প্রথম নারী । মহসীন চৌধুরী জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০১৬, ১১:২০ অপরাহ্ণ, | ২৩৮১ বার পঠিত
১.
শুক্রবারে চিঠি আসে ভাবনায় ছিল না। শুক্রবারে কি পিয়নের ডিউটি থাকে? হয়তো বাড়ির পাশে বাড়ি বলে সুযোগ মতো চিঠি নিয়ে এলো। অবশ্য আমার পিয়নকে নিয়ে ভাবনা নেই। ভেবে লাভ কী পিয়নের ডিউটি নিয়ে। আমার ভাবনা ঘিরে চিঠি-রহস্য। কে চিঠি লিখতে পারে! একবিংশ শতাব্দীতে এসে চিঠির আদান-প্রদানটাই তো বিস্ময়কর। ইন্টারনেট, মোবাইলের এ যুগে অক্ষর, শব্দ আর বাক্যের আবেদন কতটুকু পরিতৃপ্ত করে মানুষের হৃদয়।
আমার মেজ সন্তানের হাতে চিঠি। মেজটা ছেলে। দু’বোনের মধ্যমণি হয়ে আছে ভাইটি। এ বৎসর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছি। বাবাকে মাস্টার হিশেবে পেয়ে স্কুলঘর ওর কাছে খেলাঘরের মতোই। ছেলেটা দুরন্ত। আমার শৈশবকাল দেখতে পাই ওর আচরণে। ছুটে চলা সকাল, দুপুর, রাত্রিতে। মা চিঠির জন্য হাত বাড়ালেও ছেলে ছুট দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘বাবা, তোমার চিঠি। তোমাকে কে চিঠি লিখল বাবা?’
‘না পড়ে কী করে বলব বাবা?’
চিঠির খাম খুলব খুলব করছি। হাত ও মনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এ কি তামাশা! আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কিরকম অদ্ভুত চোখে চিঠির দিকে চেয়ে আছে। অপরের চিঠির প্রতিও রয়েছে ওদের নিষিদ্ধ কৌতূহল। থেমে গেল হাতের যাত্রা—ছয়টি চোখের বিব্রতকর চাহনিতে।
শারমিন বলল, ‘কিগো, কার চিঠি? তোমাকে আবার চিঠি লিখল কে?’
প্রেরকের ঠিকানা এতক্ষণ দেখা হয় নি। মনেই পড়ে নি চিঠির পেছনে ঠিকানাসহ হাজিরা দেয় প্রেরকের কণ্ঠস্বর।
‘শিক্ষাবোর্ড থেকে। হয়তো দরকারি কিছু হবে।’
‘প্রোমোশন হলো কি?’
প্রোমোশন! মনে মনে বলতে দ্বিধা নেই আমার স্ত্রী একটু লোভী প্রকৃতির। প্রোমোশনের সম্মানের চেয়ে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধিটাই ওর কাছে মুখ্য—আমি নিঃসন্দেহ। ও টাকা-পয়সা দিয়েই দুনিয়াতে সুখ কিনতে চায়—স্বস্তি পেতে চায়। অর্থের এ সুখের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে ওর চাহিদা লাগামহীন হয়ে গেছে।
অদৃষ্ট! শুধু শারমিনের কথা বলছি না—জীবন-সংসারে নির্লোভ মুহূর্ত আমার জীবনে খুব একটা আসে নি। স্ত্রীর কাছ থেকে নির্লোভ ভালোবাসা পেয়েছি কি? শরীরের সুখ পেয়েছি সত্যি, কিন্তু ভালোবাসা! অধরাই কি? স্ত্রীর লোভী আচরণ দেখতে দেখতে আমার মানসিক স্বস্তির মৃত্যু হয়েছে প্রায়ই। প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে আমার কবি-সত্তা। সত্যি, ওর শাড়ি আর গয়নার আবদারে আমি বহু কবিতাকে ভ্রূণেই হত্যা করেছি। আমার অগণিত ছোট গল্পের মৃত্যুর জন্যও ও দায়ী। কাব্যচর্চার সময় ওর নির্দয় প্ররোচনায় আমাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিউশনিতে যেতে হয়। গল্প লেখার পরিবর্তে আমাকে কোচিং সেন্টারে যেয়ে মিথ্যে পড়ার নামে গল্পের আসর জমাতে হয়। জীবনের এ পর্যায়ে এসে সময়ের কাছে আমি পুরোপুরি পরাস্ত।
