মন পবনের নাও । সোহাগ পারভেজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১২:৩৬ অপরাহ্ণ, | ১৫৮৭ বার পঠিত
হাউজিং স্টেটের প্রবেশ মুখের পাশে নবনির্মিত ‘আর্কেডিয়া’ হাইরাইজ বিল্ডিং। বিল্ডিং এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ‘স্বপ্ন’ সুপার শপ। সেখানে টুকিটাকি কেনাকাটা করে বাইরে এসে রিকশা পেলামনা। অপেক্ষা না করে আম্বরখানা পয়েন্টের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। ওখানে রিকশা মিলবে। ফুটপাত ধরে যেতে যেতে দেখি স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স এর শোরুমের সামনে মানুষের জটলা। ফিক্সড গ্লাসের এপাশ হতে শোরুমের ভেতরে রাখা টিভি স্ক্রিনে একগুচ্ছ জনতা আইপিএল দেখছে। জায়গাটা অতিক্রমের সময় টিভি স্ক্রিনে আমার চোখ একবার নজর বুলিয়ে নিল। আইপিএল যে স্ক্রিনে দেখাচ্ছে, পাশের স্ক্রিনে চ্যানেল২৪ অন। স্ক্রলবারে খুলনা সিটি কর্পোরেশন ইলেকশনের ফলাফল দেখাচ্ছে। তালুকদার খালেক অনেক ব্যাবধানে এগিয়ে গেছে। এবার বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। গতবার মেয়র হয়েছিলেন মনিরুজ্জামান মনি। এবারও কি বিএনপির মনিকে ক্যান্ডিডেট করা উচিৎ ছিল? সিলেটে থেকে বলবো কিভাবে? ১৪বছর আগে খুলনাতে ছিলাম। যতটা মনে পড়ে তখন তৈয়বুর রহমান খুলনা সিটি মেয়র। মনিরুজ্জামান মনি ছিলেন ২৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং প্যানেল মেয়র। বাফুফের উদ্যোগে সেবার ন্যাশনাল ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছিল বিভাগীয় শহরগুলোতে ভেন্যু করে। খুলনা জেলা স্টেডিয়ামে ঢাকা আবাহনী বনাম ঝিনাইদহ মোহামেডানের ফুটবল ম্যাচ ছিল। তিন নং জাহানাবাদ ছাত্রাবাস থেকে আমরা ১০/১৫ জন স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম ঝিনাইদহ মোহামেডানের সমর্থনে বিশাল ব্যানার নিয়ে। স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বারে আমাদের টিকেট চেক করা হয়েছিল। সুদৃশ্য টিকেটের নীচের এককোণে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হিসেবে মনিরুজ্জামান মনি’র স্বাক্ষর মুদ্রিত ছিল। আমরা সেদিন উপভোগ্য ফুটবল ম্যাচ দেখেছিলাম। গ্যালারী ছিল দর্শকে পরিপূর্ণ। ঝিনাইদহ জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের ফুটবলাররা ঢাকা আবাহনীর সাথে প্রায় সমানতালে লড়েছিল। ৪-২ গোলে জেতে ঢাকা আবাহনী। আমরা ঝিনাইদহ মোহামেডানের জন্য চিৎকার করে স্লোগান দিলেও, আবাহনীর পেড্রোর খেলা দেখার আগ্রহ নিয়েও গ্যালারীতে ছিলাম। গ্যালারী ভরপুর ছিল এজন্যই যে রুপসা টু ফুলতলা মাইকিং করা হয়েছিল, ব্রাজিলের প্রথম বিভাগ লীগের ফুটবলার আলেসান্দ্রো পেড্রো আবাহনীর হয়ে খেলতে এসেছে। মাঝমাঠে পেড্রোর কুশলী কোমল ট্যাকলিং, ডিফেন্স ভেদ করে ছোট ছোট পাস, ব্যাকহিল করে উইং এ পাস দিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে উঠে আসা, এবং দু’বার গোলবারের বিপরীত অবস্থানে থেকে রিসিভ করা বলে বাইসাইকেল কিক নেওয়া, বাকী গ্যালারীর মত আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবুও রিদন লিটনদের নিয়ে গড়া কোচ হাম্দান শেখের ঝিনাইদহ মোহামেডানের উদ্যমী লড়াই আমার এখনও চোখে লেগে আছে।
