‘রঘু লৈশাংথেম এর নির্বাচিত কবিতা’ থেকে ১০টি কবিতা । মাইবম সাধন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ, | ৩১৮১ বার পঠিত
রঘু লৈশাংথেম এর নির্বাচিত কবিতা ভাষান্তর : মাইবম সাধন, প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈ:শব্দ্য, প্রকাশক: চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০১৬, মূল্য: ১৩৫
[মনিপুরেরর বাস্তবতা আর কেন্দ্রের শাসন— এ দুইয়ের মাঝেই প্রতিবাদের স্বরুপ হিসেবে রঘু কবিতা লিখেন। জন্ম- ১৯৫৯ সালে, মনিপুরের রাজধানী ইম্ফালে। পেশায় একজন সরকারি কর্মকর্তা। প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো—পুন্সি তেলেঙ্গা (কবিতা, ১৯৯১), লানবু লৈ ওইনা শান্নরিবা (কবিতা, ১৯৯৫), নুং অসি লাইনি লৈ অসি ঈনি (কবিতা, ১৯৯৯), হনুবীগী ঈশিং পুন (কবিতা, ২০০২), অতিথি উচেক (শিশুতোষ গল্প, ২০০৩), খুঙ্গংগী চিঠি (কবিতা, ২০০৫), তেঞ্জৈ অমসুং ঙা মমীৎ (শিশুতোষ গল্প, ২০০৫), চীংশাং নাপোম্না কপ্লি (কবিতা, ২০০৭), পাৎ পানগী থোইবী (শিশুতোষ গল্প, ২০০৯), বসন্ত ওইগেরা নাকেন্থা ওইগেরা (কবিতা, ২০১১), শৈরেংগী খুঙ্গং (কবিতা, ২০১৫)।
‘হনুবীগী ঈশিং পুন’ কাব্য গ্রন্থের জন্য মনিপুর সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রবর্তিত তেলেম আবির এওয়ার্ড পান ২০০৫ সালে এবং ‘খুঙ্গংগী চিঠি’ কাব্য গ্রন্থের জন্য ভারতের সাহিত্য একাদেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ২০০৯ সালে।
প্রতিবাদী এ কবির কবিতা বাংলায় খুব একটা দেখা যায়নি। তাই বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। কবিতাগুলো লেখকের অনুমতিক্রমে মূল মনিপুরি ভাষা থেকে অনূদিত এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬তে চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত “রঘু লৈশাংথেম এর নির্বাচিত কবিতা” গ্রন্থ থেকে ১০টি কবিতা রাশপ্রিন্ট পাঠকদের জন্য এখানে পত্রস্থ করা হল]
ইম্ফাল
আকাশে বিদ্যুত চমকালে
দেখি বাজারদেবী পড়ে আছে রাস্তার উপর
আর বৃষ্টি মাড়িয়ে দলিয়ে অগ্রসর
সময়ের ভয়াল বুট।
আর্ত পদচিহ্ন
চেয়ে দেখি
সূর্য রশ্মিও টুকরো টুকরো খসে পড়ে
ইম্ফালের মলপোকার স্তুপের ওপর।
সময় :
সেও স্বশব্দে…
আকাশ ফুড়ে ঘুর্ণিঝড় হয়ে
শুকনো পাতার মতো খসে পড়ে।
আজ
শকুনেরা উড়ছে শহরে
মৃত মানুষের স্তুপের ওপর
চোখদুটো নিচে
শ্যেনদৃষ্টি…
মৃত বন্ধুরা
গাড়ীর শব্দ শোনা গেলো
গ্রামের নিকটতম রাস্তায়
কুকুরের ডাকও ভেসে আসে ক্রমশ:
হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বেড়ে চলে যতই কাছে এলাম
দেখতে পেলে হায়েনা-কুকুরগুলো
ধাওয়া দিয়ে কামড়াতো নিরীহ মানুষদের।
ভয়
ছেড়াফাড়া শার্টের পকেটে পুরে
মানুষগুলো নিশ্চুপ বসে আছে তৃণহীন ধূ ধু মাঠে
আর হায়েনা-কুকুরগুলো চক্রাকারে পাহারা বসিয়েছে।
ভয় আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে
অত্যাচার নিপিড়নে মৃতদের দেখে সহ্য করতে পারিনি;
কিন্ত আজ আর দেখা গেলো না সেই মৃত বন্ধুদের।
শান্তি
শান্তি।
সে এক নতুন অস্ত্রের নাম
যার গুলিতে লেখা আছে
নিরীহ মানুষের জীবন-যবনিকা।
আজও
ক্রমাগত আমদানি হচ্ছে
শান্তির নামে অত্যাধুনিক মারনাস্ত্র
যেগুলো নারীদের
সম্ভ্রম হানি উপযোগেও ব্যবহৃত।
আর কালশে শকুনেরা
এখনো উড়ে চলে প্রকাশ্যে
শান্তির নিত্য-নতুন নামে
নিরীহদের কপাল খুঁড়ে ক্রমাগত।
আদিবাসী নারী
ভারতের আসামে সম্ভ্রমহানির শিকার হওয়া এক আদিবাসী নারীকে
কেঁদোনা
হে আদিবাসী নারী
কেনোইবা কাঁদছো
ওরা তোমায় বিবস্ত্র করেছিলো
ওরা মূলত আত্মপরিচয় দিয়েছিল-বর্বর।
বলো, যখন—
বিবস্ত্র করেছিলো, কেউ কি এগিয়েছিলো
একটুকরো কাপড় নিয়ে?
