পদ্যলহরী । ঈপ্সিতা বহ্নি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ আগস্ট ২০১৬, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ২১৫৪ বার পঠিত
মানুষের বাসা
আমি এক আকাশচারী মানুষ,
করি ধুলোয় বসবাস।
আজকাল, ধুলোরাও
খানিক বাতাস পেলে
ঠিকঠাক পেয়ে যায়
ওড়ার আকাশ।
যতদূর যেতে চাই,
যাব।
কে বাঁধে?
কে হারায়?
কেন ভাবে, পথ হারাব?
হারাবার পথ নেই বাকি —
আকাশ তো খোলা থাকে
অনন্ত নক্ষত্র-ছায়াপথে;
সেখানেই খুঁজে নেব
বাসা;
সেখানেই খুঁজে নেব
হারাবার আশা।
সেখানেই খুঁজে নেব ঠাঁই।
যার যার আকাশ-তারা
তারই খুঁজে নেয়া চাই।
খবরবিহীন দেশ
কেউ কি আমায়
এমন কোনো শহর দেবে
যে-শহরে কোথাও কোনো
খবর নেই?
যেই শহরে খবরপাঠক
খবর পায় না
তাই টিভিতে
চশমা পরে
সুকুমারের ছড়া পড়ে।
চ্যানেলগুলো স্ক্রলে শেখায়
ণ-ত্ব, ষ-ত্ব, ভাষাবিধান
আর কখনো ব্যাখ্যা করে
কাব্যভাষার বাক্যাভিধান।
কাগজগুলো ছাপায় কেবল
হাসিমুখে বাঁচার ছবি,
রোদে-জলে অন্য কারো
মাথায় ধরা ছাতার ছবি,
নাটক-গল্প-গান লেখার
নতুন কিন্তু ভালো ধরন,
তারাভরা আকাশটাকে
বুঝে দেখার সমীকরণ।
যে-শহরে, যে-জগতে
মৃত ছেলের কান্নাভরা
ছবির নিচে
দেশের অর্থ বাড়ার খবর
ছাপতে হলে
বিঁধবে বুকে।
ছুটির-খুশির খবরগুলোর পাশাপাশি
রাস্তাঘাটে-মরে-যাওয়া
অর্ধশত লোকের কবর
খুঁড়তে গেলে
বিঁধবে বুকে।
জলে-ভাসা, হারিয়ে-যাওয়া
মানুষেরা যখন খবর
তখন পাশেই
জীবন কারো বিজ্ঞাপনে
ভাসছে সুখে;
এমন পাতা তিরের মতন
বিঁধবে বুকে।
এমন কোনো শহর কি নেই
যেই শহরে অশ্রু মুছতে
সকল মানুষ
একইসাথে কাঁদতে পারে,
যেই শহরে ব্যর্থদের হতাশ্বাসে
জয়ী সকল মানুষ হারে।
এমন ছোট্ট শহর আমার
কোথায় আছে?
যেই শহরে
দুঃখগুলো যায় না ভেসে
সুখের তোড়ে,
এমন শহর
যেই শহরে কোথাও কোনো
সুখে কিংবা দুখে ভরা খবর নাই।
শুধুই তারার আলো, জলের শব্দ আছে;
শুধুই আকাশ, মাটি এবং মানুষ আছে।
আসেন, কিছু আফিম খাই
আসেন, কিছু আফিম খাই।
নেশা বলে ভয় পাচ্ছেন?
ক্যান রে ভাই?
আপনি কি আর
সত্য ভুলে নিজের নেশায়
ডুইব্যা নাই?
কষ্ট ভীষণ তাই পড়ি না
চার লাইনের বেশি ভাই।
কষ্ট ভীষণ করি না আর
সত্য মিথ্যা যাচাই তাই।
হ্যাশট্যাগ আর সেলফি দিয়ে
সহজ কমেন্ট-লাইক পাই।
সুখের জীবন তোমার চেয়ে
আমার — সেটা জানিয়ে যাই।
দেশের মানুষ মরলে মরুক
আমার কোনো চিন্তা নাই।
চিন্তা করে লাভ কি আমার?
চিন্তা করে পয়সা নাই।
ধর্মের নামে শেয়ার করেই
যখন সহজ স্বর্গ পাই,
স্বদেশ তবে গোল্লায় যাক
মানবতা কিসের ছাই?
নিজের লাভ আর লোভের নেশায়
অন্ধ-বধির হয়ে থেকে
জগৎ থেকে মুখ ফেরাই।
ভালো-মন্দ বিচার ভুলে
নিজের নেশায় থাকছি যখন,
আসেন ঘুমের ওষুধ খাই।
বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখে
ভুলের স্বর্গে দিন কাটাই।
এত নেশায় মগ্ন যখন
আসেন, আরও আফিম খাই।
জলবন্দী
ভেজা গ্রিলে জল ফোটালো
মেঘলা দিনের হাওয়া।
জলবন্দী আজ দুপুরে
তোমায় দেখতে চাওয়া।
বৃষ্টি মানে বদ্ধ বাসে
ঝাপসা-ভেজা কাচ;
হাজার গাড়ির ভিড় পেরিয়ে
আইল্যান্ডের গাছ।
এই শহরে বৃষ্টি মানে
জামায় লাগা কাদা।
এই শহরে বর্ষা মানেই
পথের, পথে বাধা।
বৃষ্টি এলে এই দুজনের
পাশাপাশি হাঁটা
হয় না, কেবল থাকলে সাথে
একটি মাত্র ছাতা।
ছেঁড়া কাগজ, ছোট্ট হাতে
নৌকা হয়ে চলা,
এই শহরে বর্ষা এলেই
কবির কথা বলা।
এই শহরে বর্ষা এলেই
কদম-দানের গান।
পথের ধারে জলাঙ্গিনী —
দোলনচাঁপার ঘ্রাণ।
বর্ষা এলে তপ্ত-শহর
প্রাণের আভাস পায়।
ছেলেবেলার মেঠোপথে
স্মৃতিকে হারায়।
জলবন্দী, হলুদ পাতা
নতুন পথে চলে;
এই শহরে বর্ষা আসে
কাব্য-কথার ছলে।
কবির আড়াল
কবিতা আড়ালে যাক
আসুক সন্ধ্যা-কাঁধে বিকেল।
দেখি অন্ধকারে
সূর্যের ঢেলে-দেয়া রঙ।
কবিতা আড়ালে যায়, যাক।
আমি চাই না
শব্দের মিথ্যে আচ্ছাদন।
কাঁদি যদি কাঁদি কাব্যহীন
হাসি পেলে হাসি
যেমন সত্য হাসে মনে।
না-হোক কথার যোগাযোগ —
অর্থ না-থাকে যদি;
নিস্তব্ধতাই হোক অর্থহীন।
কাব্যে আড়াল না নেই;
থাকি সত্য মানুষ।
যেমন কবি তেমনই হোক মানুষ।