আম্বরখানা পয়েন্টে এসে রিকাবীবাজারে যাবার জন্য রিকশায় উঠলাম। অবিরত নানান ভাবনা হুড়মুড় করে একটার পর একটা আমার মগজের ফোল্ডার খুলে মানসলোকে ডিস্প্লে হচ্ছে। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম রিকাবীবাজারে। আমার বাসার পাশেই। ১২ বছর আগে এই স্টেডিয়ামে আন্তঃজেলা ফুটবল লীগের আয়োজন দেখেছি। তখন বিকেলে স্টেডিয়ামের মাঠে হাঁটতে হাঁটতে গোফওয়ালা ফর্সা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোককে দেখি মাঠ প্রস্তুতির তদারকি করছেন। চেনামুখ মিডিয়ায় দেখেছি মনে করতে পারছিলামনা। পরে মনে পড়ল আনোয়ারুল হক হেলাল। তিনি তখন বাফুফের সেক্রেটারি এবং একই সাথে সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন সাফেরও সেক্রেটারি। ওই টুর্নামেন্টেই মাগুরা জেলা দলের স্ট্রাইকার কল্লোল কুমার ঘোষ ঝুকুর খেলা নজর কেড়েছিল। কলম্বিয়ার বিখ্যাত ফুটবলার ভালদেরামার মত চুল ছিল ঝুকুর। আরেকজন ডিফেন্ডারের খেলা ভালো লেগেছিল, রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি ও ঢাকা জেলা দলের শোয়েব হোসেন সানি। শাহজালালের মাজার এলাকা যেখানটা আমরা বলি দরগা । আমাকে নিয়ে রিকশা এখন দরগা গেট অতিক্রম করছে। এই দরগা গেটের রাস্তা সংলগ্ন হোটেল বাহরাইনে ছিল মাগুরা ফুটবল টিম। ১২ বছর আগে হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে আমি এই ফুটবলারদের ‘বনফুলে’ নাস্তা খেতে দেখেছি।
প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট খেলা সরাসরি স্টেডিয়ামে বসে দেখি যশোরে ১৯৯৯ সনে। এমএম কলেজের পাশে শামসুল হুদা স্টেডিয়ামে। হাবিবুল বাশারের দলের সাথে ইংল্যান্ডের মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব । এমসিসিতে খেলেছিল অষ্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলা টনি ডটিমেইট, এন্থনি ম্যাকগ্রা, ইংল্যান্ড টিমের পেসার রায়ান সাইডবটম, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট গ্রেট আলভিন কালীচরণের ভাতিজা মহেন্দ্র নাগামোতো। মহেন্দ্র বলতেই মনে পড়ছে দ্বীপরাষ্ট্র ফিজির ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরী। আবার ওদিকে মরিশাসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নবীনচন্দ্র রামগুলাম। নবীনের পিতা শিবুসাগর রামগুলাম ব্রিটিশ উপনিবেশের থেকে মুক্তির জন্য মরিশাসের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মরিশাসের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জগন্নাথ। এই সেদিনও ব্রায়ান লারার ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কমলা বিশ্বেশ্বর প্রসাদ। ব্রিটিশ পিরিয়ডে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে আখ চাষের দাস হয়ে গায়ানা যাওয়া জগন আর বাচাউনির পুত্র চেদি জাগান গায়ানা রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। চেদি জাগানের স্ত্রী জ্যানেট জাগানও গায়ানার প্রধানমন্ত্রি হয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদন পরদেশে সুবিধা করতে না পারলেও এইসব দাসেরা উপনিবেশের আঁধার ভেঙে অপর দেশ তাঁদের নিজের করে নিয়েছেন। যশোর এম এম কলেজ মানে মাইকেল মধুসূদন কলেজ। সিলেটের এম সি কলেজ মুরারি চাঁদ হলেও গোলাপগঞ্জে এম সি একাডেমি হচ্ছে মোহাম্মদ চৌধুরী একাডেমী। আমি প্রথম সিলেটে আসি ২০০৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। ২৪শে ডিসেম্বর প্রথম কোনো ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ম্যাচ সরাসরি দেখি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ বনাম ভারত। দিবারাত্রির ঐ ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে যায়। ম্যাচ দেখে আমি সিলেটে আব্বার কাছে বেড়াতে আসার জন্য সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠি। আব্বা তখন কৈলাসটিলা গ্যাসফিল্ডে নিরাপত্তা প্রদানে এক কোম্পানী ফোর্স নিয়ে অবস্থান করছেন। কেননা কিছুদিন আগেই দরগায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমাহামলা হয়েছে।