সময় আমাকে হাসতে নিষেধ করে। হাসি তো ভেতর থেকে আসে। ভেতরের প্রাপ্তি সন্তুষ্ট হলে বাহিরে স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে। আমার প্রাপ্তি কতটুকু তা এ সময়ে এসে আর হিশেব করতে ইচ্ছে হয় না। তিনটি সন্তানের সার্থক জনক হয়েছি কি? দায়িত্ববান স্বামী? সন্তানের অবুঝ মন হয়তো আমার জনক পরিচয়কে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে আমি কি দায়িত্ববান স্বামী হতে পেরেছি? পারি নি। আরো অনেক গল্প, কবিতার অগণিত ভ্রূণকে হত্যা করে সারি সারি গহনা, শাড়ি এনে দিয়ে ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে পারলে হয়তো দায়িত্ববান স্বামী হতে পারব। সমাজের প্রতি দায়িত্ববান হতে পারি নি—লেখক সত্তার প্রতি দায়িত্ববান হতে পারি নি।
চিঠি খোলার সময়ক্ষেপন দেখে শারমিন ভেঙচি কেটে চলে গেল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে বউয়ের এ ভেঙচি বুকে কেমন নাড়া দিতো। এখন এমন হয় যে, বুকে কোনো অনুভূতিই কাজ করে না। মাঝে মাঝে কেন যেন মুখ নড়ে উঠতে উদ্যত হয়—ভেঙচিতে ভেঙচিতে কাটাকাটি হয়ে যাক অহেতুক ন্যাকামো-পাঠ।
চিঠির শেষ লাইন আমাকে বারবার ধাক্কা দেয়—ব্যথিত করে। এখন কার কাছ থেকে শুনব প্রথমার না বলা কথাগুলো। প্রথমা, কেন ভালো ছিলে না তুমি? আমাকে কী কথা বলার ছিল? দুদিন আগে আসলেও দেখা পেতাম তোমার। তুমি কি অভিমান করেছে আমার প্রতি? তুমি কি জানতে মৃত্যু তোমাকে তাড়া করছে? তবে কেন বলো নি তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি কোনো ভাবনায় যেতাম না। কোনো পিছুটান আমায় রুখতেও পারত না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি কি আমার অপেক্ষায় ছিলে…
দুটো মেয়েও চলে গেল আমার পানসে আর নিরানন্দ দেহভঙ্গিমা দেখে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে শিশুসুলভ কৌতূহল মুখ করে। বাবার প্রতি এ মুগ্ধতা একদিন কেটে যাবে। শারমিনের যেমন ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে স্বামীর প্রতি বিমুগ্ধতা—আস্থার অনুশীলন।
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে হলেও এ চিঠিটা কেড়ে নিত শারমিন। বাতাসে শাড়ির আচল নড়ে উঠত। অঙ্গে অঙ্গে ঢেউ তুলে ছোবল দিত আমার বুকে—চিঠির শরীরে। শরীরী-ভাষায় কথা বলতে বলতে এখন আমরা ক্লান্ত কি? ভেতরের টান, অনুভূতি কি শুধুমাত্র শরীরকে কেন্দ্র করে? এ ভাবনাগুলো মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। হয়তো এরকম কষ্টের দেয়ালের সাথে শারমিনও যুদ্ধ করে যাচ্ছে গোপন ক্রন্দন নিয়ে।
আনন্দ অস্থির। বলল, ‘বাবা, চিঠিটা খুলছ না কেন? আমি তো খেলতে যাব।’
চিঠিটা এখন খুলব কি খুলব না? এও তো একটা খেলা। জীবনের খেলাঘরে কত খেলা খেলেছি। পরাজয়কে কখনোই মানতে পারতাম না। যেন জয় শুধুমাত্র আমার জন্য—বিজয়ের একমাত্র অধিকার আমারই। প্রতিযোগিতার এ পড়ন্ত বেলায় এসে বুঝেছি পরাজয়ের অধিকার নিয়েই আমি জন্মেছি।
খামটা ছিড়ে ফেললাম। মুক্ত চিঠি। বার্তা ছড়িয়ে দিতে শব্দগুলো হয়তো বিদ্রোহ করছিল খামের দেয়ালে আটকে। শব্দের শরীরে আটকে গেল চোখ। স্থির, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকে মৃদু কাঁপন চলছে। শরীরের আচরণ, চোখের ভাষা লক্ষ করছে আনন্দ। ভাগ্যিস শারমিন সামনে নেই। আমি বাড়িতে থাকাকালীন সময়, ছুটির দিনে চিঠি এল—সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাঁচ লাইনের একটা চিঠিতে এতটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল আমার ভেতর-বাহিরে!
