কাল আমার বিয়ে । ফাহমিদা ফাম্মী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১১:১৬ অপরাহ্ণ, | ২১৯৫ বার পঠিত
কাল আমার বিয়ে! —কিন্তু এ নিয়ে আমার মোটেও মাথা ব্যথা নেই! হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হওয়াতেও আমি মোটেই চিন্তিত না। মেয়েরা নাকি বিয়ের আগের রাতে নানা রকম টেনশন করে, রাতে নাকি ঘুম আসে না… আরও কত কি এত দিন পর্যন্ত শুনতে পেতাম কিন্তু আমার ভেতর তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না… আমি দিব্যি আছি, পা দোলাচ্ছি আর পেয়ারা খাচ্ছি, আমার মায়ের অবশ্য এ নিয়ে অনেক মাথা ব্যথা, বার বার তিনি আমার রুমে আসছেন, এক এক সময় এক এক বাহানা ধরে, একটু আগে এসে তো তিনি রীতি মত অবাক!
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কালকে পার্লারে যাবে সকাল সকাল আমি জানি তুমি তোমার বিয়ের মত এত ইম্পরট্যান্ট একটা দিনেও ঘুম থেকে উঠতে চাইবে না। তোমাকে টেনে হেঁচড়ে তুলতে হবে। তুমি যে বসে বসে পেয়ারা খাচ্ছ, ভালো কথা খাও কিন্তু সব কিছু তো রেডি করতে হবে, সকালে মোটেও সময় পাওয়া যাবে না! আমি মুখে এক গাঁদা পেয়ারা নিয়েই বলে উঠলাম’ মা আমি বিয়ে করছি না’! মা হকচকিয়ে বললেন মানে? আমি বললাম —কথাটা তো আমি বাংলায়ই বললাম, না বোঝার কি আছে? মা আমার কাছে এসে বসে বললেন, তুমি অনেক যন্ত্রণা করেছো আর না। এইবার তুমি যদি কোন বাগড়া বাঁধাও আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারবো না। এই নিয়ে তুমি তিনটা বিয়ে ভেঙেছ, অনেক কষ্টে সব কিছু ঠিক করেছি। এই বার তুমি যদি উল্টা পাল্টা কর আমি কিন্তু…।
আমি বললাম মা শোন এই সব ইমোশনাল কথা বলে টলে লাভ নাই। আমি যা বলছি তাই! দেখো ইরা! আসাদ খুব ভালো ছেলে, এমন ছেলে তুমি আর পাবে না। আর তা ছাড়া বিয়ের আগের রাতে বিয়ে ভাঙা ও সম্ভব না! আমি বললাম মা শোন। আসাদ সাহেব ভালো এটা আমি জানি! কিন্তু আমি তো ভালো না। তুমি জেনে শুনে ঐ ভালো লোকটার ক্ষতি করতে যাচ্ছ? আমি আজ রাতেই আসাদ সাহেব কে সব বলে দেবো!
—সব বলে দিবে মানে? মা! আবারো তুমি ত্যানা পেঁচাচ্ছ? আমি ত্যানা টেনা পেচাই নাই। তুমি বলবে না মানে বলবে না! দেখো মা আমি বলবোই! মা অনেক ক্ষণ আমাকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুতেই কোন লাভ হবে না দেখে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন… আমার মন খানিকটা খারাপ হলেও আমি পেয়ারা খাওয়ায় মন দিলাম… রাত ১২ টা। রিং টোন বাজছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আসাদ সাহেবের ফোন! হ্যালো ইরা?
হুম…কি কর? ঘুমাও নি এখনো? না, এখন তো সন্ধ্যা। ও আচ্ছা! —আসাদ সাহেব হুম বল, আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল। কি বলার ছিল? আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আমি চাই আপনি সব শোনেন এবং শোনার পর বিয়েটা ভেঙে দেন। আসাদ সাহেব বললেন শোন ইরা। তুমি কি বলতে কি বলছ তুমি নিজেই মনে হয় জানো না। আমি জানি, আপনাকে অনেক বড় একটা কথা জানানো হয় নাই। কি জানানো হয় নাই? বলছি, কিন্তু আপনার কাছে আমি সত্যি অনেক দুঃখিত। আপনি মনে হয় শুনেছেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ছিলাম। কিন্তু আপনি এটা জানেন না যে আমি আমার গ্রেজুয়েসন কমপ্লিট করতে পারি নাই। হলে আমি যে রুমে থাকতাম আমার রুম মেট মাদক আসক্ত ছিল। প্রথম প্রথম তাকে আমি এড়িয়ে চলেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি। টেস্ট নিতে গিয়ে কবে যে নিজেই মাদকাসক্ত হয়ে পরি, নিজেই টের পাই নি। .নেশা আমাকে আস্তে আস্তে গিলে খেয়েছে এবং এখনো খাচ্ছে… বিশ্বাস করুন আমি খুব অসুস্থ। অনেক দিন আমি তেজগাও মাদক নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রে ভর্তি ছিলাম… আমি নেশা করি বুঝতে পেরে বাবা মা আমাকে ঐ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি ওখান থেকেও পালিয়ে আসি, তিন মাস আমি কোথায় ছিলাম কি করেছি তা আপনাকে এখন আমি বলতে পারছি না বলে আমাকে মাফ করবেন, আশা করি আপনি বুঝে নেবেন… আমাকে বাবা মা আমার পরিবার অনেক কষ্টে খুজে বের করেছেন… এক সময় আমাকে অনেক কড়া পাহারার মধ্যে রাখা হয় যাতে দ্বিতীয় বার আমি পালিয়ে যেতে না পারি।
আপনি সব জেনে শুনেই…? হুম, আমি সব জেনে শুনেই তোমার কাছে এসেছি, তোমাকে আমার করে পাব ভেবে। আমার চোখে পানি চলে এল আমি রীতি মত কাঁদছি আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলছি —তুমি খারাপ, বড্ড বেশি খারাপ। আসাদ সাহেব বললেন জানি তো, বলেই তিনি আমার হাতটা ধরতে চাইলেন, আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম, —ধরবে না আমাকে, তুমি খারাপ খুব খারাপ!
