যে কারনে আমি নরকবাসী । সহুল আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ আগস্ট ২০১৭, ১১:২১ অপরাহ্ণ, | ১৬৪৪ বার পঠিত
হোমো সেপিয়েন্সের লজ্জা
কোন এক সূর্যালোকের বেলায়, যখন
আকাশের কোনে দেখা যাচ্ছিল লাল আলো,
জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল এনে ইভ তুলে দিলেন আদমের হাতে;
জং ধরা মস্তিষ্কের জড়তা খসে পড়ে স্তরে স্তরে।
লজ্জায় অবনত হয়ে হোমো সেপিয়েন্স সেদিন
প্রথম আবিষ্কার করে নিজের অনাবৃত দেহ,
আবিষ্কার করে আবৃত করার কলাকৌশল,
আবিষ্কার করে — লজ্জা।
সেই থেকে, পৃথিবীর প্রত্যেক ঘূর্ণনের সাথে,
মানুষ, লজ্জায় ধীরে ধীরে
অনাবৃত দেহকে আবৃত করে,
হাত-পা-মুখ সব ঢাকতে থাকে, একে একে।
দিনের আলো যত প্রখর হয় মানুষের লজ্জার
তীব্রতাও তত প্রখর হতে থাকে,
রাত যত গভীর হয় সে লজ্জা ততই মৃদু হতে থাকে।
প্রখরতা ও মৃদুতার এই দ্বন্ধে মানবজাতির লজ্জা
শুধু বাড়তেই থাকে, জ্যামিতিক হারে।
আদম-ইভের যুগ পার হয়ে ঘূর্ণনের স্থায়ী প্রক্রিয়ায়
লজ্জা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র দেহতলে।
মানুষের লজ্জা এখন মাথায়, তাই চুল ঢেকে রাখে, যদিও
সেখানে বাসা বেঁধেছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের লাশগুলো।
মানুষের লজ্জা এখন মুখে, তাই নাক ঢেকে রাখে, যদিও
পাশের ডোবা হতে আসছে ফেলে আসা দেহের উৎকট গন্ধ।
মানুষের লজ্জা এখন হাতে, তাই হাত গুটিয়ে রাখে, যদিও
সে হাত দিয়েই তৈরি হচ্ছে একের পর এক শশ্মান।
মানুষের লজ্জা এখন চোখে, তাই চোখ ঢেকে রাখে, যদিও
চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিকৃত হাত-পা।
মানুষের লজ্জা এখন দেহের প্রতিটা অঙ্গে, প্রতিটা লোমে, প্রতিটা শিরায়, কেননা,
পাপের সৌধ উঠেছে আনাচে কানাচে।
তবে, লজ্জায় আক্রান্ত দেহের খুলির ভেতর লুকিয়ে থাকা
মস্তিষ্ক নিষ্কৃতি পেয়েছে লজ্জা থেকে। আর তাই,
সমুদ্রের তীরে উবু হয়ে পড়ে থাকে শিশুর লাশ,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
ক্যামেরায় ভাসে রক্তাক্ত শিশুর ছবি,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
ধ্বংসের পর ধ্বংস হয়ে যায় বসতবাড়ি,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
পিঁপড়ার সারির মতো উদ্বাস্তুরা ছোটে,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকে জননীরা,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
বাতাসে বারুদের গন্ধে আকাশে উড়ে শকুনেরা,
মানুষ এতে লজ্জা পায় না।
কিসে সেপিয়েন্সের লজ্জা, আর,
কিসে লজ্জা না — বোঝা বেশ দুষ্কর!
শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প
রাত ১২টা বেজে পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হলো।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিহ্নধারণকারী এক পশু
দাঁড়িয়েছিল তোমার খাটের পাশে;
মনে পড়ে চন্দ্রা? এই সেই খাট —
যার প্রতিটা ইঞ্ছি,
প্রতিটা অনু পরমানু
সাক্ষী হয়ে আছে আদম — ইভের প্রথম চুম্বনের;
যেথায় নরের সম্মুখে আবিষ্কৃত হয়েছিল নারী,
এবং, নারীর সম্মুখে নর;
দুজনেই উত্তাপ নিয়েছিল এক অচেনা অতিপ্রাকৃত প্রকৃত স্বর্গীয় বস্তুর,
যাহার নাম আমরা ভূখা কবিরা দিয়েছিলাম “ভালোবাসা”।
এবং, এখানেই আমি আবিষ্কার করেছিলাম এক দেবীকে।
ঠিক মধ্যরাতে আচল-ঘোমটা ফেলে দিয়ে ঐ মাতালের তলে
তুমিও বিসর্জন দিয়েছিলে আমার পরম পূজনীয় গ্রীক দেবীকে!