আনন্দ ঘোরলাগা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কার চিঠি বাবা? তুমি এমন করছ কেন?’
‘আমার এক বন্ধুর চিঠি বাবা। তুমি এখন খেলতে যাও।’
কথাটা কি মিথ্যে বললাম ছেলেকে? বন্ধু! বন্ধু? প্রথমা কি সত্যি আমার বন্ধু ছিল? আছে? প্রায় বিশ বছর ওকে দেখি না। কোনোরকম যোগাযোগ নেই। শুধুমাত্র লেখক হওয়ার সুবিধার্থে ও ঘুরেফিরে গল্প, কবিতায় চলে আসে—ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন শরীরী অবয়বে। আজ চিঠির মাধ্যমে সম্পর্ক সংযোগ করতে হলো। জীবনের সঠিক রাস্তা খুঁজতে যেয়ে প্রথমাই বিয়োগ করেছিল আমাদের সম্পর্ককে—আমাকে। আমি প্রেমিক হিশেবে আশ্বস্ত করতে পারি নি প্র্রথমাকে— প্রথমার বিশ্বাসকে। সময়ে সুখের পাঠ গ্রহণ করে ও রচনা করেছিল নিজস্ব জগৎ। যে জগতে আমি ছিলাম অপাঙ্ক্তেয়। ওর নির্ভরতার মূল্য দিতে পারি নি বলে ও আমার ভালোবাসারই কোনো মূল্য দেয় নি।
২.
‘আকাশ, তোমাকে চিঠি লিখলাম। তোমাকে! বহুবছর পর। ভালো আছ আশাকরি। জান, তোমার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে। আমার পক্ষে আসা সম্ভব না। আমার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানই। আসবে? ওকে তোমার কথা বলেছি। তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, অবশ্য সম্পূর্ণটা বলতে পারি নি। তুমি এখন সুপরিচিত কবি। প্রেরকের ঠিকানায় আমার নাম দেই নি। আমার কারণে যদি তোমার কোনো সমস্যা হয়। তোমার স্ত্রী সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানি না। আসবে একবার? আমি ভালো নেই। একটিবার দেখা করবে? তোমাকে কিছু কথা বলারও ছিল।’
এর আগেও প্রথমার চিঠি পেয়েছি। আবেদন ছিল চিঠির শরীর জুড়ে। আমায় যে খুব ভালোবাসত। সেই সময়—নির্ভাবনার দিনগুলি—কবিতা আর প্রথমা। আমার প্রথম পাঠক, প্রথম প্রেমিকা। সেই প্রথমাকে চিঠির খামে ভরে কত কবিতা দিয়েছি তার হিশেব নেই। পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে শিহরন। কবিতার আবেদন ভ্রমণেও বাদ যেত না। নৌকার গলুইয়ে বসে ঢেউয়ের সাথে তাল রেখে কবিতা আবৃত্তি করে যেত প্রথমা। কিছু কিছু স্মৃতি আবছা হয়ে যায়—কিছু স্মৃতি এখনও সমুজ্জ্বল।
মনে হচ্ছে এই তো সেইদিন—প্রথমার হাতে হাত রাখলাম, জোর করে। লাজুক ছিল—হাত সরাতে চাইল। বলল, ‘জোর করে আমার হাতে হাত রাখতে হবে না। আমি নির্দ্বিধায় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবো। আগামী দিনগুলো তো আমাদের—শুধুই আমাদের।
‘তোমার বাবা তো আমার সাথে তোমার বিয়ে দিবে না। বেকার ছেলের হাতে কোন বাবা মেয়ে তুলে দেয়।’
