নৈরাজ্য নেই রাজ্য । অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০১৮, ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ, | ১৯৩০ বার পঠিত
১.সুরঞ্জন ছেলেটা কেমন খ্যাপাটে ধরণের! হৈমন্তীর সাথে যখন প্রথম পরিচয় হয়…টি.এস.সি.র ক্যাফেতে অনেক বন্ধু-বান্ধবীর ভেতর সেদিনই প্রথম নতুন আসা এই ছেলেটি বলে বসলো, ‘আমি সুরঞ্জন দাস। কেমিস্ট্রি সেকেন্ড ইয়ার। আমি একজন নৈরাজ্যবাদী।’
বিরক্ত লাগে হৈমন্তীর।
‘সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়ো তখন তোমাকে তুমি করেই বলি। নৈরাজ্যবাদী বলতে তুমি কি বোঝ বা কি বোঝাও? আমার বড় বাবা বলতেন ‘নৈরাজ্যবাদ’ পুঁজিবাদী সমাজেরই একটা ফ্যাশন।’
‘বড় বাবা?’
বন্ধু-বান্ধবীরা অনেকেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
‘বড় বাবা নয়? মায়ের বাবার বাবার বাবা। সোজা কথায় আমার নানার বাবা আর কি! উনি কমিউনিস্ট ছিলেন।’
‘আপু– কমিউনিজম ত’ ফল করেছে! নৈরাজ্যবাদ ছাড়া উপায় কি? সুরঞ্জন– গুছিয়ে বল্ না হৈমন্তী আপুকে– আমাদের যেমন বলিস!’
সুরঞ্জনের ক্লাসমেট হাবিব বলে।
সুরঞ্জন মুচকি হেসে বলতে থাকে, ‘নৈরাজ্য মানে নেই রাজ্য। ঐ যে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে না- আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে? গানে দ্যাখেন আপু– রাজা সবারে দেন মান/সে মান আপনি ফিরে পান/মোদের খাটো করে রাখে নি কেউ কোন অসত্যে। কিন্তÍ, রাজা যদি মান না দেন? যদি অসত্যে খাটো করে রাখেন আমাদের? তখন করণীয় কি?’
‘করণীয় কি?’
হৈমন্তী মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিধ্বনি করে।
‘তখনই নেই রাজ্য– রাজা ভাল না হলে আমরা নিজেরাই হাতে রাজ্য নিয়ে নেব। পুলিশী আইন-কানুন মানব না। আমার সহপাঠীকে বাস চাপা দিলে আর তার কোন বিচার না হলে. মন্ত্রী পদত্যাগ না করলে স্কুলের বাচ্চা ছেলে–মেয়েরা যেমন আজ দু’দিন হয় পথে নেমে এসেছে– গাড়ি বা সব ধরণের যানবাহনের লাইসেন্স চেক করছে, মোবাইল বা ভিডিও গেমসের এ্যাপস থেকে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে, রিক্সার জন্য আলাদা লেইন করছে, ভিআইপিদের গাড়ি আটকে দিচ্ছে, গোটা ঢাকায় সড়ক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনছে– কোন রাজা নেই– আমরা নিজেরাই আইন তুলে নিয়েছি হাতে–’
‘কিন্তÍ এভাবে কতদিন চলবে? এভাবে কি বেশিদিন চলতে পারে? বাচ্চারা কতদিন এভাবে পারবে?’
‘যে ক’দিন চলে– এরপর যদি বাচ্চাদের উপর দমন–পীড়ন আসে– তখন দেখাই যাবে কি হয়!’
হৈমন্তীর মাথায় কেমন জট পাকিয়ে যায়। গত দু’দিনে এই তার শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠা অবধি তেইশ বছরের এত চেনা শহরটাকে এতটা ভিন্ন চেহারায় সে যেন কখনো দ্যাখেনি। কিছু একটা হচ্ছে যা এতদিনের চেনা সবকিছু থেকে একদম আলাদা অথচ এত সুন্দর– এত প্রবল সুন্দর যে তার উপমা দেবার মত যথেষ্ট শব্দই যেন তার শব্দভান্ডারে নেই। হৈমন্তীর সহপাঠী, এক/দু’ক্লাস উপরের বা নিচের বিভিন্ন বিভাগের ছেলে-মেয়েরা– হোক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় বা ধানমন্ডি এলাকায় বাসার কারণে আশপাশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুখ চেনা, ফোনে-ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবী বা বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীরা সবারই অনুভূতিটা এক। একটা কোন ঘোর লাগা রূপকথা সময়ের ভেতর দিয়ে তারা চলেছে– কি যেন একটা হবে, নতুন কিছু একটা দানা বাঁধছে বা বাঁধবে– যেন অন্ধকার আকাশে সম্মিলিত নীহারিকাপুঞ্জের সহসা প্রবল বিষ্ফোরণ হবে– সহ¯্র কুসুমের ফুটে ওঠার মত ভয়াবহ সুন্দর এক বিষ্ফোরণ– কেমন হবে সে রূপবাণ প্রলয় তা’ হৈমন্তী এখনো জানে না! ঠিক এমন সময়েই সন্ধ্যার আজান পড়ে আর রোগা–পটকা, চোখে পুরু কাঁচের চশমা আর কদম ছাঁট চুলের সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে একত্রিশ জুলাইয়ের সন্ধ্যায় টিএসসির আড্ডা থেকে উঠে পড়ে হৈমন্তী। আজ দু’দিন হয় রাস্তা-ঘাট ফাঁকা ফাঁকা– যেন ঈদের সময়ের ফুরফুরে আবহ! হৈমন্তীর পেছন পেছন আসে রশিদ- ওর ক্লাসমেট ও বেস্ট ফ্রেন্ড।
‘এই সুরঞ্জন ছেলেটা কিন্তÍ বেশ ব্রিলিয়্যান্ট, না? ভাব্– আমাদের দুই ক্লাস নিচে পড়ে অথচ কি দারুণ বিশ্লেষণ!’
