বিন্দুবাসিনী উদ্যান । আবু হেনা মোস্তফা এনাম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ৭:০১ অপরাহ্ণ, | ১৯১৯ বার পঠিত
আশ্চর্য এখন, সুদূর মৃত্যুতীর্থ পেরিয়ে সেই কোমল ধ্বনিতরঙ্গ — পরিব্যাপ্ত ও মর্মরিত। মর্মরিত নিকুঞ্জের এত নিকটে, গ্রীষ্মিত দুপুরের দৃশ্যোজ্জ্বল সবুজ আলোর ফসফরাস গাছগাছালির ভেতর নদীর ঝিকিমিকি। সেখানে, বৃক্ষের উপকণ্ঠে, নীলাব্ধি দিন অজস্র তরঙ্গে চঞ্চল; অদৃশ্য হাতছানিতে করুণা, কী সুদূর আর অপরূপময়তা। তবু শ্রুতি ও স্পর্শে সময় কেবল বিবিধ কণ্ঠস্বর নিয়ে আসে — কেননা তার দৃশ্যের ভেতর অবিরাম আলো অথবা নিরবচ্ছিন্ন আঁধারের অনুবাদ — নিকটস্থ অথবা সুদূর, সকাল অথবা বিকেলের মর্মার্থ বৈচিত্র্যহীন। একেকটা সকাল দুপুর সন্ধ্যা কত দূরস্থিত; একেকটা দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি অথবা প্রভাত দূরস্থিত স্মৃতিদৃশ্যের প্রাজ্ঞ ও প্রেতার্ত রোদ্দুর বয়ে যাওয়া; স্থির, নিষ্কম্প; দৃশ্যমান না লুপ্ত; কেবল কখনো কখনো পাখির কণ্ঠস্বর দ্বিখণ্ডিত স্নায়ুর ভেতর সময়ের উল্লম্ফন এঁকে দেয়। পাখির কণ্ঠস্বর স্খলিত হলে তার মনশ্চক্ষু স্থির নক্ষত্র। তখন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় সকাল, বুক উঁচিয়ে ছুঁয়ে দেয় মধ্যাহ্ন, ধূসর চুলে অনুভব করে সন্ধ্যার নতুন জ্যোতিষ্ক। আর জীর্ণপল্লবের নিস্তব্ধতার ভেতর লুণ্ঠিত নদী হিম হিম জল ফণিমনসা নিঃসঙ্গ কুকুর আর নিঃসঙ্কোচ শঙ্খচূড়া হারিয়ে গেলে জলবসন্তে ধাঁধানো কুজ্ঝটিকা, কুণ্ডলিত কালো কালো কুয়াশার স্তম্ভ। তখন সময় নির্বোধ এক প্রতিবিম্ব; প্রহেলিকাময় চন্দ্রদগ্ধ কুয়াশার অভ্রভেদী প্রেতার্ত বিকট ছায়ান্ধকার বিরামহীন হামাগুড়ি দিয়ে স্পর্শকাতরতাকে সময় নিঃসঙ্কোচে কামড়েখামচে ভয়ঙ্কর বিসর্পিল। আর বটপল্লবের মর্মর হৃৎপিণ্ডের অন্তর্গত, মর্মর গ্রীবার রক্তে, সহনশীলতা এবং ধৈর্যে মর্মরিত ভঙ্গুরতার ভেতর তখন ভেসে এল নূপুরের গুঞ্জন — মৃদু, স্খলিত নরম জ্যোৎস্নার ধ্বনি অথবা টুপটাপ নিমফল। গুঞ্জন আর বটপল্লবের ছায়াময় নিদ্রাশিকারী আতপ্ত করুণ বাতাস। ভেসে এল আর তখনই তার ঘুম কণ্টকশোভিত, অলক্ষে এলোমেলো, নদীসূর্যনীলিমারৌদ্রমর্মরিত কুহকে ঘুম ভেঙে গেল। নিঃসঙ্গ বিজন আঁধারে নিরালম্বিত তার দগ্ধ ভস্মের মধ্যে বীভৎস চোখ দুটো হলোকাস্ট হয়ে এলে দৃশ্যাবলি এবং রঙবেরঙের চক্রাকার আলোর ঝিকমিক লুপ্ত চোখে একটির পর একটি মৃত্যুধূসর ধস্ত রেখা টেনে দিয়ে যাচ্ছে, আর অবিরাম সূর্যকিরণদগ্ধ দুপুরে স্তব্ধতা হু হু করে উঠলে আকাশ ক্রুদ্ধ — গগনধূলিঘূর্ণির আবর্তনে হৃৎপিণ্ডে পিপাসিত নখ গেঁথে যায়। রৌদ্রধূলিঘূর্ণির ক্রুদ্ধ আস্ফালনে শঙ্খচূড়াটি ঝিকিমিকি শরীর লেজে ভর দিয়ে ফণা বিস্তার করে। ঈর্ষায়, অভিমানে সবুজ শঙ্খিনী জিব ছুঁড়ে মারে নূপুরের গুঞ্জরিত নিকুঞ্জবিতানে।
তবু, তখন, দগ্ধ হাওয়ায় প্রতিবিম্বিত ছিল স্মৃতিঅভ্যুদয়গুলো, মাটির গভীরে অঙ্কুরিত নৈশগীতি, কীটের বাস্তুতন্ত্র, পল্লবের মর্মরে রূপায়িত নূপুরের গুঞ্জন — এইসব অভ্যুদয়ের চণ্ড হাওয়ায় তাতানো খুন্তির মতো বিন্দুবাসিনীর বয়স গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের অপরূপ পাতায় চুলবুল করে ওঠে। ঘোলা জলশ্বাসে ভেজা মহিষের অজস্র আষাঢ়ে এলো চুল তার, স্রোতস্বিনী বংশীর গর্ভঘূর্ণি ফেড়ে তুলে আনা এঁটেল মাটিতে মাজা — যেন লণ্ঠনের কটাশে আলোয় সুবর্ণধূলিলাবণ্য। আঁচলের নিচে স্ফিত যুগলস্তন ধূমঅগ্নিকুণ্ডে ফুঁসে উঠলে বিন্দুবাসিনীর তামাটে শরীর অনাবৃত হয়। ঝনঝনে রৌদ্রের গন্ধ নিভৃত যুগলস্তনের খোলস ছেড়ে চিবুক চোখ আর উড়ন্ত চুল আগুনের তীক্ষè তার জড়িয়ে ধরে, ভ্রুর ভেতর শঙ্খচূড়ার হিলহিলে জিহ্বা উন্মত্ত কাঁপে — জ্যান্ত, ক্রুদ্ধ তার চঞ্চলতা। এখন রৌদ্র ঋতুর দিন! চঞ্চল পত্রপুঞ্জের বরফিকাটা রৌদ্রছায়াবিদ্ধ মঞ্জুরিত দুপুর, চঞ্চলতা প্রজাপতি, চঞ্চলতা বংশীর বালুতটে ঝিকিমিকি আর চঞ্চলতা মৃত্যুশিকারী খয়েরি পাতার ভঙ্গুর হ্রেষা। তখন শুকনো পাতার দিনপঞ্জিতে ঐন্দ্রজালিক গিরগিটি হেঁটে গেলে মনে হয় অশোকের পদধ্বনি — আর সমস্তই স্তব্ধতা, গুরুগুরু; হয়তো গোধূলি অথবা নক্ষত্রের গাঢ় আঁধার, রৌদ্রের শ্বাস; পাখির কণ্ঠস্বর, গুল্ম আর পতঙ্গের জীবন, প্রতিধ্বনিময় বাতাস, সেলাইকলের অজস্র টঙ্কার, উত্তরের লুপ্তপ্রায় অরণ্যকঙ্কাল, দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তর-পুবে প্রাগৈতিহাসিক আকাশ, সহস্র সবুজ সবুজ আদিম গ্রাম নদীর শুকনো খোলের ভেতর নিশ্চিহ্ন। সে কেবল বিন্দুবাসিনী, একরত্তি বিন্দু; বিন্দু বিন্দু। বড়ো নিঃসহায়।
