে গেটের দিকে। পুরনো টিনের কয়েকটি দোকান। মাস গেলে যারা ভাড়া দিয়ে যায় তারাও বেশ গরীব। তবু ফাঁকা বাড়িতে একলা নানুয়াকে এরাই দেখে রাখে। নদীর জলে ঝালমুড়ির ঠোঙা ভাসিয়ে দিয়ে হাসে দুভাইবোন। অই ত এগিয়ে আসছে নানু বাড়ির ছোট্ট শহর। গেট খুলেই ওরা দেখবে নানুয়া হয়ত ভাত বসিয়ে কলাগাছ থেকে মোচা ছিঁড়ছে। রান্নাঘরের বারান্দায় কাত করে রাখা বটি।
সেখানে শণপাতার ঝাঁপিতে ডিম, মরিচ পেঁয়াজ, রসুন আদার পাশে কয়েকটা চিচিঙ্গা দাগ দাগ গায়ে শুয়ে আছে। ওদের দেখে নানুয়া মোটেও অবাক হবে না। শুধু বলবে, মা যদি হয় পর, দুনিয়াদারী আর কার ! যাও ত সোনাপাখিরা, জামাজুতা খুলে ব্যাগ রেখে গামছাটা নিয়ে পুকুরে যাও। তেলাপিয়া পেলে ত ভালোই নইলে যা পাও ধরে নিয়ে এসো। আজ আমরা পিকনিক করে খেয়ে নিই দুপুরে ।
পুরনো খাওয়ার টেবিলে মন খুলে আলাল প্লেট প্লেট ভাত খাবে। পেট ভরে উঠবে গলা পর্যন্ত। তারপরেও নানুয়া বলবে, আরেকটু ভাত দিই নানুভাই ? বড় হচ্ছে।এখন ত রাক্ষুসে ক্ষুধা লাগবে তোমার। খাও । পেট ভরে খাও সোনা। আলাল পেট সোজা করে নানুয়ার হাতের বড় চামচটা দেখবে।
সাদা মোটা ভাতে চামচটা কি ভরভারান্ত ! ও আরো ভাত নেবে। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে আলাল দেখবে, বড় হওয়ার কি অপরাধ ছিল ওর !