‘আপত্তি কী? তোমার একটা চাকরি নিশ্চয়ই হবে। তুমি ভেবো না, আমাদের প্রেম হয়েছে সফল হবার জন্যেই।’
‘আমার কবিতা লেখার কী হবে? তোমার জন্য তো কবিতা লেখা ছাড়তে হবে।’
‘কবিতা লেখা আপাতত বন্ধ রাখ। বিয়ের আগে শুধুমাত্র আমার জন্যে একটা চাকরি নাও। বিয়ের পর আমি চাকরি করব। তুমি শুধু কবিতা নিয়ে থাকবে। বড় কবি তোমাকে হতেই হবে।’
আমার হাত চেপে ধরেছিল প্রথমা। নদীতে ঢেউ থেমে গেল। নিশ্চল, শান্ত, বয়ে চলছে উত্তাপহীন। দৃঢ় মুষ্টিতে আমিও হাত ধরলাম। প্র্র্র্রথমার প্রতি মায়া জাগল। মিষ্টি মুখেতে দেখলাম দৃঢ় প্রত্যয়। প্রথমা হয়ে উঠল আমার জীবনে আকাঙ্ক্ষিত নারী। শরীর আছে, মনও আছে—সৌন্দর্যঘিরে।
বিষাদময় এ জীবনে কল্পনার সুখস্মৃতি যখন মনকে কিছুটা হলেও স্বস্তির স্পর্শ এনে দেয় তখনই কোনো না কোনো উৎকট ঝামেলা এসে আমাকে নাড়িয়ে দেয়। সুখস্মৃতি চলে যায় আর আমি বিষণ্ন শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি বিমূঢ়ের মতো।
শারমিন কি খুব বেশি বিরক্ত? বলল, ‘বাজারে যেতে হবে না? তোমাকে যদি সবসময় এমন তাড়া দিয়ে দিয়ে কাজ করাতে হয় তবে ছেলেমেয়েদের কিভাবে সামলাব? আমার হয়েছে যত জ্বালা।’
বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল চিঠির মধ্যে। ভাজ করা শার্টের পকেটে। চিঠির শেষ লাইনটা বারবার কানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। ‘আমি ভালো নেই। একটিবার দেখা করবে?’ কী হয়েছে প্রথমার? স্বামী দিয়ে কি সুখী নয়? দুশ্চরিত্র? লম্পট? নেশাখোর? গায়ে হাত তোলে? নাকি নপুংশক? এসব সমস্যা হয়তো নয়। ছেলেকে নিয়ে সমস্যা? সন্ত্রাসী? বাউণ্ডুলে? বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী? মেয়েরাও তো আজকাল নানান সমস্যার জন্ম দিয়ে থাকে? প্রেম করতে যেয়ে ইজ্জত হারিয়েছে কি? ধর্ষিতা? কী ভাবছি এসব! বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সমস্যার তো শেষ নেই। আমাকে না পাওয়ার আক্ষেপ কি? আমাকে পেলেও আক্ষেপ করত নিশ্চিত। শারমিন যেমন পেয়েও ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে কাঁদে। আমার এরকম লাগছে কেন? আমি কি ক্লান্ত নাকি প্রথমার ভাবনা আমাকে সম্মোহিত করে ফেলছে। মাথার ভেতর খেলা করছে সেই সময়ের সুখস্মৃতি আর দুঃস্মৃতি মিশেলে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা। বাজার থেকে কী কী যেন আনতে বলল? আজও নির্ঘাৎ উচ্চবাক্যের সম্মুখীন হতে হবে। ছেলেমেয়েদের সামনেই শারমিনের মুখ চলে—যত সব বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
জীবনটা এমন কেন? সুখ কি সব সময়ই উদাহরণ হিশেবে পাশের বাড়িতে পড়ে থাকবে?