রশিদও হৈমন্তীর সাথে জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে পড়ছে।
‘একটা কথা বল্ তো– গত দুই দিন তুই সবসময় আমার সাথে ছায়ার মতো ঘুরছিস ক্যানো? আগে ত’ ঘুরতি না!’
‘মানে শহরে এখন যা অবস্থা কখন কি হয়?’
‘দূর– আমি ত’ কোন মেয়েই না। আমাকে নিয়ে কিসের ভয়?’
‘মেয়ে না মানে?’
‘হা-হা- মেয়ে না মানে আমি এই লম্বা আর হ্যাংলা-পাতলা- আমাকে কতজন ছেলে বলে গুলিয়ে ফ্যালে! মা ত’ প্রায়ই বলে যে কবে আমি মেয়েদের মতো দেখতে হবো?’
‘তাই বলেন বুঝি?’
‘বলে না? সত্যি রে– আমি মা’র মতো সুন্দরী হতে পারতাম! মা-ও অনেক লম্বা তবু কত নারী নারী! কেমন ধবধবে সাদা– আমি ত’ বাবার মতো হয়েছি।’
‘কি রে তুই- এই সন্ধ্যাবেলায় চেহারা নিয়ে মন খারাপ করছিস? এমন ত’ আগে দেখি নাই!’
‘না– দেখতে দেখতে বয়স তেইশ বছর হইলো কিনা– মা’র ত’ চব্বিশ বছর বয়সে বিয়া হইছে। মা খুব টেনশন করে। আমি এত শুকনা আবার কাইল্যা যে আমার বিয়া হবে কিনা, বুঝলি?’ বলেই সশব্দে হাসে হৈমন্তী।
দু’জনেই পাশাপাশি সাইকেল চালাতে চালাতে কখন যে ফাঁকা ফাঁকা এই অলৌকিক নগরীতে দিব্যি টিএসসি ছাড়িয়ে ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকায় চলে এসেছে তা’ খেয়ালই করেনি।
‘মাথা গ্যাছে একদম। এই– আজ আর তোদের বাসায় না যাই? এইটুকু রাস্তা একা যেতে পারবি না?’
‘খু-ব পারবো। বা-ই!’
‘আসলে ক্লান্ত লাগছে, বুঝলি?’
‘ক্লান্ত লাগবে না? আমি ত’ বাসা থেকে বের হয়েছি দুপুরের পর। তুই ত’ সকাল থেকেই আজ ক্যাম্পাসে।’
‘সেইটাই– আসি রে দোস্ত!’
‘দুপুর তিনটায় বের হয়ে এই বাসায় আসা হলো? আমি ত’ টেনশনে শেষ। তোর বাবা এখনো অফিসে।’
মা দরজা খুলে দিতে দিতে গজগজ করে। আসলে হৈমন্তীকে নিয়ে মা’র কত যে চিন্তা! মাথায় এত লম্বা মেয়ে তবে কিনা হাজার খেলেও গায়ে কিছু লাগে না। বড় হচ্ছে না বুঝি মেয়ে? জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে সম্মান শেষ করে সামনে ¯œাতকোত্তরে উঠবে। এখনো কেমন বালক বালক কিশোর কিশোর চেহারা। হৈমন্তী বনানী হক। একদম ছোটবেলায় কেজি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার নাম নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা আর সহপাঠীরা অবাক হতো।
‘তোমার নামটা কেমন হিন্দুদের মতো শুনতে! কে রেখেছে?’
আরো বেশ খানিকটা বড় হতে হতে– ‘ও’– লেভেল শেষ করে ‘এ’-লেভেলে উঠতে উঠতে ক্লাসমেটরা কেউ কেউ সহসাই চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে বা করতো, ‘এই তোমার মা কি হিন্দু ছিল?’
‘ক্যানো বলো ত’?’
