জীবনলঙ্কারনে কথাবলা গল্পের গল্পামী । জাকিয়া জেসমিন যূথী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, | ২৬৯৮ বার পঠিত
ডিসেম্বর দুইহাজার পনের খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সকাল রয়ের একক গল্পগ্রন্থ “প্রেম হলো প্রেমের মতো”। লেখকের অর্ধযুগ ধরে লেখা গল্পগুলি থেকে ভিন্ন স্বাদের বারোটি গল্প এতে যুক্ত হয়েছে। বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন তৌহিন হাসান। মলাটে কোন ফ্ল্যাপ নেই। লিপিবদ্ধ গল্পগুলো হলো- যে নগরে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারে সম্ভ্রম কেনা যায়।। আঁধারের অনুভব ।। প্রেম হলো প্রেমের মতো।। শেষ থেকে শুরু কিংবা বিন্তির স্বপ্নভঙ্গ ।। নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশতো বড় ।। প্রাণেরও আশা ছেড়ে স্বপেছি প্রাণ ।। আমি শুধু পোস্টার হয়ে ঝুলে রইবো দেয়ালে দেয়ালে ।। শ্রীহীন কাহন।। অনিলা, তুমি ভালো নেই।। পুড়ে যাচ্ছে সব।। কে প্রথম ভালোবেসেছিলো, কে প্রথম কাছে এসেছিলো ।। কেউ কেউ হারিয়ে যায় এভাবেই নাগরিক কোলাহলে।
লেখক গল্পগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘সকল বন্ধুদের’। প্রায় প্রতিটি গল্পে শিরোনম বড় হলেও গল্পের কিন্তু বড় নয়। কম কথায় গল্প সাজিয়ে তোলার মুন্সিয়ানা রয়েছে প্রতিটি দৃশ্যকল্পে। প্রথম গল্পটি একটি কিশোরী ধর্ষণকে কেন্দ্র করে। গল্পের নাম-যে নগরে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারে সম্ভ্রম কেনা যায়, শিরোনামের সম্ভ্রম শব্দটি গায়ে শিরশিরে অনুভূতি জাগায়। কী জানি অঘটনের বর্ণনা শুনতে হবে! লেখক রূপকের আলোকে বাস্তবতার নৃশংস এক প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন এখানে। পড়া শেষে কিছুক্ষনের জন্য থমকে যায় বুকের ভেতরটা। ইস! সমুদ্রার জীবনে যদি এই রকমটি না হতো!
পরবর্তি গল্প, ‘আঁধারের অনুভব’। মিষ্টি প্রেমের জীবনবোধের গল্প। গল্পের চড়াই -উৎরাই, দৃশ্য থেকে দৃশ্য পালটে পরিণামের পথে অগ্রসর হয়ে একটু যেন কৃষ্ণচূড়া দোলা দিয়ে যায়। গ্রামের সরল শিক্ষক নিজের গন্ডিতে কখনো আকাশ চাইতে পারেনা কিন্তু কখনো কখনো আকাশ মাটিতে নেমে আসে আর সেটাই উঠে এসেছে। এই গল্পে মিষ্টি একটি অনুভব সুস্পষ্ট অঙ্কিত। জীবনবোধের পরিত্যক্ত প্রেম নিয়েও একটি গল্প আছে, “কে প্রথম ভালোবেসেছিলো, কে প্রথম কাছে এসেছিলো” যে গল্পের শুরু আর মধ্যবর্তি চমৎকার বুননে অঙ্কিত হলেও শেষটা তাহাহুড়ো করেই যেন শেষ হয়ে গেছে। গ্রন্থের নামাঙ্কিত গল্পটি বইয়ের তৃতীয় সারিতে, “প্রেম হলো প্রেমের মতো” গল্পটিও রূপকের ধাঁচে, কাহিনী ছোঁয়া যায় কি যায় না। অভিমান অনুভবের আকাশ পাতাল মূর্ছনায় ভেসে গল্পের কাহিনী এগোতে থাকে। সিনেমার মত দৃশ্যগুলো চোখের পর্দায় আলো ফেলতে থাকে।
