সাধিত রাতের নীরবতায় আবর্তমান | রাসেল রাজু
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জানুয়ারি ২০১৮, ৬:৫৯ অপরাহ্ণ, | ১৫৪২ বার পঠিত
একদিন সমস্ত রহস্যজাল ভেদ করে
একদিন সমস্ত রহস্যজাল ভেদ করে সদ্যোজাত মথটির মত
আবাসিক স্থল ভেদ করে সমগ্র জীবন হাতে করে
বেরুনোর ডাক আসবেই—
অদ্য পৃথিবীটা স্থবির ঠেকছে খুব।
ভ্যাঁপসা গরমে বান এসেছে শরীরে
তবু একদিন সমস্ত রহস্যজাল ভেদ করে সদ্যোজাত মথটির মত
নিমেষেই অস্বীকার করে ফেলবো পুরনো আবাস
তারই পূর্বাভাস যেন সদ্য ভেসে গেছে ঘামের দুর্গন্ধ হয়ে
দেহ হতে নির্গমন করে করে।
কামনারহিত দেহে যদিওবা শীত আসে
জেগে ওঠে পূর্ণচন্দ্র গগনললাটে
একদিন অমনি রহস্য ভুলে ভেসে যাবো
বানভাসি ঘামে, একা একা!
পুরনো আবাস পড়ে রবে যথাস্থলে
শুধু রাতটাকে ছিদ্র করে ছুটে আসে একপ্রস্ত আলো
একদিন সহসা দুপুর রাতে।
তবু আমি চলে যাবো পুরনো মরচেধরা টিনে
কর্তিত মস্তকে দিগন্তছাপিয়ে একা একা
বেড়ে ওঠা বৃক্ষটির মত
যেমন এসেছি একা চিৎকার সাথে করে
সেই চিৎকার থামিয়ে আবার ঝরে যাবো রাতে
একদিন।
একদিন বিহ্বল রহস্যচ্ছলে সদ্যোজাত বৃদ্ধটির মতো
অনাবাসিক কবরে ভোরের শিশিরসিক্ত ঘাসের মতন
মাটি ভেদ করে বেরুনোর ডাক আসবেই
মৃত্যুভেদ করে জেগে যাবো পুনর্বার ঘাসের মতন
বৃক্ষের মতন
বীজভেদী অঙ্কুরোদগমের মতন।
একদিন সুশীতল রাতে যামিনীকে বলে দেবো বিদায় আবার
শয্যাগত দেহে করে দেবো পার সমস্ত প্রহর
একদিন।
একদিন সমস্ত রহস্যজাল ভেদ করে সদ্যোজাত মথটির মত
আবাসিক স্থল ভেদ করে সমগ্র জীবন হাতে করে
বেরুনোর ডাক আসবেই—
একদিন রাত্রিদুপুরের স্বপ্নে আবাসিক স্থল ভেদ করে করে
উড়ে যাবো দূরের গগনে পিপীলিকা পাখা গজানোর কালে
কেননা রাত্রিতে বেরুনোর ডাক আসবেই
অভুক্ত ফিঙের বুভুক্ষিত চোখের মতন।
নৈঃশব্দ্যের ধুন
আমাকে উত্তরোত্তর তাড়া করে ফেরে সেসব বৈকালি আভা
কোমল ঘাসের বুকে চিত্রিত চিহ্নাদি।
একেকটা ক্লান্ত সন্ধ্যা একা বসে থাকে বেখেয়ালে
কেমন বাতাসে ভেসে আসে তবে তোমাদের কণ্ঠ?
বেখেয়ালি পীঠে চড়ে বসে কোন শূন্যতার মন্ত্রে?
চড়াই উতরাই পেরিয়ে শেষে সব নিয়মের পাদদেশে
ঝর্ণার শব্দের মতন চিৎকার ভালবেসে ফেলি মুহূর্তেই
তারপর যেন নৈশব্দের ধুন বেজে চলে অন্তরে অন্তরে।
এরা কার নৈকট্যে জীবন গোছাতে ভুলে যায়?