আব্বার কাছে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে কতবার গিয়েছি। পাহাড়ে যখন ছিলাম, সন্তু লারমার শান্তিবাহিনীর আক্রমণের আশংকা থাকতো সেসব ক্যাম্পে। মহালছড়ির পাহাড়ে থলিপাড়া ক্যাম্পে বসে আব্বা আমাকে স্কুলের পড়া করাতেন- বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপুরে। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন আণ্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট গ্রুপ ১৯৯৯ সনে যখন রাষ্ট্রের কাছে সারেন্ডার করে, ওই সময় আব্বা হরিণারায়ণপুর, আব্দালপুর, পাটিকাবারি প্রভৃতি ক্যাম্পে ছিলেন। ওইসব ক্যাম্পেও বেড়াতে গিয়েছিলাম। পাটিকাবারি যেতে গোস্বামী-দুর্গাপুর রোডে ৩০ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালাতে হয়েছিল। বাকী ১০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তায় বাইসাইকেল কাঁধে নিয়ে, হাঁটু কাদার পথ পেরিয়ে, ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। ১৯৯৯ সনেই প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট খেলা যশোরের শামসুল হুদা স্টেডিয়ামে দেখলেও, প্রথম কোনো স্টেডিয়াম দেখি ১৯৯৭ সনে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম। আব্বা তখন এক কোম্পানী ফোর্স নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে। আব্বার বেড সংলগ্ন জানালা থেকে চল্লিশ হাজার সিটের গ্যালারী, বিশাল দেখতে লাগতো।
বাসায় এসে বিছানায় নেতিয়ে আছি। মন পবনের নাও এখন সাভার নবীনগরে। মৃত মিলিশিয়া তখন সব জাগতিক দায়ভার থেকে মুক্ত, চিরনিদ্রায় এ্যাম্বুলেন্সে শায়িত। এ্যাম্বুলেন্স যখন সাভার স্মৃতিসৌধ মোড় অতিক্রম করছিল, তখন আমার মন পবনের নাও ভেসে যাচ্ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কোনো এক সন্ধ্যায়। মহালছড়ি থেকে মুড়ির টিন বাসে চিটাগং, চিটাগং থেকে ট্রেনে কমলাপুর, এক দিন এক রাত পরের দিন গত হওয়া সন্ধ্যায়, গাবতলী আমিনবাজার হয়ে বাস আরিচা অভিমুখে ছুটে চলছে। মিলিশিয়া নং-১১৪২ তখন সন্তানবৎসল পিতার ভূমিকায় আমাকে কোলে নিয়ে বাসের জানালার সিটে বসে আছে। আমি তখন পরম নিশ্চিন্তে, ক্লান্ত শিশু পিতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম।
২০০৬ সনে আবার সিলেটে আসার পর রিকাবীবাজারের জেলা স্টেডিয়ামের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। সেই মাঠে জাতীয় ক্রিকেট লীগের খেলায় স্টিভ টিকোলো, অলক কাপালী, এনাম জুনিয়র, রাজিন সালেহ, তাপশ বৈশ্যদের খেলা দেখা হয়েছে। মেয়র কাপের ফাইনালে মোহাম্মাদ রফিক, সাকিব আল হাসানের খেলা দেখতে উপচে পড়া দর্শক মাঠের ভেতরে ঢুকে পড়লে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ থাকেনি। তখনকার সিটি মেয়র কামরান হ্যান্ড মাইক নিয়ে চড়কির পাকের মত ঘুরতে থাকেন। প্রায় বাউন্ডারী রোপের সাথে লেগে বসে থাকা দর্শকদের সাথে সাথে থাকেন, ম্যাচের শেষবল পর্যন্ত। নতুন প্যাভিলিয়নের চারতলার বারান্দায় ঠাঁসা ভিড়ে দাঁড়িয়ে আমি আতংকিত হই, বারান্দার রেলিং যদি ধ্বসে পড়ে। আমি যে ওয়ার্ডের বাসিন্দা সেই ১১নং ওয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। ৪নং ওয়ার্ড রফিক সাকিবকে ফাইনালে রিক্রুট করে এনেও হেরে যায়। আর ১১নং ওয়ার্ডের ক্রিকেট খেলুড়েদের ছবি জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলে সেখানে আমাদের পাশের বাসার ফাহাদকেও দেখা যায়।
