হাসিনা । রুখসানা কাজল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০১৮, ১১:০১ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৯৭ বার পঠিত
মুন্নুমিয়ার মুদি দোকান লাগোয়া ছোট্ট গুদামঘর। তার বারান্দায় ঠাই নিয়েছে ওরা। আজ নিয়ে চারদিন হলো। স্বামী স্ত্রী, একটা ল্যাদা বাচ্চা। দোকানের স্থায়ী কর্মচারী ইমান আলির দয়ার শরীর। তাড়িয়ে দিতে গিয়ে ভাবে, থাকুক না হয়। কতদিন কত বর্ষা বাদলে কত কুকুর বেড়াল উঠে আসে। থাকে অই বারান্দায়। আর এরা তো মানুষ !
মাঝে মাঝে সুর করে কাঁদে বউটা । সেই সুরে মিশে থাকে ছেলে হারানো, ঘর হারানো, উঠোন হারানোর দুঃখ। স্বামীটা সারাদিন কাজ খুঁজে হয়রান। ছুটকো ছাটকা কাজ করে যে চুটকি টাকা পায়, দুটি রুটি ভাজি কিনতেই শেষ হয়ে যায় সব।
গেলো বিকেলে অজু করতে এসে ইমান আলি বলেছিল, মিয়ার বেটা শুনো ত দেহি। তুমারে কিডা কইছে টাকা দিয়ি সবকিছু কিনা যায়! একবার আইসো আমার কাছে। স্বামী ইস্তিরি তুমাগো একটা না একটা কাজ জুটায়ে দিবানি ইনশাল্লাহ।
কথামত গুদামঘরের পেছনের দরোজা সামান্য খুলে দেয় ইমান আলি। সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে ছোরাব। অন্ধকার ছাওয়া মাখা একটা কোণ দেখিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে বলে ঈমান আলি চলে যায় দোকানের সামনে। সেখানে কয়েকজন কাস্টমার চাল, ডাল তেল নুনের নিত্য দাম বেড়ে চলায় সরোষে সরকারের মুন্ডুপাত করছে।
সেই মুন্ডুপাত শুনতে শুনতে হঠাত গন্ধ পায় ছোরাব। নাকের পাটা ফুলে ওঠে ওর । চাল, ডাল, আটার গন্ধ ছাড়িয়ে ছোরাবের নাকে আসে নুন নুন, কটা কটা গন্ধ। গাল ভেঙ্গে মুখ ভরে আসে টকনুনতা জলে। জিভ ডুবে যায় সেই নোনা সাগরে।
দুঃখ কষ্ট অনাহারে গর্তে ঢোকা চোখে হাজার পাওয়ারের আলো জ্বেলে ছোরাব খুঁজতে শুরু করে নুনের বস্তা। আঙুলের নোখ ডাবিয়ে দেয় একেকটা বস্তায়। অবশেষে পেয়ে যায়। নিমিষে দাঁত বসিয়ে ফুটো করে চুষতে শুরু করে নুনের বস্তার এক কোণ।
গেলো পাঁচদিন তারা নুন ছাড়া। নদি ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে নেমেছিল ছোরাব। পথ কেড়ে নিয়েছে আড়াই বছরের ছেলে রুস্তমকে। ছমাসের মেয়েটা বেঁচে আছে মায়ের দুধ খেয়ে। কিন্তু খাবার না পেলে বুকে দুধ আসবে কোথা থেকে! অচেনা শহর, অচেনা মানুষজন । সে চাষাভুষো জনমজুর। শহরের কাজকাম কিছুই জানে না। বউয়ের পায়ের গোছা দুহাতে চেপে ধরে ছোরাব, একবার যা হাসু। লক্কি বউ আমার। মাইয়েটাও যে মরি যাবিনি ! ও বউ আমাগের তুই বাঁচা বউ।
ইমান আলি জানেনা আজ দুপুরেই মুন্নুমিয়া এসে ঘুরে গেছে। বাচ্চাটা তখন দুধ খাচ্ছিল আর মায়ের বুক নিয়ে খেলছিল আপনমনে। ফল্গু নদীর ভেজা বালির মত চিকচিক করছিল খোলা বুক। তিরতির জল উসকে পড়ছিল বুকের চরে। মুনুমিয়ার তৃষ্ণার্ত মুখ দেখে বুক ঢাকতে মাথার কাপড় টানাটানিতে যে সে অবস্থা !
সন্ধ্যা গায়ে জড়িয়ে পেছনের সেই দরোজা দিয়ে ছোরাবের বউ ঢুকে পড়ে গুদামঘরে।
ইমান আলী কয়েকটা বড় বড় ঠোঙ্গা দেখিয়ে বলে, আয়, বস ইখানে। দেখতি পাতিছিস ঠুঙ্গাগুলান? সব তোর ! তয় নেবার আগি তোর গুদামঘরের দরোজাখান খুলি দেখা ত সোনা, দেখি, কেমন মালসামান মজুত রাখিছিস সেখেনে!
হাসিনা ওর গুদামঘরের শাড়ি ব্লাউজ, সায়া খুলে হাসে, সব নিতি চাও নাকি মিয়া? দিবানি। তয় বুকদুডোতে কিন্তু হাতমুখ দিবার দেবোনানে। বুকির মধ্যি আমার বাচ্চাডার জন্যি দুধ জমা রাখিছি যে!
আধো আলোয় ইমান আলির চোখ জ্বলে ওঠে। হাসিনাকে কাছে টেনে নীরব হাসি ছড়িয়ে দেয়, বলদ মেয়েমানুষ ! আগাগোড়া না দিয়ি তুই যাবিনি কোহানে ও ময়না!
গুদামঘরের ফ্লোরে শুয়ে পড়তে পড়তে হাসিনাও হাসে। বুক খোলা হাসি, আবাল ব্যাটা, মায়ের দুধের কি শেষ আছে, না থাকে ! যত খাবো ততো বাড়বিনি। তয় আমার মরা ছেলে রুস্তমের কসম, শুরেরবাচ্চা ঈমান আলি তোরে আমি দোকান ছাড়া করবই করব।
ইমান আলি জানেনা আজ দুপুরেই মুন্নুমিয়া এসে ঘুরে গেছে। বাচ্চাটা তখন দুধ খাচ্ছিল আর মায়ের বুক নিয়ে খেলছিল আপনমনে। ফল্গু নদীর ভেজা বালির মত চিকচিক করছিল খোলা বুক। তিরতির জল উসকে পড়ছিল বুকের চরে। মুনুমিয়ার তৃষ্ণার্ত মুখ দেখে বুক ঢাকতে মাথার কাপড় টানাটানিতে যে সে অবস্থা !
মুন্নুমিয়া চলে গেছে ঠিকই। চোখদুটো রেখে গেছে হাসিনার ঠিক বুকের উপর।