বিন্দুবাসিনী বাঁশের চ্যাঙারি বুকের নিভৃত নির্ভার দুঃখী বৃত্তনিকুঞ্জে বহন করে বেরিয়ে পড়ে; হয়তো, শীর্ণ হয়ে ওঠা ইতিহাস নদীর বহমান নিগূঢ়তা চৌচির করে, নাগরিক রক্ত শালবৃক্ষের বৃত্তনিকুঞ্জ তথা লুণ্ঠিত পাতার খয়েরি ও হলুদকে আড়ষ্ট করেছিল; এখন সে থামে শালবৃক্ষ উদ্যানে — উদ্যানে তখন ভোর ওঠে, উদ্যানে এখন রাগী সূর্য ওঠে, উদ্যানে শিরিষ কদম আম বট বকুল বেত গাব ডুমুরের জঙ্গল ওঠে, উদ্যানে মাটির ধূসরতার ভেতর, শ্যাওলার শাশ্বত আখ্যানের ভেতর পাখির কলরোল অনুভূতিবিলীন মায়াময় শূন্যতা ওঠে; দিকচক্রবাল শূন্যউদ্যানে নগর ওঠে। নগরের ভেতর উদ্যান, নগরের মৃৎশিল্পে উদ্যান, তার উপর প্রাচীন বিদগ্ধ অন্ধকার, কার্নিসে কার্নিসে জ্যোৎস্নাশিকারী নিঃসঙ্কোচ কামনাবিন্দু। নগরজীবনের ইতিহাসের রক্তোদ্যান উবু হয়ে থাকে। উদ্যানের ছায়া বিন্দুবাসিনী। বিন্দুবাসিনী শালবৃক্ষনিচয়ের ছায়া অম্লান করে। বিন্দুবাসিনীর শরীর, শরীরের ছায়া, ছায়ার শরীর, শরীরের ছায়া শান্তি, শান্ত ছায়ার ভেতর ছায়ার মর্মার্থ এই যে — অশোককে বেপথু ও উন্মনা করা; যে অশোক একটি নদীর নাম — বংশী নয়। শালবৃক্ষনিচয় একদা যেমন অরণ্যের বিস্তার ছিল, ছিল নৈসর্গিক আঁধার, ছিল গন্ধের সোনালি, ছিল বিবিধ বিহঙ্গগান, ছিল বৃক্ষফুলের জ্যোৎস্না, ছিল জ্যোৎস্নাপল্লবের প্রভাত, টুকরো টুকরো আলোর ঝিকিমিকি। এখন মৃত্যুকে ঐশ্বর্য করা — অরণ্য এখন মৃত একটি নদীর হাড় — হাড় আর রক্তের ভেতর, আশ্চর্য এখন, শান্ত ও করুণ কালো রক্তের হিলহিলে নদীস্রাব; নদীস্রাবের দু-তীর উজ্জ্বল দুঃখের নিদারুণ বালুরাশি অলৌকিক শীর্ণতায় নির্জীব; বিনম্র বংশী নয় অশোক। অশোক অশ্বক্ষুরের রক্তচাবুক। দস্যু তাতারের পেশি ওর কিম্ভুত বাহুতে বুকে বিদ্যুৎগ্রীবা ক্ষেপে উঠছে; খরস্রোতা ক্ষুরের শৃঙ্গারে পাড় ভেঙে উচ্ছৃত জলের ঘূর্ণাবর্ত নদী। অথচ বিন্দুবাসিনীর নূপুরনিক্কণ শুনে দুরুদুরু হৃৎকম্প, কম্পনের শব্দে মাটির দিব্যকান্তি সবুজতার ছবি রোমাঞ্চিত হয়।
গহন বালুর মরীচিকায় থুথু ছিটিয়ে, যে বিন্দুবাসিনী, রৌদ্রছায়ার নিরুদ্বিগ্ন রোমাঞ্চ আর কোমলতায় তির্যক অঙ্গ দুলিয়ে শিরিষ কদম আম বট বকুল বেত আর লুপ্তপ্রায় শালবনে দুপুরের ভেতর ঝকমকে রৌদ্রকুহরিত বিন্দুবাসিনী থামে। থামে পাখিদের কূজনে, থামে মৃত পল্লবের মর্মরে। মর্মরিত শুকনো পাতা ঝেঁটিয়ে কুড়োয় বিন্দুবাসিনী — তাতে গুল্মের জীবন পতঙ্গের সবুজ বাস্তুতন্ত্র অথবা পাখির কণ্ঠস্বর থাকে অবিরল ও প্রগাঢ় স্তূপময় পাতার আঁধার ধূসরতা, রূপালি কোমরবন্ধনি অথচ দোলায়িত ব্যাকুল ঝাঁটের তোড়ে ঘোরলাগা ধূলিকুণ্ডলি — ধূলিমেঘসম্ভার, রৌদ্রের পৌরাণিক ধূলিজ্যোৎস্না, ধুলোর গন্ধ সবুজ পাতার সমূহে, রৌদ্রে, হাওয়ায়; ধাবমান ধুলোর গ্লেসিয়ার নক্ষত্রে — ফলে নতুন স্তব্ধতার ঐকতান স্বচ্ছ নীল ধূলিগন্ধে ঐন্দ্রজালিক। ঝাঁটের তোড়ে বিন্দুবাসিনী ধূলিজ্যোৎস্নায় ভাসমান রাজহংসীর পেখম উড়িয়ে — নিঃসঙ্কোচ বিন্দুবাসিনী মহিমান্বিত আঁটোসাঁটো স্তনভারে আনত; তার ধূলিলিপ্ত কালো পদযুগলে রূপার নূপুর, শুকনো পাতার মর্মর তরঙ্গ না কি নূপুরের রুনুরুনু অনুরণন; সূক্ষ্ম ধ্বনিখঞ্জন; যেমন, সম্ভবত ঝিল্লিরব রাত্রির নকটার্ন; তার, অশোকের বোধের মধ্যে বিকারকে কাতরতা করেছিল — বিন্দুবাসিনী এইসব শুকনো সরল বৃক্ষপল্লব কুড়িয়ে কুড়িয়ে কুড়িয়ে ছড়িয়ে দেয় কুটিরের সামনে, উঠোনে; যে কুটির বটবৃক্ষের নৈসর্গিক ছায়ায়, মুঠো মুঠো ছায়াপ্রক্ষেপণে। যে উঠোনে বংশীর হাওয়া, উঠোনে রৌদ্রের বাওকুড়ানি, উঠোনে ঘৃতকুমারী ঝোপ, উঠোনে তুলসির ঘুম ঘুম গন্ধ — আলোর স্বপ্নের ভেতর তুলসির গন্ধ, আলোর ঘুমের গন্ধে তুলসির আশ্চর্য, ছায়ার সবুজের স্পর্শে তুলসির কালো স্বাদ। আর উঠোনের ভেতর লেবুঝোপের কাঁটা — লেবুফুলের শ্বেতগন্ধ নয়, বিন্দুবাসিনী লেবুঝোপের কাঁটা ভালোবাসে তার অস্তিত্বে, আর প্রায় জনবিরল বিক্ষিপ্ত ঝোপজঙ্গল, লেবুফুলের শ্বেতগন্ধসম্ভারে ঘেরা উঠোনে পল্লবছায়ায় শঙ্খচূড়ার নিদ্রাশ্বাস। কুটিরের জীর্ণতার ভেতর দিয়ে ঘরের আঁধারে টুকরো রৌদ্রের ঐশ্বর্য। ঘরের সামনে মাটির