‘না– তোমার নামটা–’
হৈমন্তী কথা বাড়ায় না বা বাড়াতো না। অনেক কথা বলতে হয় যে তবে! সবসময় বুঝি এত কথা বলা যায় না বলতে ভাল লাগে? হৈমন্তীদের পরিবার যে এমনি। ‘বড় বাবা’ মানে মা’র নানার বাবা ছিলেন বড় কমিউনিস্ট নেতা। বৃটিশ আমল থেকে বড় বাবা জেল খেটেছেন। প্রায় আঠারো বছর জেল খেটেছেন বৃটিশ আর পাকিস্থান আমল মিলিয়ে। রেলওয়ের শ্রমিক নেতা ছিলেন। সহজ মানুষের মেঠো ভাষায় তাঁর বক্তৃতায় সাম্যবাদের কঠিন তত্ত্ব এত জোরালো ভাবে বলতেন যে কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা নেতাদের বক্তৃতা শুনতে গিয়ে শ্রোতারা যখন ঝিমিয়ে বা ঘুমিয়ে পড়তো, বিশ জন শ্রোতার আরো পাঁচ জন উঠে যেত- তখন হৈমন্তীর বড় বাবা করিম উদ্দিন মন্ডল বক্তৃতা শুরু করলেই পাঁচ/দশ হাজার কৃষক-শ্রমিকের জমায়েত অনায়াসে তৈরি হয়ে যেত: ‘ভদ্রলোকদের দিয়ে হবে না। আমার মতো দাদওয়ালা, পা–ফাটা, হাতুড়ি পেটা, শাবল চালানো, বয়লার মারা, চাষা–ভূষা, শ্রমিক–মেহনতি মানুষ যতদিন দলে না আসবে ততদিন হবে না। এরাই বিপ্লব করবে, এদেরই বিপ্লব দরকার, ভদ্রলোকের না।’
বড় বাবা বহুদিন বেঁচেছিলেন। আয়ুর জোর ছিল তাঁর। এই ত’ সেদিনও কিশোরী হৈমন্তী বড় বাবার হাত ধরে জনসভায় গেছে। ডায়াসের সামনে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বড় বাবা বলছেন, ‘দরখাস্ত করে, হুজুরের পানিপড়া দিয়ে, শ্লোগান দিয়ে এই সমাজ একচুলও বদলানো যাবে না। সমাজতন্ত্র ছাড়া কৃষক–শ্রমিক–মেহনতি মানুষের ভাগ্যও বদলাবে না। চল্লিশের দশক থেকে এখনো যারা ক্ষমতায় আসছে বা এসেছে, তারা বড় লোকের, জোতদারের ও মহাজনের সরকার। এরা শ্রমিকের ভাল দেখবে না। শ্রমিকের রাজনীতি বুঝে, অঙ্ক করে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে এই সমাজ ভাঙ্গতে হবে এবং ভাঙ্গিতেই হবে। শ্রমিককেই লড়াই ও বিপ্লবের মাধ্যমে এ্্ই বড় লোকের সমাজ ভেঙ্গে তার নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি কমিউনিস্ট এবং এখনো এই রাজনীতিই আমার রাজনীতি। আমি এটা করছি পেটের যন্ত্রণায়, ক্ষুধার তাড়নায়, বাঁচার জন্যে এবং অন্যকে বাঁচানোর জন্য। এই হাত দিয়ে ব্রিটিশকে গুলি করেছি, পাকিস্তানীদের মেরেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি– আজো আমি এই সমাজ ভাঙ্গার জন্য কাজ করছি। তোমরা না ছাত্র! তোমরা না যুবক! তোমাদের ভয় কিসের? শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ গ্রহণ করে আর নিজের সুখ–দু:খ ত্যাগ করে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সমাজ ভাঙ্গার লড়াই করতে হবে।’
চোখের সামনে দেখতে দেখতে সমুদ্রের মত ফুঁসে উঠছে মানুষ। শ্লোগানে ফেটে পড়ছে তারা। অথচ, বড় বাবার স্কুল-কলেজের লেখা–পড়া বলতে বিশেষ কিছুই ছিল না। এমন বড় বাবার সাথে তাঁর চলে যাবার আগের দিনগুলোয় কিছু বেয়াদবিও করেছে হৈমন্তী।
‘গোটা সোশ্যালিস্ট ব্লক ভেঙ্গে পড়লো তাসের ঘরের মত– তুমি কি করে নিশ্চিত যে এরপরও তোমরাই ঠিক?’
বড় বাবা অসহায়ের মত হাসতেন, ‘ওরে পাকা বুড়ি– যত কড়া কথা বলিস না কেন– আমার মন বলে একটা সময় তুুই মানুষের জন্য পথে নামবি। কাজ করবি, লড়াই করবি আমার মত করেই।’
মা প্লাবণী শ্বাস ছাড়েন। নানা ভাইয়ের কথা বোধ করি সত্য হতে চলেছে। হৈমন্তী তবে শেষমেশ নানা ভাইয়ের পথেই হাঁটা শুরু করলো? ছোটবেলা থেকে নানা ভাইয়ের কাছে সেই স্বদেশী আন্দোলনের গল্প, পাকিস্থান আমলে জেল খাটার গল্প শুনে সে বড় হয়েছে। সেই যুগে মুসলিম যুবকেরা স্বদেশী আন্দোলন সাধারণত: করতো না। নানা ভাই কিন্তÍ করতেন। আর সে নিয়ে কিশোর বয়স থেকেই বৃটিশের জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে।
‘না’– মাথা ঝাঁকিয়ে বলতো হৈমন্তী, ‘আই এ্যাম এ্যান ইংলিশ মিডিয়াম স্টুডেন্ট। এ লেভেল করে ভাল সাবজেক্টে পড়বো। বিদেশে যাব। কেরিয়ার করবো। তোমাদের পথ একেবারেই ঠিক ছিল না।’
মা বকতো আড়ালে, ‘বুড়ো মানুষটাকে তোর এত কষ্ট না দিলে হয় না হৈমন্তী?’