হাজার মাইল দূরে বসে আমি শিল্পী এক — একেছিলাম সে সঙ্গমদৃশ্য।
যে কারনে আমি নরকবাসী
ইশ্বরের প্রেমিকা উঠে এসেছিলেন হরপ্পা
থেকে — গত সন্ধ্যায়
বিস্তর আলাপ হয়েছে মুখোমুখি বসে
নিয়ন আলো উকি দিয়েছিল জানালায়।
তিনি (ইশ্বর) নাকি আজকাল বড্ড ব্যার্থ
হচ্ছেন মিলনে; বয়সের ভার
এবং দীর্ঘদিনের জং ধরা শরীর নিয়ে
এখন খুলতে পারছেন না স্বর্গ দুয়ার।
ভুলে গিয়েছেন, সৃষ্টির আনন্দ কিভাবে
সন্ধান দিত নতুন পথের;
আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি এখন
খোঁজ করেন অন্য এক ইশ্বরের।
তিনি (ইশ্বর) নাকি প্রায়শই আজকাল
গুলিয়ে ফেলেন — আলো আর আঁধারে,
জোয়ারের কালে হাঁটতে গিয়ে পথ
ভুলে ঢুকে পড়েন সামন্তের খোঁয়াড়ে।
২
এভাবেই ইশ্বরকে নিয়ে চলছিল গল্পের পর
গল্প; কবিতার পর কবিতা
তৈরি হচ্ছিল তাঁর (প্রেমিকার)
হাঁসিতে; ঝরছিল অজস্র মণিমুক্তা।
বয়েসি রাতের কালো কুচকুচে আকাশ
ছড়াচ্ছিল আলো — ভরে গিয়েছিল তারায় তারায়।
বৈষ্ণব পদাবলির ছন্দ হতে ওঠে আসা সে নারী
বললেন, ‘এবার গ্রহণ করো আমায়’।
দ্বিধাহীন চিত্তে মিলিত হই তাঁর (প্রেমিকার) সাথে
সুর তাল লয় সৃষ্টি হয় দীর্ঘ অযত্নের তানপুরাতে।
জোছনার প্রবল আলোয় সৃষ্টিতে মগ্ন দুজন—
দেখে ফেলেন ক্রোধান্ধ ইশ্বর;
অতঃপর, নরকই হয়ে ওঠে আমার
স্থায়ী নিবাস— সে রাতের পর।
কাঁটাতার
হাতে চুড়ি পরানো হলো, কোমরে বিছা,
পায়ে দেখলাম শিকল, বলা হলো —
এটা নাকি পায়েল! গলাতে ঝুলেছিল
দামি ধাতুর দড়ি, মস্তিষ্ক বাধা হলো অশ্লীলতার
কাঁটাতারে, অতঃপর,
বলা হলো আমাকে নাচতে — বলা হলো,
হাত পা মাথা ছাড়িয়ে হাওয়াতে দেহটাকে ছেড়ে দিতে।
মাথার উপরে ঠাটানো রোঁদ, সেই রোঁদে
উত্তপ্ত তখন কালো কালো পিচের রাস্তা,
রাস্তার প্রান্ত থেকেই আসছে গন্ধ, ডাস্টবিনের গন্ধ;
হ্যাঁ! ধরতে পেরেছেন! প্রতিদিন আপনি –
এবং আপনারা পেটপুরে খেয়ে যা রেখে দেন
অভুক্তের জন্যে ঐ ডাস্টবিনে, সেখান থেকেই আসছিল
ঝালসানো গন্ধ ! আমিও শুঁকে নিচ্ছিলাম নিতান্ত অনিচ্ছায়,
কেননা, আমি ক্ষুধার্ত! তবুতো – নাচতে হবে,
কেননা, আপনারা আদেশ দিয়েছেন।
আমি নাচলাম, একবার ডান হাত উপরেতো
আরেকবার বাম হাত নিচে,
তিড়িং বিড়িং করে নামচলাম। দেখলেন
আপনারা সবাই সোৎসাহে, রোঁদের তীব্র আলোতে
আপনাদের হাসি থেকে ঝরছিল মনি-মুক্তো।
আমি খুঁজছিলাম প্রতিটা তালের সাথে
আপনাদের মাঝে একজনকে — ভেবেছিলাম,
সে কাঁদবে আমার রকাক্ত ‘আমি’কে দেখে!
প্রেমিকের বন্দিত্ব কি প্রেমিকাকে কাঁদাবে না?
তাই, খুঁজছিলাম – ভিড়ের এক ফাঁকেই
প্রেমিকার চোখে চোখ পড়ল আমার।
দেখলাম, সে হাসছে, আপনাদের মতোই তালি দিচ্ছে ক্রমাগতভাবে।
গৃহহীনের চাঁদ দেখা
আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে — দেখেছো?
ছাদের তলা হতে বেরিয়ে এসেছে পঙ্গপালের
মতো একঝাক মানবসন্তান – চাঁদ দেখবে বলে;
আকাশের বুক হতে যে ছিদ্র ফিনকি দিয়ে
ঝরাচ্ছে নীলাভ আলো, তার তলে
স্নান করতে আজ শহরজুরে বড্ড জ্যাম
লেগে গিয়েছে; সন্তানেরা দলে দলে
ঝাপ দিয়েছে পোড়া মাংসের গন্ধে গন্ধময়
দুনিয়াতে — ঢলে পড়ছে রবী বাবুর কোলে
অসীম হুইস্কির টানে, কখনো ভেসে যাচ্ছে
লেনিন, মাও, চারুদের বিপ্লবের জলে।
অথচ, দেখো! আমরা কত না সৌভাগ্যবান!
আমাদের ‘পরে যে কোন ছাঁদ-ই নেই!