মাদকদ্রব্যের প্রতি অপ্রিতিরোধ্য আকর্ষণ আমাকে এক সময় সুইসাইড করতেও উদ্ভদ্দ করে কিন্তু বাবা মায়ের কারনে আমি এই কাজটাও করতে পারিনি… এখনো প্রায় প্রতিদিন দিনে একটা সময় আমার শরীরে খিঁচুনি হয় আমি তখন ভুলে যাই আমার পাশে কে আছে আর আমি তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন… বলেই ফোনটা আমি কেটে দেই। আমি বুঝতে পারিনি আসাদ সাহেব কি বলবেন… কিন্তু তার দীর্ঘশ্বাস শুনে আমি বেশ বুঝতে পারি তিনি থমকে গেছেন, হয়ত কি বলবেন ভাষা খুজে পাচ্ছেন না… প্রচণ্ড ঘুমে আচ্ছন্ন আমি, সারারাত খিঁচুনির কারনে ঘুমাতে পারিনি। মা এসে আমাকে ডাকতে শুরু করলেন। মায়ের চেহারা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল আসাদ সাহেব কাউকে এখনো বিয়ে ভাঙার বিষয়ে কিছুই জানান নাই। বিয়ের তেমন কোন ধুমধাম নেই বাসায়। কয়েকজন বিশ্বাসী কাছের আত্মীয় ছাড়া কাউকেই আর তেমন বলা হয় নাই, এর অবশ্য একটা কারন আছে, যাতে কোন ভাবেই বিয়ের আগে বর পক্ষের কানে আমার অসুস্থতার কথাটা না যায়!
হাত ভরা চুরি পরে বসে আছি, কণে সাজাতে আমাকে খারাপ লাগছে না বললে ভুল হবে আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। আমি যে এতটা সুন্দরী তা তো আমি নিজেই জানতাম না, দীর্ঘ দুই বছর আয়নায় ভালো ভাবে নিজের চেহারা দেখিনি বলেই হয়ত নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার ধারনাই ছিল না। মা আমকে এসে বললেন ইরা বর পক্ষ তো এখনো এল না, আসার কথা ৭ টায় এখন বাজে প্রায় ১০ টা এখনো কেন আসলো না। আসাদ বা ওদের বাসার কেউ ফোনটাও ধরছে না। আমি হাসলাম আর বললাম মা, ওরা আসবেও না… তুমি বসো তো আমার পাশে, মায়ের কিছু বোঝার বাকি থাকলো না ধপ করে বসে পড়লেন মেঝেতে, তিনি নিস্তব্দ হয়ে বসে আছেন, আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমিও চুপ করেই বসে রইলাম। হঠাৎ আমার দুইটা কাজিন এসে বলল আপা আপা বর আসছে! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে… মা আমাকে কিছু না বলেই উঠে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলো। আমি বসে আছি ছিমছাম সাজানো একটা ঘরে। এই ঘরটাকে আর যাই বলা হোক বাসর ঘর বলা চলে না। পাশেই বসে আছেন আসাদ সাহেব। আমাদের মধ্যে কোন কথা হয়নি গত দুই ঘণ্টা যাবত, হঠাৎ নীরবতা ভেঙে আসাদ সাহেব আমাকে বললেন। ইরা, হুম! তোমার মনে আছে? তোমার বইয়ের ফাঁকে মাঝে মাঝেই একটা চিরকুট পেতে? হুম; মনে আছে, কিন্তু এটা আপনি কিভাবে জানলেন? তোমার একটা কাছের বন্ধু ইরতাজের কথা মনে আছে? হুম, সে তো এখন আমেরিকায় থাকে। হ্যাঁ, তুমি জানো না যে আমি তার কাজিন। তোমাকে আমি প্রথম দেখি আমি তার মোবাইলের একটা গ্রুপ ছবিতে, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগে যায়, আমি বলবো না যে আমি তোমাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলি।
তবে তোমাকে আমার অনেক ভালোলেগে যায়। তারপর তোমাকে কি বলবো কিভাবে বলবো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তাকে দিয়েই তোমার বইয়ে চিরকুট গুঁজে দিতাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তোমাকে মুখে কিছু বলার আগেই তোমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমাকে ইরতাজ প্রথমে জানায় তোমার বিয়ে হয়ে গেছে আমিও মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু সেদিন তোমাকে ঐ শপিং মলে দেখে আমার মনে হল তোমার বিয়ে হয় নাই, পরে আমি আবার ইরতাজের সাথে যোগাযোগ করি তখন সে এক এক করে আমাকে সব বলে দেয়…।
তার মানে কি? আপনি সব জেনে শুনেই…? হুম, আমি সব জেনে শুনেই তোমার কাছে এসেছি, তোমাকে আমার করে পাব ভেবে। আমার চোখে পানি চলে এল আমি রীতি মত কাঁদছি আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলছি —তুমি খারাপ, বড্ড বেশি খারাপ। আসাদ সাহেব বললেন জানি তো, বলেই তিনি আমার হাতটা ধরতে চাইলেন, আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম, —ধরবে না আমাকে, তুমি খারাপ খুব খারাপ! আসাদ সাহেব আমকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন আমি তার বুকে নাক ঘসতে ঘসতে বললাম তুমি খারাপ বড্ড বেশি খারাপ…