পাণ্ডুলিপি থেকে । বীথি সপ্তর্ষি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ, | ১৫০৯ বার পঠিত
বীথি সপ্তর্ষি প্রথম কাব্যগ্রন্থ, দ্বিতীয় বই সাড়ে তিনশ’ বছর। প্রকাশ করেছে চৈতন্য। মূল্য: ১৫০ টাকা। মেলায় স্টল ৫৩৫-৫৩৬ পাওয়া যাবে যাচ্ছে।
দেয়াল
তুমি দাগ টানতে জানো গাঢ় করে
লাশকাটা ঘরে যেমন গভীর করে আঁচড় কাটে ছুরি-কাঁচি।
মানচিত্রের মতো দাগ টেনে আলাদা করতে জানো সীমানা
ইটের পর ইট রেখে তুলে ফেলতে পারো নিশ্ছিদ্র দেয়াল
তুমি বোঝাতে পারো তোমার আলাদা দেশ।
অনুভূতিরা সীমানা পেরুতে গেলে
তুমি গুলি ছুঁড়তে জানো, এক দু্ই তিন।
গুলিবিদ্ধ কত অনুভূতি রক্ত-স্নানে দেয়ালে লেপ্টে থাকে লাল হয়ে
তার হিসেব তুমি রাখো না।
জীবন-মৃত্যুর হিসেব তোমাকে ভাবায় না
এত যে দেয়াল, কাঁটাতারের বেড়া, সীমানা প্রাচীর তুলে রাখো
কত পাখি রোজ বিকেলে সব পেরিয়ে এপার ওপার হয়-
তুমি কি আটকাতে পারো পাখিদের?
গুলি ছুঁড়ে মারতে পারো, এক দুই তিন?
আমাকে নাহয় আটকে রাখো,
আমার ফুসফুস ধোয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড
তোমার গাছেদের নাকে কি যায় না?
একটা সীমান্ত, কাঁটাতার আর ইমিগ্রেশন দিয়ে কি মন আটকানো যায়?
তুমি তো কেবল দাগ টানতে জানো গাঢ় করে
ইটের পর ইট রেখে তুলে ফেলতে পারো নিশ্ছিদ্র দেয়াল
তাতে কী?
তোমার পাখিরা কি এ পাশের সরোবরে আসে না?
পথ
ফেরার কথা বলে পথ হারিয়ে বসে আছি অজোয়িক যুগ থেকে
যে জোনাকি লণ্ঠনের মতো জ্বলেছিল পথ দেখাবে বলে তাকে নেভানো হয়নি।
ফিতের মতো মেপেছি তোমাদের হৃদয় পেরুনো জীবন
আহ্ কি ছোট, অপচয়ে ভেসে যাচ্ছে সব এ বেলা ও বেলা
বহমান হৃৎপিণ্ড বেঁধে রেখেছ নোংরা পোতাশ্রয়ে
তাকে তুলে রাখবে বলে ভুলে গেছ, নোঙর ফেলেছ আলগোছে
প্রাচীন শরীরে নামে ঈশ্বর, পৃথিবীতে নামে না তবু মায়ার সফেন ঢল!
