‘হুমায়ুন আহমেদ’ বেঁচে আছেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’তে… । মোঃ অনিকউজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২:৫৫ অপরাহ্ণ, | ২৯৫২ বার পঠিত
আজকের দিনে যদি কেউ বলে যে ‘হুমায়ুন আহমেদ’ বেঁচে নেই, তিনি মারা গেছেন তবে আমি বলবো সে মিথ্যা কথা বলছে। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ মারা যাননি, তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ বেঁচে আছেন তার যোগ্য স্ত্রী ‘মেহের আফরোজ শাওন’ এর তৈরী সৃষ্টিতে। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ বেঁচে আছেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’তে…
আজ মুক্তি পেল ‘মেহের আফরোজ শাওন’ এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর উপন্যাস ‘কৃষ্ণপক্ষ’ অবলম্বনে মুভি ‘কৃষ্ণপক্ষ’। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে চলে গেলাম ‘বলাকা’ তে এবং দেখে এলাম আজকের প্রথম দিনে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ এর প্রথম শো। কতদিন পর যে সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখলাম তা আমি নিজেও বলতে পারবো না, আর এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে একমাত্র ‘হুমায়ুন আহমেদ’ ও তার সৃষ্টির প্রতি ভালবাসার কারণে। মুভিটি দেখার পর এখন কিছু কথা না বললেই নয়। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর একটি অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র ‘মুহিব’ আর ‘অরু’। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ তার উপন্যাস অবলম্বনে যত গুলো মুভি নির্মাণ করেছেন তার কোনটাই তিনি পুরোপুরি উপন্যাস ফলো করে তৈরী করেন নাই। সব সময় তিনি মুভিতে গল্প, ঘটনা ও আবেগ চেঞ্জ করে দিয়েছেন যার ফলে তার মুভি ছাড়িয়ে গেছে তার উপন্যাসকেও। এখন ‘কৃষ্ণপক্ষ’ উপন্যাসটি আমার পড়া নেই, তাই আমি বলতে পারবো না, ‘শাওন’ ঠিক কতটুকু বই ফলো করেছে বা চেঞ্জ করেছে। তবে শুনেছি শাওন নাকি ক্লাইম্যাক্স কিছুটা চেঞ্জ করে নিজের মত করেছে। সিনেমার গল্প অনুযায়ী ‘কৃষ্ণপক্ষ’ কোন আহামরি ও বিস্তৃত গল্প না হলেও অন্তত ‘আমার আছে জল’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুভির থেকে যথেষ্ট গুণে একটি স্ট্যান্ডার্ড মানের ও খুবই আনপ্রেডিক্টেবল একটি গল্প, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা উপন্যাসটি পড়েন নাই। তাই, আপনি যদি উপন্যাসটি না পড়ে থাকেন তবে গোটা সময়টি আপনি সিটে বসে এঞ্জয় করতে পারবেন ও আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, ক্লাইম্যাক্সে আপনার জন্য কি অপেক্ষা করছে, আমার ক্ষেত্রে অন্তত তাই হয়েছে।
‘কৃষ্ণপক্ষ’ এমন একটি গল্প যেখানে আছে ভাই বোনের ভালবাসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর জমানো ক্ষোভ ও কষ্ট, প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার অপরিসীম ভালবাসা, এক স্বপ্নবাজ তরুণের জীবন ও প্রেমিকার কষ্ট জড়ানো আকুতি। মুভিটি ‘হুমায়ুন আহমেদ’ নির্মাণ না করলেও মুভিটির প্রতিটি দৃশ্য, ডায়লগ, আবেগ সব কিছুতেই ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর একটি প্রছন্ন ছায়া খুঁজে পাওয়া গেছে। কখনো মনেই হয়নি যে এই মুভির নির্মাতা ‘হুমায়ুন আহমেদ’ নয় বরং অন্য কেউ ‘শাওন’। অনেকেই মুভি রিলিজের আগে অনেক কথা বলেছেন যে ‘শাওন’ আবার মুভি পরিচালনা করবে, কত সমালোচনা ইত্যাদী ইত্যাদী। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, হলে গিয়ে মুভিটি দেখে আসুন। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এত সুন্দর ও নিখুঁত পরিচালনা, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, কোরিওগ্রাফী, সিনেমাটোগ্রাফী, ক্যামেরা শর্ট, ট্রলি ও ক্রেনের ব্যবহার, কালার গ্রেডিং শেষ কবে কোন মুভিতে দেখেছিলাম তা মনেই পড়ে না। এই মুভিতে এমন কিছু ক্রেনের শর্ট নেয়া হয়েছে যা দেখে বিষ্ময়ে আমি হা হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এমন নয় যে শর্ট গুলোর খুব প্রয়োজন ছিল। চাইলে নরমাল লং শর্টেই দৃশ্য গুলো শেষ করে দেয়া যেত কিন্তু ঐভাবে শর্ট গুলো নেবার কারণে এখন গোটা মুভিটির আবেদন বহু অংশে বেড়ে গেছে। এই মুভি দেখে কেউ বলতেই পারবে না যে এটা ‘শাওন’ এর নির্মিত প্রথম মুভি। বানিজ্যিক মুভির অনেক নির্মাতাদের উচিত ‘শাওন’ এর কাছে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নেয়া যে একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মুভি বানাতে গেলে কিভাবে কিভাবে শর্ট ডিভিশন করতে হয়। মাত্র এক মাসে তৈরী এই মুভির প্রতিটি দৃশ্য ও ফ্রেমে ছিল অত্যন্ত যত্ন ও ভালবাসার ছাপ। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ‘কৃষ্ণপক্ষ’ যদি স্বয়ং ‘হুমায়ুন আহমেদ’ তৈরী করতেন তবে তিনিও পারতেন না এত নিখুঁত একটি মুভি বানাতে, কারণ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর এ যাবৎ কালের নির্মিত সকল মুভির মধ্যে নির্মাণকৌশলীর দিক থেকে সব থেকে সেরা ও নিখুঁত একটি মুভি।
অনেকেরই হয়তো আপত্তি ছিল ‘অরু’ চরিত্রে ‘মাহি’কে কাস্ট করার কারণে। আমি যেহেতু উপন্যাসটি পড়ি নাই, তাই বলতে পারবো না উপন্যাসের ‘অরু’ কেমন, তবে আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ‘কৃষ্ণপক্ষ’তে ‘মাহি’ তার লাইফের সেরা অভিনয়টি দিয়েছে। কোন ধরণের ন্যাকামো ছিল না তার অভিনয়ে, তার অভিনয় ও আবেগ ছিল একদম মাপা এবং ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর উপন্যাসে সব সময় শাড়ী পরা একজন প্রকৃত নারী যেমনটি হয়া উচিত ঠিক তেমনটিই লেগেছে ‘মাহি’কে। পাশাপাশি ‘শাওন’ একজন দক্ষ পরিচালকের মত ‘মাহি’র ভিতর থেকে অভিনয় বের করে এনেছে যা এ পর্যন্ত অনেক নামী দামী বানিজ্যিক সিনেমার পরিচালকেরাও করতে পারেনি। সুতরাং কেউ যদি এখন বলে যে ‘মাহি’ অভিনয় পারে না, তবে তাকে চেয়ারের সাথে হাত পা বেধে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ দেখিয়ে দেয়া উচিত। আর ‘মুহিব’ চরিত্রে ‘রিয়াজ’কে নিয়ে বলার কিছুই নেই। সেই ছিল এ মুভির প্রধান আকর্ষণ। আমরা ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’ মুভিতে যে ‘রিয়াজ’কে দেখেছি, ঠিক সেই ‘রিয়াজ’ ও তার শান্ত-শিষ্ট সাবলীল অভিনয় খুঁজে পাব আমরা ‘কৃষ্ণপক্ষ’তে। কোন ধরণের ভাঁড়ামো, যাত্রার ঢঙ্গে ডায়লগ বলা, ইমোশোনাল দৃশ্যে চিল্লিয়ে ওভার অ্যাকটিং কোন কিছুই ছিল না ‘রিয়াজ’ এর মধ্যে যা আমরা তার সকল বানিজ্যিক মুভি গুলোতে দেখতে পাই। এ মুভিতে হলুদ পাঞ্জাবীতে ‘হিমু’ বেশে ‘রিয়াজ’ এর লুক ছিল সব থেকে অসাধারণ। তবে, ‘মুহিব’ চরিত্রে ‘রিয়াজ’কে বেশ বয়স্ক লেগেছে, তার ফোলা মুখে চামড়ার ভাজ ও শরীরের ভুঁড়ির আকার ছিল বেশ প্রকট। আফসোস, ‘রিয়াজ’ যদি একটু স্বাস্থ্যসচেতন হত, তবে তাকে এভাবে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিতে হত না। পাশাপাশি অতিথী চরিত্রে ‘ফেরদৌস’কেউ ‘আবরার’ চরিত্রে অল্প সময়ের জন্য অনেক ভাল লেগেছে। তবে, এ মুভিতে আরো যে দুটি চরিত্রের কথা না বললেই নয়, তারা হল ‘মুহিব’ এর বড় বোন ও দুলাভাই চরিত্রে ‘তানিয়া আহমেদ’ ও ‘আজাদ আবুল কালাম’ ছিল এক কথায় অসাধারণ। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর উপন্যাসের চরিত্র ঠিক যেমন হয়া দরকার, তারা ছিল ঠিক তেমন। তাদের গল্প ও পারফরমেন্স মুভিটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