বড় বাবা কখনো শুনে ফেললে হাসতো, ‘ও যত যা-ই বলুক না কেন, আমার পথেই আসবে একদিন।”
তাই কি হচ্ছে তবে? নয়তো হৈমন্তীর কি হলো যে বাসের চাপায় ঐ দু’জন স্টুডেন্টের মৃত্যুর খবরের পর থেকে সে এত অস্থির হয়ে গেল কেন? কেন তার পড়ায় মন বসছে না? রোজ বিকেল হবার আগেই সে কেন সাইকেল সহ একজন ছেলে সহপাঠীকে নিয়ে পুরো শহরের খোঁজ নিতে আর চক্কর দিতে বের হয়ে পড়ছে?
২. ‘নিহিলিজম’ শব্দটি প্রথম ফ্রেডরিখ হেইনরিশ জ্যাকোবি (১৭৪৩–১৮১৯) ব্যবহার করেন (১৭৪৩–১৮১৯)। যুক্তিবাদ ও ইমানুয়েল কান্টের কাজ নিয়ে আলোচনার সময় জ্যাকোবি এই শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন। ফিকেটের আইডিয়ালিজম নিহিলিজমে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এমন একটি চিঠিতে প্রথম জ্যাকোবি এই শব্দটির ব্যবহার করেন।
তবে ইভান তুর্গেনিভের পিতা ও পুত্র’ উপন্যাসের মাধ্যমে নিহিলজম শব্দটি প্রথম ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যেন বা এই উপন্যাসের হাত ধরেই গোটা রাশিয়ায় নিহিলিস্ট বা নৈরাজ্যবাদী হয়ে ওঠে ‘পিতা ও পুত্র’ উপন্যাসের নায়ক বাজারভের মতো।’
‘নৈরাজ্যবাদী’র ইংরেজি প্রতিশব্দ যে ‘নিহিলিজম’ সেটা হৈমন্তী জানত। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি টো টো করার পর আজ দুপুর অবধি সে বাসায় বিশ্রাম নেবে। রশিদ আসবে দুপুর তিনটার পরে। সুরঞ্জনের বলা ‘নৈরাজ্য নেই রাজ্য’ শব্দবন্ধটি থেকে থেকে তার মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে। কাজেই আজকের দিনে সব জ্ঞানের সহজ পথ গুগলের শরণাপন্ন হওয়া।
‘তোরা আসলে কি করতে চাচ্ছিস হৈমন্তী?’
মা কখন যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে!
‘জানি না–’
‘বাসের চাকায় চাপা পড়ে দু/দু’জন কলেজ ছাত্র মারা গেল। তবু কোন বিচার নাই। এই আন্দোলন খুবই ন্যায়সঙ্গত। তবু এই সরকার ফল করলে যদি তোকে-আমাকে হিজাব পরতে হয়? আমরা মেয়েরা যদি আর কাজে না যেতে পারি?’
‘মা– তোমরা সারা জীবন সিপিবি করেছো। আমরা আওয়ামি লীগকে অনেক সহ্য করি– সবকিছুর পরও মেনে নিই। তাই বলে এমন আর কতদিন চলবে বলো ত’? এটা একটা জুজুর ভয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে নাতো? ’
মা প্লাবণী একটু দমে যান। মেয়েকে কি বলবেন বুঝতে পারেন না।
কলিং বেলে শব্দ হয়। রশিদ এলো কি?
‘বের হচ্ছি মা– এই সময়টা আমি ঘরে থাকতে পারব না।’
‘যা– আমি কি তোকে নিষেধ করেছি?’
মা প্লাবণী শ্বাস ছাড়েন। নানা ভাইয়ের কথা বোধ করি সত্য হতে চলেছে। হৈমন্তী তবে শেষমেশ নানা ভাইয়ের পথেই হাঁটা শুরু করলো? ছোটবেলা থেকে নানা ভাইয়ের কাছে সেই স্বদেশী আন্দোলনের গল্প, পাকিস্থান আমলে জেল খাটার গল্প শুনে সে বড় হয়েছে। সেই যুগে মুসলিম যুবকেরা স্বদেশী আন্দোলন সাধারণত: করতো না। নানা ভাই কিন্তÍ করতেন। আর সে নিয়ে কিশোর বয়স থেকেই বৃটিশের জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে।
৩. ‘আজ সারা দিনে শহরের আপডেট কিরে?’
‘মীরপুরে নাকি স্টুডেন্টদের পুলিশ খুব পিটাইছে।’
রশিদ সিগারেট টানছে।
‘আজ আমরা কোনদিকে যাব প্রথমে?’
‘প্রথমে চল মোহাম্মদপুর টাউনহলের দিকে যাই।’
‘চল।’
টাউনহলের সামনে গিয়ে সেই গত ক’দিনের একই পরিচিত দৃশ্য। স্কুল-কলেজের বাচ্চারা সব ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে।
‘ভাইয়া– আপুরা– তোমরা বাসায় ফিরবা না?’