তোমরা কেবলই ঘৃণা কর, জোনাকির আলো গিলে ফেল
নষ্ট কর গাছেদের ঘর, পাখিদের সংসার
ঈশ্বরের কথা ভেবে ভুলে যাও পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকা ক্ষীণ ঈশ্বর
তোমরাও তাই ফেরার কথা বলে পেরিয়ে যাও মহাকাল
কেবল যাও, যেতে থাক
পথ হারালে বুঝে নিও এটাই পথ, মানুষের কোন পথ থাকতে নেই
অরণ্য, সমুদ্র, আকাশ ব্যাপী তার পথ, পথ না হারালে এর সন্ধান পাওয়া যায় না।
আমি ঘরে ফিরি
যখন ক্লান্ত ট্রাফিক সিগন্যাল ছেড়ে
একচালার টিনের নিচে কাঠের বেঞ্চিতে বসে
জুতো খুলে হাত বুলায় পায়ে।
বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় ফেরারি বাসে,
গাঁজার গন্ধ আর লাল চোখ পথচারী দেখে অপূর্ণ কৌতূহল।
উত্তরাধিকার
নাম মনে নেই আমার, বয়স ২২
৬২ হাজার গ্রাম, তার একটি আমার
আমি বুলেটের উত্তরাধিকার।
৭১ এ পিতামহ,
স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে
বুকে জমিয়ে রেখেছিল বুলেট একটা।
আদ্ধেকদিন হাঁটুভেঙ্গে পড়ে থেকে
বিবাগী দুপুরে চললেন সূর্যের পানে,
খাড়া আকাশের দিকে।
থেকে থেকে তখনও স্টেনগান,
টাইপ ফিফটি সিক্স অ্যাসল্ট রাইফেল,
আরপিজির উদভ্রান্তি কপালের নিচে, চক্ষুকোটরে
স্বাধীনতা বড় দামী
কিস্তিতে এখনো শুধছি তার ঋণ
ছোট কুঁড়েঘর, ১৩ ছটাক জমি।
কয়লার বলে জলের স্তর হল মায়ের কপাল
তলাল সমান, তারপর গেল তিনজন
পিতার বুকেও লেগেছিল বুলেট।
মা বলেছিল আমাদের স্বাধীনতা পতাকায়, জাতীয় সঙ্গীতে
বলেনি, স্বাধীনতা সেঁটে থাকে বুলেটেও।
বুকে এসে লাগলেই মুক্তি।
আর আমি মাইনে কিছু চেয়েছিলাম বেশি,
গেল কাপড়ের নকশায় বুলেট-ছাপা রক্ত-মুক্তি
বুলেট, মাকেও দেখে রেখো। চেনোনি, আমি বুলেটের উত্তরাধিকার!
ঘরে ফেরা
আমি ঘরে ফিরি
যখন ভাঙা কাঁচের শহরের শেষ বাসে ড্রাইভার হেল্পার ঝগড়া করে।
প্যাসেঞ্জারের দেওয়া দু’এক টাকা বাড়তে বাড়তে
কনডেন্সড মিল্কের চায়ের দাম হয়,
পাঁচটা বিড়ির চেয়ে দু’চার টাকা হয় বেশি।
ভাগাভাগির টাকার হিসাব মেলে না যখন।
আমি ঘরে ফিরি
যখন রাস্তায় রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের
নষ্ট ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে চাঁদের আলো ঝরে।
ফুটপাতের খালি গা বৃদ্ধ করুণ চোখে তাকায়।
হাঁটি বলে যে ফুটপাথে ঘুমাতে গিয়ে,
আমার জুতোর শব্দে চোখ লাগে না।
আমি ঘরে ফিরি
যখন ক্লান্ত ট্রাফিক সিগন্যাল ছেড়ে
একচালার টিনের নিচে কাঠের বেঞ্চিতে বসে
জুতো খুলে হাত বুলায় পায়ে।
বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় ফেরারি বাসে,
গাঁজার গন্ধ আর লাল চোখ পথচারী দেখে অপূর্ণ কৌতূহল।
আমি ঘরে ফিরি
যখন কড়া লাল লিপস্টিক আর ঝকঝকে ইমিটেশন
ফুটপাতের ওপর বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
যখন রিকশার মোড় খালি হয়ে আসে,
যাযাবর কুকুরেরা সঙ্গী খোঁজে যে যার মতো।
চেনা ঘ্রাণে শান্ত চোখ খুঁজে পায় ছেঁড়া জুতো আর পাটের ব্যাগ।
আমি ঘরে ফিরি
যখন টং দোকানে নিভে আসে কেরোসিনের চুলো,
বাসি কেক আর পচা সবরি কলা ঝোলায় ঢোকে ঘুমোবে বলে।
আমি তখনও হেঁটে চলি ঘরে ফিরব বলে।
মোড়ের চিলেকোঠার আলোটা দপ করে নিভে যায়,
আঁধারে লেখা হতে থাকে না দেখানো গল্পসমগ্র।
আমি ঘরে ফিরি
যখন আমার ব্যাগ ভার হয়ে আসে মাটির গন্ধে,
কাঁচাবাজারের মুরগির গন্ধে।
নাক ভার হয়ে আসে পোড়া মরিচ আর ডাস্টবিনের গন্ধে।
আমি ঘরে ফিরি
অনন্তকাল ধরে হেঁটে হেঁটেও যে ঘরে ফেরা হয় না।
তবুও ফিরি!
