ওরা । স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ মে ২০১৭, ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৩৬ বার পঠিত
—না। তুমি এক্ষুনি যাবে।
শালিনীর এক উচ্চগ্রামে পিকুর যাবতীয় বিপ্লব তুচ্ছ হয়ে গেলো।
বাবা বলতেন— জীবনে কত সেন দ্যাখ্লাম, এই বখ্তিয়ারের সামনে সব্বাই দেহি লক্ষণ। ভাত ফেইল্যা খিড়কি ঠেইল্যা পলায়!…
পিকু মিনমিন করে একবার প্রতিবাদের চেষ্টামাত্র করেছিল, কিন্তু হঠাৎ-ই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় শেষমেশ তাও পরিণত হলো একটা উইন্ড্জ চেইনের নিতান্ত মনোজ্ঞ স্বরে।
ওদের গভীর দাম্পত্যে বেশ কিছুদিন ধরে দামামাবাদন চলেছে। আর এটা তৈরির নেপথ্যে ছোট্ট একটা চারপেয়ে মেয়ে।
এরই মধ্যে গত রাতে ওরা অশান্তির শৃঙ্গ জয় করে ফেললো। দু’পক্ষই দু’পক্ষের পুরুষোদ্ধার পর্বের শেষেও ক্ষান্ত হলো না। বরং সংঘর্ষবিরতিকে বিশ বাঁও জলে ফেলে শালিনী এক চরমতম দাবি পেশ করে বসলো। যে, বুটুং-কে তক্ষুনি বিদেয় দিয়ে আসতে হবে।
—কোথায়?
আহত গলায় পিকু জিজ্ঞেস করে।
—আমার জানার দরকার নেই তো! হাটে-মাঠে-বাজারে-ভাগাড়ে…, যেখানে ইচ্ছে তোমার। আরও মিষ্টি করে— দ্যাখো, আমি কিন্তু এখানে তোমার মতকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। পরে আবার কিছু ব’লো-ট’লো না যেন। শুধু এমন জায়গায় ফেলবে, চিনে যাতে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আর ফিরে আসতে না পারে। বাবাহ্, ওদের নাক যা সাংঘাতিক! ঘুরপথে নিয়ে যাবে, নাহলে…
—ঠিক আছে, ঠিক আছে…। উত্তেজিতভাবে শালিনীকে থামিয়ে দিলো পিকু— তা
বলে এখন পারবো না। সকাল হোক, দেখা যাবে।
তখনই শালিনী ওই সময়সীমা দেয়। পর মুহূর্তেই সিদ্ধান্তের কিছু রদবদলে মানে সকাল অবধি অপেক্ষা করতে কেন যে রাজি হলো কে জানে!…
একটা সময়, প্রফুল্লনগরের বিড়ালপাড়া বলে পরিচিতি ছিলো। যখন দু’চারখানা বড়ো বাগানবাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না, তখন এ চত্বর বিড়ালছানা পাচারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ছিলো লোকশ্রুত। পিকু মা’র মুখে গল্প শুনেছে— ওর ঠাকুরদাদাও নাকি ঠাকুমার উপদ্রবে মাঝেমধ্যেই এ পাপ করতেন। বাড়ি ফিরে বলতেন— বোঝ্লা বউমা, বড়োসড়ো একটা গেটওয়ালা বাড়ির সামনে ছাইড়্যা এ্যালাম অরে, মাছ-টাছ খেতি পারবখন!… তারপর এখানে ছোট ছোট প্লটে ছোট ছোট বাড়ির সংখ্যা যতই বাড়তে লাগল, ততই ওরা পাল্লায় কমলো। ওদের চেহারায় ছিয়াত্তরের কাঠিপনা দেখা দিলো। তবু, লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ কেউ এখনও যে ওদের ফেলে যেত না, এমনটা নয়। এমনই এক শীতের রাতে বুটুং-এর আশ্রয়প্রাপ্তি ও নামকরণ দুই-ই ঘটে গেলো। অনেকক্ষণ ধরে একটা কুঁই-কুঁই আওয়াজ পিকুর কানে আসছিলো। বাড়ির সামনে কালভার্টের নিচ থেকে টর্চ জ্বালিয়ে কোনওক্রমে ওকে যখন বের করে আনা হলো, অচেনার ভয়ে ওর তুলতুলে বুকটা তখনও দুড়দুড় করছে।
পিকু ওর অভ্যস্ত সংলাপ আওড়াতে শুরু করলো— “দুষ্টু তুমি…কত সুন্দর দেখতে তোমাকে তুমি নিজেও জানো না…গোলটাইপ মুখ, সরু সরু গোঁফ তোমার…”
তারপর বুকে তুলো উজিয়ে, উঠোনের ধুলো বেয়ে পিকু ঘরমুখো হাঁটতে থাকে…
—দ্যাখো, দ্যাখো, পিকু বললো, কী সুন্দর মুখখানা! নাকচেপ্টির নাম দিলাম বুটুং। ছোট নাকে অনুস্বারে মিলবে খন… ভালো হলো না?