যাব নাকি প্রথমার কাছে? কী লাভ! কেনই-বা বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে দাঁড়ানো। সময়ের ব্যবধান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়াতে প্রথমার প্রতি ক্ষোভ কিংবা ঘৃণা হয়তো সেই অর্থে আর নেই—তাই বলে কি ভুলে গেছি সেই দিনগুলোর কথা? আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সেই মুহূর্তটি আজও ব্যথিত করে—নিজের কাছে নিজেই অপমানিত হই, লজ্জিত হই।
প্রথমার সাথে অনেকদিন দেখা হচ্ছিল না। চাকরির বিষয়ে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। তাই বলে আমায় এড়িয়ে চলবে? ভাবতে পারছিলাম না কিছুই। বাড়িতেই চলে যাব কি? ওর বাবাকে দেখলেই তো পা আটকে যায়। তবুও যেতে হয়েছে ভেতরের তাড়া থেকে। প্রথমা! অনেক দিনের না দেখা প্রথমা। প্রায় তিন মাসের আক্ষেপ। বাড়িতে গেলাম। উঠানেই দেখি যৌবতি কন্যা। ভরাট শরীর নিয়ে ছুটোছুটি করছে। প্রতিটি অঙ্গ তখন জীবন্ত—উৎফুল্ল। আমাকে দেখল। নিভে গেল কি? আমি ওর অঙ্গের দিকে লক্ষ করছিলাম। জীবন্ত অঙ্গের নিভে যাওয়া মুহূর্তটি। পা থেমে গেল। হাত অসাড়। বুকের স্পন্দনও থেমে গেল কি? চোখের ভেতর কালো মেঘ। হাসির রানি মেয়েটা তখন হাসতে চেষ্টা করছে।
আমার সামনে এসেও শরীরে শরীরে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বলল, ‘তুমি হঠাৎ বাড়িতে?’
‘কেন আসতে নেই?’
‘তা কেন—তবে আগে তো হাজারবার বললেও আসতে চাইতে না।’
আমি বিব্রত। ‘অনেক দিন পর তোমার সাথে দেখা, তারপরও তুমি খুশি হও নি।’
প্রথমা নিশ্চুপ। আমার প্রতি ওর যাবতীয় মুগ্ধতা চলে গেছে আমি নিশ্চিত। রুমের ভেতরে এসে বসলাম। আমার মাথা প্রচণ্ড গরম। থাকব নাকি চলে যাব বুঝতে পারছিলাম না।
প্রথমা বিনয়ের সাথে বলল, ‘শোন, বাবা তোমাকে পছন্দ করে না। বেকার ছেলের হাতে মেয়েও তুলে দিবে না।’
‘বাবার কথাই কি তোমার কথা?’
আবারও প্রথমা নিশ্চুপ। ওর নীরবতাতেই আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল। বাড়ি থেকে বের হবো হঠাৎ পিয়ন এসে হাজির। পরিচিত পিয়ন। হাসি মুখে আমার হাতে চিঠি দিয়ে বলল, ‘প্রথমা বুবুর চিঠি।’
চিঠি হাতে নিলাম। প্রথমার দিকে চোখ পড়তেই দেখি ও বিচলিত, উদ্বিগ্ন। চিঠির পোশাকে জ্বলজ্বল করছে—প্রেরক আফজাল আহমেদ। নিষিদ্ধ সম্পকের ঘ্রাণ পেলাম। আমার চিরদেনের অপন্দের কাজটা করে ফেললাম নির্দ্বিধায়। খাম ছিড়ে চিঠির অধিকার নিলাম। প্রথমার কোনো বাধা মানলাম না। পড়ছি আর বিস্মিত হচ্ছি। চিঠির শরীর জুড়ে প্রেমের পঙ্ক্তি। নিষিদ্ধ রোমান্টিকতা। চিঠির ভাষা বলছে এ চিঠি প্রথম নয়। তিন মাসের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল! হৃদয় বেশিদিন শূন্য থাকে না। ঘৃণা জন্মাল খুব। প্রেম-ভালোবাসা-নারী-প্রথমার প্রতি। আফজাল? আফজাল নিশ্চয়ই চাকরি করে। প্রথমা হয়তো ভালো ছেলের ভালোবাসার চেয়ে ভালো স্বামীর নির্ভরতা চেয়েছে বেশি। আমার পরাজয় হলো—প্রথমার মাধ্যমে। এ পরাজয়কেই আশীর্বাদ মনে করলাম। এতদিনে চাকরি হয় নি বলে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম। বিয়ের পর চাকরি না থাকলে কী হতো?