‘না– আর বিচার নিয়া ফিরবো।’
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ড্রেস পরা একটি মেয়ে নিরাবেগ মুখে বলে।
‘বাচ্চাগুলা সব বারুদ হইয়া ফুঁসতেছে। বাড়ি ফেরার কথা বললেও রেগে যাবে– ওরা তোকে শত্রু মনে করবে।’
রশিদ হৈমন্তীর কাণে ঝুঁকে ফিসফিস করে।
‘জাস্ট ওদের স্পিরিটটা বোঝার চেষ্টা করলাম আর কি। এদিকটা ত’ দেখলাম। এখন কোথায় যাওয়া যায়?’
‘শান্তিনগর যাই চল্।’
তাই হলো। আসাদ গেট থেকে কারওয়ানবাজার, বাংলা মটর পার হয়ে এক ফাঁকা ঢাকায় দুই বন্ধু পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে দ্রুতই পৌঁছে গেল শান্তিনগর। পথে কাকরাইল অবধি ছেলে-মেয়েরা ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছে। তবে শান্তিনগর পৌঁছানোর পর নটরডেম কলেজের ছেলেদের সাথে দেখা হলো। রশিদ নিজেও ছিল নটরডেমিয়ান।
‘পুলিশ মতিঝিলে স্টুডেন্টদের রাস্তায় বসতে দিচ্ছে না। মাইরের উপর রাখছে ভাইয়া!’
নটরডেমের ছেলেরা বললো।
‘ওহ্– মতিঝিল যাওয়া যাবে না?’
রশিদ যেন একটু হতাশ হয়।
‘চল তবে আবার শাহবাগ যাই?’ হৈমন্তী বলে।
‘সত্যি কথা বলতে এতক্ষণ ভয় লাগছিল না। এখন কিন্তÍ তুই পাশে থাকায় তোকে নিয়েই একটু ভয় ভয় লাগছে।’
‘কেন– তুমি কি আমাকে নারী মনে করিতেছো?’
‘না– ঠিক তা’ না!’
‘চারপাশে এত সুন্দরী সব সত্যিকারের নারী রাস্তায় আন্দোলন করিতেছে আর তুমি কিনা আমাকে লইয়া ভয় পাইতেছো?’
হৈমন্তী খিকখিক করে আবার হাসে। এবার রশিদের মুখেও হাসি ফোটে। দুই বন্ধু মিলে সায়েন্স ল্যাবরেটরী অব্দি এসে দ্যাখে ছাত্র আর পুলিশ সবাই কেমন টগবগ করছে। সাধারণ ছাত্ররা রাস্তার ডিভাইডার থেকে রড তুলছে আর বাঁশ ভাঙ্গছে। সামনে আওয়ামি লীগ অফিসের দিকে যাবার প্রস্তÍতি নিচ্ছে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। ওমা– দুপুর তিনটায় না তারা মাত্র বাসা থেকে বের হয়েছিল? এর ভেতর শহরের এতগুলো পয়েন্ট চক্কর দিয়ে আবার ফিরতেও পারলো? সায়েন্স ল্যাব থেকে লালমাটিয়ায় বাসা ত’ খুব দূরে নয়।
‘আল্লাহ্– আমার ঐ মেয়েগুলারে নিয়া খুব ভয় হচ্ছে।’
‘কাদের কথা বলছিস?’
‘ওদিকে দ্যাখ!’
রশিদের তোলা আঙুল খেয়াল করে হৈমন্তী দেখল পপুলার ডায়াগনোস্টিকের সামনে দশ-বারোটি মেয়ে সহ জনা ত্রিশেক ছেলে দাঁড়ানো।
‘ঠিকই বলছিস।’
‘এখানে দাঁড়ায় থাকাটা রিস্কি লাগতেছে। চল্- রাইফেল স্কোয়ারের দিকে যাই।’
রাইফেল স্কোয়ারের দিকে এগোতে গিয়ে হৈমন্তী আর রশিদ দেখতে পেল হেলমেট পরে এদিকে এগিয়ে আসছে অনেকে। তাদের ঠিক মুখোমুখি ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট সহ বেশ কিছু বাম ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা। এদিকে কলেজের ড্রেস পরা ছাত্ররা অনেকে রাস্তায় শুয়ে পড়ছে।
‘পরিস্থিতি বেশ জটিল রে হৈমন্তী– কিছু পুলিশ আছে সিভিলিয়ান ড্রেস পরা। স্টার কাবাবের সামনে থেকে সরকারী বাহিনী পজিশন নিছে।’
‘তবে?’
‘সিভিলিয়ান ড্রেসে পুলিশ কিন্তÍ ধীরে ধীরে এসে ছাত্রদের ঘেরাও করে ফেলতেছে। এখনি একটা প্রচন্ড মার-পিট শুরু হবে। চল্– তোকে বাসায় রেখে আসি!’
‘পালাব?’
‘এত বীরত্ব করে লাভ নাই! বাজে প্রায় ছয়টা। তুমি এখন বাসায় যাবা–’ রশিদ সহসা চেঁচিয়ে ওঠে।
রশিদ চেঁচাতে না চেঁচাতে রাইফেল স্কোয়ার থেকে জিগাতলায় ইন্ধিরা গান্ধি সেন্টারের সামনে অব্দি রাস্তার লাইটগুলো হুট্ করে নিভে গেল।
‘আল্লার দোহাই লাগে– এবার চল্ হৈমন্তী!’