বারান্দার চারপাশে শ্যাওলার লক্ষ্যহীন বিস্তার ছিল, এখন, বিন্দুবাসিনীর বাবা, যে বোনো, অঞ্জলিবদ্ধ মায়ার ভেতর যে কাপড় সেলাইয়ের কল চালাত; এখন সেইটুকু স্মৃতি বড়ো মোহ জাগ্রত করে। এখন যে অন্ধ এবং নির্বিকার; তার অন্ধ আলোলুপ্ত দৃষ্টিবিভ্রমে সেলাইকল প্রাগৈতিহাসিক ফসিল — স্পর্শহীন সেই মরজগতে ধূলি ইঁদুর আরশোলা আর মাকড়সার নির্বিঘœ তন্তুসংসার বিস্তারিত ছিল। এখন, ক্ষুধার ঝকঝকে ইস্পাত রুক্ষ আর ধূসর দিকচক্রবাল প্রতিফলিত করে দিলে বিন্দুবাসিনী সেলাইকল নিয়ে বসে। এইটুকু, দুজনের ক্ষুধার অহঙ্কার তিরোহিত হলে, তখন, নামফলকে উৎকীর্ণ এপিটাফের নিস্তব্ধতা সেলাইকলে; এখন লুপ্তপ্রায় শালফুলের স্মৃতিচন্দ্রালোক।
শালফুলের ঘ্রাণের ভেতর দিয়ে, কেননা, গাঁয়ের লোক আসে, কাপড় সেলাইয়ের নিবেদন নিয়ে। সেলাইয়ে ঝুঁকে নিবেদিত বিন্দুবাসিনীকে তারা দুচোখের সূক্ষ্ম সুইয়ে সেলাই করে বিন্দুবাসিনীর পা। বুক। বাহু। নাক। ঠোঁট। চিবুক। চুলের কালো। নূপুরের গুঞ্জন। লোকেরা সেলাইয়ের ভেতর শালফুলের স্মৃতি স্পর্শ করে, সেলাইয়ের ভেতর হাত স্পর্শ করে, হাতের ভেতর সেলাই স্পর্শ করে, হাতের ভেতর রক্তের শিশির স্পর্শ করে, রক্তপ্রণীত ছায়াতরঙ্গে ঘুম ঘুম অগ্নিময়ূরের ভ্রƒকুটি, সেলাইয়ের ভেতর গাঁয়ের প্রান্তে ঢুকে-পড়া লুপ্ত বনভূমি অথবা বনের বিরলতার ভেতর গ্রামের যে ইতিহাস ঘরের যে আঁধার আঁধারের ভেতর যে অন্ধ বাবা শুকনো পাতার সমারোহে যে নিদ্রা নিদ্রার ভেতর গাঁয়ের লোকেরা ঢুকে পড়ে, জাগরণের ভেতর গাঁয়ের লোকেরা ঢুকে পড়ে, শুকনো পাতার স্তূপে ঢুকে পড়ে, গন্ধের বিস্তারে, ছায়ার ভেতর, শালপুষ্পের নিরুদ্যম স্মৃতির ভেতর গাঁয়ের লোকেরা ঢুকে পড়ে; তখন, একদিন বিন্দুবাসিনীর ভীরুতা গাঁয়ের লোকদের পাতা কুড়ানো ঝাঁটা দেখিয়েছিল। আর, যে বিন্দুবাসিনী লেবুগাছের কাঁটা ভালোবাসে তার অস্তিত্বে, লেবুগাছের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল সে — গাছ আমারে ঠাঁই দেও; শ্বেতপুষ্পগন্ধে আকুল লেবুগাছের নবীন ডাল জড়িয়ে ধরতেই বিন্দুবাসিনী কচি সবুজ শাখায় পাতায় কাঁটায় ঝামরে-ওঠা লেবুগাছ হয়ে যায়। গাঁয়ের লোকেরা লেবুগাছের চারপাশ ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা নামে, জ্যোৎস্না নামে; গাঁয়ের লোকেরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, গাঁয়ের সন্ধ্যায় দ্বন্দ্বের উত্তেজনা প্লাবিত হয়, উত্তেজনার মধ্যে ঈর্ষা হয়, উত্তেজনার সন্ধ্যায় গাঁয়ের কেউ কেউ নিরুদ্দেশ হলে আতঙ্ক হয়, গাঁয়ের নিরুদ্দেশ লোকদের সন্ধানে থানাপুলিশ এক অনির্বচনীয় শোক বয়ে আনে; শোকের ভেতর নৈসর্গিক মৃত্যু — বৃক্ষের মৃত্যু, পোকার মৃত্যু, শ্যাওলার মৃত্যু, পাখির মৃত্যু, নদীর মৃত্যু, ছায়ার মৃত্যু, সন্ধ্যার মৃত্যু, ইতিহাসের মৃত্যুউৎসব চলে। বৃক্ষের মৃত্যু হলে গাঁয়ের লোকেরা মৃত বৃক্ষের চারপাশে গাঁয়ের ভেতর ঢুকে-পড়া লুপ্ত বনভূমির বিরলতার ভেতর বিন্দুবাসিনীকে সন্ধান করে। সেখানে বোনো ক্ষণে ক্ষণে কারণে অকারণে ডেকে চলে অবিরাম — বিন্দা, বিন্দা… বিন্দা …
শুষ্ক পত্রপুঞ্জের মর্মরিতে বোনোর অন্ধ মণি ও মন চাঞ্চল্যে উৎকর্ণ; উৎকর্ণ মাত্র, কিন্তু বিন্দুবাসিনী নিরুত্তর। কখনো অকস্মাৎ নিসর্গ ও রৌদ্রের সমূহ আহ্বান ভুলে সে দেখে বিবর্ণ শুকনো পাতার স্তূপ, কণ্টকিত লেবুর বাঁকা ডাল, স্তূপীকৃত ছাই, নিঃসঙ্কোচ গ্রীষ্মিত উঠোনে স্নায়ুর ভেতর শিকারী দুপুর তাকে দ্বিখণ্ডিত করে গোপন স্ফুলিঙ্গে। এমন দুপুরে অলক্ষ্যে ভাসমান উল্লোল ধারালো মেঘমণ্ডল, এইটুকু গ্রীষ্মগুঞ্জরিত শিকারী সময়ের নীরব প্রস্থানে গাল পেতে রক্তাক্ত আলস্যে তীক্ষè কাঁটার কুশীলব — সেখানে দীর্ঘশ্বাস তাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল, সেখানে রৌদ্রের ঝনৎকার গায়ে লাগে, সেখানে ঘুমের সকল অনুধ্যানই অভিনীত, সেখানে নিঃশ্বাসে অগ্নিস্পৃহা, কাঁচা ফলসম্ভারসদৃশ স্তনের লালে অগ্নিস্পৃহা, চিবুকের মধ্যস্থ কামনাবিন্দুর ভেতর অগ্নিবৈদুর্য, উন্মাদ হাওয়ার গরগরে অগ্নিআর্দ্র, স্বপ্নের ভেতর রাগী শঙ্খচূড়ার লেলিহ অগ্নিজিহ্বা; সে যে বিন্দুবাসিনী, ফলে এরূপ অগ্নিস্পর্শিত বৈদুর্যে নীরব এবং অনির্দেশ্য অপেক্ষায় দগ্ধ হতে হতে অন্ধ বাবার ডাক বাবার জলতৃষ্ণা সে বিস্মৃত, এরূপ অলক্ষ্যে মনে হয় — মরে না কেনে? হাড়-মাস জ্বালি খেল!