কেমন ভালবাসা নাই যার তীর্থ কোন
নাই যার কোন স্পর্শবিন্দু কিংবা তল।
তবু কার যেন গোপন ইশারা ভেসে আসে রাতে
ঘর ছেড়ে ছুটে চলি ওই পথে
ঝর্ণার শব্দের মতন চিৎকার ভালবেসে ফেলি মুহূর্তেই
তারপর যেন নৈশব্দের ধুন বেজে চলে অন্তরে অন্তরে।
তবু মধ্যরাতে যেসব তারা একা ঘর ছেড়ে
আমাদের দিকে ধাবিত হতে চায় পিঁপড়ার সারির মতন
নিঃশব্দ পা ফেলে ফেলে
অথচ নীরব হুংকারে যেসব জীবন তারাদের মত
অগোছালো আলো বিলিয়ে যায় গগন জুড়ে
আমাকে সেসব আলো তাড়া করে ফেরে অযথাই
আমি তাই সব সীমান্ত লঙ্ঘন করে
ঝর্ণার শব্দের মতন চিৎকার ভালবেসে ফেলি মুহূর্তেই
তারপর যেন নৈশব্দের ধুন বেজে চলে অন্তরে অন্তরে।
কাঁটা
সেবার জোছনাবর্তী হতে হতে কতদূর হয়ে গেছি একাকী আগুন
দিকচক্রবাল জুড়ে জ্বলেছি-পুড়েছি দাবদাহকালে।
ফিরে দেখা সেই দৃষ্টিসুখ, কার্তুজ হারানো সম্মোহিত সন্ধ্যাকালে
যেই রোদ মুছে দিয়ে আপনার কালিটুকু গুটিয়েছে অন্ধকারে
আপনার প্রণয়রহিত সত্তাটুকু। খুব যেন চেনা আভা
লেগে থাকে রাত্তিরের গাত্রজুড়ে, খরতাপ পেরুনো সন্ধ্যায়।
না-লব্ধ সংবাদ যেন বিকিয়েছে নব্য টিআরপি সূত্রে
সন্ধ্যা কিংবা সুগভীর নীলিমার চ্যানেলে চ্যানেলে।
চাইনি ত ভেসে আসে মাগরেব মুহূর্তে আজান
সন্ধ্যার সে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য যা, হোক তবে অফুরান—
অস্ফুট উচ্ছ্বাসে তাই হয়তো চেয়েছি খুব করে।
তবু ত জোছনাবর্তী হতে হতে একটু আশ্রয়
জুটেছিল কেনা কবিতার সে পাতায়
কফি আর কবিতার গেলাসে গেলাসে গোগ্রাসী পেয়াস
শতাব্দী পেরুনো, হে আঁধার,
সন্ধ্যার সে ক্রান্তিকাল করিনি পরোয়া মোটে
দেখিনি ত ফিরে কী ছিল একদা নেই হয়ে গেছে আজ তবে।
কোন কোন দিন বিউটি ও বিস্ট সিনেমার মরালগামিনী ডানায়
মেলেছি ময়ূরাকৃতি পেখম হয়তো
গিলেছি সে খন্ডকালীন হাওয়ার মিঠাই
মুখে পুরে ফের নেই হয়ে যাওয়া অনুভূতিসহ
খোলা চোখ মুদে দেখি নেই ত কিছুই আর
দৃশ্যমান সব যেন সেই কবে গেছে যে হারিয়ে।
পুরনো ফিনিক্স নই, বিশ্বাসেরা নিয়েছে গুটিয়ে সত্তাটুকু
অভ্রভেদী হাওয়া যেন গেছে ঝরে বহুদূর
জোছনার দেরাজে রয়েছে লাগোয়া বিশ্বাস
তার ডানা কেটে ফেলি রোজ
গোলাপের কাটা হয়ে তাই বিঁধে চলে খুব
অন্তরে অন্তরে…
জিজ্ঞাসু স্তনের মত ওই উঁচুতে
ওভাবেই ছিল রাত রিরংসার বুকে হেলে
কোথাও যে ছিল স্তন, কোথাও নিতম্ব
এই রাত ভাতের মতন ঝরিয়েছে ফেনা
নীরবে গিয়েছে বুকের সিম্ফনি শুনতে।
জোনাকি উত্তর কালে ঘর কার আছে বসে
ঝিমঝিম মাথা ধরা সুরের মতন
নিভিয়ে রাতের কালো, জিজ্ঞাসু স্তনের মত
ওই উঁচুতে!
এই যে কলেরা কালো
রাত পোহাবার মত নিকষ কালো
মৃত্যুঘন রাতের মত কালো
স্তনবৃন্তের মত প্রগাঢ় কালো
নিঃস্বার্থ চাঁদের মত ঝলমল ঝলমল কালো
গিলছে রাতের গিলোটিন, মস্তিষ্ক পড়েছে কাটা
অন্তর্গত সুরের মতন
উপত্যকা পেরিয়ে মায়াহরিণীর দল
ঘাসচোয়াল করেছে চর্বণ রাতের শিশিরে ভিজে
জড়িয়ে সুতনু দেহবীজে
কোন সে সবুজ দেশ।
ওরা ভেসে আসে রাতে
আনমনে ছিঁড়ে চলে ঘাস
হেলানো ভূ-ত্বকে।
ঘাসেরা যেমন ক্ষণকাল আগে জেনে যায়
প্রয়াণ দিবস
উত্তেজিত স্তনাগ্রের মত
তবু বায়ু বয়ে যায় কোন সে সীমান্তে?
