তৃতীয় চোখ বা অন্য কবিতা । মেহেদি হাসান তন্ময়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মে ২০১৬, ১১:৪১ অপরাহ্ণ, | ৩৬০১ বার পঠিত
মেটাফোর জীবনযাপন
যত ধীরে ফিরে যায় নিক্কন
তত গভীরে জেঁকে বসে হ্রেষা।
পাতাদের যত আদিবাসী নাচ;
বেজে ওঠে মৃদঙ্গের সুরে
শ্যাওড়াতলী অই ঝর্ণার কলতানে ঝরে।
অই স্রোতে ভেসে গেলে বৃক্ষ
তবুও সে মহৎ—
অই বৃক্ষের বায়ু শরীরে ঢুকে গেলে
ক্ষীয়মাণ মানব জানতে পারে
অথবা কখনোই জানতে পারেনা—
যতটা সে ফেলে দেয় নিশ্বাস
তত দ্রুত সরে যায় আত্মা
তৃতীয় চোখ
একুশ বছর কাটিয়ে দিলাম মৃত্যুর গান শুনে
কেমন নির্জীব এ প্রাণ ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধ্বসে গ্যাছে!
একুশ বছর কাটিয়ে দিলাম কে যেন আসবে বলে
জানিনা, কেন যাবো, যাবো, যাবো ঢেউ তুলে
আমি হারিয়ে যাই।
বুকের কোন কোণায় লুকিয়ে আছে তার দুঃখ
সেই মৃতহাত খুঁজে পাইনি কোথাও। কেবল—
যেখানে বৃষ্টি দেখি সেখানেই ফুটে থাকে তৃতীয় চোখ…
হাওয়া
হাওয়ার ভেতর ছুটে যায় যেমন হাওয়া;
তেমনি সমস্ত স্ট্রিটল্যাম্প নিভে গেলে—
আমিও চোখের ভেতর খুঁজে নেবো চোরাপথ।
জল এলে অইখানে, পার হবো শাশ্বত সাঁতারুর
ন্যায়। লাফ দেবো নিখুঁত ডলফিনের মতো। ডুবে
যাবো অঝোর শ্রাবণী গন্ধে। নেমে থাকবো ততক্ষণ—
যতক্ষণ হাওয়া না এলে বন্ধ হয়ে যায় প্রশ্বাস।
জার্নি বাই বাস
আলো দিয়ে অন্ধকারের গতি মেপে চলে বাসটি। তখনো আমি জীবিত, যেহেতু স্রোতের সাথে ভেসে চলে কেবলি মৃত মাছ। আর সেই বাসের লাইটগুলো এক মেরুন বেহালা নিয়ে বসে থাকে প্রত্যেক যাত্রীর ভেতর। যেভাবে এই বিস্তর জ্যামের অঞ্চলে অপেক্ষা আর উপেক্ষার মুহুর্তগুলো নির্দ্বিধায় ঢুকে গ্যাছে।
পথের এই দোটানায় বাসটি আর চলতে পারছে না। তাই এখানে শিখতে হবে কোন পথ হয় পার হতে আর কোন পথ হয় পোড়াতে। আমার যেহেতু এত মাথাব্যথা নেই তাই আমি অন্যের জন্য নিয়ম বানাই, আর তোমার জন্য জানালা খুলে রাখি।
জ্যাম ছেড়ে দিলেই পাওয়া যায় বাংলামটর। তুমি জানালায় হেসে বসো। যেন হাওয়ায় তোমার চুল উড়ে যায়, আর প্যাঁচিয়ে ধরে আমার হৃদয়। তখন হৃদয়ের উপর এতটা জোর দিই, যেন আমার শরীর ধীরে ধীরে যাচ্ছে ক্ষয়ে!
আর এই কোনো সমাধান নেই বলে এই সমস্যা নিয়েই আজীবন বসে আছি। আর দেখছি ধীরে, সোডিয়াম বাতির তলায় চুল উড়িয়ে চলে যাচ্ছে বাসটি। যেন এই পথের শেষ হয়নি কোথাও, কখনো..
মা
আমার মাকে আমি কখনো ডাকি নাই। সে আমার কথা শুনে না। যেদিন সে চলে যায় তার আগের দিন সে আমারে ডাক দেয়। আমার একটা হাত ধরে, আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। আমার মায়ের দুইটা হাত, এক হাতে আমার হাত ধরে সেদিন অজানা ভাষায় কি যেন বললো। ঠিক বুঝার আগেই তার আরেক হাত শূণ্যের দিকে উঠে যাচ্ছে কেন?
ঠিক বুঝলাম না। তারপর আমার মা আর কোনোদিন আমারে ডাকে নাই। আমিও ভুইলা গেছি ডাক কারে কয়, কিন্তু যেদিন সে চলে যায় অইদিন আমি তারে দেখি, সে আমার দিকে চাইয়া আছে। যেন ডাকতেছে আমারে।
তখনি কে যেন তার চোখ বন্ধ কইরা দিলো। তখন তার ধবধবা শাদা শরীর যেন আমারে জড়িয়ে ধরতে বলতেছে। কাঁনতে বলতেছে, ডাক দিতে বলতেছে, যেন বলতে বলছে আমারে, ডাক দেয়ার পূর্বেই অই মাটিতে ঢুকে যেও না, মা!