নূপুরের খঞ্জনিক্কণ আর জীর্ণ পল্লবলুণ্ঠিত রৌদ্রের পৌরাণিক ধূলিজ্যোৎস্নায় বিন্দুবাসিনী ঘুমায়; বিন্দুবাসিনী ঘুমায় গাঁয়ের মর্মরিত ইতিহাসের আঁধারে, ছায়ার ভবিষ্যতের মধ্যে, বৃক্ষের ভবিষ্যতের ভেতর, বৃক্ষ ও ফুলের প্রজ্ঞার ভেতর, বৃক্ষের সবুজ হাড়ের ভেতর, ঘুমায় বৃক্ষের উদ্যানে, বৃক্ষের সংসারে, বৃক্ষের শোকে-বেদনায়, বৃক্ষের আনন্দে, বৃক্ষের অতীতে…
হয়তো অনির্ণেয় অপেক্ষার ভেতর, একদিন অশোক আসে দুপুরে অথবা নক্ষত্রের পূর্বে, হয়তো অশোক আসে শালমহুয়ার বনে অথবা উঠোনে, কণ্টকশোভিত লেবুঝোপে লতাপুষ্পকুঞ্জে, গুল্মের সবুজে, পাখিদের কণ্ঠস্বরে — এমন নিমেষ আসা-যাওয়া বিন্দুবাসিনীকে ব্যাকুল অনুভবে অসহায় করেছিল। একদিন তার নতুন যুবতী হৃদয় ভীরু, এই হেতু, সে অশোককে পাতা কুড়ানো ঝাঁটা দেখিয়েছিল। যেমন অশোক, এই লুপ্ত বনের প্রতিটি বৃক্ষের ইতিহাস চেনে; পাতার ঐশ্বর্য, শ্যাওলার মৃদু সংসার, পতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র, পাতার মৃত্যুবিষাদ, ফুলের উন্মীলন; উন্মীলনের অন্তর্গত ঘ্রাণ ও রঙের প্রজ্ঞা, রঙের প্রজ্ঞার ভেতর পরাগের স্বভাব; — এই জ্ঞান, এখন, যখন অশোকের নিজের দৈনন্দিনের সঙ্গে সম্পূর্ণই বিপরীতস্বরূপ, — একমাত্র, এই মৃত্যুচিহ্নিত বনভূমি লাশ ব্যবচ্ছেদের মতোই তার মুখস্তবিদ্যা। আর বিন্দুবাসিনী বৃক্ষের নীরবতার চিহ্নমাত্র যেন, বাতাসেই কেবল তার বৃক্ষকণ্ঠ কদাচিৎ স্বগতোক্তি করে; ফলে ঝাঁটার আত্মরক্ষা দেখে অশোক নির্লজ্জ উন্মাদ হেসেছিল। এরূপ হাসির শব্দ শুনে বোনো, অন্ধ চোখে অশ্রুপাত জমিয়ে স্তিমিত, রাগ এবং কান্নার টুকরো টুকরো কথা শোনা গিয়েছিল — আমি ম’লে তবে যাস … ভগমান … মরণ … মরণ … শত্তুর …
কান্নার অভিমানে এরূপ অভিসম্পাত বড়ো কষ্টে বংশীর কালো জলে ভেসে গেলে সোনালি শঙ্খচূড়ার হিংস্র চোখের জ্বলজ্বল দুপুরে মহুয়ার ছায়ায় শুকনো পাতার স্তূপে বিন্দুবাসিনী নিদ্রা যায়, তখন নিসর্গের ব্যাকুল কাঠবিড়ালি, লক্ষ্মীপেঁচা, ধানটুনি আর বিবিধ পতঙ্গের মৃদু বাস্তুতন্ত্র বেদনার ছায়ায় বিবসিত। ক্লান্ত বিন্দুবাসিনী। শিরিষ, কদম, মহুয়ার নিবিড় পল্লবের শৈথিল্য ছিটকে আলোছায়া খেলা করে নিদ্রাশিথিল নিষ্কম্প গালে, চিবুকে — তখন লাল শাড়ির আশ্চর্য; অবিন্যস্ত আলুলায়িত আঁচলের পাহারায় অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা বিন্দুবাসিনী, তামাটে বিদ্যুৎ মেঘের বজ্র চিরে শিথিল পৌরাণিক রক্তজবা, — ফুটন্ত, ছিন্ন; ভয়ঙ্কর মায়া। বনবাদাড়ে লতাপাতার স্যাঁতসেঁতে আলো আর ছায়ার গন্ধের ভেতর দোয়েলের শিসের ভেতর ঘুঘুর ঘুম ঘুম ডাকের ভেতর সে ঘুমায়। নির্জন ছায়ার ভেতর ঝুড়ি আর পাতাকুড়ানো ঝাঁটা ঘুমায়; যে ঝাঁটা বিন্দুবাসিনী দেখিয়েছিল গাঁয়ের লোক আর অশোককে। অশোক দেখে এরূপ দৃশ্য — যেন ঝাঁটার তীক্ষè তীর সজারুকাঁটার নিবিড় আত্মরক্ষার মোহিনী। অশোক দেখে মোহিনী প্রজ্ঞাপারমিতার লাল আঁচলের নিচে সোনালি বিদ্যুৎ, আঁচলের নিচে শিথিল রক্তজবা, আঁচলের নিচে নীল পুষ্পদল, হলুদ পুষ্পদল, বেগুনি পুষ্পদল। অশোকের কী যে হয়, মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে দেখে হাত-পা মুড়ে কুণ্ডলিত বিন্দুবাসিনী — এক অনাস্বাদিত ধেনোর উন্মাতাল উপলব্ধি হয় অশোকের, স্মৃতির অনির্বচনীয় উপলব্ধির ভেতর দেখে ছায়ার কোজাগরে নিদ্রিত নারীর মুঠোয় স্বর্গ, পদতলে স্বর্গের নূপুর, চিবুকে চোখে কপালে স্বর্গীয় সূর্যালোক; যে অশোক, সে ডোমের পুত ডোম, এগারো বছরের বাল্যকাল থেকে যে বাবার সঙ্গে লাশ ব্যবচ্ছেদ করে; লাশের খুলি ফাটিয়ে মগজ বের করে, কণ্ঠার হাড়ের নিচ থেকে নাভি অবধি ফেড়ে দেখে লাল মাংসের নিচে হলুদ চর্বির স্তর, মৃত বুকের ভেতর রঙের ছড়াছড়ি — নীল, হলুদ, লাল, বেগুনি, পিতাভ কলকব্জা স্থির নিষ্পন্দ নিস্তব্ধ। আর বাবা একবার এক গর্ভবতীর লাশ ফেড়ে বের করে এনেছিল মৃত শিশু। বাবার অঞ্জলিবদ্ধ মৃত শিশু প্রস্ফুটোন্মুখ ছেঁড়া পদ্মের আশ্চর্য! বাবা বলেছিল — আয়, স্বর্গ দেইখা ল! অশোক দেখে, সোনার প্রদীপের কোমল উজ্জ্বলতায় শিশুর কুণ্ডলিত হাতের মুঠোয় স্বর্গ, দেখে তুলতুলে পদতলে স্বর্গ, দেখে নিরুদ্বিগ্ন চিবুকে স্বর্গ, দেখে নিদ্রিত চোখে কপালে স্বর্গীয় চন্দ্রালোক; আর বাবার চোখে ব্যথার ঐকতান স্বচ্ছ নীল অশ্রুনির্ঝর। স্মৃতির স্বর্গলোক থেকে লুপ্তপ্রায় বনের আলোছায়ার টুপটাপ ঝরে-যাওয়া শুকনো পাতা আর বুনো ফুলের রেণুর ভেতর অশোকের কান্না এরূপ দৃশ্যনির্মাণে মৃত বৃক্ষকাণ্ডের বিধুরতা। বিধুরতাময় নির্জন বিপুল ফাঁকা বনের আলোছায়ায় নিঃশব্দে ঝরে শুকনো পাত, ঝরে বুনো ফুলের রেণু, গুল্মের চিহ্নে ধানটুনির চঞ্চল সুর ঝরে, কাঠবিড়ালির লাফ ঝরে, ঘুম ঝরে, ঘুমের মধ্যে পাতা ঝরে; শুকনো পাতাগুলো নূপুরের গুঞ্জনে ঘুম হয়; ঘুমের মধ্যে কচি সবুজ পাতার শঙ্খচূড়া ফণায় নূপুর কামড়ে ধরে, অথবা নিজেই সে, বিন্দুবাসিনী, সোনালি শঙ্খচূড়া, গলার ভেতর নূপুরের খঞ্জধ্বনি বংশীর কালো জলে সংক্রমিত, হৃৎপিণ্ডের ভেতর ফুসফুসের ভেতর ধমনীর ভেতর রক্তের আদিম কুহেলিকার ভেতর তাকে তাড়া করে সেলাইকলের