মানুষ
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বেদনা জমেছে বিশদ
তার সব ছেনে তুমি এখন বুনছ কামনা
যতটা বেদনা ঢেলে মসৃণ করেছ শিয়র
তার চেয়ে কিছু কম উত্তাপ
এই শীতে গৃহহীন লোকেরা পায়,
তারপর ছেড়ে চলে যায় অন্যখানে, নতুন সন্ধানে।
যে চুমু চেয়ে চেয়ে বহুকাল আগে-
রুমালে জল ঢেলে মুছেছি যোনি ছেঁড়া দাগ,
এঁটো ঠোঁটে চুমু বাকি রেখে,
তারাদের কানাকানি ফুরাল যখন
শোধ দিতে এসে দরজার বাইরে একমনে চাপছ কলিংবেল।
ঘরে নেই কেউ, বারান্দার টবে শুধু ফুলকপির কঙ্কাল।
নির্জন দ্বীপে একা যতবার খুঁজেছি মানুষ
তুমি থেকে গেছ গাছেদের দলে,
আরো বেশি করে গেছ একা,
পাখিদের গলায় গেয়ে গেছ গান।
আগুনের-বিজলীর শিকারীরা সন্ধান পেয়ে
এসেছে তখন সংসারসহ লোকালয়ে নিতে।
তুমি এসেছ তখনি প্রেমপত্র হাতে,
হাঁটুগেড়ে বসে চেয়েছ নি:সঙ্গ মানুষের হাত,
নি:স্ব মরুবন, বেড়ালের চোখ, কুমারীর স্তন।
যাবতীয় রাস্তা ফুরাল, আজ এই রাতই তবু শেষ রাত
এখনই ঘরে না গেলে ঝরে যাবে পৃথিবী অচেতন
মানুষের ভিড়ে এখন তোমারও একা হয়ে যাবার মৌসুম।
‘প্রেমিক অথবা’
একটা সরল রাত্রির মধ্যবর্তী বিরতিতে
তোমার ভাঙ্গা রোদ-অমানিশা পেয়ে বসি প্রায়ই।
তোমার ঢ্যাঙ্গাবেলার পাতা কুড়নো দিন,
বন্ধু হারানো নদীর নাম
নদীতে জমানো সমূহ বিপদ, মামলা পালানো শৈশব-কৈশোর। অথচ তোমার তখনো বয়সই হয়নি—
প্রেমিক কিংবা আসামী হবার। তবু পালিয়ে বেড়াচ্ছ আশৈশব, যৌবনের যাবতীয় রতি-আরতির দোনামনা আর বিভ্রাটে
যুবতী অন্তর্বাস খুলে দিলে
এক প্রহর যদি নিজেকেও ভুলে যেতে পারো,
তবে ওটুকুই তোমার থলের তলানি।
এর বেশি চাইলে জেলার কিংবা নিরুপায় প্রেমিকার কেউই চাবির গোছা হাতে তুলে দেবে না।
সরল রাত্রির ব্যাংকে যা জমিয়েছ আয়ুরেখা ঘেঁষে,
সম্বল যা কিছু আছে তাতে নিজেকেই টেনে তোলো।
পুলিশ আর আবেগী প্রেমিকারা বয়স মানে না
অথচ তখনও তুমি শিশু,
এখনো বয়স বেড়েছে বলে সব বেদনা ভুলে না গেলে
তোমার বুকটা শিশু হয়ে আছে। একটা সরল রাত্রির মধ্যবর্তী বিরতিতে
তোমার বয়স্ক শরীরে শিশু নেমে আসে।
মৃত বন্ধুর অঙ্কের খাতা যত্নে তুলে রাখো।
খাতা-চুরির মামলায় ফাঁসি হয় না বলে তুমি এভাবেই বেঁচে থাকো।
আমিও এইসব ফিকে তারাফুল-জোনাক সাজানো রাত্রির বিরতিতে
তোমার ভাঙ্গা রোদ-অমানিশা পেয়ে বসি প্রায়ই।