৪. বাসায় ঢুকতে মা’র মুখ থমথমে।
‘এই আসলি? তিনটায় বের হয়ে এখন প্রায় সাতটা! কি অবস্থা শহরের?’
‘মা– শহরের অবস্থা ত’ ভাল না।’
‘ভাল না যে জানা কথাই- তবে আজ আবার গলির মোড়ে টেইলরিংয়ের দোকানটায় গেছিলাম কয়েকটা ব্লাউজ বানাতে দিতে। ওরা বললো–’
‘কি?’
‘ওরা বললো বছরের এই মাঝামাঝি সময়ে স্কুল ড্রেসের চাহিদা বেড়েছে। এবং ড্রেসগুলোর মাপ বড়দের গায়ের মাপে। ছাত্রদের নাম করে বড়রাও ঢুকে পড়ছে।’
‘তুমি বিএনপি-জামাতের কথা বলবা ত’? মা– তারা ত’ খারাপই। তবে মোহাম্মদপুর টাউনহলের সামনে থেকে আসাদ গেট হইয়া ঐ কাওরান বাজার, বাংলামটর থেকে শান্তিনগর, মতিঝিলের কাছ থেকে আবার সায়েন্স ল্যাবরেটরি হইয়া বাসায় আসতে আসতে গোটা শহরটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যেকোন সময় যুদ্ধ শুরু হবে। সিভিল ওয়্যার শুরু হবে– গৃহযুদ্ধ লাগবে এমন মনে হচ্ছিল। মা– তোমার কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সরকার কেন একটা করাপ্ট মন্ত্রীকে বিদায় করে না?’
…তীব্র হুইসেল বাজছে কোথাও। খুব কাছে ঘনিয়ে আসছে একটি পুলিশের গাড়ি। তুহিনের কি হলো সেটা না দেখেই ওরা তিন বান্ধবী প্রবল ছুট লাগায়। একটি চোরা গলিতে ঢুকে পড়ে হৈমন্তী। সেখানে একটি বাসার দরজা খোলা। বাড়িটার ভেতর ঢুকতে গেলে বাড়ির মানুষেরা আপত্তি জানায়।
মেয়ের সব যুক্তিই বোঝে প্লাবণী। তবু ঘাড় নেড়ে জেদি সুরে উল্টো কথা বলে, ‘তোর ফেসবুকে গতকাল যে ছেলে-মেয়েদের ছবি দেখলাম তাদের ভেতর দু’টো মেয়ে দেখলাম হিজাবি। জামাতি-বামাতিদের সাথে মিশে তোর মুখের বাংলাও যা তা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।’
‘মা– আমাদের মাশরুরের বাবা জামাত করতো সত্যি। ওর বোণরা হিজাব করে। তবে মাশরুর কিন্তÍ গীটার বাজায়। ভাল লিরিকস লেখে।’
‘জামাতি পরিবারের ছেলেও তোদের দলে আছে– কি বলিস?’
‘আবার হিন্দু ছেলে সুরঞ্জনও আছে। আমরা সবাই মিলে নেই রাজ্য নৈরাজ্য করবো মা–’‘নেই রাজ্য নৈরাজ্য কি?’
‘উফ্-এবার খেতে দাও ত’ আমাকে! ভাত খাব আচ্ছা করে। অনেক খিদে লেগেছে।’
৫. আসলে প্রতিটা দিনই সংক্ষুব্ধ। প্রতিটা দিনই স্বপ্নে উত্তাল। সত্যি কি রাজপথে কিছু স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়ে একটি গোটা সিস্টেমের সব অন্যায়, সব ভুল-ভ্রান্তি মুছে ফেলতে পারবে? বুঝিবা সেই প্রশ্ন আর দ্বন্দের উত্তেজনাতেই চারই আগস্ট ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। বিশ্ববিদ্যালয় ত’ কয়েকদিন ধরে বন্ধই আছে।
‘সকাল না হতেই বাই সাইকেলে হাত? এখনি বের হবি?’
‘হতে ত’ হবে।’
মা যেন দেবী। মা যেন শাপভ্রষ্টা এক অপ্সরী যে ভুল করে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। হৈমন্তীর এই যাবতীয় টো টো গিরি আর ঝুঁকি নেয়ায় এতটুকু বাঁধা দিচ্ছে না। আবার রাজ্যের উদ্বেগও আছে তার।
‘তা’ টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার– এখন কোথায় যাওয়া হবে?’
‘কাল রাতেই ফেসবুকে ইভেন্ট খুলেছিলাম আমরা। আজ ঢাবি বিজনেস ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীরা সমাবেশ ডেকেছে- ভিসি অফিসের সামনে জমায়েত হবে।’
‘যাও- ভাল ভাবে ফিরো।’
সিরিয়াস হলে মা’র মুখে ‘তুই’ উধাও হয়ে ‘তুমি’ আসে।
ঘড়িতে সকাল দশটা। বৃষ্টি নামছে। আজ যেন গত ক’দিনের থেকে পথে একটু বেশি জ্যাম। কি করবে মানুষ? খেতে ত’ হবে। কাজেও বের হতে হবে। দিনের পর দিন আন্দোলন করা অত ত’ সহজ নয়। গতকাল সন্ধ্যায় সাইকেলটার একটা চাকা বিগড়েছে। আর রশিদ বলেছে সে আজ একটু দেরিতে বের হবে। হৈমন্তী একাই তাই একটা রিক্সা নিলো। বৃষ্টি আর বৃষ্টির জন্যই সৃষ্টি হওয়া খানিকটা জ্যাম পেরিয়ে হৈমন্তী পোঁছে গেল ঢাবি বাণিজ্য অনুষদের সামনে। ছেলে-মেয়েরা বৃষ্টির ভেতরেই শ্লোগান দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি আর ফিল্ম সোসাইটির ছেলে-মেয়েরাও এসেছে।
‘আমরা কি শাহবাগ অবরোধ করব না?’