সাকিবের মাগুরার কথা মনে পড়ায় আমার ইকোনো বলপেন ইয়াদে আসে। ইকোনো কারখানার মালিকের বাড়ী মাগুরা। মহালছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইকোনো বলপেনের কালি লিক করে স্কুলের সাদা শার্টের পকেট কালিমালিপ্ত হয়ে যেত। স্কুলে থাকতে আমি দোয়াতকলমেও লিখেছি। নিউজপ্রিন্ট কাগজে দোয়াতকলমের কালি চুষে লেখা থেবড়ে যেত। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ইকোনো দিয়ে লিখলেও হোমওয়ার্ক লিখতাম দোয়াতকলমে। বৃত্তি পাবার পর আমার আর বড় বোনের ছবি খাগড়াছড়ির পত্রিকায় ছাপা হয়। সেই পেপার কাটিং আব্বার মানিব্যাগে আমৃত্যু ছিল। তখন পঞ্ছম শ্রেনীর পাঠ্যবই থেকে জানতে পারি রোমানিয়ার নাদিয়া কোমেনিচির কথা যিনি মন্ট্রিল অলিম্পিকে জিমন্যাস্টিকে পারফেক্ট টেন স্কোর করে খ্যাত হন। তখন দিস্তা খাতা ছাড়াও নিউজপ্রিন্টে বাঁধাই খাতা কেনা হত। সেসব খাতার কভারে পেলে, ম্যারাডোনা, ম্যাকগাইভার,সাদ্দাম হোসেনের ছবি থাকতো। রোজিনা শাবানা অঞ্জু ঘোষের ভিউকার্ড কিনতে পাওয়া যেত। মহালছড়ি সিনেমাহলের রাস্তার সামনে দিয়ে স্কুলে যাবার সময় কুড়িয়ে পেতাম হল কতৃপক্ষের ফেলে দেওয়া বাতিল ফিল্মের নেগেটিভ। সেই নেগেটিভ রোদের আলোর দিকে ধরলে স্বচ্ছ ছবিতে দেখা যেত ‘পরিবার’ সিনেমায় জসিমের রিয়েল লাইফের বউ নার্গিসকে, যিনি সিনেমায় জমিদার আহমেদ শরিফের জেদী কন্যা। সিনেমায় খামারি জসিমের সাথে দান্ধিক সম্পর্কের পরিণতিতে তাদের প্রেম হয়। নেগেটিভের সারিতে দেখা যেত একই ছবির অসংখ্য মুডের রিল, যেখানে জমিদারকন্যা ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। নীল আকাশের দিকে তাক করে, নীচ থেকে ধরা ক্যামেরায় শুট করা খয়েরি হ্যাট আর সাদা গাউনের নার্গিস আমাদের হৃদয় হরণ করেছিল, যেহেতু তখনো পর্যন্ত সঞ্জয় দত্তের মা নার্গিসকে দেখা হয়ে ওঠেনি। মহালছড়ি সিনেমা হলেই মায়ের কোলে বসে জসীমের ‘হাতি আমার সাথী’ রাজ্জাকের ‘নীতিবান’ দেখেছি। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আব্বা নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা মোটা একটা বই কিনে দিলেন। নাম ‘বিশ্বের ডায়েরী’। সেখানে সন্ধান পাই দাবার গ্যারি কাসপরভ, ববি ফিশারের। চিনলাম ইমলেদা মার্কোস, কোরাজন একুইনো, শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে কারা। ঠাসা তথ্যের নানান সমাহারে গর্ভাচেভ, গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রেইকা শব্দগুলোও ছিল। ডায়েরীতে আরও ছিল ১৯৯২এর বার্সিলোনা অলিম্পিকে সাবেক সোভিয়েত কম্বাইন্ড টিমের সাঁতারু আলেকজান্ডার পপভের সাঁতারে একাই ৪ স্বর্ণপদক পাবার তথ্য। ছিল ১৯৯২এর ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের নেইল ফেয়ারব্রাদারের ৬২ রানের ইনিংসের কথা। সেই ফেয়ারব্রাদার ঢাকায় এসে আবাহনী বনাম কলাবাগান ম্যাচে ৬২ রান করেন। তাঁর সাথে জুটিতে আকরাম খান করেছিল ৬৪ বলে ৯৪ রান। তখন আইপিএল বলে কিছু ছিলোনা। ইত্তেফাক সংবাদ মিল্লাত সহ গুটিকয়েক জাতীয় বাংলা দৈনিক ছিলো।
আব্বা তখন ইত্তেফাক পত্রিকা আনতেন। সেখানে টারজানের কমিক পড়তে ভালো লাগতো। এরপর সাদাকালো টিভি কেনা হলে ম্যাকগাইভার আর টারজান দেখতে পাই। হারকিউলিস সিরিয়াল দেখার সময় জানতামনা গ্রীক মাইথোলজির কথা। মুভি অব দ্যা উইকে দেখি ‘দি ওল্ডম্যান ইন দ্যা সী’, ‘বেনহার’ প্রভৃতি সিনেমা। বিটিভিতে এক প্রোগ্রামে একজন জ্যোতিষীর সাক্ষাতকার দেখেছিলাম, তাঁর নাম ছিল- লায়ন দেওয়ান মোহাম্মাদ গোলাম সারোয়ার লালনশাহ লাকুটিয়া। এই নাম মনে পড়তেই আমার মনে হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয় যাকে, সেই অগাস্ট ক্যোঁতে কে, যার পুরো নাম- ইসিলো মেরি অগাস্ট ফ্রাংকোস জেভিয়ার ক্যোঁতে। আবার ওদিকে ইবনে খালদুনের পুরো নাম আবু যইদ ওলিউদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল-তুনিসী আল হাদরামী আল ইশবিলী আল মালিকী। এরা ক্রিকেট খেলোয়ার হলে এক্সেলশিটের অবস্থা কেমন হত ভাবা যায়? আমাদের গ্রামের বাজারে প্রবেশ মুখেই একটা দোকানের নাম সাইনবোর্ডে লেখা আছে- চৈতী এন্ড শাহ সুলতান বিন ওমর ফারুক গারমেন্ট এন্ড সু স্টোর। আমি দোকানীর নিকট এই নামের হকিকত জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর জবাব ছিল-এটা বিপণন কৌশল। কিভাবে? দোকানীর জবাব ছিল- যাত্রীবাহী বাস এই দোকানের মোর অতিক্রমের সময়, বাসের জানালা দিয়ে দোকানের পুরো নাম পড়ে শেষ করা যায়না। তাই কৌতূহলী কিছু যাত্রী ২০ গজ সামনের স্টপেজে বাস থেকে নেমে দোকানের নাম পড়তে আবার ফিরে আসে। ঐসময় তাদের ২/৪ জনের এই দোকানে কিছু কেনাকাটার চাহিদা তৈরি হয়। এই তাঁর বিপণন কৌশল। ঐ দোকানে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা টেপরেকর্ডারে শোনা যেত। বেদের মেয়ে জোছনাকে অপহরণ করতে যেয়ে রাজকুমার ইলিয়াস কাঞ্চনের হাতে মার খায় সেনাপতিপুত্র নাসির খান। আহত নাসির খানের পিঠে চামচা দিলদার তেলমালিশ করলে নাসির খান বেদনায় কাতরাতে থাকে। তেলমালিশরত দিলদার নাসির খান কে বলে- জোছনাকে পাইতে হইলে গরম ত্যাল একটু সহ্য করিতেই হইবে। শৈশবে টেপরেকর্ডারে আমাদের শোনা হত আনোয়ার হোসেনের ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’র পদবি- নবাব মনসুরুল মূল্ক্ শেরে কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজুদ্দৌলা হায়বত জং বাহাদুর।
ওরকম এইলানে নবাবী ডাক শুনলেই আমার এখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন হলে স্পীকারের আগমন ঘোষণার কথা মনে পড়ে। স্পীকার অধিবেশন পরিচালনার জন্য, কাঠে কারুকাজ করা সিংহাসনে এসে বসেন। সিংহাসনের পেছনে পার্লামেন্ট ভবনের দেওয়াল দেখলে, মনে পড়ে স্থপতি লুই আই কানের কথা। এসে যায় স্থপতি মাযহারুল ইসলামের কথা। মাযহারুল ইসলামের নকশায় নির্মিত ছাত্রাবাসের কক্ষে আমি ছাত্রজীবনের চারবছর বেশ আরামেই অতিবাহিত করেছি। মাযহারুল ইসলাম আর ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ শহীদুল্লার উদ্যোগে দেশে প্রথম নির্মান পরামর্শক প্রতিষ্টান ‘বাস্তুকলাবিদ’ স্থাপিত হয়। অকৃতদার শহীদুল্লা স্যার তাঁর উপার্জনের অধিকাংশ দিয়ে দেন জাতীয় তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা কমিটির আন্দোলনে। ১৪ বছর আগে খুলনার রাস্তায় আমি দেখেছিলাম এক কিলোমিটার লম্বা লংমার্চ। সেখানে স্লোগান ছিল- নো অয়েল , নো গ্যাস/ নো নো হ্যারি কে টমাস।
এসব ভাবতে ভাবতে আমাকে নিয়ে রিকশা চৌহাট্টা হয়ে ভিআইপি রোড অতিক্রম করে। আমি রিকাবীবাজার পয়েন্টে এসে নামি। ভিআইপি রোডের ডিভাইডার সহ প্রশস্ত পথের পিচঢালার কাজ হয়েছিল ১২ বছর আগে। এক ইন্ডিয়ান শিখ ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে রাতের শিফটে কাজ চলতো। তখন আমিও জবের কাজ শেষে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে রাত এগারোটায় আম্বরখানা থেকে হেঁটে হেঁটে মধুশহীদের বাসায় আসতাম। আমার বাসায় প্রবেশের সময়, একই সময়ে একজন মনিপুরী ভাই ঘরে ফিরতো। উনি আমাদের উপরের তলায় থাকতেন। উনি শেরম ইপম সিংহের মামা। শেরম ইপম হচ্ছে লাক্স ফটো সুন্দরী শানারেই দেবী শানুর খালাতো ভাই। শানুর বাবা মনিপুরী ভাষার প্রখ্যাত কবি একে শেরাম। আমার বাবা কবি ছিলেন না। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। রিকাবীবাজারে বাজার করতে করতেই তিনি মারা যান। আমার মা এখন রিকাবীবাজারে প্রায়দিনই বাজার করতে আসেন। বাজারের ঠিক কোন জায়গায় আব্বা ঢলে পড়েছিলেন সেইখানটা সবজি বিক্রেতা কবিরের কাছে জেনে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে মা সেখানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