কুরপাত কুরপাত কম্পাঙ্ক; জলের ভেতর লাল হলুদ নীল বেগুনি সবুজ কালো কপার, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, গ্রিন অ্যাসিড, সোডিয়াম, ক্রোমিয়াম; জল নয় — ডাইং শিল্পের রঙের অভ্যুদয়ে গনগনে আগুন — জলজ অগ্নির স্ফুটনাঙ্কে ঝলসানো শঙ্খচূড়া মোচড়াতে মোচড়াতে খসে-পড়া ত্বকের স্ফুলিঙ্গে বদলাতে থাকে; নুপনুপুনুপনুপু নূপুরের খঞ্জনিক্কণের ভেতর শুকনো পাতার মর্মরিতে অগ্নিদংশিত শঙ্খচূড়া বদলাতে বদলাতে একখণ্ড থেঁতলানো মাংসের বিবমিষা হলে ভয়ে আতঙ্কে ছুটতে ছুটতে বুনো কাঁটায় খোঁচে চিরে রক্তাক্ত বিন্দুবাসিনী ঘুমের গহন ভেঙে উঠে স্থির। আর অশোক, কাছেই, একটি মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে অঞ্জলিবদ্ধ বুনোফুল টুকরো করে।
তখন, এই দৃশ্য বিন্দুবাসিনীর বিস্ময় নয়; উদাস, তাও মুহূর্তের আয়োজন, নূপুরের খঞ্জনিক্কণ ছায়ায় মিলিয়ে গেলে বিন্দুবাসিনীর — যে তখন বিন্দু, বিন্দু বিন্দু — শ্রুতিবিভ্রম লুপ্ত হয়, লুপ্ত দৃশ্যবীথি, আর বিস্ময় তখনই; জীর্ণ পল্লবলুণ্ঠিত শোকের শৃঙ্গারিত শিস তার আকণ্ঠ নিমজ্জিত আঁধার করোটি কাঁপিয়ে দিলো। বিন্দুবাসিনী ভয়ে কেঁপে শুকনো পাতার ঝুড়ি বুকে আঁকড়ে বন পেরিয়ে এল — শিকারীর হ্রেষায় লাফিয়ে পালানো বালিকা হরিণের ঝনঝন বিদ্যুৎ অধ্যাসে। এরূপ দৃশ্য আলতামিরার বলগা হরিণের ক্ষিপ্র শরীর। রৌদ্রের গ্রীবামুহূর্ত গতিময় এবং অশোক এরূপ চঞ্চল হরিণদৃশ্যে আনন্দে চিৎকার করেছিল।
বলগা হরিণের ক্ষিপ্রপ্রপঞ্চে বন পেরিয়ে এলে তার কুমারী রক্তমাংসের ভেতর ধাবমান বিবিধ ধ্বনির উত্তেজনা। প্রাকৃত বাতাসের ধস্ত চিৎকার তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে; তখন মাংসের উষ্ণতায় অশোকের নির্লজ্জ উল্লাস, অশোকের খুলি ফাটানো বজ্রচেরা চাকু; মাংসের ভেতর সবুজ শঙ্খিনী; অন্ধ বোনো পিছন পিছন শ্লেষ্মাকণ্ঠে চিৎকার করে — পালিয়ে যা বিন্দা … পালিয়ে যা বিন্দা … বিন্দা, পালিয়ে যা বিন্দা … বিন্দুবাসিনী ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে উঠোনের কোণে নবীন পুষ্পঘ্রাণময় কণ্টকশোভিত লেবুগাছ জড়িয়ে ধরে। রক্তাক্ত হয় তার হাত, অভ্রময় চিবুক; তারও চেয়ে, স্নায়ুর ভেতর লেবুর তীক্ষè কাঁটা মুহূর্তে দ্বিখণ্ডিত করে ছুটে যায় গোপন স্ফুলিঙ্গ, হাড়ের ভেতর তীব্র জ্বরের স্ফুটনাঙ্ক, ত্বকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অগ্নিস্পৃহশিস। অথবা সে দুষ্পাঠ্য ভয়ে কেঁপে একটি নিবিড় প্রাকৃত অনুভবের ভেতর এসে দাঁড়ায়, সেখানে, হয়তো, রৌদ্রঋতুর দিন পল্লবের ছায়ার বেদনা। আর বিন্দুবাসিনী যেন বিন্দুবাসিনী নয়, অন্য কেউ। যেন নিজের ভেতর নিজে এক নতুনের অভ্যুদয়। নতুন অভ্যুদয়ের ভেতর লুপ্তপ্রায় শিরিষের বন জারুলের বন মহুয়ার বন। অশোক মহুয়ার ফুল ছিঁড়ে এনে দেয়; সময় তখন স্বপ্নকর্মপ্রতিভায় সন্তর্পণ। অথচ একদা শরতের মধ্যাহ্নে অশোককে দেখে ভীত বিন্দুবাসিনী — অশোকের চোখে রক্তোচ্ছ্বাস, অশোকের কোঁকড়ানো চুল উদ্ভ্রান্ত আর উদোম বুকের পেশিতে কালো বিদ্যুতের উল্লম্ফন — ভীত বিন্দুবাসিনী নবীন কাঁটাসম্ভারে লেবুগাছের ভেতর প্রবেশ করেছিল, গাছের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল বিন্দুবাসিনী, শ্বেতপুষ্পগন্ধে আকুল লেবুগাছ জড়িয়ে ধরতেই বিন্দুবাসিনী কচি সবুজ শাখায় পাতায় রূপান্তরিত। তখন অশোক; তখনো লাশের যকৃত ফুসফুসের লালচে গন্ধ তার শরীরে, তখনো কেরোসিনের গন্ধ তার শরীরে, তখনো মদের গন্ধ তার শরীরে; লেবুগাছের চারপাশ ঘুরে ঘুরে গাঁয়ের ভেতর ঢুকে-পড়া লুপ্ত বনভূমির বিরলতার ভেতর, ছায়ার ভেতর, ফুলের উন্মোচনের ইতিহাসে ঘ্রাণ ও রঙের অভিজ্ঞতার ভেতর, নীলাব্ধি দিন আর বিকেলের মর্মার্থে, নদীর নিষ্কম্প হাড়ের ভেতর, পাখির স্খলিত কণ্ঠস্বরে, পতঙ্গের প্রতœসংসারে, লতাপুষ্পকুঞ্জে, রৌদ্রধূলিঘূর্ণির নিগূঢ়তায়, মঞ্জুরিত বেদনার গহনে, স্মৃতির নৈসর্গিক অভ্যুদয়ের ভেতর বিন্দুবাসিনীকে সন্ধান করেছিল।
তখন, একদিন গাঁয়ের ভেতর ঢুকে-পড়া লুপ্ত বনভূমি; অথবা বনের বিরলতার ভেতর গ্রামের যে ইতিহাস একটি আপাদমস্তক প্রাগৈতিহাসিক ছায়ামূর্তির ক্ষয়িষ্ণু কঙ্কালে লুপ্তচিহ্ন, এই নির্জনতার মধ্যস্থ নগরের ক্রুর ইটকাঠকাচলোহার কম্পোজিশনে লুপ্তপ্রায় বনভূমি মাথার মধ্যে একখণ্ড মনোরম উদ্যান রচনা করে, উদ্যানের মধ্যে ভয়ঙ্কর বিদগ্ধ আঁধার আকাশ আর বটপল্লবের মর্মরিত বাস্তুবৃত্তান্তের ভেতর দূরে বংশীর পচে দুর্গন্ধময় জলরেখার কালো ক্রোমিয়াম, গ্রিন অ্যাসিড এক অনিশ্চয়তার দিকে ইশারা করে, নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় নিঃসঙ্গ করে। অশোক বলে, — ভয় পাস বিন্দু, বিন্দুরানি …!
বিন্দুবাসিনী নিশ্চুপ! চরাচরপ্লাবী রৌদ্রসঙ্কাশিত পদসঞ্চারে পুড়তে পুড়তে পৃথিবীর সমস্ত শব্দ তার শ্রুতির অভ্যন্তরে নিঃশব্দ অনুভবে বয়ে চলে, মর্মের মধ্যে বয়ে চলে, ত্বকের গহনে বয়ে যায়, রক্তের প্রাচীন কুহেলিকাতরঙ্গে বয়ে যায়। আনন্দ না ভয়! ভয় অথবা আনন্দের নিবিড় বেদনায় ব্যাকুল দৃষ্টিপাত করে বিন্দুবাসিনী নিশ্চুপ!