যতটুকু মনে পড়ে প্রথমা গেটের বাহিরে এসে বলেছিল, ‘তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়। ভুল বুঝে চলে যাচ্ছ।’
পরে জেনেছি প্রথমা আফজালকে বিয়ে করে নি। ওর পরিবারের সবাই আমাদের বিষয়টা জানত। জানত কিছু বন্ধুও। শেষ সময়ে হয়তো সমাজের কাছে বিশ্বাসঘাতিনী হতে চায় নি। পচিশ বছরের মেয়ে হয়ে বিয়ে করেছিল পয়তাল্লিশ ঊর্ধ্ব এক লোককে। লোকটি সরকারি চাকরিজীবী।
৩.
আমি মাঝে মাঝে নিজেই নিজের বিরোধিতা করি কারণ ভাবনাগুলো প্রায়ই আমার বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
আমি প্রথমার সাথে দেখা করতে চাই। প্রথমা যে আচরণই করে করুক, প্রয়োজনের তাগিদে যতই মিথ্যাচার করুক, প্রতারক, সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী যে অভিধাতেই ওকে ফেলি না কেন, অদ্ভুতরকমভাবে ওর প্রতি ভালো লাগা এখনও কাজ করে। তবে কিভাবে ওর আহবানকে অস্বীকার করব? গত সাতদিনে ভাবনাগুলো দুঃসহস্মৃতি নয় যেন সাপ হয়ে প্রথমার অস্তিত্বের দিকে ছোবল হানছে, ওর প্রতি অভিযোগ পাহাড় সমান দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে—সেই আমিই আবার ছোবল উপেক্ষা করছি, অভিযোগের পাহাড় জয় করে ফেলছি। ‘আমি ভলো নেই। একটিবার দেখা করবে?’ সত্যি বলতে, প্রথমার এ আবেদনকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার এখনও নেই। প্রথমার শরীরের আবেদন আর নেই। মনের আবেদন উভয় পক্ষ থেকেই উপেক্ষিত হবে। জানি, আমাদের মিলনও কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবুও প্রথমা আমার প্রথম নারী—প্রথম প্রেম। এ আহবানে সাড়া না দিয়ে আমি কোনোভাবেই স্বস্তি পাব না। বাকিটা জীবন এ অস্বস্তি আমায় তাড়া করে বেড়াবে।
আজ বৃহস্পতিবার। চিঠি পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে নিতে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। প্রতিটি দিন আমার ভেতরে প্রশ্ন জেগেছে। উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি ধ্যানী হয়েছি—আমার মগ্নতার সঙ্গী হয়েছে অন্ধকারের কপাট বন্ধ ঘর, নির্জন দুপুর, শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া ক্ষণও।
কয়েকটা দিন আমি শুধু ভাবনার সাথেই বসবাস করেছি। ছেলে-মেয়েদের সাথে আত্মিক সম্পর্কে অনিহা দেখিয়েছি। স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্কেও আগ্রহ হারিয়েছি। শারমিন আমাকে প্রায়ই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত। চিঠি পাওয়ার পর আমার এ পরিবর্তন ছিল বিস্ময়কর। অন্য সবার কাছে এমনকি আমার নিজের কাছেও। গত পনের বছরের মধ্যে আমার চিন্তান্বিত চেহারা শারমিন খুব বেশি দেখে নি। এদিকে শারমিনের চিন্তায় বেশি কাজ করেছে চিঠি সম্পর্কে বিরূপ ভাবনা। শিক্ষাবোর্ডের চিঠি! স্কুলের