একটি অনিশ্চিত ভ্রমণ । শেখ লুৎফর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:১৬ অপরাহ্ণ, | ১৫৪৭ বার পঠিত
সারাদিন তেজিরোদ আর ঘামঝরা গরমের পর সন্ধ্যার ছাই-ছাই গন্ধমাখা পৃথিবীটা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আকাশে পাখির ঝাঁক। হাওরের শেষে ঝিমিয়ে পড়া গ্রামগুলোর উপর একটু একটু করে জমছে অন্ধকার। ঠিক এমনি সময় আকবরের মোবাইলটা হঠাৎ ডেকে ওঠে। ওপাশে শাজাহানের ফাঁকা-ফাঁকা গলা — আকবর ভাই, রাজু ভাইয়ের ভগ্নিপতি কাসেম সাব মারা গেছে।আকবরের বুকটা ধড়াস করে ওঠে। হাত-পা অবশ অবশ লাগে। মুখে ভাষা জুটে না। যেকোনো মৃত্যু সংবাদের প্রথম ধাক্কায় তার এমনটা হয়। তাই সে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে, কখন?
—একটু আগে।
—কোথায়?
—দিরাই বাস-স্ট্যান্ডে।
—কিভাবে?
—হার্টঅ্যাটাক।
আকবরের টাকরায় একটু আগে শেষকরা চায়ের তাজা স্বাদ, ডান-বাঁয়ে তার মেয়ে-বউ। পেছনের রুমে টেবিল-চেয়ার, খাট, আলনা, আলমারিসহ কতকিছু। ছোট ছোট পাওয়া, আনেকগুলো না পাওয়ার জন্য খুব দ্রুত ব্যাত্লা হয়ে যাওয়া অগুনতি সাধ, বেঁচে থাকার দায়-দণ্ডি, ব্যাস্ততা ও নানান আয়োজন আকবরের কাছে কয়েক মিনিটের জন্য মিথ্যা হয়ে যায়! সে আরেকবার জীবন নামক ধাঁধাটার বাস্তবতা টের পায়। তার মনে হয় সকলের পেছনে ছুরি উঁচিয়ে ঝিমধরে হাঁটছে একটা ঘাতক। ছোট্ট একটা ভুল। একটু অসর্তক। পটকা মাছের মতো পটাস করে ফুটু করে দিবে !
এইসব ভাবতে ভাবতে আকবর তার পাশে বসা কন্যাটির দিকে তাকায়। বাপ-বেটির চোখাচোখি হয়। মেয়েটি তার একটা হাত খাবলে ধরে, বাবা…।
মেয়ের চোখে ভয়, শূন্যতা। তাদের চারদিক ঘিরে ফেলা অন্ধকার। সেখানে কাসেমের অদেখা, অস্পষ্ট মুখ খুঁজতে খুঁজতে আকবর ইনক্রিমেন্ট, বোনাস, পদোন্নয়ন, নারী ও যৌনতার কথা ভাবে; ভাবতে ভাবতে অবাক হয়। পাশে বসা কিশোরী কন্যার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কিছুটা যেন শরমও পায়।
আকবর খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে। কাসেম সাহেবের জানাজায় শরিক হতে দূরের শহরে যাবে সে। না গেলেও কোনো দোষ নাই। তার সাথে কোনোদিন লোকটার দেখাও হয় নাই। শুধু ঘনিষ্ট এক বন্ধুর ভগ্নীপতি। তবু সে ঝটপট হাতে তৈরি হয়ে দরজার ছিটকিনি খোলে। বাইরে থিকথিকে কালো। তার মাঝেই ভোরের আলো দুধের সরের মতো জমতে চাইছে। কিশোরি কন্যাটি নিশব্দে এসে তার মায়ের পাশেদাঁড়ায়। আকবর হৃদয় দিয়ে টের পায়, তার পিঠে দুই জোড়া চোখের পরশ। নিশ্বাস চেপে রাখার মতো ঘরের গুমোট ভাবটা টপকে সে বাইরে পা বাড়ায়।
খালি রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে পরে আছে বাসি রাতের ভগ্নাংশ। দুই পাশে সারি সারি রেন্ট্রি গাছ। তাই এখানে ভোরের আলো এখনো অনিশ্চিত। আকবরের মনটা বাঁশের সাঁকোর মতো নড়বড় করে। ব্যালকনিতে স্ত্রী আর সন্তানের মাঝে বসে গরম গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাওরের ভোরটা দেখার লোভ মনে টালবাহানা শুরু করে। তবু ‘কাসেম’ নামটা মাখামাখি আলো-কালোতে তাকে হাঁটতে তাড়া দেয়। শহরে গিয়ে সবার আগে তাকে নাস্তা করতে হবে, এই কথা বেরুবার সময় তার কন্যাটি তাকে বলে দিয়েছে। বোধকরি তাই সে পোয়ারুটি আর সবজি-ডালের কথাটাও একবার ভাবে !