‘দরকার ঢাকা অচল করে দেবার!’
দীপ্তি আর জোবায়দাও এসেছে। ওরা দু’জনেই হৈমন্তীর ক্লাসমেট। সুন্দরী মেয়ে বলতে যেমনটা বোঝায় ওরা তাই। ওদের দু’জনেরই বাসা আর সেই মালিবাগ শান্তিনগর।
‘যা বুঝছি এবার আন্দোলনটা অন্য সব আন্দোলনের মত শাহবাগ-চারুকলা-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বদলে জিগাতলা-সায়েন্স ল্যাব-পপুলারের দিকেই হচ্ছে ও হবে। এখান থেকে জমায়েত হয়ে আবার ওখানেই যেতে হবে। ইউ ল্যাবের ছেলে-মেয়েরাও ওখানে আছে। ধানমন্ডি–২৭–এর ওখানে আছে ড্যাফোডিলের ছেলে–মেয়েরা!’
জোবায়দা ধীরে–সুস্থে কথা বলতে পারে না।
‘কিন্তÍ তোরা দুই রূপসী কি বুইঝা আসলি? আন্দোলন– সংগ্রাম করবে আমার মত রোগা– কাইল্যা মেয়েরা!’
হৈমন্তীর কথায় ওরা দু’জনেই বিরক্ত হয়, ‘সবসময় ঠাট্টা– তামাসা ভাল লাগে না হৈমু!’
তিন বান্ধবী মিলে ক্যাম্পাস থেকে আরো অনেকের সাথেই হাঁটতে হাঁটতে সাড়ে বারোটা নাগাদ জিগাতলায় পৌঁছে গেল। চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই নাকে-মুখে টিয়ার গ্যাসের তীব্র ঝাঁজ এলো।
‘পালান– পালান–’
জিগাতলা ইন্টার সেকশনের চারপাশে সমবেত ইউ ল্যাব, ড্যাফোডিলের মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী পাগলের মত দৌড়ানো শুরু করে।
‘পুলিশ মরিচের গুঁড়া স্প্রে করছে। আর টিয়ার গ্যাস। পালান সবাই!’
ওফ্– টিয়ার গ্যাস– মা নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের গল্পের সময় টিয়ার গ্যাসের গল্প করেছে কত! চোখ জ¦লছে। যেন বাড়িতে অনেক মানুষের জন্য রান্নার আয়োজনে মা’কে পেঁয়াজ কাটতে সাহায্য করছে হৈমন্তী।
‘পানি– পানি–’
হৈমন্তী, দীপ্তি বা দীপ্তি রাণী সাহা আর জোবায়দা বেগম অসহায়ের মত অনেকের দেখাদেখি জিগাতলা লেকের কাছে ছোটে। যেন লেকের জল ছুঁতে পারলেই চোখের এই তীব্র ঝাঁজের হাত থেকে মুক্তি মিলবে।
‘দ্যাখ-দ্যাখ- হৈমু– লাল জামা পরা ছেলেটা আমাদের তুহিন না? ও লেকের পানিতে ঝাঁপ দিলো ক্যানো?’
জোবায়দা হৈমন্তীর কাঁধে খোঁচা মারে।
দীপ্তি আগে থেকেই খেয়াল করেছিল, ‘তুহিনের দিকে পুলিশ পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। আগে জানতাম সাধারণ মানুষ পুলিশের দিকে ইঁট বা পাথর ছোঁড়ে আর আজ দেখছি উল্টা।’
…তীব্র হুইসেল বাজছে কোথাও। খুব কাছে ঘনিয়ে আসছে একটি পুলিশের গাড়ি। তুহিনের কি হলো সেটা না দেখেই ওরা তিন বান্ধবী প্রবল ছুট লাগায়। একটি চোরা গলিতে ঢুকে পড়ে হৈমন্তী। সেখানে একটি বাসার দরজা খোলা। বাড়িটার ভেতর ঢুকতে গেলে বাড়ির মানুষেরা আপত্তি জানায়।
‘আমি খুব বিপদে পড়ে একটু আশ্রয় নিতে আসছি। একটু দাঁড়াতে দ্যান।’
তিন জন পুলিশ পিছন পিছন আসে।
‘খানকি মাগী– আন্দোলন করিস?’