চাকরিটাই চলে গেল কি? আমার বিরামহীন ভাবনা দেখে ওর ভেতরে এ চিন্তা কাজ করাটা অমূলক নয়। গতকাল ছলছল চোখে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, আমি পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। প্রথমে আশ্বস্ত হতে পারে নি—চিঠি দেখতে চাওয়ার পর আমার মধ্যে গড়িমসি দেখে। পরে ঠিক আশ্বস্ত হয়েছে আমার আত্মবিশ্বাসী মনোভাবে। কী করে ওকে চিঠি দেখাব? এও কী সম্ভব? পনের বছরের মধ্যে প্রথমার বিষয় নিয়ে শারমিনের সাথে আলোচনাই হয় নি। বেশি বয়সের বিয়ে বলেই হয়তো বউয়ের প্রতি জোরাল প্রেম কিংবা আদিখ্যেতা খুব একটা কাজ করে নি। মাঝে মাঝে আমার কিছু গল্প-কবিতা পড়ে নারী চরিত্রগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত—এ ভীতি অবশ্য সন্তান আসার আগ পর্যন্ত ছিল। সন্তান আসার পর শারমিন আমার প্রতিই অমনোযোগী হয়ে গেল—আমার প্রেমিকাদের প্রতি মনোযোগ দেবার সময় কোথায়।
আগামীকাল সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছি। প্রথমার উদ্দেশ্যে। প্রথমা কী বলতে চায় আমাকে তো জানতেই হবে। অনুতপ্ত হবে কি? প্রথমার সেই সময়ের আচরণে অনুতাপের কোনো লক্ষণই ছিল না। বিয়ের কিছুদিন পর একটা চিঠি দিয়েছিল, সে-চিঠিতেও অভিযোগের আঙুল আমার দিকে ছিল। চাকরি জোগাড় করা আমার জন্য নাকি কঠিন কিছু ছিল না। সত্যি কি আমি কবিতার জন্য কবিতা-অনুরাগিণীকে দূরে ঠেলে দিয়েছি?
সে-সময় আর এ সময় তো এক না। বয়স মানুষকে আত্মশুদ্ধির পথে নেয়। সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়। কাল হয়তো অনুতপ্ত হবে। ভুল স্বীকার করবে।
শারমিন সিলেট যেতে চেয়েছিল—ছেলেমেয়েরাও। ভ্রমণটা নাকি মন্দ হবে না। মাজার জিয়ারতও করা যাবে। শারমিনের প্রতি সবসময়ই আমার নেগেটিভ ধারণা কাজ করে। হয়তো ওর মানসিকতাই আমাকে এরূপ ভাবতে প্ররোচিত করে। আমার সাথে বেড়াতে গেলে ভালো লাগা কাজ করবে—এটা কি মুখ্য উদ্দেশ্য নাকি মাজার জিয়ারত করাই মুখ্য উদ্দেশ্য? তারপরও অন্য কোনো সময় হলে ভেবে দেখা যেত—আগামী কালকের ভ্রমণে সঙ্গী করা তো কোনোভাবেই সম্ভব না।
আমি সময় পার করছি ঘোরের মধ্যে। একে তো প্রথমা, তারওপর অস্থিরতা! প্রথমা! সেই প্রথমা যে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। চরম অপমান করেছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমার প্রেমকে—প্রেমিক সত্তাকে। তারপরও আমি প্রথমাকে দেখতে অস্থির, আগ্রহী। এটাই হয়তো মানুষের ধর্ম। ভালোবাসার মানুষের প্রতি মুগ্ধতা কখনোই অস্বীকার করা যায় না। হয়তো মাঝে মাঝে কিছু কষ্টের প্রলেপ, ঘৃণার বারুদ বুকে জমা হয়—সেই কষ্ট, ঘৃণা একটা সময় শিথিলও হয়—চিরন্তন ভালোবাসা রয়ে যায়। আগামীকালই দেখব প্রথমাকে—যৌবতি কন্যা সেই প্রথমা নয়, জীবন-যুদ্ধের প্রথমাকে।
৪.
