পাণ্ডুলিপি থেকে । মৌসুমী বিলকিস
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০১৮, ১২:০৯ অপরাহ্ণ, | ১৬৪৯ বার পঠিত
কবি মৌসুমী বিলকিস-এর অণুগল্প হলদে শাড়িটি ও অন্যান্য অণুগল্প প্রকাশ হয়েছে ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায়। প্রকাশক বাংলাদেশের ছোটকাগজ চিরকুট। বইটি কলকাতায় পাওয়া যাবে শিগগির।
হলদে শাড়িটি ও অন্যান্য অণুগল্প থেকে
শোক
ভোর রাতে মারা গেছে এক রোগে ভোগা লোক। তাদের বাড়ির কার্নিশে ছটফটাচ্ছে নরম আলোছায়া। সামনের গলির কর্পোরেশনের সময় কলে জল ভরছে মেয়েরা। খালি বালতিতে শব্দ করছে জল। একটা কাক লাফিয়ে নামলো সদ্য ফেলা উচ্ছিষ্টে। দুধের প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছে মাস মাইনের ছেলে। সাইকেলের চাকা এসে থামলো গলিতে। রোল করা সংবাদপত্র কয়েকটি বাড়ির দোতলায় ছুঁড়ে দিয়ে চাকা ঘুরে চললো অন্য গলিতে। কারো রান্নাঘর থেকে ক্রমাগত খুন্তি নাড়ার শব্দ। বাজারের ব্যাগ হাতে ফিরছে পাশের বাড়ির লোক। ব্যাগের প্রান্তে লকলকাচ্ছে লাউডগা। কয়েকজন তরুণ হাতে সাদা ফুলের মালা, গুচ্ছ রজনীগন্ধা, ধূপকাঠি ইত্যাদি নিয়ে ঢুকে গেল মৃতের বাড়ি। একটা শব বহনকারী গাড়ি এসে দাঁড়ালো নির্জন গলিটায়। মৃতের বাড়ির দোতলার খাঁ খাঁ বারান্দায় ছিটকে বেরিয়ে এলো এক কৃশ তরুণী। রোগীর সেবা করা শেষ। মাইনে বুঝে নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে তাকে। অথচ সে শব্দ করে কাঁদছে। গলিটা নড়বড় করে নড়ে উঠলো।
আমাদের না
এখন জল ভর্তি করা হচ্ছে। এই তো ভরে এলো। জলে টলটল করছে চল্লিশ তলা বাড়ির ছাদের সুইমিং পুল। পুলের সুদৃশ্য রঙিন মেঝে জলের নিচে কাঁপছে। পুল মিস্ত্রিরা জল ভরে পরীক্ষা করছে। জামাকাপড় ছেড়ে জাঙ্গিয়া সম্বল করে নেমে পড়লো এক মিস্ত্রি। জলে আরাম করে ভাসছে তার শরীর। অন্যরা সেকেণ্ড মাত্র হকচকিয়ে গেলেও তাকেই অনুসরণ করলো। চিৎ সাঁতারে ভাসতে ভাসতে আকাশ দেখছে তারা। আকাশে কেবল ধোঁয়া।
: আমাদের গ্রামের আকাশ কী স্বচ্ছ আর নীল!
: আমাদের গ্রামের পুকুর আয়নার মতো আর তাতে…
: ভেসে থাকে গ্রামের ছবি।
: চাষের জমির কথা মনে পড়ে? কী সুন্দর!
: হাওয়ায় দোলে ফসল!
: এখন সব স্বপ্ন।
: সব শুকিয়ে গেল।
: শালার বোতল কারবারি!
: বোতলে জল ভরে গ্রামের সব জল…
: শুয়রের বাচ্চারা!
: নিজের জমি থাকতে পরের কোম্পানিতে লেবার খাটছি।
: কপাল!
: কপাল না রে, আমাদের জমি, আমাদের ঘর, আমাদের বাতাস, আমাদের জল…
: কিছুই আমাদের না!
দৃষ্টি
আমার চোখ ছুরি দিয়ে উপড়ে নিলো সেই মানুষটা যে প্রত্যেকের চোখ সংগ্রহ করে বানিয়ে ফেলেছে একটা সংগ্রহশালা, কেননা চোখের জায়গায় চোখ থাকা বা না থাকা নিয়ে আজকাল কিছুই যায় আসে না আর চোখ উপড়ানোর পদ্ধতিটায় রক্তও ঝরে না।
মহিলাকে আর কোনোদিন দেখা যায় না। সে কোথায় চলে গেছে, নাকি মারা পড়েছে কেউ বলতে পারে না। তার শতচ্ছিন্ন শাড়ির টুকরো কৃষি খেতের এখানে ওখানে খুঁজে পাওয়া যায় এখনো।
হলদে শাড়িটি
উঠোনের কাঁঠাল গাছতলায় বসে ডালের মধ্যে রুটি ভেজাচ্ছে মহিলা। নোংরা কালচে আঙুল ডালে ডুবিয়ে রুটির টুকরো তুলে তুলে খাচ্ছে। সে সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। মহিলারা ডেকে ডেকে মাঝে মাঝে তাকে খেতে দেয়। সারা গায়ে ময়লার আস্তরণ। চুলগুলো উস্কোখুস্কো, রুক্ষ। হলদে শাড়িটা কালচে হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কথা বলে সে। কি ভাষায় কেউ বোঝে না। সে কোথা থেকে এসেছে জানে না কেউ। যুবতী নয় সে। পাগলি একটা।
গ্রামের কিছু পুরুষ একদিন তাড়া করে তাকে। সে দৌড়তে দৌড়তে কৃষি খেতের দিকে চলে যায়। তার আঁচল খুলে গিয়ে মাটিতে এলিয়ে পড়ে তার পিছন পিছন এগিয়ে চলে। দৌড়ায় সে। পুরুষদের কারো কারো হাতে গরু খেদানোর লাঠি। উল্লাসে চ্যাঁচায় কেউ কেউ, ‘ধর ধর।’
: শালীকে মার।
: যাবে কুথায়?
মেটে রাস্তার পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। মহিলারা আর্তনাদ করে, ‘পাগলিটা কার কী ক্ষতি কর্যাছে?’
: বয়স্ক মানুষ।
উল্লসিত পুরুষরা এইসব শব্দ ও বাক্যের পাশ কাটিয়ে দল বেধে দৌড়ায়। গ্রামে গ্রামে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে। তার ওপর উঠছে নতুন ব্রিজ। না হলে ব্রিজের আয়ু দীর্ঘ হবে না। খবর দেয় একজন।
মহিলাকে আর কোনোদিন দেখা যায় না। সে কোথায় চলে গেছে, নাকি মারা পড়েছে কেউ বলতে পারে না। তার শতচ্ছিন্ন শাড়ির টুকরো কৃষি খেতের এখানে ওখানে খুঁজে পাওয়া যায় এখনো।