আমি বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার শব্দগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গ্যালো। আমার মা আমার কথা শুনতে পেলো কিনা বুঝতে পারলাম না। তারপর থেকে আমি নিশ্চিত সে শুধু আমারে ডাক দিতে কয়, কিন্তু আমার কোনো কথা শুনে না।
মৃতফুল
একবার দেখতেই শাদাফুল হয়ে ঝরে পড়লো সেই চোখ! এবার, হে অন্ধ আয়না, আমাকে পড়ো। যেহেতু খোলা বইয়ের পেইজে লেখা আছে চরিত্র। বিস্তৃত স্মৃতির ক্লান্ত অধ্যায় এবং নিবিড় অন্ধকারের গল্প। সেহেতু অইসব ভায়োলেন্স সেখানেই তোলা থাক।
বরং সেইখানে ঘনীভূত তরঙ্গের আস্তরে এবার বড় অক্ষরে নিজের নাম লিখো। যেন তিমিমাছ ঘুমিয়ে পড়ে অই ঘরে, আর অস্থির আমি অন্ধের মতো হাতরাই তোমার প্রাণ যেহেতু আমার চোখেও ফুটে আছে দুইটি মৃতফুল।
গান গাও লুসিয়ানা
ওহ লুসিয়ানা! এ কিভাবে ঢুকে পড়ছো তুমি—
অথৈ সমুদ্রের মাঝে কতগুলো কাঁটাতার, নাবিকদল
বন্দুক তাক করে আছে। তার ফাঁক গলে
কি আশ্চর্যগতিতে জেগে উঠছো তুমি!
আমার এই চোখ চুরি হয়ে যায়— অথচ দেখা যায়নি
যা-কিছু আছে অন্তর্গত। কিন্তু তোমার যে গান
জাহাজে ফেরি করতে করতে চলে আসছে
সেই সুরের সমুদ্র ডুবে গ্যাছে আমার আত্মার ভেতর
ওহ! লুসিয়ানা! তোমার নোনাজল আমি চুষে খাচ্ছি
তিনহাজার বছর। অথচ তুমি দেখতে পাওনি জেনে
একা বসে থাকে কবিতারা, মৃত উড়াসাগরের পার ধরে
তারা হেঁটে যায় শ’কোটি বৎসরের যাত্রায়
আমার এই চোখ গলে যায়, আমার এই তালু
খসে যায়, সমস্ত শরীর তোমার গভীরে ঢুকে যায়
অথচ তুমি আমাকে আজও দেখতে পাওনি
একথা নিশ্চিত জানি আজ। আর আমার এই মৃত নদী
তোমার মোহনার দিকে চলতে চলতে বালুচরে
ঢুকে পড়ে। তুমি এই বালুকণায় ডুবে যেতে পারো জেনে
আমি ক্রমশ পাথরের দিকে ধাবিত হচ্ছি।
আর সেই অন্ধপাথরের দিনে আমাদের দেখা হলে
তোমার অই চোখ ফিরিয়ে নিও না—
আমাকে একাকী ফিরিয়ে দিও না।
আমি অই উড়াসাগর থেকে জমে আসা ক্ষয়িষ্ণু মেঘ
ক্রমাগত পার করা এমন পাথরের দিনে ডুবে যেতে চাই
তোমার মোহনা বেয়ে ক্রমশ অনন্ত গভীর পথে।
অপরাপর অন্ধকার
হোমো সেপিয়েন্স, নিথর অন্ধকারে হাঁটছো তুমি। চোখের ভেতরে তোমার শিশিরের নিস্তব্ধতা; আর অদূরের প্ল্যাটফর্মজুড়ে বিশদ জীবনের সমারোহ। তাই দেখে তুমি ফিরে যেতে চাচ্ছো বহুদূরে ফেলে আসা প্রান্তে।
ফিরে যেতে চাচ্ছো বলে তুমি উঠে পড়ো আন্তঃনগরীয় ট্রেনে; বাতাসে পৃথিবী ছেড়ে দেয়া ভয়; আর ককটেলের অলীক শব্দে মহিমান্বিত ক্রসিং ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছো একাকী বেজান এক শহরে।
আর তোমার দেহের গভীরে যে নিস্তব্ধতা জেগে আছে বলে এখনো তুমি চলেছো একা, মূলত তার গভীরেও কেউ নিশব্দে বসে আছে। তুমি দেখতে পাচ্ছো না; তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছো না।
তাই বলে তাকাবে পাশের সিটে; অই নগ্ন পাহাড় থেকে ভেসে আসা মেঘ, আজ এসে ঢুকে গ্যাছে বগির ভেতর। আর কুণ্ডলী করে তুমি উড়ে যাচ্ছো কেমন ধোঁয়ায়। আর তার সমস্ত শরীর উন্মত্ত বারুদের ন্যায় ফুটছে তোমার গভীরে।
নাক, স্তন, চঞ্চুরী ও সমগ্র শরীর য্যানো চেয়ে আছে তোমার দিকে। প্রত্যেক বৃক্ষ পার হয়ে যখন চাঁদনি এসে ঢুকে পড়ে সেখানে তুমি তার মতো চাঁদ দেখতে তাকাও জানালায় ওপাশে
রেলের বিকট শব্দ যখন খেলে গ্যালো উভয়ের কর্ণপথ এবং ঝাঁকি দিয়ে গ্যালো সমস্ত যাত্রীদের; তখন একটি কালভার্ট একত্রে পার হলে দেখা গ্যালো উভয়ের চোখ— আর মৃদ্যু সিম্ফনি দোলা দিয়ে গ্যালো নরম হাওয়ায়।
পরের স্টেশনে ট্রেন থেমে গেলে তুমি নেমে পড়ো এই প্ল্যাটফর্মে। আর ভাবো, এই পথ নয় অনন্তকালের— এইসব মুহুর্ত আসে প্রত্যেক অনন্তকালের শেষে। আর আমরা প্রত্যেকে ফিরে যাই অন্ধকূপের কাছে। হোমো সেপিয়েন্স, নিথর অন্ধকারে একাকী হাঁটছো তুমি।