আমি আব্বার জন্য কাঁদতে চাই কিন্তু অবসর পাইনা। ক্রমাগত বিশৃঙ্খল ভাবনা নিয়ে অবিরাম সচল মগজের সাথে এখন আমি বাসায় প্রবেশ করছি। ঘুমাতে যাবার আগে পর্যন্ত মগজ এভাবেই বিশৃঙ্খল ভাবনা অবিরাম অব্যাহত রাখবে। এখন মনে পড়ছে কয়েকদিন আগে আমি জীবিকার কাজে ঢাকা থেকে ঘুরে এসেছি। কাজের অবসরে ৫ ঘন্টার বিরতি ছিল। তখন শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে কি কি নতুন সংযোজিত হল দেখতে যাই। মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের একটা স্লটে বড় করে ছাপানো অনেক পেপার কাটিং যুক্ত হয়েছে। যেখানে একটা ছবিতে দেরাদুন ট্রেনিং ক্যাম্পে হাজারখানেক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সমাপ্তির কুচকাওয়াজ করছে। আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি শব্দহীন কান্নায় স্থির দাঁড়িয়ে আছি। দু’একজন দর্শনার্থী আমার দিকে তাকাচ্ছে। নীরব কান্না দেখে যাই বুঝুক কেউ কিছু জানতে চায়নি। না জানতে চাওয়ায় আমিও স্বস্তি পেয়েছি।
আমার মন পবনের নাও তখন ভেসে যাচ্ছিল ২০০৫ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে। আসন্ন ত্রয়োদশ সার্ক সামিট উপলক্ষে ভিভিআইপিদের জন্য ৭ই নভেম্বরে আমি শেরাটন হোটেলের ছাদে গ্রামীণ ফোনের টাওয়ারে এক্সট্রা রিসিভার যুক্ত করার কাজে তদারকি করি। ওটাই ছিল আমার প্রথম চাকুরীর দিন। শেরাটনের কিচেন দিয়ে পাস কার্ড দেখিয়ে প্রবেশ করি। কিচেন রুমের একাংশে ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত সংযুক্ত কাঠের তাকের খোপে খোপে ড্রেসিং করা চিকেন সাজানো ছিল। শেরাটনের ছাদে কাজ তদারকির সময় ভেতরের সুইমিং পুলের পারে বিকিনি পরিহিত বিদেশিনীকে সানবাথ নিতে দেখি। এরপর ১৩ নভেম্বর ২০০৫। মনমোহন সিং থেকে মামুন আব্দুল গাইয়ুম পর্যন্ত সাত দেশের সরকার প্রধানদের কনভয় শাহবাগ পেড়িয়ে আগারগাঁও যাচ্ছে। নীলাভ জংলিছাপা ইউনিফর্ম পরিহিত, হাতে ওয়াকিটকি, আর কোমরে রিভলবার ঝোলানো একজন আর্মড পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর অন্যান্য রুটের যানবাহন থামিয়ে এই কনভয় নির্বিঘ্নে শাহবাগ অতিক্রমের তদারকি করছেন। তিনি অতীতে দেরাদুন মিলিটারি একাডেমী থেকে কমান্ডো ট্রেনিং কমপ্লিট করেছিলেন। এই কনভয় প্রটোকলে নিযুক্ত হবার জন্য সিলেট থেকে ঢাকা এসেছেন। আসার আগে সিলেটের লাক্কাতুরা গল্ফ কোর্সে তিনি পুনরায় রিভলবার শ্যুটিং প্র্যাকটিস করেই এসেছেন। ১৯৫৪ তে জন্ম নেওয়া এই মানুষটার ১৯৭১সনে আরেকবার জন্ম হয়েছিল। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এসআই হবার অনেকবছর আগেই তাঁর অর্জিত জন্মসনদ হচ্ছে- সেক্টর নং-৮, অস্ত্র নং- এ/ থ্রি নট থ্রি ৩১৫০৫, মিলিশিয়া নং-১১৪২। এরপরের ৪২ বছরে দেহজ মৃত্যুর আগে তিনি আরও কয়েকবার জন্ম না নিলেও মরেছেন অনেকবার। নানান ঘাত প্রতিঘাতে মরে মরে বেঁচেছেন, যেমনটা কোটি কোটি আম পাবলিক মরার আগে মরে বেঁচে থাকে। মিলিশিয়া নং-১১৪২, ১৯৭২এ হয়ে যান জে আর বি-১১০৫৪। ১৯৭৪সনে জাতীয় রক্ষী বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। রক্ষীবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি শেরেবাংলানগরে ছিলেন। কিছুদিন নির্মীয়মান জাতীয় সংসদ ভবনের মূল অধিবেশন হলের ফ্লোরে অস্থায়ী সৈনিক ক্যাম্পে বেঞ্চি পেতে ঘুমাতেন।