এককিলো দক্ষিণের বাজারে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা মাল বোঝাই ট্রাককে গোঁ…গোঁ…করে আসতে দেখে সে। ভোরের ফাঁকা-ফাঁকা নীরবতায় নোংরা বাজারটাকে উলঙ্গ, অশ্লিল লাগে। সে মনের এইসব অস্বস্তি ও অস্থিরতা তাড়াবার জন্য বেহিতের মতো ছুটে গিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়ায়। দু’হাত উপরে তুলে ট্রাকটাকে থামতে মিনতিমাখা ভঙ্গি করে। তরুণতর চালক মুচকি হেসে ব্রেক টানে। ট্রাকের জানলার কাছে গিয়ে আকবর চিৎকার করে করে নিজের আবদারটা ড্রাইভারকে জানায়, ওস্তাদভাই একটা জানাজায় যাবো, ইচ্ছা হলে নিতে পারেন।
আকবর ভেবেছিল জানাজায় হাতেগুনা লোক-টোক হবে। ঈগাহে এসে দাঁড়ায় সে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছেই। কয়েক মিনিটের মাঝেই চাতালটা উপচে ওঠল! বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। কাউকে সে চিনে না। তাকেও তাই। আশ-পাশের কেউ কেউ অক্ষেপ করছিল, আহ্, ফুয়াডা খুব ভালা আছিল।
ছেলেটা আবার হাসে। তার ব্যাংক থেকে কিস্তিতে লোন নিয়ে ছেলেটা এই মিনি ট্রাকটা কিনেছে। তাই ড্রাইভার দরজার ছোট জানালা দিয়ে গলা বের করে। রাতজাগা লাল লাল চোখে— খুনির মতো কড়া নজর। তবু সে একটা শুকনা হাসি দিয়ে বলে, আমি জগন্নাথপুর পর্যন্ত যাইমো স্যার।
—তাই সই…
বলে আকবর এক ঝটকায় উঠে চালকের পাশে বসে।
অস্থিরতার জন্য কোনো কিছুই লক্ষ করেনি সে। এবার স্থির হয়ে বসতেই মেঘে ছাওয়া আকাশ আর গোমড়া দুনিয়াটা চোখে পড়ে। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। কাসেম সাহেবকে আকবর একদিনও দেখেনি। কিন্তু তার কথা রাজু আর শাজাহানের মুখে বহুবার শুনেছে। খুব ব্যস্ত মানুষ। ঠিকাদারি-ফিকাদারির জন্য সারাদিন খালি নাকি ছুটাছুটি করতো। নানান জাগায় নানান সাইড, কোটি কোটি টাকার কাজ। সব ফেলে লোকটা ধ্বপাস করে শোয়ে পড়লো!
ট্রাক এখন বাজার ছাড়িয়ে মাঠের দিকে। দুপাশে দুটো হাওর। বাতাসে পানির তাজা গন্ধ। বেঁচে থাকার তৃপ্তিতে বেহিসাবি মানুষের মতো আকবর বড় করে একটা শ্বাস টানে। ব্যাংকের চেয়ারে বসে দিনের শেষে ‘ডেবিট-ক্রেডিট’ লেখার মতো করে সে কাসেম সাহেবের শতভাগ সংসারি জীবনটা দুই-এক বাক্যে বুঝে নেয়। যার অর্থ, বেঁচে থাকতে লোকটা তার জীবনটাকে হিরো হোন্ডার মতো ছুটিয়েছে।
জগন্নাথপুরের পৌর পয়েন্টে নামবার আগেই শুরু হয় টিপটিপ বৃষ্টি। আকবর অপেক্ষা করে। লাইনের প্রথম খেপ সাড়ে সাতটায়। জানাজা আটটায়। তাই বিকল্প ছাড়া কোনো পথ নাই। আকবর উদাস হয়ে অপেক্ষা করে। একটু পরেই একটা মিনি ট্রাক হেলেপড়া ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ায়। ওস্তাদ ডালা খুলে লাফ দিয়ে নামে। আশ-পাশ একবার নজর বুলায়। তারপর দুই দালানের চিপায় দাঁড়িয়ে পেশাব করে। এই ফাঁকে আকবর ট্রাকের দরজার পাশে চলে আসে। ওপাশে পেশাব আছড়ে পড়ার শব্দ নেতিয়ে এসেছে। ওস্তাদ প্যান্টের চেন টানতে টানতে ফিরে আসে। আকবরকে তার গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকায়। সে ছোট্ট করে বলে, আমাকে নেবেন ? একটা জানাজা ধরতে হবে।
—কোয়াই যাইতা ?