সিলেট থেকে বাড়িতে ফিরছি। ট্রেনে। প্রকৃতি আজ কাঁদছে। ট্রেনও কি কান্নারত? ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দের মধ্যে যেন কান্নার আবহ মিশে আছে। আমার কান্না বাহিরের থেকে ভেতরেই বেশি। বাহিরের কান্নায় জল চোখ বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে আর ভেতরে চলছে রক্তক্ষরণ।
শারমিন আমাকে দেখে নিশ্চিত অবাক হবে। অন্তত দু’দিন তো থাকার কথা ছিল প্রথমার শহরে।
প্রথমার স্বামীর সাথে দেখা হলো। ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মানুষটা ভেঙে পড়েছে। কাঁপা কাঁপা হাত আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুখে ছিল কষ্টের হাসি। আমাকে থেকে যেতে বলেছিল বারংবার—অন্তত একদিন। আগামীকাল চারদিনের খরচে শরিক হতে।
প্রথমা পৃথিবীতে নেই। দুদিন আগে চলে গেছে না ফেরার দেশে। প্রথমা নেই? প্রথমা! সেই প্রথমা! আকাঙ্ক্ষিত নারী। এ কথা শোনার পর নিজেকে কি ধরে রাখা যায়? খুব কষ্ট হয়েছে সামলে নিতে। কান্না উঁকি দিয়েছে চোখে কোণে। বুক নড়ে উঠেছে। অবশ হয়ে যাওয়া হাত-পা নিয়ে বসে থেকেছি বিমূঢ়ের মতো। শরীরে কাঁপন চলছিল—ভেতরেও—দ্রুত। প্রথমা আমার জীবন থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছে সত্যি। তবুও তো স্মৃতিতে ছিল—মনের স্বস্তিতে ছিল।
প্রথমার কোনো সন্তান হয় নি। স্বামী-স্ত্রী দুটো জীবন মিলে আর কোনো মানবশিশুর জন্ম দিতে পারে নি। নতুন প্রাণের, নতুন মুখের প্রত্যাশা ছিল জীবনের কাছে। ব্যর্থতায়, বিষণ্নতা বাসা বেধেছিল প্রথমার দেহে। তখন জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো ব্যবধানও ছিল না। স্তন ও গর্ভাশয় ক্যান্সার প্রথমাকে মুক্তি দিলো জীবনের জটিলতা থেকে।
প্রথমার স্বামী বলেছিল, ‘প্রথমা আমাকে সব বলেছে আপনার সম্পর্কে—আপনাদের সম্পর্কে।’
বিস্মিত হয়েছিলাম। বলতে পারি নি, কতটুকু জানেন আপনি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে? বলতে পারি নি—আপনি কি জানেন প্রথমা আমাকে কি বলতে চেয়েছিল?
‘আমি ভালো নেই। একটিবার দেখা করবে? তোমাকে কিছু কথা বলারও ছিল।’ চিঠির শেষ লাইন আমাকে বারবার ধাক্কা দেয়—ব্যথিত করে। এখন কার কাছ থেকে শুনব প্রথমার না বলা কথাগুলো। প্রথমা, কেন ভালো ছিলে না তুমি? আমাকে কী কথা বলার ছিল? দুদিন আগে আসলেও দেখা পেতাম তোমার। তুমি কি অভিমান করেছে আমার প্রতি? তুমি কি জানতে মৃত্যু তোমাকে তাড়া করছে? তবে কেন বলো নি তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি কোনো ভাবনায় যেতাম না। কোনো পিছুটান আমায় রুখতেও পারত না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি কি আমার অপেক্ষায় ছিলে?
যদি দেখা হতো তবে হয়তো দেখতাম আত্মশুদ্ধির পর তোমার চেহারার দীপ্তিতে পুরো ঘর আলোকিত। বাকিটা জীবনে আমার শরীরেও আলোর দ্যুতি মিশে থাকত নিশ্চিত।
নীরব হয়ে ট্রেন থেমে গেল। চোখ থেকে শেষ ফোটা জল পড়ল ট্রেনের বুকে। নেমে গেলাম আমার চিরচেনা শহরে। প্রথমা ও আমার স্মৃতি-যাত্রার এখানেই সমাপ্তি কি?
ভালোই হলো দেখা হয় নি প্রথমার সাথে। প্রথমার এ রূপ আমার সহ্যই হতো না। মৃত্যু পথযাত্রী একটা শরীরে জ্যোতির্ময় আভা হয়তো থাকে—ত্রয়োবিংশের চোখ জুড়ানো রূপ তো আর থাকে না। চোখের ভেতর সেই স্মৃতিটাই খেলা করুক না—যে স্মৃতিতে প্রথমা সমুজ্জ্বল নিজস্ব অবয়বে। ভরাট শরীরের ছুটোছুটি, প্রতিটি অঙ্গ জীবন্ত, মন উৎফুল্ল, একান্ত প্রিয়—প্রথম নারী।