প্রত্যুত্তরে একটু কাঁধ ঝাঁকালো শালিনী।…
বড়োপিসির মুখে না একদম ট্যাক্স নেই। বলেন— বুইলি বাবা, মা-য় না বিড়াল ছানাগো বুকের দুদ্ খাওয়াইতো। —ধ্যাৎ, কী যে বলে! পিকু অবাক হতো শুনে। বড়ো হয়ে পরে ওর মনে হয়েছে, এটা বোধহয় কোনও ফ্রয়েডীয় বিকার-টিকারই
হবে। তো এহেন ঠাকুমাই আবার নির্বিকারে এদের তাড়াতেনও। জটিল মনস্তত্ত্ব!
কিন্তু, শালিনীর ব্যাপারটা অন্য। বিড়ালের নামগন্ধই ও সহ্য করতে পারে না। শালিনী, বাড়ির উঠোন থেকে ম্যাক্সিমাম ঘরের মেঝে পর্যন্ত বুটুং-কে এন্ট্রি দিয়েছিলো। অবশ্য তার একটু বেশি অর্থাৎ কাঁটাকুঁটা দিয়ে বুটুং-এর কাছে কোনও রকম কোনও ধন্যতার আশা করছে না ও। তারপর ওই যা হয় আর কি, শান্তিচুক্তি অগ্রাহ্য করে বুটুং প্রথমে বিছানা, আস্তে আস্তে পিকুর কোল অবধি জবরদখল করে। শালিনীর কাছে আবার বিড়াল সংক্রান্ত কিছু মান্যবচন রয়েছে। যেমন, ওর সামনে দিয়ে বিড়াল হেঁটে গেলে ও কাটাকুটি খেলতে থাকে। এছাড়াও ও নিশ্চিত জানে যে, বিড়াল কখনও মালিকের উপকার করে না। ইনফ্যাক্ট ভালো পর্যন্ত চায় না। উল্টে আবার অভিশাপ দেয়— মালিক অন্ধ হয়ে যাক, তখন রান্নাঘরের সব মাছ সাঁটাতে পারবে! ওদিকে কুকুরকে দ্যাখো— একটুফোঁটা খেতে দিয়েছো কি দুয়োরে পড়ে থাকবে।…
ভাববার মতো কথাই বটে। কথাটায় যথেষ্ট আধুনিক সমাজরাজনীতির ছোঁয়া রয়েছে।
—বোকার মতো কথা ব’লো না তো; পিকু দাবড়ি দেয়, ওদের জীবনে কি ডিক্শনরি আছে যে ওরা অভিশাপ মানে জানবে? আর কার্যকারণ সম্পর্কটাই বা কী? মানুষ অন্ধ হয়ে গেলে রান্নাবান্নাটাই বা কে করবে, সেটা শুনি! ক্রসের এলোপাথারিতে প্রথম ইনিংসে বেমক্কা আউট হয়ে শালিনী দ্বিতীয় ইনিংসে রোগ-টোগের লাইনে এক্কেবারে স্ট্রেটব্যাটে খেলতে গেলো, অথচ তা সত্ত্বেও খোদার কসম পর্যুদস্ত হলো। শুধু তাই নয়, নিয়তিবাদ নিয়ে কিছু বাছাই লেকচারও ওকে শুনতে হলো।
তাই আজকাল শালিনীর ব্যারোমিটার বরাবর চড়েই থাকে।
ভোরবেলা আর পাঁচজন মানবসন্ততি অপাপবিদ্ধ মনে যখন সমর্পণের ফুল খুঁজতে বেরোয়, তখন শালিনী ঘুম থেকে উঠে পড়ার আগেভাগে, পিকুকে ঘরের আনাচকানাচ চষে বেড়াতে হয়। যেন বুটুং-এর একটা অপকর্ম প্রমাণিত হলেই সমস্ত দায়ভার মাথায় নিয়ে পিকুকে শিরস্ত্রাণ খুলে রাখতে হবে!…
সেদিন সন্ধেয়, শালিনী কাঁদো-কাঁদো মুখ করে পিকুর দ্বারস্থ হলো। না, বড়ো দেয়াল-আলমারিটায়, ওই তো যেখানে শালিনীর বিলাসবহুল শাড়িকাপড়গুলন থাকে, একটা নেংটি ইঁদুর দেখেছে। যদিও একঝলক, তবুও ওর মনে হচ্ছে যে, ধারণাটা নিতান্তই অমূলক নয়। এখন এই পাহাড়প্রমাণ মালপত্র নামাতে হবে, একথা ভেবেই শালিনীর হাউমাউ করতে ইচ্ছে করছে।
পিকু বললো— বেশ তো, আলমারিটা হাট করে বুটুং-কে ছেড়ে দাও। ব্যাটা কুঁড়েমনিষ্যি কোথাকার! তিনবেলা যে মাছ খাওয়াচ্ছি, দিক তার প্রতিদান।
বোঁচা নাকটা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে অল্প কিছুক্ষণের ভিতরেই অসভ্য নেংটির ঘেঁটি মট্কে তিরের মতো বুটুং বের হয়ে গেলো।
যাবার সময় পিকুকে একবার চেখে গেলো নাকি? ওরা সব টের পায়।
ঠিক সেদিনই খাবার টেবিলের নীচে বুটুং জীবনের এক ও একমাত্র ন্যক্কারজনক ছক্কাটা হাঁকিয়ে ফেললো।
অপরিসীম ঘেন্নায় লাফদড়ি খেলতে লাগলো শালিনী।
বুটুং-এর উপর নির্বাসনের ফতোয়া জারি হলো।
আজ সকালটা ঠিক অন্যান্য দিনের মতো করে শালিনীর শুরু হলো না। অনেক আগেই ঘুম ভাঙলো। মনে একটা ফুরফুরে ভাবও এসেছে ওর। পিকুকে ঠেলা মেরে তুললো।
—কী হলো? যেতে হবে না? ওঠো।
—কোথায়?