বাসার মেইনডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কলিংবেল বাজানোর পর ভেতর থেকে দরজা খোলার অপেক্ষা করছি। আমার মন পবনের নাও ভেসে যাচ্ছে ৬ই মে ২০১৩ তে। সকাল সাড়ে ৯টায় সিলেট ওসমানী মেডিকেলের ইমার্জেন্সি রুমে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা অবসরপ্রাপ্ত আর্মড এসআই ক্রমিক নং-১১৭৫২কে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তিনিই মিলিশিয়া নং-১১৪২। সকাল ৯টায় রিকাবীবাজারে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। ঐদিনই সন্ধ্যায় একটা এ্যাম্বুলেন্সে নরসিংদীর পাঁচদোনা বাইপাস দিয়ে সাভারের দিকে যাচ্ছি। শাপলা চত্ত্বরের পরিস্থিতির কারণে রাজধানী এড়িয়ে বাইপাস দিয়ে যাচ্ছি। মিলিশিয়া নং-১১৪২কে নিয়ে তাঁর গ্রামে দাফন করতে যাচ্ছি। লাশ স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা। পাশে সিটে বসা আমার হাতে বসুন্ধরা টিস্যুবক্স। পায়ের কাছে আরএফএলের বালতি। মিলিশিয়ার ডাকনাম লাল। কথিত অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে লালের গ্রামে গুজব রটেছে ঢাকায় হেফাজতের সাথে সংঘর্ষে লাল দারোগা নিহত। মৃত লালের নাক দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। এ্যাম্বুলেন্সে বসে আমি পাঁচ মিনিট পর পর লালের নাকের বাম পাশের ছিদ্রে পুঁটুলি করা টিস্যু গুজে দিচ্ছি। কিন্তু মৃত মিলিশিয়ার অবাধ্য হৃদয় আমার বাঁধ অগ্রাহ্য করছে। হৃদয় ফাটা রক্ত বার বার টিস্যুর পুঁটুলি ভিজিয়ে লাল করে দিচ্ছে। বালতিতে রক্তে ভেজা টিস্যুর পুঁটুলি ফেলে দিয়ে, আমিও বার বার নতুন টিস্যু গুজে দিচ্ছি। কবরে নামানোর সময়ও নাকের বাম ছিদ্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। তবু মুখটা তাঁর অনেক সজীব দেখাচ্ছিল, যেন ঘুমাচ্ছেন, এখনই জেগে উঠবেন।
চলন্ত এ্যাম্বুলেন্সে বসে মৃত্যুশোকের সাথে নানাবিধ দুশ্চিন্তা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আগামী দিনগুলিতে মিলিশিয়ার রেখে যাওয়া পরিবার আমি কি ঠিকঠাক প্রতিপালন করতে পারবো? নানাবিধ আর্থিক ব্যয় বহন করতে পারবো? মনে পড়ছিল ১৯৯৬সনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনের দিনগুলির কোনো এক সন্ধ্যা। মিলিশিয়া কোয়ার্টারে এসে ইউনিফর্ম ছেড়েছেন। গোসল সেরে আদুল গায়ে বিছানায় বসে আছেন। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাত মাথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মিদের সাথে সেদিন সংঘর্ষ হয়েছে। মিলিশিয়ার ঠোঁটে ইট পাটকেল নিক্ষেপের আঘাত লেগে তখনও রক্তাভ ক্ষত। ঐ ক্ষতে তিনি ‘নিভিয়া’ ক্রিম আংগুলে নিয়ে আলতো করে মালিশ করছেন। এবং মাকে বলছেন, মানুষের দেহে লাঠি চার্জ করতে উনার মন সায় দেয়না। সংঘর্ষের সময় জাস্ট বর্মের আড়ালে পজিশন নিয়ে থাকেন। আজ অপর দিক থেকে ধেয়ে আসা ইটের আঘাত এড়াতে পারেন নি।
১৯৯৫ সনের ডিসেম্বরের শীতের রাত ৪টা। কোয়ার্টার থেকে এক কিলোমিটার পথ হেঁটে জ্যাকেট আর মাফলার মোড়ানো মিলিশিয়া যাচ্ছেন বগুড়া এপিবিএন প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেখান থেকে গাড়ীতে উঠে জয়পুরহাটে যাবেন পরের দিন গোলাম আযমের জনসভার ডিউটিতে। এভাবে তিনি হাসিনা খালেদা এরশাদের জনসভার ডিউটিতেও বহুবার গেছেন ও যান। মিলিশিয়ার একহাতে কিডব্যাগ আর আরেক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। আর হাফপ্যান্ট হাফ সোয়েটার পরিহিত আমি ঠক ঠক কাঁপুনি সহ মিলিশিয়ার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছি। ঘুমঘোর না কাটা আমার মাথায় ছিল মাফলারের ওপরে হোল্ডঅলে মোড়ানো বেডিং। সাইজে আনুমানিক ৭৫ কেজি চাউল ভর্তি বস্তার মত দেখতে, ১৫ কেজির বেডিং আমি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, পুলিশ পিকাপে তুলে দিয়ে আব্বাকে বিদায় দেবো। আরও মনে পড়ছে ২০০৮ সনের কোনো এক গভীর রাতের কথা। মিলিশিয়া তখন RAB-11 তে ডি এ ডি। কোনো এক ক্রসফায়ারে টিমের সাথে গেছেন। স্বচক্ষে পরিকল্পিত শ্যুটিং দেখার গ্লানি তিনি নিতে পারবেন না। ঘটনাস্থল থেকে দূরে এসে মাকে ফোনকল করেছেন। ফোনকলের অপর পাশে মা শুনতে পাচ্ছেন, ইউনিফর্ম পরিহিত RAB ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