হে আদিবাসী নারী
চোখ বন্ধ রেখে ভাবো
একটুকরো কাপড়ের জন্য
তোমার দিগিদ্বিক ছুটে চলা
প্রকাশ্যে।
হে অপরিচিতা
আদিবাসী নারী,
তোমাকে মানুষই মনে করেনি
এ মনুষ্যত্ববর্জিত সমাজ।
তাহলে কাঁদছো কেনো
সংখ্যালঘু হয়ে জন্মেছো
স্রেফ এইটুকুই অপরাধ তাই—
তোমার এ অশ্রুফোটা হোক
বসন্তে উত্থিত নতুন পত্রপল্লবে বৃষ্টির পরশ।
প্রতিবাদ
ইতিহাসের সত্য ভূমিতে
দাড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়
সকল সময়ে
সকল মুহূর্তে
এই আকাশ আমাদেরও অংশ আছে।
যুদ্ধ
একদিন বৃষ্টিবন্দী আষাঢ়ে
ডালার কোণ থেকে
হা-ভাতে শীর্ণ এক বাবুইছানা
পত্ পত্ ডানা ঝাপটিয়ে বেরোয়
ওমনি শিকারি বাজ খপ্ করে ধরে।
তা দেখে এক ইদুর
হুড়মুড়িয়ে ঢোকে গর্তে
চোখজোড়া অপলক
সজল-সঘন।
তাজা খবর
শুনেছো
সে তাজা খবরটা—
পানিতে সাতরানো এক যৈবতী মাছ
গতরাতে আকস্মিক
ভেসে ওঠে জলে-অন্ধকারে
ওদিকে তার জন্যে ব্যাকুল
এক মৎস্য শিকারী।
আর আকাশজুড়ে
কাকের পায়চারি ভোরের প্রতীক্ষায়
সেই সান্ধ্যবিকেল থেকে বাজপাখিরাও।
মৃত ঈশ্বর
কবরের উপর
ধর্মান্ধের বিষাক্ত তীরে বিদ্ধ
এক ঈশ্বর
পড়ে আছে
যেনবা মৃত, জ্বলে ওঠবে এখনি।
আমি কাঁদবোনা ঈশ্বরের ওমন মৃত্যুতে।
কারণ
আমি অতিসাধারণ;
জাতপাত
গোষ্ঠীতন্ত্র
ভেদ-বিভেদে অবিশ্বস্ত একজন।
কাঁসাই
বাজাও জোরে-শোরে
কাঁসাই।
হা-ভাতে শীর্ণ দু’হাতে
যেন জেগে উঠবে তোমাদের ঈশ্বর
দীর্ঘদিন হয়ে গেল ঈশ্বর নিদ্রা যায়।
আমি মৃত
আমি এখন মৃত
অবস্থান শবগায়।
জীবিত ছিলাম যখন
তোমরা প্রত্যেকেই
আড়মোড়া টেনেছিলে গলায়
হিংসা-বিদ্বেষের শেকল পেঁচিয়ে।
আজ
আমি মরে যাবার পর
পুনরায় তোমরা
সমবেদনা জ্ঞাপন করছো শবাধারে
কপটতায় মহানুভব হৃদয় সেজে;
তাই
সত্যিকারে মৃত হতে পারলাম না।
এখন
আমি সত্যিই মরে গেলে
তোমরা ভেঙে ফেলোনা আমার স্বপ্নস্তম্ভ।
আমি মৃত।