তার এরূপ নিভৃত ও নিশ্চুপ ও অবলীঢ় দৃষ্টির মধ্যবিন্দুতে বনষ্পতির জ্যোৎস্না ছিল, দৃষ্টির ভেতর স্বপ্নহন্তারক রাত্রিকৃত বিহঙ্গগান, দৃষ্টির ভেতর বনস্থালির অর্জিত ছায়াচন্দ্রালোক। ছায়াচন্দ্রালোকে অশোক দিশেহারা, কেননা ছায়াচন্দ্রালোক অথচ নক্ষত্রশিল্পের জ্যোতির্ময় ঠিকরে বেদনাসঙ্কুল বিন্দুবাসিনীর দু-চোখ। দু-চোখের মধ্যবর্তী স্বপ্নবিন্দুর নেশায় বুঁদ অশোক রাত্রি দুপুর ভোরের ব্যবধান ভুলে যায়। সকাল সন্ধ্যা দুপুর লুপ্তচিহ্ন প্রাচীন বনভূমি আর বংশীর মরীচিকায় ঘুরে ঘুরে অশোকের ক্রোধ হয়, ব্যাকুলতা হয়; প্রতিদিন বংশীর মৃত্যুঐশ্বর্য প্রলম্ব রৌদ্রে আর্তনাদ করে, প্রতিদিন নির্জন বনস্থালি প্রবল পরাক্রান্ত কালো কালো ট্রাকের ক্রোধান্ধ গর্জনে ছিন্নভিন্ন কাটা লাশ হয়ে ওঠে, প্রতিদিন ছায়াচন্দ্রালোক অতিকায় কালো চাকার দাবড়ানি অশ্বক্ষুরের ঝনৎকারে থেঁতলে রক্তদগ্ধ পড়ে থাকে। ছায়াচন্দ্রালোক হারিয়ে যায়, বিহঙ্গের জ্যোৎস্নাকণ্ঠ হারিয়ে যায়, শুকনো পল্লবের মর্মর হারিয়ে যায়। তবু বিন্দুবাসিনী দেখে মৃত বৃক্ষকাণ্ডের কালো ধ্বংসপ্রলম্বিতের ভেতর উজ্জ্বল সবুজ শ্যাওলার অঙ্কুর, দেখে গগনধূলির ভেতর মৃদু ঘাসের সবুজতা, জ্যোতির্ময় গুল্মের চিহ্ন, পতঙ্গের গান। ক্রমেই একদিন দেখে অগ্নিস্পর্শিত রৌদ্রবৈদুর্যে ঘাসের দণ্ডশীর্ষে মৃদু শ্বেতপুষ্পের প্রমিতি দুলছে একটুকরো আলো; ফলে বন লুপ্তপ্রায় হলেও শুকনো পাতার ঐশ্বর্য কমে না — এরূপই বিন্দুবাসিনীকে অম্লান স্বস্তিদায়িনী করেছিল।
ফলে অশোক পুনর্বার বলেছিল, — বিন্দু, ভয় পাস বিন্দুরানি…! বিন্দুবাসিনী বলেছিল, — বাবা…! এই প্রথম, স্তব্ধতাবিচূর্ণ ওঙ্কার, সে বাক্যবিনিময় করে। ক্রিয়া এবং অব্যয়শূন্য, সর্বনাম এবং বিশেষণশূন্য একটি শব্দের ব্যাকরণ উচ্চারণে দ্বিধার জড়তা ছিল, ভয়ের কম্পন ছিল, অস্থির চাঞ্চল্য ছিল। এরূপ একক শব্দময় বাক্যে বিবিধ অর্থের ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়ে এলে অশোক ধৈর্যের গাম্ভীর্য ছুঁড়ে, — তোর বাবায় একটা বুইড়া বটগাছ, খালি শিকড় গাইড়া রাহে, তোরে হেই শিকড় গাইড়া মাইরা ফেলাইব। তথাপি, বিন্দুবাসিনী পুনর্বার চুপ। বরং বাবা সম্পর্কে এরূপ উক্তি তাকে দুঃখী করে। তবু, হয়তো প্রতিদিন অশোক আসে দুপুরে অথবা নক্ষত্রের পূর্বে, হয়তো আসে বংশীর মরীচিকাউৎসবে অথবা উঠোনে, নিসর্গের ব্যাকুল সমারোহে, অম্লান কাঠবিড়ালির উল্লম্ফনে, উজ্জ্বল কীটের সবুজে, পিঁপড়ার প্রতœসংসারে, ছায়ার পদবিক্ষেপের ভেতর, হয়তো আসে বৃক্ষের ভবিষ্যতের ভেতর; বৃক্ষের অতীতের অভিজ্ঞতার নিকট, হয়তো আসে নদীর দীর্ঘশ্বাসে, নদীর প্রাচীন সংগীতের ভেতর, হয়তো আসে শুকনো পাতার এলোমেলোর ভেতর বিন্দুবাসিনীর নিদ্রাশিথিল পৌরাণিকে। তখন, বিন্দুবাসিনী নিজের ভেতর নতুন অভ্যুদয়ের ছায়াচন্দ্রালোকে বিমূঢ়। তখন, বিন্দুবাসিনী দ্বিধার সঙ্কটে পড়ে, দুঃখের আঁধারে ডুবে যায়। অথবা আঁধার নয়, হয়তো অশোক আসে আর রক্তের দুর্জ্ঞেয় কুহেলিকার মধ্যে চক্ষুকর্ণহীন অন্ধ ধ্বনি লেলিহ হয়ে ওঠে — পালিয়ে যা বিন্দা, পালিয়ে যা বিন্দা …
তখন একদিন, বটফুলের ঘ্রাণের ভেতর দিয়ে গাঁয়ের লোকেরা আসে; তারা বনের বিরলতার ভেতর গ্রামের যে ইতিহাস, ঘরের যে আঁধার, ক্ষুধার যে অহঙ্কার; তার ভেতর ঢুকে পড়ে, সেলাইকলের ভেতর ঢুকে পড়ে, ছায়ার ভবিষ্যৎ ও প্রাচীনতার ভেতর ঢোকে, ছায়ার ঈর্ষার ভেতর ঢোকে, শুকনো পাতার ঘৃণার ভেতর ঢোকে, শিকড়ের ভেতর ঢোকে, নূপুরের খঞ্জনিক্কণের ভেতর ঢুকে তারা বলে — ডোমের পুত ডোম … এসব টুকরো বাক্যে সহসা দুর্বিনীত বিন্দুবাসিনী পাতা কুড়ানো ঝাঁটা ছুড়ে মারে। আর অশোক, যে ডোমের পোলা ডোম, ভেবেছিল, সে তার পাঁচপুরুষের নাম জানে, এ-ই তাদের পেশা; তাদের পারিবারিক প্রাচীনত্ব দ্যুতিময় প্রলম্বিত গৌরবে অশোক অট্টহাসি করেছিল; ভেবেছিল, গাঁয়ের লোকেরা কখনো আলুপটল বিক্রি করে, কখনো কাপড় বেচে, কখনো প্লাস্টিকের জুতো বেচে, কখনো কালো কালো ট্রাকে বংশীর মাটি তোলে, কখনো হেলপারি করে, কখনো রিকশা চালায়, কখনো গরুর হাটের ব্যাপারি, গাঁয়ের লোকেরা কখনো ফেরিওয়ালা; ভেবেছিল, এসব পেশার কোনো পারিবারিক ইতিহাস নেই, বংশপরম্পরা নেই; ভেবেছিল, শিকড় নেই বাকড় নেই, পরগাছা, নির্জীব, অর্থগৃধ্নু নিষ্ঠুরতা; কেবল লেলিহ লোভের জিহ্বা লকলকে। আর সে, অশোক, পেশিতে পেশিতে বটের শক্ত ডাঁটো ঝুরি পাকিয়ে পাকিয়ে এই মাটির গভীরে ইতিহাসের গহনে আস্তানা গেড়েছে। প্রকাণ্ড দাঁতাল রৌদ্র, ভয়ঙ্কর দুর্যোগময় কৃষ্ণরাত, বিক্ষুব্ধ ঝড়ের তাণ্ডব তার মাথার উপর দিয়ে জীবনের গলিঘুপচি দিয়ে ইন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে লেলিহান বিষভাণ্ড