লাশের পাশে বসে মনে চলে যায় ১৯৯৭ সনে। বগুড়া এ পি বি এন পাবলিক স্কুল। সপ্তম ক্লাসের ভর্তি রোল ৯৭। ৮ম এ এসে ২৬ থেকে নবম ক্লাসে প্রোমোশনের সময় আমি সেকেন্ড প্লেস করেছি। টিফিন পিরিয়ডের ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে কতিপয় সহপাঠি আমার খাতায় লিখে রেখেছে-“ ঘুপ্সি মাগীর ছৈল, বেশ্যা মাগীর ছৈল তুই যদি আর রেজাল্ট ভালো কোরবুতে তক্ কুবান হোবি, ঠ্যাং কাইটা লিওয়া হোবি” । পরে আমি লেখা দেখে চিনতে পারি কে লিখেছে, কারা মিলে লিখেছে। ওদের অপরাধ লঘু করতে আমি লেখাগুলো ঘিচিঘিচি করে কেটে দেই। কিন্তু বড়বোন কেটে দেওয়া লেখার পাঠোদ্ধার করে আব্বাকে দেখায়। আমার এই অহেতুক গান্ধীবাদিতায় মিলিশিয়া বিরক্ত হন। দুপুরবেলায় ইউনিফর্ম পরিহিত তিনি আমাকে সামনে পেয়ে যান। পুলিশি বুটের তলায় আমাকে লাথি সহ পিষে মারতে থাকেন। আবার সেদিন রাতেই মিলিশিয়া আমাকে কোলে নিয়ে বসে শিশুর মত কাঁদতে থাকেন।
(মৃত মিলিশিয়া যখন উনার পৈতৃক ভিটায় অবস্থিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রামীণ জানাজা নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় ফ্ল্যাগ স্যালুট অথবা গার্ড অব অনারের আয়োজন ছিলোনা। তিনি ১৯৭২ এ প্রাপ্ত সনদপত্র নানান সুযোগে নবায়ন করেন নি। তিনি বলতেন- “আমি দরিদ্র বটে, কিন্তু অস্বচ্ছল নই। আমার ভাতার প্রয়োজন নেই।“ -কবরে নামানোর আগে মিলিশিয়ার কপালে শেষ চুম্বন দেবার সময় ভাবিনি, কিন্তু এখন ভাবি এই মিলিশিয়া নং-১১৪২কে কেন্দ্র করে অনেক, অনেক কথা লেখার আছে। সেই লেখার শিরোনাম কি হবে? লালে লাল সালাম? প্রান্তিক গণ কহে? এখনো জানিনা।)
বাসায় এসে বিছানায় নেতিয়ে আছি। মন পবনের নাও এখন সাভার নবীনগরে। মৃত মিলিশিয়া তখন সব জাগতিক দায়ভার থেকে মুক্ত, চিরনিদ্রায় এ্যাম্বুলেন্সে শায়িত। এ্যাম্বুলেন্স যখন সাভার স্মৃতিসৌধ মোড় অতিক্রম করছিল, তখন আমার মন পবনের নাও ভেসে যাচ্ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কোনো এক সন্ধ্যায়। মহালছড়ি থেকে মুড়ির টিন বাসে চিটাগং, চিটাগং থেকে ট্রেনে কমলাপুর, এক দিন এক রাত পরের দিন গত হওয়া সন্ধ্যায়, গাবতলী আমিনবাজার হয়ে বাস আরিচা অভিমুখে ছুটে চলছে। মিলিশিয়া নং-১১৪২ তখন সন্তানবৎসল পিতার ভূমিকায় আমাকে কোলে নিয়ে বাসের জানালার সিটে বসে আছে। আমি তখন পরম নিশ্চিন্তে, ক্লান্ত শিশু পিতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের অনুপম স্থাপত্য সাভার স্মৃতিসৌধ। তখন সান্ধ্যবাতি প্রজ্বলনে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স আরো মনোরম দেখাচ্ছে। আব্বা ডেকে জাগালেও আমি তখন প্রগাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম। মিলিশিয়া নং-১১৪২ তাঁর একহাতে আমার চিবুক ধরে মাথা উঁচু করিয়ে, আরেক হাতের দুই আঙুল দিয়ে আমার দু’চোখের পাতা টেনে খুলে, বাসের জানালা দিয়ে বার বার দেখাচ্ছেন- ঐ দেখ বাবু, স্মৃতিসৌধ। আমি বার বার ঘুমে ডুবে যাচ্ছি। মিলিশিয়া বার বার আমার চিবুক ধরে আমায় জাগাচ্ছেন। পিতা বার বার বলছেন- বাবু জেগে থাকো, ঐ দেখো স্মৃতিসৌধ, দেখ দেখ।।।
চিরনিদ্রায় শায়িত মিলিশিয়া নং ১১৪২কে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স যখন পাটুরিয়া টু দৌলতদিয়া রুটের ফেরিতে ছিল, মৃত মিলিশিয়াকে আমার একই ভাবে জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছা হয়েছিল। তিনি যেন এখনই ঘুম থেকে উঠে পরিবারের হাল ধরেন। আরও কিছুদিন দায়মুক্ত শিশু হয়ে যেন, আমি তাঁর কোলে ঘুমাতে পারি। ও বাবা, আমি কি তোমার দু’চোখের পাতা টেনে খুলবো? জেগে থাকো, ওঠো, ভার নাও। তোমার মত করে আমি কি এত ভার বইতে পারি? স্মৃতি বড্ড ভয়ানক বাবা, আমাকে এখন ঘুমাতে দেয়না।