আজরফ’স টি স্টল । হাসান ইনাম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুলাই ২০১৬, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ, | ২০৩২ বার পঠিত
গলির প্রবেশ পথ। টুং টাং আওয়াজ। চা’এর দোকান। আজরফ দোকানি। সকাল ছয়টায় কেটলি বসায় স্টোভে। ঝাঁট দেয় দোকানের সামনে। বিস্কুটের বৈয়ামগুলো যত্ন করে মুছে। আরো কিছু টুকটাক কাজ। এরপর বেন্সনের প্যাকেটে হাত দেয়। আয়েশ করে দিয়াশলাই হাতে নেয়। আকাশের দিকে চেয়ে উদাস নয়নে সিগারেট ফুঁকে। এই সময়টাতে তেমন কাস্টমারের দেখা মেলে না। বিপত্তি ছাড়াই পুরো সিগারেট শেষ করতে পারে আজরফ। আজ আজরফের মেজাজ খারাপ প্রচুর। মেজাজ এবং ভয় একত্রে জ্যামিতিকতার সাথে বৃদ্ধি পেলে নিউরনে যেমন উত্কট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তেমন কিছু একটা হয়েছে আজরফের। আজরফ কাঁপছে। হয়তো ভয়ে নয়তো রাগে। দোকানের ঝাঁপ এখনও খোলা হয়নি। সিগারেট খাওয়ার সময় উতরে যাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল নেই। আজরফের দোকানের সামনে দুটো বেঞ্চী। বেঞ্চীদুটো সন্ধ্যায় থেকে রাত অব্দি পরিপূর্ণ থাকে। মহল্লার বড় ভাই নামধারী টিট্টু এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বসে থাকে। পুরোটা সময়জুড়ে সর্বোচ্চ তিন কাপ চা বিক্রি হয়। সিগারেটের চালান সে সময় ভালো থাকলেও ক্যাশবাক্সে টাকা আসতে মাসের পর মাস লেগে যায়। বিকিকিনি কম হলেও সন্তুষ্ট আজরফ। মহল্লার সবাই তার দোকান চেনে। যে টিট্টুকে চেনে সে আজরফের দোকান চিনতে বাধ্য। আজরফের আস্তানা বললেও ভুল হবে না আজরফের দোকানটাকে। দোকানের পরিচিতির পেছনে শুধু টিট্টু নয় আরো অনেক কিছুই জড়িত। মতিন সরদার হলেন কাউন্সিলার। তার নামের সড়কটার শুরুতে আজরফের দোকান। সরু একটা গলিকে সড়ক বলে আখ্যায়িত করে ‘ফলক’ লাগানো হয়েছে আজরফের দোকানের সামনে। মতিন সরদারের উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম একটা প্রকল্প হলো ‘মতিন সরদার রোড’। বিভিন্ন আলোচনা সভা অথবা দুআ মাহফিলে বুক ফুলিয়ে মতিন সরদার বলে থাকেন এভাবে ‘আপনারা জানেন , আমি আজরফ মিয়ার দোকান থেকে প্রেমপাড়া পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করেছি। আপনাদের সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকলে আমি আপনাদের পাশে থেকে আপনাদের উপকার করে যাবো আজীবন। মতিন মিয়ার এহেন বক্তব্য প্রদানের ফলে এক শ্রেণীর সমালোচক এবং আরেক শ্রেণীর উত্সুক মানুষজন রাস্তা দেখতে এসে থাকে।
মতিন সরদার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। টিট্টুকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ছেলেটাকে সবাই ভয় করতে শুরু করেছে। তাকে কেউ ভয় করছে না। অথচ তিনি কাউন্সিলর।
আরো অনেক কারণ আছে। সেগুলি তেমন কিছু না। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গত মাসে খবরের কাগজে আজরফের দোকানের নাম আসাটা। পালাক্রমে ধর্ষণ এবং অবশেষে খুনের পর শাপলার লাশ যখন আজরফের দোকানের সামনে পড়ে ছিলো তখন অনেক লোক এসেছিলো দেখতে। দোকান খুলতে পারেনি সেদিন আজরফ। ইশ… সেদিন দোকান চালাতে পারলে কত লাভ হতো ! এখনও আফসোস করে আজরফ। ধর্ষিত শাপলা কাস্টমার ছিলো দোকানের। সকাল সাড়ে দশটায় ফ্লাস্কে চা নিয়ে যেতো। কাজের মেয়ে শাপলা। তখন কেউ চিনতো না মেয়েটাকে। স্তনের খয়েরী বোঁটা দুটো কেঁটে নাকে গুজে দেওয়া ছিলো। নিতম্বের কাছ থেকে খামচি দিয়ে এক ছটাক মাংস উঠানো। ভরাট নিতম্ব ছিলো শপলার । চা নিয়ে যাওয়ার সময় ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতো আজরফ। এখনতো পুরো দেশ চেনে। বিচার হবে না বলে শোনা যাচ্ছে। রুমন ভাই ছিলো গতবছর। টিট্টু ভাই তখন এলাকায় মাথা নিচু করে চলে। ধর্ষণ মামলা দাখিল হওয়ার পর রুমন ভাই এখন জেলে। রুমন ভাই জেলে যাওয়ার পর থেকেই টিট্টু ভাইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু এবং বিকিকিনি কমা শুরু আজরফের।
আজরফ আলি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপাকাঁপি বন্ধ হয়েছে কিছুটা। টিট্টু ভাইয়ের লাশ বেঞ্চীর উপর। গলাটা দোকানের ঝাঁপের সাথে ঝুলানো রশি দিয়ে। বডিটা বেঞ্চিতে। আজরফ মিয়া কর্তিত মাথা দেখে ভয় পেয়েছে। এরকম কর্তিত লাশ আগে কখনও দেখেনি। মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণ হলো, আবারো লোকজন জড়ো হবে দোকানের সামনে। পুলিশ আসবে। দোকান খুলতে দেবে না অনেকদিন। খবর ওয়ালারা ছুটে আসবে। জেরা করবে।
চট করে বুদ্ধি খেলে গেলো আজরফের মাথায়। লাশটা লুকিয়ে রাখলে কেমন হয়!?
গতকাল রাতের শেষ প্রহরে…
মতিন সরদার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। টিট্টুকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ছেলেটাকে সবাই ভয় করতে শুরু করেছে। তাকে কেউ ভয় করছে না। অথচ তিনি কাউন্সিলর।
টিট্টুকে খুন করে আজরফের দোকানের সামনে ফেলে রাখা হবে। তাহলে সবাই দেখতে পারবে। আজরফের দোকানেই তো টিট্টু আস্তানা পেতেছে। আস্তানাতেই লাশ ফেলা হবে।
আজ দুপুরে…
মতিন সরদার থাপ্পড় কষলেন মোবারকের গালে। একটা কাজ ঠিক মতো করতে পারে না। ‘লাশ কই?’
পরিশিষ্ট
আজরফের দোকান ভালোই চলে। টিট্টু না বসায় লোকজন দোকানে বসে। মতিন সরদার খুব শংকিত। বাম হাতে মাদুলি ঝুলিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন টিট্টু মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়েছে। কোন একদিন আবার লোকসমাজে ফিরে আসবে। খুন হওয়া ব্যাক্তি পুনরায় যদি ফিরে আসে তাহলে অনেক নিষ্ঠুর রূপে আসে। খুনের প্রতিশোধ নেয়। মতিন সরদার মৃত্যুর জন্য প্রহর জপছেন এবং দুটে স্কুল একটি মসজিদ একটি মাদরাসা ও কয়েকটা সড়কের কাজ শুরু করেছেন।