ঝরে গিয়েছে; তথাপি সে এই প্রাচীন আকাশ, প্রাচীন বৃক্ষ, ছায়ার ইন্দ্রজাল, জ্যোতির্ময় গিরগিটি, রঙিন পিপীলিকা, প্রাচীন শ্যাওলা, প্রাচীন লক্ষ্মীপেঁচা, পৌরাণিক নক্ষত্র আর প্রাচীন নিসর্গেরই অতন্দ্র করুণাধারা। করুণাধারা, তখন, দ্যুতিময় বৈদুর্যে অশোক অট্টহাসি করে আর দিগন্তব্যাপ্ত হাসির বিদ্যুৎহ্রেষায় বিন্দুবাসিনী, বোনো, গাঁয়ের লোক এবং অশোক ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণাবর্তে ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে সৌরমণ্ডলে আর প্রতিপক্ষের ক্রূর ঘূর্ণাবর্তে ছুটতে ছুটতে গাঁয়ের লোকেরা বুঝেছিল — এ বড়ো গোলকধাঁধা, ধূম্রজাল; আর বোনো শুকনো হাড়ের মধ্যে অন্ধ প্রাণ শিকারী শঙ্খচূড়ার টঙ্কার তুলছে। বিন্দুবাসিনী হাড়ের মধ্যস্থ টঙ্কারে অগ্নিবন্দনা করে — তার নিঃশ্বাসে, তখন, অগ্নিস্পৃহা; চিবুকের লালে অগ্নিবৈদুর্য আর উড়ন্ত চুলে গরগরে শঙ্খচূড়ার লেলিহান অগ্নিজিহ্বা; সেখানে অগ্নিউপাসক অশোক ছিল, সেখানে ঘোর ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে শুকনো পাতার স্তূপে প্রতিবিম্বিত বিন্দুবাসিনী — নিসর্গের মতোই দৃশ্যস্বরূপ, সবুজতাপ্রযুক্ত যুবতীর মহিমান্বিতে উদ্দাম। আর অশোক, কাছেই, একটি মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে অঞ্জলিবদ্ধ মহুয়াফুল টুকরো করে। টুকরো মহুয়াফুল পায়ে দলিত করে বিন্দুবাসিনী সচকিতে এসে দাঁড়ায় চণ্ড দুপুরে লেবুগাছের প্রাচীন কাঁটাবিদ্ধ নিঃসঙ্গ ডালের নির্মমতায়। এমন নয় যে, এই সচকিত চঞ্চলতা ঘৃণাসঞ্জাত অথবা ভীতিতাড়না; এ ভাষা তার চিত্তের সৌন্দর্য প্রকাশের বুনো রুক্ষতা, নতুন করে বাঁচার সুকৃতি।
রুক্ষ কাঁটা, তখন মনের মধ্যে ক্রমাগত ষড়ৈশ্বর্য ছড়িয়ে নির্লিপ্ত, স্মৃতির অভ্যন্তরে লাল আঁচলের মোহিনী প্রজ্ঞাপারমিতা প্রতিধ্বনিত ছিল, ফলে বর্তমান বিস্মৃতিতে শুধুমাত্র প্রাচীন রুক্ষ কাঁটার রক্তিমোচ্ছ্বাস। চারদিকে ছিন্ন কুন্তলের সূক্ষ্ম শূন্যতা কোথাও কান্নার অপকীর্তি। শূন্যতা যেন অন্নময়। ক্ষুধার ম্রিয়মান প্রসূন। শূন্যতা যেন ভবিষ্যৎ, শূন্যতা যেন বৃক্ষের ঈর্ষা, শূন্যতা নদীর মৃত্যুগীত। শূন্যতার রৌদ্রতরঙ্গিত নিস্তব্ধ দুপুরে, অন্ধ, থুরথুরে বোনো, কাঁপতে কাঁপতে ক্ষুধাকাতর শিশুকণ্ঠে ডাকে — বিন্দা … বিন্দা … বিন্দা …
এই সম্বোধনে নিষ্ঠুর স্বরের গ্লানি; এই সম্বোধনে, বারংবার, নতুন করে বাঁচার সুকৃতি নির্বাক হয়ে এলে উঠোনে চুলোর ভেতর শুকনো পাতা গুঁজে দিতে দিতে ঝামরে-ওঠা রৌদ্রে পাতাঝরা লুপ্ত বনভূমি, বিন্দুবাসিনীর মনে হলো, একটা গনগনে চুলা। বাবা তাকে চিরে চেলা করে গুঁজে দিচ্ছে চুলার কুণ্ডলিত অগ্নিবিটঙ্কে।
তবু, এমন ছায়াচন্দ্রালোকের রহস্যকর্মা গ্রীষ্মিত উঠোন রাত্রির স্নিগ্ধ আঁধারে ডুবে এলে বোনো হাতড়ে হাতড়ে ছোট কাঠের তোরঙ্গ খুলে বের করে এনেছিল রূপার নূপুর। যদিও তার অন্ধ চোখ, আঁধারে-আলোয় প্রকৃতিস্থ স্পন্দন লক্ষণীয় নয়, তথাপি নূপুরযুগল তার চোখের কুঁচকে বিকৃত মণি কাচের ঝকঝকে চিকচিক জলজ স্নেহ হয়েছিল। উঠোনে জ্যোৎস্নাপল্লবের ছায়াচন্দ্রালোকে মৃদু হাওয়া এইসব জলজ অভ্যুদয় দীর্ঘনিঃশ্বাসে রোমাঞ্চিত, এবং বিন্দুবাসিনীকে এরূপ দীর্ঘনিঃশ্বাস আড়াল করতে নূপুরযুগল নেড়ে নূপনুপুনূপনূপু ধ্বনির তটস্থ অন্তরালে বলেছিল — তোর মায়ের, ভালো মানাতো কী যে …। নূপুরযুগল খুলে রেখেছিল, বোনোর বারণ না শুনে, ইরাবাসিনী, বিন্দুবাসিনীর মা। এ নিয়ে বোনো শিশুসুলভ অভিমানে উত্তেজিত হয়েছিল, আশ্চর্যের কথা — ইরাবাসিনী স্বামীর এমন অভিমানে হেসেছিল। সেদিনই রৌদ্রছায়াবিদ্ধ স্তব্ধ দুপুরে, বোনো সেলাইকলে কাপড় সেলাইয়ে ব্যস্ত। আর বটপল্লবের ছায়ানিকুঞ্জ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল কতিপয় বিশ্রামার্থী, চেনা-অচেনা মহিষের পাল, চলে যাচ্ছিল পুষ্পের উন্মেষ, বৃক্ষের স্বস্তিদায়িনী ভবিষ্যৎ, বৃক্ষের নদী, পতঙ্গের নদী, ছায়ার নদী, গুল্মের নদী, চলে যাচ্ছিল নদীর ভেতর ইতিহাস, চলে যাচ্ছিল নদীর রক্তের ভেতর উদ্যান, নদীর হাড়ের ভেতর নগর, চলে যাচ্ছিল নিঃসঙ্গ কুকুর, উদাস পিপাসার্ত কাক, ক্লান্ত ফেরিওয়ালা। তখন গ্রীষ্মিত দুপুরের প্রাকৃতিকে সবুজ আলোর স্পন্দন গাছগাছালির ভেতর বংশীর কালো ঝিকিমিকি, প্রহেলিকাময় দগ্ধ সূর্যঋতুর দিন নিস্তব্ধ এবং পুনর্বার শূন্যতা বিবিক্ত। এই বিবিক্ত বেলায় ইরাবাসিনী উঠোনে লুটিয়ে পড়েছিল — বাবা গো, মরে গেলাম গো — এই বলে উচ্চারিত চিৎকারের মর্মান্তিক, রচিত কোনো ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত নয়; এই চিৎকারে জীবনসংহারী বিমূঢ়তা প্রকট, মৃত্যুর বিভীষিকা চঞ্চল ছিল। তার মুখে গেঁজলা ফেণাচিহ্ন, চোখে দিকচক্রবাল বিস্তৃত নিঃসঙ্গতা নিভে আসছিল। তার এলো চুলের নিচে, ঘাড়ে, গলগলে দুটি মৃদু ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসছিল মৃত্যুজর্জরিত চিকন সুচরক্ত, শঙ্খচূড়ার কালো মৃত্যুবিষ। সে বছরই জলবসন্তে গলে বেরিয়ে গিয়েছিল বোনোর দু-চোখের কালো মণি।
