যন্ত্রজীবন । তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ, | ৯৮২ বার পঠিত
পাশের ফ্ল্যাটের সুন্দরী তরুণীটি আবার আমার কুটু মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে, ইন্টারকমে। কুটু মিয়া, আমার পোষা বিড়াল। পাশের ফ্ল্যাটের সেই তরুণীর বিড়ালীর সাথে ভাব জমাতে চায়। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজেরও কুটু মিয়ার মত এই তরুণীর সাথে ভাব জমাতে ইচ্ছে করে। কুটু মিয়ার মত সাহসী নই, তাই নিজের ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে রাখি।হয়ত মেয়েটির কোন সংগী আছে, এটুকুই স্বান্তনা।
তরুণীর অভিযোগে ছুটির দিনের ঘুমটা আমার ভাঙলো। আমি অবশ্য তাকে মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছি, তার বিড়ালীকে প্রয়োজনীয় ওষুধপাতি সে খাওয়াক। তরুণী এরপর আমার দায়িত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান দান করেছে। সুতরাং এখন আমার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কুটু মিয়াকে পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে খাসি মানে কাস্ট্রেট করা।
আমি ছুটে চলে গেলাম সেই সুন্দরী তরুণীর ফ্ল্যাটের দরজায়। হয়ত কুটু এখানেই চলে এসেছে। অস্থির হয়ে তার দরজায় ডিজিটাল সংকেত পাঠাতে থাকি। অনেকক্ষণ পর একজন বয়স্ক লোক দরজা খুললো।
কুটুকে কাস্ট্রেট করিয়ে বাসায় ফেরার পথে চোখে পড়লো সেক্স রোবটের দোকানটা।অনেকদিন থেকেই এর প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখে আসছি। মানুষের একাকিত্ব নাকি দূর করে দেবে এই রোবট। এদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও আছে। কৌতুহলের বশেই দোকানে যাওয়া। এরপর সুন্দরী যৌন আবেদনময়ী ক্লারা নামের এক রোবটকে ভালো লেগে গেলো। তা-ই ক্লারাকে কিনে ফেললাম। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেলো। কিন্তু তাতে আমার তেমন গায়ে লাগলো না।
বাসায় ফিরে কুটুকে বিশ্রামের জায়গায় রেখে দিলাম। পাশের ফ্ল্যাটের তরুণী আশা করি আর অভিযোগ করবে না। কুটুকে রেখে আমি ক্লারার কাছে গেলাম। স্টার্ট বাটন চাপ দিয়ে ক্লারাকে চালু করলাম। সত্যি ক্লারা এক অনিন্দ্য রোবট। আমার একাকিত্ব ক্লারা-ই দূর করে দিতে পারবে। ক্লারার সাথে আমি ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছি। এমন সময়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো কুটু মিয়া। কুটুর চোখে বিস্ময়। আমার নিজেরও লজ্জা লজ্জা লাগছিল। শুধু ক্লারা অভিমানের সুরে বললো, আরে, ওতো একটা বিড়াল!
— হুম, বিড়াল। কিন্তু রোবট নয়!
আমি ক্লারার কাছ থেকে উঠে কুটুকে কোলে নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াই। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। জানালা দিয়ে বিশাল সব যান্ত্রিক অট্টালিকা, অত্যাধুনিক যান্ত্রিক যানবাহন দেখি। দেখতে দেখতে কুটুর গা বুলিয়ে দিই।কুটু যেন আমাকে কিছু বলতে চায়।
আজকের এই সভ্যতায় মানুষ এত যান্ত্রিক আর একা যে, মানুষের সংস্পর্শে কোন প্রাণী থাকলে সেই প্রাণীকেও মানুষ তার-ই মত নি:সংগ করে দিচ্ছে। ক্লারা ধীর পায়ে হেঁটে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। মিষ্টি করে হাসলো।তারপর সোফায় বসলো। ক্লারার হাঁটাচলায় আশ্চর্য এক ধরনের আত্নবিশ্বাস ও স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে।যেকোন পুরুষকে মুগ্ধ করার মতই এই সৌন্দর্য। ক্লারার মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
— আমাকে তাই বলে রোবট বলে অপমান করবে?
— এতে অপমানের কী আছে? তুমি তো রোবট-ই। তাই না?
— আমি রোবট এটা তো আমার অপরাধ না, তাই না? আমাকে দেখে কি কোনভাবে বোঝা যায়, আমি রোবট? তাছাড়া আমার বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে।
ক্লারা আসলেই বুদ্ধিমতী। যেমন যুক্তি দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে মানুষের চেয়েও বেশি বুদ্ধি রাখে। আমি কথা খুঁজে না পেয়ে হাসলাম। ক্লারাও হাসি ফেরত দিলো।
— এই বিড়ালের জন্য রোবট বলে আমাকে অপমান করতে পারো না।
ক্লারা যেন কান্না লুকালো। কৃত্রিম বুত্তিমত্তার সাথে এসব রোবটকে মানবিক আবেগও দেওয়া হয়েছে নাকি? রেগে গেলে তো মুশকিল হবে! ক্লারার কান্না দেখে একটু বিচলিতই হয়ে গেলাম। কুটু মিয়া আমার কোল থেকে লাফ দিয়ে জানালার কার্নিস ধরে কোথায় যেন চলে গেল। ক্লারা কাঁদছে, এমন অবস্থায় তার পাশে বসে মান ভাংগানোই হয়ত আমার উচিত। কিন্তু কুটু এভাবে কার্নিস ঘেঁষে কই চলে গেল। কুটুর জন্য টেনশন হতে লাগলো। এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ক্লারা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে দেখলো আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে ডাকলো, এই, কোথায় যাচ্ছ তুমি এভাবে? বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা!
আমি ছুটে চলে গেলাম সেই সুন্দরী তরুণীর ফ্ল্যাটের দরজায়। হয়ত কুটু এখানেই চলে এসেছে। অস্থির হয়ে তার দরজায় ডিজিটাল সংকেত পাঠাতে থাকি। অনেকক্ষণ পর একজন বয়স্ক লোক দরজা খুললো।
— কে আপনি?
— আমি আপনার পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।
— কিন্তু কোন ইনফরমেশন না দিয়ে এভাবে হঠাৎ কেন নক করলেন?
— ইয়ে মানে, মানে..
— কী চান আপনি? এত আমতাআমতা না করে বলুন, কাকে চান?
ওহো, আমি কী করে বলি কাকে খুঁজছি। মেয়েটার নাম যে আমি জানি না!
— এ বাসায় কি কোন pet আছে?
— না, এ বাসায় কোন pet নেই।
— সরি, বিরক্ত করলাম।