চতুর্থ গল্পটি একটি রাজনৈতিক গল্প। যে গল্পের শুরুটা শেষের দিক থেকে শুরু হয়েছে। উঠে এসেছে নষ্ট রাজনীতিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়ের কথা। রাজনৈতিক বলি ও নষ্ট শাসন ব্যাবস্থা নিয়ে আরেকটি শব্দমুগ্ধ গল্প রয়েছে “আমি শুধু পোস্টার হয়ে ঝুলে রইবো দেয়ালে দেয়ালে”।
এছাড়াও মিষ্টি প্রেমের তিক্ত বিরহের গল্প ‘প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ’ রুপকের আচ্ছাদনে লেখাটাই এই লেখকের স্বকীয়তা। কী দারুন ছন্দবদ্ধ রূপে গল্পের কাহিনী এগোয়, মন শুধু মুগ্ধতায় মাতে। রবীন্দ্রগীতিকে কেন্দ্র করে গল্পটি অল্প করে ডালপালা ছড়িয়ে গেছে। সমকালীন সম্পর্কমাত্রা নিয়ে লেখা ‘শ্রীহীন কাহন’ গল্পের দৃশ্যকল্প বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চক্রবাক দেখিয়েছে। লেখক সেই চক্রবাক ভাবনায় লিখেছেন, ‘সত্যিকারের ভালোবাসা আজকাল সিনেমায় হয় বাস্তবে নয়’। গল্পটিতে গল্পের ছলে উঠে এসে বাস্তবতা, জীবনবোধ, প্রেম-বিচ্ছেদ, রাগ অনুরাগ সবই। শ্রীহীন কাহনে রয়েছে সমাজের অনেক না বলা গল্প যা কঠিন বাস্তব হয়েও অধরাই রয়ে যায় চিরকাল। অতীত থেকে যা বর্তমান সমাজের একটি অন্ধকার রূপ।
কারো চোখ দেখেও কেউ বলে দিতে পারে মানুষটি ভালো নেই। এটা সেই পারে যে গভীরভাবে তাকে অনুভব করতে পারে। কিন্তু জীবনের পাশাখেলায় সেই ভালোবাসার পথিককে পাশে পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। এরকমই স্মৃতির বনে প্রেমিকের হেঁটে যাওয়ার গল্প ‘অনিলা তুমি ভালো নেই’। একজন লেখকের জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার গল্প এটি।
গল্পগ্রন্থের শেষের দিকে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে একটি গল্প রয়েছে। একটি মন্দির পুড়িয়ে দেবার দৃশ্যকল্প দিয়ে গল্পটির শুরু, মানবিক বিলাপেও ঈশ্বর যেখানে অনঢ়। যেখানে সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষগুলোর অহমিকা আর আক্রোশে বলি হয়ে যাচ্ছে কিছু নিরীহ মানুষ। সেইসব মানুষদের নিয়ে লেখা গল্পটা। ভুল সমাজ কখনো কখনো পরস্পরের মাঝে দেয়াল উঠিয়ে দেয় আর এই দেয়াল কখনো কখনো দাঙ্গায় রুপ নেয়। এই গল্পটিকে লেখক অন্তি মূহুর্তে শেষ করে দিয়েছেন যে কারনে পাঠকের একটা আক্ষেপ থেকে যায়। আক্ষেপ ভরা গল্পটির নাম ‘পুড়ে যাচ্ছে সব’। বইয়ের সর্বশেষ গল্পটিতে রয়েছে চমকের পর চমক। একটি রুবী’র আংটিকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই হতে পারে। লেখক সেটাই কম কথায় চিত্রিত করেছেন। তবে যে লেখাগুলোতে গল্পামী ভাবটা একটু রঙহীন নিজস্ব শব্দশৈলীর গুনে সেগুলো উৎরে গেছে।