এসব অনুপুঙ্খ শুনতে শুনতে ঘুম আসে বিন্দুবাসিনীর, লাশকাটা চাকুর ঝকঝকে ঘুম, মাটির শীতলে পোকামাকড়ের প্রতœসংসারে নির্বিঘœ ঘুম। বাবার পায়ে মাথা রেখে ঘুমায় সে, যেন এরূপ নিদ্রাই সে ভালোবাসে — যে ঘুম মৃত্যুগন্ধে ঘৃণা ও ক্রোধের অভ্যন্তর থেকে স্নেহের অশ্রু আনে। যে ঘুমের শিথিল চন্দ্রালোকে একদিন বাবা তার পায়ে পরিয়ে দিয়েছিল নূপুরযুগল। এখন, পৌঢ়নিদ্রাশৈথিল্য দেহে বোনো হাত বুলিয়ে দেয় বিন্দুবাসিনীর চুলে। কুঞ্চিত লোলচর্ম আঙুলের স্পর্শে বাবার দুষ্পাঠ্য মনের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে না পেরে দুর্নিবার বিমূঢ়তা স্পর্শ করে। আর অতিসুদূর জ্যোতিষ্কমণ্ডল থেকে ভেসে আসে বটপল্লবের আঁধারে দীর্ঘশ্বাস ছিন্ন নূপুরের খঞ্জনিক্কণ — পালিয়ে যা বিন্দা … পালিয়ে যা বিন্দা … বিন্দা পালিয়ে যা বিন্দা …
নূপুরের খঞ্জনিক্কণ আর জীর্ণ পল্লবলুণ্ঠিত রৌদ্রের পৌরাণিক ধূলিজ্যোৎস্নায় বিন্দুবাসিনী ঘুমায়; বিন্দুবাসিনী ঘুমায় গাঁয়ের মর্মরিত ইতিহাসের আঁধারে, ছায়ার ভবিষ্যতের মধ্যে, বৃক্ষের ভবিষ্যতের ভেতর, বৃক্ষ ও ফুলের প্রজ্ঞার ভেতর, বৃক্ষের সবুজ হাড়ের ভেতর, ঘুমায় বৃক্ষের উদ্যানে, বৃক্ষের সংসারে, বৃক্ষের শোকে-বেদনায়, বৃক্ষের আনন্দে, বৃক্ষের অতীতে; যে ঘুমে মর্মরিত নিকুঞ্জের হলুদ পাতার মৃত্যুপ্রতিবিম্ব, বটফুলের ঘ্রাণ আর উদ্যানের ছায়াসূর্যালোক। তখন শুকনো পাতার দিনপঞ্জিতে ঐন্দ্রজালিক গিরগিটি হেঁটে গেলে ঘুমের ভেতর অশোকের পদধ্বনি শোনে, তখন বলগা হরিণের ক্ষিপ্রতায় বন পেরিয়ে শুকনো পাতা কুড়ানো ঝুড়ি বুকে আঁকড়ে ছুটতে ছুটতে ছুটতে উঠোনের কোণে কণ্টকশোভিত লেবুগাছের ডাঁটো ডাল জড়িয়ে ধরে। সূর্যকিরণদগ্ধ গরগরে দুপুর তাকে পোড়ালো। উঠোনে চুলোর চারপাশে স্তূপে স্তূপে শুকনো পাতা, তপ্ত গ্রীষ্মিত ঋতুর দাহ্য প্রহেলিকায় বিন্দুবাসিনী চুলোর নিভু নিভু আগুন উস্কে উঠোনের পল্লবস্তূপে গুঁজে দেয়, অতঃপর পুনর্বার কণ্টকিত লেবুগাছের ভেতর প্রবেশ করলে, তখন, প্রাচীন রুক্ষ কাঁটার রক্তিমোচ্ছ্বাস। আর কোথাও কান্নার অপকীর্তি ক্রমেই আগুনের লকলকে লাল জিহ্বা উঠোনের শুকনো পাতার পরিধি ছাড়িয়ে ঘরের চাল স্পর্শ করে, ক্রমেই আগুনের লেলিহান ঘরের চাল ক্রীড়াচ্ছলে ভস্মীভূত করে, ভস্মীভূত করে ছায়ার স্মৃতিঅভ্যুদয়, বৃক্ষের দিনপঞ্জি, নদীর দিনপঞ্জি, পাতার দিনপঞ্জি, পতঙ্গের দিনপঞ্জি, ফুলের দিনপঞ্জি, ধূলির দিনপঞ্জি, রৌদ্রের দিনপঞ্জি, শ্যাওলার দিনপঞ্জি; আকাশপ্রবাহী ধূমঅগ্নিপ্রলয়ে বটের সবুজ পাতা বিবিধ রং চিত্রিত হয় — প্রথমে বাদামী ধূসর, পরে খয়েরি কালোর চক্রাকার, অতঃপর হাড়ের বেদনা অশরীরী মায়ায় ভাসমান কালো ভস্মপুঞ্জ — আকাশপ্রবাহী ধূমঅগ্নিপ্রলয়ে বটের সবুজতা বোনোর পৌঢ় নিঃশ্বাসে ছায়ের ঘুণাক্ষর, ধমনি-শিরায় রক্তের বিকারে ধূমকুণ্ড নেশার ক্ষতচিহ্ন মিশিয়ে দিলে তার প্রাচীন ত্বক চিত্রিত হতে থাকে — বটপল্লবের সবুজতা কৃষ্ণময় কুঞ্চিত ত্বকে সোনালি সবুজের মসৃণ চক্রাকার বিদ্যুৎগ্রীবা, রক্তাক্ত হাড় নিষ্প্রভ হাত-পা গলিত অনৈসর্গিক উত্তেজনায় লিকলিকে অগ্নিশিখা আর ধূমকুণ্ডে মোচড়াতে মোচড়াতে বোনো বদলে যাচ্ছে, তার ইতিহাস বদলে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ বদলে যাচ্ছে, বৃক্ষ, চন্দ্রালোক, ছায়ার উন্মীলন, নদীর অনুধ্যান বদলে যাচ্ছে, শালফুলের স্মৃতিচিহ্ন বদলে যাচ্ছে, কান্নার সাধনা বদলে যাচ্ছে। বদলে বদলে বোনো অগ্নিহাড়ের মসৃণ চক্রাকার শঙ্খচূড়ার গ্রীবায় রূপান্তরিত হলে তখন বিন্দুবাসিনী নির্বাক, বিস্ময়ে তার আশ্চর্যের ভেতর একটির পর একটি মৃত্যুরক্তিম অগ্নিকুণ্ড ধস্ত রেখা টেনে দিয়ে গেলে নূপুরের ছিন্ন ফলের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু আগুনে পুড়ে যায়, আর বিন্দুবাসিনী পায়ের নূপুরযুগল খুলে ছুঁড়ে ফেলে অগ্নিকুণ্ডে।
অপরূপ অগ্নির অট্টরোল নিষ্প্রভ হয়ে এলে ভয়ঙ্কর অগ্নিদগ্ধ রক্তাপ্লুত একটি শঙ্খচূড়া ফণায় নূপুরযুগল কামড়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় বটের কুঞ্চিত নিকুঞ্জবিতানে। তখনও, ক্রমাগত ধূমঅগ্নিপুঞ্জের কুণ্ডলোচ্ছ্বাস ফুঁসে উঠছে, আর লেবুর কণ্টকিত রক্ত বিস্ফারিতে অশ্রুপ্রতিবিম্বিত বিন্দুবাসিনী দেখে নিজেরই পা দুখানি, যে পা খালি, শূন্যতার অপরূপময়, গগনধূলির সুবর্ণলাবণ্যে বড়ো চঞ্চল।