নিতম্বের কোমলতা জুড়ে কোন সে আভাস
বয়ে যায় রাতে ঝিমঝিম মাথাধরা সুরের মতন
নিভিয়ে রাতের কালো, জিজ্ঞাসু স্তনের মত
ওই উঁচুতে!
স্তুতিবাক্যপরম্পরা
প্রতিটি ভুল থেকে ছুটে যাই আরও ভুলে
গভীর চোখের দিকে যেতে যেতে দিই ডুব
যে চোখে কচুরিপানা ভাসে তাতে
এখানেওখানে ভাসে পদ্ম, ভাসে ফুল
শিউলি-বকুল, ঝরা কাশফুল;
সমস্ত প্রতীতি হতে আরও দূরে যাই
অন্ধ-কালা-বাকহীন, ধ্যানীর মতন
পড়ে থাকি দেহে প্রাণ জমা রেখে
মহাশূন্যে চাই, কত তারা তাতে
তবু কী সীমান্তবিহীন গগন;
এইটুকু নদী আছে দেহের ভিতর
লোহিত-শ্বেত আর অণুচক্রিকা দলে
হৃদপিন্ডে স্তরে স্তরে জমে আছে
হাজার বছরের সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস
ভালবাসা আর একাকীত্ব;
উত্তরগোলার্ধ্ব থেকে পশ্চিমে যাই, পূর্বে যাই
মন থেকে একা বেরোই গভীর রাতে
সপ্তর্ষিমন্ডল দেখি, অন্ধকারে চেনা চেনা লাগে
নক্ষত্রের ছায়ায় আনুনাসিক বোধ
কত ভাবে অনুভবে করি রদ বিচরণ
যে হাতের মুঠোয় এসে ফের ফসকে গেছে
জোঁকের মতন, জলের মতন ফোটায় ফোটায়;
না দেখা ছবির মতন বুকের ভিতর আছে
না গেলা বায়ুর মতন এখানেও আছে
পাপোষে পায়ের ছাপের মতন লেগে আছে
এইটুকুমাত্র সুপেয় জীবন!
দিনের শেষলগ্নে
সাদা সাদা ঘাসফড়িঙ
ঘাসে ঘাসে উড়ছে শুধু
ধূধূ সন্ধ্যাবেলা—
এলাচগুচ্ছের মত সাদা
কী একটা ধাঁধাঁ শ্যেনচক্ষু
চেয়ে থাকে যেন এদিকটায়
ছোট ছোট চোখে, বিস্মিত প্রায়।
রাতের মলাটে বিক্ষুব্ধ দিন
ক্ষণকাল যেন জেগে জেগে
সাপের আহারের মত একা
ইশারায় শুধু আছে তার
মৃত্যুরূপী দেহে একটু সাড়া!
কী বিষণ্ণ জেগে আছে দূরে
মিটিমিটি তারা নৈসর্গের
মত করে একা, বিপন্নপ্রায়।
হাহাকার ঘেরা কৃশ গহ্বর
পৃথিবীব্যাপী যার আছে শুধু
আধোআধো ছায়া
কারে যেন দেখে, ভেবে যায়
পরম্পরাগত জল্পনায়
নীরবতা জুড়ে আসে ভোর
ক্রমশ অতি জল্পনায়
নাতিদীর্ঘ ভোর আসে আর
নিঃশ্বাসের মত একা রেখে
ছুটে ছুটে যায় বিবমিষায়!
ক্রমশ নিসর্গ ভাসে আর
তাতানো রোদের প্রখরতায়
ভাপা পিটার মত বিষণ্ণতায়
মূর্ছিত তাপিনী ভোরগুলো,
আহা! শিশিরের বাহু হতে
পাখির ডানা হতে, কেন যেন
এত এত দূরে সরে সরে যায়
কোলাহল ঘেরা কুটিলতায়!
টেরাকোটা বারান্দায় কেদারায়
ইংরেজ শাসনে রায়টে
যায়নি যে ভোর ক্ষয়ে ক্ষয়ে
মৃদু চক্ষুঃ যাচ্ছে ক্রমে সরে
পালাচ্ছে ক্রমশ জীবন পেরিয়ে
বহুদূর পটে আঁকা চোখের মত ভীড়ে
কাকতাড়ুয়ার কাঁধে বসে আরও দূরে
যাচ্ছে ক্রমশ সরে সরে।