উত্তর-দক্ষিণা — একটি সমীক্ষা । আজমিরি শাহাবুদ্দীন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুন ২০১৮, ৮:০৫ অপরাহ্ণ, | ১৮৫২ বার পঠিত
অনেক দিন পরে একটি চমক লাগা বই পড়লাম। নাম উত্তর দক্ষিণা, লিখেছেন সাগুফতা শারমিন তানিয়া। আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী হাসিনা ইকবাল এর আগ্রহে বইটি পড়ি এবং চমতকৃত হই। এ ধরনের লেখা খুব কমই চোখে পড়ে।
বাংলা রূপকথার জগতে দক্ষিণা রঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার ঝুলি ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। হাজার বছরের পুরানো এই রূপকথার কাহিনীগুলো দক্ষিণারঞ্জন যখন সংগ্রহ ক’রে শত বছর আগে প্রকাশ ক’রেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সব খ্যতিমান লেখক ও কবিরা এর উচ্ছসিত প্রশংসা ক’রেছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ এর ভুমিকাও লিখে দিয়েছিলেন।
সাগুফতা সেই চিরপরিচিত ঠাকুরমার ঝুলির বিভিন্ন কাহিনীগুলোকে অন্যভাবে, নতুন মাত্রায় উপস্থাপন ক’রেছেন। এগারটি গল্পে রাজারানীর কাহিনী প্রকাশিত হ’য়েছে অন্য বলয়ে। সাগুফতার এই সাহসী প্রয়াস প্রশংসার যোগ্য। এখানে রানীরা নির্দ্বিধায় রাজার কথা, জ্যোতিষির কথা,সতীনের কথা মেনে নেয়না। তারা তর্ক করে,প্রতিবাদ করে,নিজের ইচ্ছায় চলে। দৈহিক কামনা বাসনাকে হেলা করেনা, রাজাকে ছলেবলে কৌশলে বশীভূত ক’রে নিজের নারীত্বের অধিকারকে প্রতিষ্ঠীত করে।
তাই রানী অশ্রুলেখা সন্তান লাভের জন্য অনুর্বর রাজাকে পরিত্যাগ ক’রে অন্য সঙ্গী বেছে নিতে দ্বিধা করে না। বহু পরিচিত কিরণমালার কাহিনীতে যখন কিরণমালার মা যে কিনা ছিল লোহারের কন্যা ,ভাগ্যগুনে রানী হ’য়েছিলো। তার বোনেরা যখন তার তিন সন্তানের জন্মের সময় রাজাকে মিথ্যা সংবাদ দেয় যে তার পেটে কাঠের পুতুল হ’য়েছে এবং সন্তানদের ভাসিয়ে দেয়। নদীতে স্থানীয় ব্রাম্মনের ঘরে সন্তানেরা প্রতিপালিত হয়। সেই অরুণ বরুণ কিরণমালারা যখন বড় হ’য়ে ,কৃতী হ’য়ে মাকে ফেরত আনে তখন রাজা তাদের পরিচয়ে হয় গর্বিত। কিন্তু কিরণমালার মা তা মেনে নেয় না। সে রাজাকে অভিযুক্ত করে তার প্রাসাদে অবিচারের দায়ে, এবং প্রাসাদে প্রবেশ ক’রতে অস্বিকার করে।সাগুফতার কিরণমালা তাই প্রতিবাদী নারীত্বের অনন্য প্রতীক।
উত্তর-দক্ষিণা : পুনরুজ্জীবিত রূপকথা
সাগুফতা শারমীন তানিয়া
প্রকাশক : প্রথমা
মূল্য : ১৭৬ টাকা
মালঞ্চমালা গল্পে বারো দিনের শিশু রাজপুত্রকে নিয়ে বারো বছর বয়সী মালঞ্চমালার কাহিনী। সে কাহিনী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রূপভান কন্যার কাহিনী হিসাবে প্রচলিত। সেখানে মালঞ্চমালার কষ্ট,বেদনা,নির্যাতনের কাহিনী উঠে এসেছে। এর সাথে দক্ষতার সংগে লেখিকা ফরাসী কাহিনী বিউটি এন্ড দ্যা বিস্ট-এর কাহিনীকে গ্রথিত ক’রেছেন। এভাবে সাগুফতা প্রতিটি প্রাচীন কাহিনীর অন্তরালে আসল সত্যকে তুলে ধরেছেন। মোট এগারটি গল্পের প্রতিটিতে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাগুফতা রামায়ন,মহাভারত থেকে আরম্ভ ক’রে অধুনা কালের নারী নির্যাতনকে বলিষ্ঠ ভাবে গল্পগুলির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
এসব শিশুতোষ রুপকথা নয়, বরং প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর আলেখ্য। লেখিকা দক্ষিণারঞ্জনের ভাষারীতিকেও সুন্দরভাবে ব্যবহার ক’রেছেন,যেমন ঃ-স্যাঙ্গাতনি রানীর দশা দেখিলো। নিরালা কাননে রানী আর কাহাকেও ডাকেন না। কুঞ্জে কেহ জলসেচ দেয় না। যদিও দক্ষিনারঞ্জন এক শত বছর আগে ঠাকুরমার ঝুলির কাহিনীগুলি সংগ্রহ ক’রে প্রকাশ ক’রেছিলেন,এগুলোর জন্ম হাজার বছর আগে আবহমান বাংলার পল্লীগ্রামে। সেই কাহিনী সমুদয় থেকে বেছে নিয়ে সাগুফতা নতুন আঙ্গিকে রচনা ক’রেছেন তাঁর উত্তর দক্ষিণা বইটিতে। তাই তাঁর নারীরা প্রতিবাদী,রাজারা ভন্ড,সাধারণ মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত।
এ ধরণের অভূতপূর্ব গল্প উপহার দেবার জন্য সাগুফতাকে অকুন্ঠ ধন্যবাদ।