—সুনামগঞ্জ।
নির্ঘুম চোখ আর ভাঙাচোরা গালে একটা বিস্বাদ ভঙ্গি করে লোকটা বলে, উটৌক্ক্যা।
দুপাশে হাওর। ছাতিম-জারুল-হিজল আর এ্যকাশিয়া-রেনট্রির ফাঁকে ফাঁকে ভরা হাওরের ঢেউ। ঘাস, লতাপাতা, পানির আঁশটে গন্ধ আর ট্রাকের ঝাঁকুনিতে আকবরের মাথাটা বুকের কাছে নেমে এসেছে। সে ঝিমায়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ঘুমায়। কখনো ঘুম জড়ানো চোখে চারপাশটা দেখে : মাইলকে মাইল একঘেঁয়ে হাওর। কলকলি, ভাতগাঁও, ভমভমী, আক্তাপাড়া, ছ’আড়া, ডাবর…। আকবর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নামগুলোর মানে বুঝতে চেষ্টা করে। ট্রাকের শক্ত ঝাঁকিতে মাঝে মাঝে আকবরের এইসব স্বপ্ন স্বপ্ন আবেশ কিংবা চিন্তাগুলো টুটাফাটা হতে হতে এক সময় ট্রাকটা ‘দেখার হাওর’ এলাকায় এসে পৌঁছায়। উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষে চুপচাপ দর্শকের মতো মেঘালয়ের পাহাড়। মাইলকে মাইল হাওর শরীর পেতে দেওয়া প্রিয়তমার মতো বৃষ্টিতে ভিজছে!
বাড়িটাতে যখন আকবর পৌঁছায় তখন তার পাশে বন্ধু শাজাহান। ছোট-খাট ভীর ঠেলে তারা মৃতের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লাশ বারান্দায় এনে এইমাত্র রাখা হয়েছে। একজন ছোট ছোট দুটো ছেলে- মেয়েকে মৃতের সিথানে এনে বললে, আমার ভাতিজা-ভাতিজিরে একটু দেখাও। আকবরের সরে পড়তে ইচ্ছা করছিল। এইসব দৃশ্য দেখলে তার কাছে সব কিছু খালি খালি লাগে। কালো কাপড় আর দড়ি হাতে জল্লাদের কথা বারবার মনে পড়ে। তখন অফিসের কুনি-মারামারি কিংবা প্রায় প্রেমিকা হয়ে ওঠা মহিলা কলিগদের সাথে ঠাট্টা-মস্কারা করতে ভালো লাগে না।
আকবর দূর থেকে শিশু দুটুকে পরখ করে : তাদের বোকা বোকা শরীরের ছোট ছোট হাত-পায়ে যেন শিকলের ভার! চোখের কোনায় জমে ওঠা কালো ছায়াটাকে আকবর মন দিয়ে ঠাহর করে। জীবন নামক আলোর বিন্দুটাকে তালাশ করে। কিন্তু ভীড় আর দূরত্বের জন্য দেখাটা পস্ট হয় না। মনে মনে ভাবে; মানুষটা ধ্বপাস করে মরে গেলো! আকবরের ভেতর কে যেন চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে : নিশ্চয়ই না। সে বেঁচে থাকবে তার সন্তানের মাঝে। আজকের দূর্বল বালক এই সমস্ত প্রতিকুলতা আর স্বজনদের হীন স্বার্থের চক্রান্ত ছিন্ন করে একদিন বড় হবে। নিষ্ঠুর কিন্তু সুন্দর এই সংসারটাকে একটু একটু করে চিনবে। সৃষ্টির সুখ আর ধ্বংসের পাপিষ্ট বিকার তাকে জনমভর দৌঁড়াবে।
আকবর ভেবেছিল জানাজায় হাতেগুনা লোক-টোক হবে। ঈগাহে এসে দাঁড়ায় সে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছেই। কয়েক মিনিটের মাঝেই চাতালটা উপচে ওঠল! বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। কাউকে সে চিনে না। তাকেও তাই। আশ-পাশের কেউ কেউ অক্ষেপ করছিল, আহ্, ফুয়াডা খুব ভালা আছিল।
একজন বললো, অসুখের সময় আমারে চিকিৎসার লাগি পয়সা-পাতি দিছিল।
আকবর বুড়োর দিকে তাকায়। আশি ছুঁই-ছুঁই। কপালের কুঁচকানো বলিরেখায় শেষ জীবনে দুর্ভোগের আভাস। চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা আর দু’ফোঁটা জল। মমতার, ভালোবাসার। ওয়ান টাইম গ্লাসের মতো এই জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে বুড়ো লোকটার মতো আকবরের চোখেও পানি জমে ওঠে। এবং কেউ দেখে ফেলার আগেই সে চট করে চোখটা মুছে নেয়। কারণ ভালোবাসর মতো কান্নাও একটা সংক্রামক রোগ।