ঘুমজড়িত গলায় পিকু প্রশ্ন করলো।
শালিনী কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে বললো— তুমি জানো না?
—ওটা না করলেই নয়?
নরম গলায় বললো পিকু।
শালিনী শুনিনা-শুনিনা ভাব করে বললো— বুঝেছো, ভেবে দেখলাম, তুমি ওকে মাছবাজারেই বরং ছেড়ে এসো। খাওয়ার অভাব হবে না।
বুটুং-এর খাওয়ার ব্যাপারে হঠাৎ-ই শালিনীকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
—হ্যাঁ, পিকু বললো— লাথি খাবে, ঝাঁটা খাবে, গায়ে মাংসধোয়া জল ঢেলে দেবে কেউ কেউ। মাছের রক্তাক্ত কানকো খেয়ে খেয়ে একটা বাজারে মেয়েছেলের মতো চেহারা হবে ওর। ওর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেবার জন্য আর কেউই থাকবে না।
চোখের পুকুর থেকে লাভা নিক্ষেপ করলো শালিনী।
—বেশি-বেশি ঢং ক’রো না তো; বিরক্তি লাগে।
আর বাক্যব্যয় না করে পিকু উঠে পড়লো।
—কিন্তু ওকে ছাড়বো কী করে? আমি পিছন ফিরলেই তো ফের দৌড়ে আসবে, কোলে উঠতে চাইবে, তখন কী করবো?
আদ্যন্ত নিরীহভাবে পিকু জানতে চাইলো।
শালিনী সেই দাওয়াইও বাতলে রেখেছে।…
বাজারের থলিতে চেপে, সাইকেলের স্পোকে বাড়ি খেতে খেতে বুটুং যাচ্ছে। যন্ত্রের মতো নাবিকী করছে পিকু।
বাজার তখনও বসেনি। আশপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বুটুং-কে ছেড়ে দিলো পিকু। বুটুং দৌড়ে ফিরে আসছিলো। ওম্নি পটাং করে অ্যাই অ্যাত্ত বড়ো মাছের টুকরোটা ওর মুখের সামনে পিকু ফেলে দিলো।
বুদ্ধিটা শালিনীর। এটা আবিষ্কার করে শালিনীর নিজেরই নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করছিলো।
খাওয়া শেষ হতে হতেই পিকু হাওয়া হয়ে যাবে। ওখানকার ধাড়ি ধাড়ি প্রাচীন বাসিন্দারা আঁচড়ে-কামড়ে ওকে একদিন ওদের দলভুক্ত করেও নেবে। মানুষের বাচ্চা হলে বিছ্ড়নো বোনেদের পুনর্মিলনের একটা ফিল্মি ছক হয়তো বা তৈরি হতো।…
গেটের সামনে রানিমুখে শালিনী দাঁড়িয়ে ছিলো।
সাইকেল থামাতেই সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা চোখে পড়লো পিকুর।
—পাঁচিলের ফাঁকে এমা এটা কী রে!
পিকু বিড়বিড় করে ওঠে।
তারপর অনেক যত্নের হাতে তুলে আনে সদ্য মা-ছাড়া শিশুকে। তুলোর বল একটা। ধবধবে শাদা। এখনও চোখ ফোটেনি ভালো করে।
শালিনী ফালাফালা চোখে চেয়ে আছে।
পিকু ওর অভ্যস্ত সংলাপ আওড়াতে শুরু করলো— “দুষ্টু তুমি…কত সুন্দর দেখতে তোমাকে তুমি নিজেও জানো না…গোলটাইপ মুখ, সরু সরু গোঁফ তোমার…”
তারপর বুকে তুলো উজিয়ে, উঠোনের ধুলো বেয়ে পিকু ঘরমুখো হাঁটতে থাকে…