গোটা মুভিটিতে গান ছিল মাত্র তিনটি, ‘ঠিকানা’, ‘চল না বৃষ্টিতে ভিজি’ ও ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর মুভিতে বৃষ্টির গান থাকবে না তা কি কখনো হয় ? সব গুলো গানের কথাই ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর লিখে যাওয়া আর গান গুলোর সুর ও সঙ্গীত ‘এস আই টুটুল’ এর। তবে, গান তিনটি এতটাই মন কাড়া যে গানের দৈর্ঘ্য খুব ছোট হওয়াতে একদমই মন ভরেনি। আর গান গুলির চিত্রায়ন ও কোরিওগ্রাফী বিশেষ করে ‘চল না বৃষ্টিতে ভিজি’ গানটিতে ‘রিয়াজ’ ও ‘মাহি’র ক্যামিস্ট্রি ছিল তুলনার অতীত। ‘শাওন’ এ মুভি পরিচালনার পাশাপাশি ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো’ গানটি গেয়েছে ও ‘ঠিকানা’ গানটির কোরিওগ্রাফী করেছে। মুভিটিতে একটি বেশ জোরদার গাড়ী এক্সিডেন্টের দৃশ্য আছে যা অত্যন্ত নিখুঁত ও যত্ন সহকারে তৈরী করা হয়েছে যেন দেখতে সম্পুর্ণ বাস্তব সম্মত লাগে। যেখানে ঢালিউডের অন্যান্য বানিজ্যিক মুভিতে এসব এক্সিডেন্টের দৃশ্য গুলো বিদেশী মুভির সিন কেটে বসিয়ে দেয়া হয় বা উদ্ভট গ্রাফিক্সের দ্বারা কার্টুন বানানো হয় সেখানে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ এর মত একটি মুভিতে এমন একটি বাস্তব সম্মত দৃশ্য তৈরী করা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। মুভিটির প্রথম অর্ধেক ছিল বেশ দ্রুত গতির ও বেশ হিউমারে পরিপুর্ণ, হলের মানুষেরা অত্যন্ত এঞ্জয় করেছে মুভির প্রথম অর্ধেক তবে ইন্টারভেলের পর গল্প বেশ স্লো হয়ে যায় ও গল্পে ইমোশনের প্রভাবটা থাকে বেশী কিন্তু শেষ ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি যেভাবে শেষ হয়েছে এর পরে এই মুভি্র গল্প নিয়ে আর কোন কথা থাকে না। আমি আমার লাইফে অনেক মুভি দেখেছি, খুব কম মুভিই আছে যার এন্ডিং দেখে আমার চোখে পানি এসেছে বা কাঁদতে মন চেয়েছে। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ মুভির ক্লাইম্যাক্স এমনই এক এন্ডিং যা দেখে আমি চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই সময় ব্যাক গ্রাউন্ডে চলছিল ‘শাওন’ এর কন্ঠে ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়’ গানটি আর সেই সাথে আমার দুচোখ ছলছল করছিল, খুব মন চাচ্ছিলো কাঁদতে। শেষ দৃশ্যটির যেভাবে শর্ট নেয়া হয়েছে আমার দেখা বাংলা সিনেমার এ যাবৎকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ শর্ট ছিল সেটি। অতঃপর দর্শকদের এক ঘোরের মধ্যে রেখেই মুভি শেষ হয়ে গেল, আমার আর কাঁদা হল না কিন্তু হলের সকল দর্শকদের সাথে আমি নিজের অজান্তেই হাত তালি দিলাম ‘হুমায়ুন আহমেদ’ ও ‘শাওন’ এর প্রতি শ্রদ্ধায়। তখনো ব্যাকগ্রাউন্ডে গানটি চলছে এবং গানটি শুনতে শুনতে যখন হল ত্যাগ করলাম, হেঁটে হেঁটে বাসায় পৌছালাম, গোটা পথে এক অদ্ভুত বিষন্নতায় আমার মন ছেয়ে ছিল। এ ঠিক সেই বিষন্নতা যা ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবন মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘আমার আছে জল’ দেখে হয়েছিল। তখন বুঝলাম, ‘হুমায়ুন আহমেদ’ মারা যাননি, তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন কারণ তার শিল্প ও সৃষ্টির উত্তরাধিকার এখন তার যোগ্য স্ত্রী ‘শাওন’ এর হাতে আর ‘শাওন’ যত দিন বেঁচে থাকবে তার কর্মের দ্বারা এভাবেই ‘হুমায়ুন আহমেদ’ এর বার বার পুনরুত্থান ঘটবে। আর আমরাও বার বার ফিরে পাব আমাদের হারিয়ে যাওয়া গল্পের জাদুকরকে… !!!