আয়নাময় উত্তরীয় এবং বিষাক্ত গরল । ফারুক সুমন
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ৮:২০ পূর্বাহ্ণ, | ১৬১৭ বার পঠিত
বায়বীয় কথামালা
আমার ব্যর্থতা এখানেই যে,
উড়তে থাকা এই ছেঁড়া পৃষ্ঠাকে ধরতে পারিনি।
এখানে লেপ্টে আছে মায়ের মুখ, পিতার তর্জনী।
বোনের বেণী দোলানো উঠান
দাদার মেহেদী রাঙানো দাড়ি
সবই উৎকীর্ণ আছে এই ছেঁড়া পৃষ্ঠায়।
গাঁয়ের প্রান্তিকে স্তম্ভিত তেঁতুল গাছে
প্রতি সন্ধ্যায় হাহ হা করে হেসে ওঠতো ভূত-পেত্নি
দাদি বলতেন, আজ ওদের বিয়ে বাড়ি, মরা মাছ
আর হাজার প্যাঁচের জিলাপি খাবে ওরা।
আমার ব্যর্থতা এখানেই যে,
উড়তে থাকা এই ছেঁড়া পৃষ্ঠাকে ধরতে পারিনি।
অনুবাদ করতে পারিনি অতিপ্রাকৃত এসবের মর্মকথা।
প্রতি সন্ধ্যায়—
ডানাভাঙা খেজুর গাছের বিমূর্ত বিলাপ
আর শুকনো কলাপাতার করুণ কাতরানি—
আমাকে নিয়ে যেতো ভীত-সন্ত্রস্ত কোন জনপদে।
টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের আলোয়
সুদূর পরানপুর থেকে ভেসে আসতো গান—
মনু মিয়ার দেশে রে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজে রে।
এই সব আনন্দ নাদ ক্রমাগত ভাসতো রাতের ইথারে।
আর আমি নেই নেই হয়ে গুটিয়ে যেতাম মায়ের জঠরে।
ও আমার রাতকানা সময়,
এবার ফিরিয়ে দাও ছেঁড়াপৃষ্ঠাবলি
যেখানে রেখাঙ্কিত বায়বীয় কথামালা।
ঘুমিয়ে থেকেও কেউ কেউ দেখে
আমি বুঝি অবুঝই থেকে গেলাম অপ্সরী!
যেখানে দিন রাত্রির বৈষম্যে-
নিয়তই নিহত হয় সান্ধ্যনদী।
তার খোঁজ রাখ তুমি?
শুনেছি, মানুষ মুগ্ধ হয় মৌলিকতার টানে,
আবার হতে হতে মরেও যায়।
হাসতে চাই তোমার গ্রীবার মতো
যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে গোধূলির আলো
স্থির, মসৃণ। আহা!
আমি যেন মুগ্ধতার অনলে ঝলসে যাওয়া
এক পোড়াবাড়ি।
তোমার কণ্ঠ বেয়ে শুয়ে আছে মাতামুহুরি নদী।
আপন ইচ্ছায় বইছে আর বইছে।
কত প্রগাঢ় আহ্বানে তোমাকে বাঁধি
স্বর্গীয় সব সুরে তোমাকে সাধি।
আহত দুটি হাত গুটিয়ে নিয়ে
চোখে-চোখে ডাকি।
সবুজ সজনে পাতার মতো কাঁপি আর কাঁপি।
মানুষ যা কিছু না পায়
তার প্রতি ক্রমাগত ধায়।
কোথায়?
পাওয়া না পাওয়া নদীর মোহনা কোথায়?
ঘুমিয়ে থেকেও কেউ কেউ দেখে।
কার নাক দিয়ে ঝরে তরল জল,
কে অবলীলায় পান করে বিষাক্ত গরল।
নির্দিষ্ট নক্ষত্রের প্রতি
নীরবতা মানেই নিস্পৃহতা নয়;
দূরত্ব মানেই বিমুখতা নয়,
নীরবতা আর দূরত্ব দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ
যেখানে ভালবাসা মৌন কথা কয়।
তোমার আবির্ভাবে বিমোহিত সাতরঙ,
সময়ের সমষ্টি করেছি রঙিন।
উচ্ছ্বাসে ফেলে আসা পথে পথে কার পদছাপ?