বাড়ির গেটের ভেতরে বারান্দাতেই লোহার হ্যান্ডকাফ দিয়ে পুলিশ হৈমন্তীর মাথায় মারতে থাকে। মারছে ত’ মারছেই। হৈমন্তী বুঝতে পারে মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
৬. অল্প সময়ের জন্যই জ্ঞান হারিয়েছিল বটে হৈমন্তী। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বেডে যখন তার পুরোপুরি চেতনা ফিরে এলো, ততক্ষণে তাকে ঘিরে বেশ কিছু ক্যামেরা, উদ্বিগ্ন সহপাঠী আর সাংবাদিকরা। রশিদও খবর পেয়েছে। সে-ও আছে পাশেই দাঁড়িয়ে।
একে ত’ রোগা–পলকা হৈমন্তী, তাতে মাথার চুল ফেলে দিয়ে নেড়া হতে হলো তাকে আহত মাথায় স্টিচ নেবার জন্য। মাকে ফোন দিয়েছে রশিদ-জোবায়দা-দীপ্তি। জোবায়দা আর দীপ্তি শুরুতে আলদা হয়ে গেলেও খানিক বাদেই হৈমন্তীকে খুঁজতে ওরা তার পিছু পিছু এসেছিল। ওরাই ওকে পুলিশের পিটুনিতে মাটিতে পড়ে যাবার সময় ধরে ফ্যালে আর রশিদের মোবাইলে ফোন দেয়, হাসপাতালে নিয়ে আসে।
‘আমার ছবি নে ত’ তোরা ভাল করে। ফেসবুকে ভাইরাল করে দে। মানুষ দেখুক কি হয়েছে?’
কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। মশারি খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে হৈমন্তী টের পায় তার মুখ থেকে গলগল করে বের হয়ে আসছে বমি। বাবা-মা-রশিদ পাগলের মত এ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাসার কাছেই ‘জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হসপিটালে’র রিসেপশন থেকে হৈমন্তীকে যখন মাত্রই স্ট্রেচারে তুলে দিতে সাদা শাড়ির সিস্টার হৈমন্তীর হাতে সূঁই ফুটিয়ে ক্যানোলায় যুক্ত করছেন স্যালাইনের নল, বারো বছরের কিশোর করিমউদ্দিন তখন নারকেলডাঙা রেল কলোনীর পাশ থেকে বড়বাজারে কংগ্রেসের মিছিলে ছুটছিলেন।
জ্ঞান ফেরার পর এটাই ছিল হৈমন্তীর প্রথম সংলাপ। হৈমন্তীর বিভাগের তিন শিক্ষকও এসেছে তাকে দেখতে। তাদের একজন বাম, একজন বিএনপি ও একজন আওয়ামি লীগের। হৈমন্তীর কেমন হাসি পেয়ে গেল সেই অবস্থাতেই!
একটু পরেই হন্তদন্ড হয়ে এলো মা নিজেই। বাবার অফিসের গাড়ি এসেছে। বাসায় ফিরেও দিব্যি হাসছিল আর কথা বলছিল হৈমন্তী। রশিদ গত কয়েকদিনের ধকলে খুবই ক্লান্ত। সে আজ হৈমন্তীদের বাড়ির ড্রয়িংরুমেই কাটাবে ঠিক হয়েছে। মা-বাবা-রশিদ তাকে দশটা নাগাদ বিছানায় মশারি গুঁজে ঘুমাতে পাঠালো ঠিকই তবে আধা ঘন্টা পরেই হৈমন্তী বুঝলো জ¦র আসছে।
…উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল থেকে মা’কে ফোন দিলো হৈমন্তী।
‘কি রে– হৈমু– কিছু বলবি?’
কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। মশারি খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে হৈমন্তী টের পায় তার মুখ থেকে গলগল করে বের হয়ে আসছে বমি। বাবা-মা-রশিদ পাগলের মত এ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাসার কাছেই ‘জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হসপিটালে’র রিসেপশন থেকে হৈমন্তীকে যখন মাত্রই স্ট্রেচারে তুলে দিতে সাদা শাড়ির সিস্টার হৈমন্তীর হাতে সূঁই ফুটিয়ে ক্যানোলায় যুক্ত করছেন স্যালাইনের নল, বারো বছরের কিশোর করিমউদ্দিন তখন নারকেলডাঙা রেল কলোনীর পাশ থেকে বড়বাজারে কংগ্রেসের মিছিলে ছুটছিলেন।
‘কোথায় যাও খোকা? ও স্বদেশী মিছিলে আমাদের মুসলমানের ছেলেরা যায় না! ও হিন্দুদের মিছিল!’
করিম উদ্দিন ভীত ভাবে আব্বার মুখের দিকে তাকালে আব্বা স্মিত হেসে হাত নেড়ে অভয় দিয়ে পড়শি শরাফত আলীকে বললেন, ‘যাক না– সেই দেশেরই ত’ ডাক!’
‘তবে আর কি– ভারতমাতার পূজা করতে বসো। বন্দে মাতরম বলো!’
‘সেসব জানি না। গান্ধীর দলে মৌলানা আবুল কালাম আজাদও ত’ আছেন– যাও খোকা!’
বাবার অনুমতি যেন রেলগাড়ির কু ঝিক ঝিক আনন্দ হুইসেল। যেন আস্ত একটা ঘুড়ি পাবার পুলক।
‘বন্দে মাতরম– বৃটিশ ভারত ছাড়ো! কুইট ইন্ডিয়া’– বলতে বলতে কিশোর করিমউদ্দিন রেল লাইনের পথ ধরে কংগ্রেসের ভলান্টিয়ারদের পেছনে ছুটতে থাকেন।
২/১১/২০১৮।