কারো না; কিছু ফেনিল সময়
কিছু আবেগের ধারাপাত।
হে মূর্ছিত সময়—
শিশুর মুখের মতো ঘুমিয়ে যাও,
আমি উবু হয়ে দেখি
কেমন কেঁদেছো তুমি ঘুমোনোর আগে।
গন্তব্য থেমে থাক চোখের কোণে,
বেদনার নীলনদে।
তোমার চোখ ছেড়ে কোথাও নেই নীরব সুন্দর।
মৌনমন্দির তুমি; কেবলি প্রশান্তির সুধা ছড়াও
আমাকে দাও প্রাচীন পিরামিড।
যেখানে খোদাই করা পৌরাণিক শোকগাঁথা।
ভালোবাসার উপলখণ্ড
যখন অসুস্থ্ থাকো—
এই নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ থেকে,
আমাকে কে যেন নিয়ে যায় হিমঘরে।
হিমায়িত কোনো দ্রব্যের মতো জমতে থাকি;
পড়ে থাকি নিঃসাড়।
আমাতে ভর করে নির্জন কোনো দ্বীপ।
কুয়াশা—ভেজা প্রজাপতির ডানার মতো
রিক্ততায় ছেয়ে যায় সমস্ত আকাশ।
ধুলোপড়া পাতার মতো মলিন মুখাবয়ব।
তুমি যখন অসুস্থ থাকো—
আমার বুকের উপর আড়াআড়ি পড়ে থাকে হাত।
নিঃশব্দে কেটে যায়; রক্ত ঝরায় নিষ্ঠুর করাত।
জানি,
ভালোবাসার বীজতলাই কেবল হতে পারে এমন কণ্টকময়।
তবুও স্থির থাকেনি,
ভালোবাসার উপলখণ্ড গড়িয়ে পড়েছে সময়ের আবর্তে।
এই দুঃসময়ে হাহাকারের আকার নেই,
ভেতরের অনুভূতিকে পাঠযোগ্য শব্দে সাজাই বসে বসে।
অভাগা শুধায়,
তোমাকেই ভালোবাসি
এই বাক্যটি লেখা হোক
পৃথিবীর সকল শূন্য পৃষ্ঠায়।
আয়নাময় উত্তরীয়
কবি খলিল মাহমুদকে
আয়নাময় উত্তরীয় ছিল তোমার গায়ে,
বিম্বিত আলো ঠিকরে পড়তো অলক্ষে।
অথচ দৃষ্টিহীন দূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারিনি।
আমি পলাতক মৌমাছি;
উবু হয়ে পড়েছিলাম অন্য অলিন্দে, কৃত্রিম টবে।
তোমার প্রস্থানের বহুদিন পরে,
ঈষদুষ্ণ হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে—
যেন প্রবল ঝড়ের রাতে নিভু নিভু বাতি হয়ে
আমার আরতি এই বলে—
এখানে আসো যদি ফিরে
তোমার কবিপ্রাণ ভরিয়ে দেবো,
হাজার ফুল আর পাখিবৎ শিশুদের কলরোলে।
তুমি নেই বলে,
এখন এখানে ধাতব সন্ধ্যা নামে।
রোবটিক বাতাসে ভারী হয় বুক,
উৎকণ্ঠিত প্রতিটি মুখে শুধু
দুঃস্বপ্নের কানামাছি উড়া উড়ি করে।
হতাশা নিয়ে ফিরে যায় সবে
ঘরহীন কোনো ঘরে।
এখন এখানে নেই সরব উন্মোচন,
নীরব বৃক্ষ হয়ে চেয়ে থাকে প্রকাশের মন।
অথচ, ভাষার বধিরতা বড় ভয়ানক,
কে জানে! আর কোনো দিন
ফিরবে কী তুমি আচানক?