মৃদুল মাহবুব প্রণীত ‘কাছিমের গ্রাম’ থেকে একগোছা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, | ২৩৮৯ বার পঠিত
মৃদুল মাহবুব প্রণীত ‘কাছিমের গ্রাম’ থেকে একগোছা
পাঠ করি ইম্যাজিনেশনের নামে দেবতারও-ঈর্ষা-জাগানো কবিতারাশি এইখানে এই বিপন্ন ভুবনকঙ্ক্রিটের চৌকো বাতায়নপাশে বসে। এখানে এখনও রয়েছে একটুকু ছোঁয়া লাগার মতো ভরসাবাতাস। অনেক হতাশ্বাসের ত্রসরেণু উড়ে গেলে পরে দেখা যাবে এখনও উঁকি দিচ্ছে যেটুকু পুনর্ভবাশ্বাস, বহু অনুপস্থিতির ফোকর ফুঁড়ে এখনও রয়েছে একটুখানি ফিনিক্সপাখসাট, সবটাই প্রায় বাংলা কবিতায়। আজ এই বিদূষক-বলয়িত দুনিয়ায়, এইখানে, এই মৃদুলদর্শিত কাছিমের গ্রামে, হে পাঠক, ক্যাম্প ফেলে একটু জিরোই, এই নিরঞ্জন নশ্বরতাচারণের দ্বীপে এবে হোক নক্টার্ন—।
লক্ষ করব যে এখন এই বাংলাদেশজ সাহিত্যে, বিশেষভাবেই কবিতায়, একের-পর-এক পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যাপৃত সম্ভাবনাময় প্রাণস্পন্দ। প্রথানত ‘কবিতার মতো কবিতা’ ফাঁদবার দিন ভাটি নিয়েছে, ক্যালকাটাকাব্যিকতা থেকে কবিরা পাশ ফিরিয়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিচ্ছেন দৃষ্টি, একহাজার-একটা আশাহীনতার ভিতরেও ঘটনাটা আদ্যোপান্ত হর্ষময় এবং সবিশেষ দ্রষ্টব্যও। বৈচিত্র্যে এবং বিভূতিতে, ডেকোরেশনে এবং ডিকশনে, এক্সপেরিমেন্টগুলো অতিকায় বিহঙ্গের ডানা ঝাপ্টাচ্ছে দিগদিগন্তরে। চেনাচর্চিত কনভেনশন্ থেকে বেরোবার রোখ বাংলাদেশের কবিতায় এই মুহূর্তে দূরবীন ছাড়াই দৃষ্ট। ফলে দেখা যাবে এমনকি রীতিমতো প্রবন্ধশৈলীও কবিতার ভিতরে এঁটে নেবার মতো গ্রহিষ্ণু হয়েছে এখানকার কবিতাজগৎ। অন্যান্য অভিনবতাগুলোও দুর্লক্ষ নয় নিশ্চয়। এরই ভিতর পোরা আছে এক অন্যতর সঙ্কেতমালার দিশা। আছে এক নতুনপন্থী সিগ্ন্যালিং সিস্টেম্।
পড়তে চলেছি এইখানে যে-কবিতাগোছা, ‘কাছিমের গ্রাম’ থেকে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতাধারার উজ্জ্বলতর কয়েকটি নিদর্শন অভিনিবিষ্ট কবিতাপাঠকের নজর এড়াবে না আশা করা যায়। এমনটা দাবি করা সংগত হবে না যে এই কয়েক কবিতাই প্রোক্ত কবিতাবইয়ের প্রতিনিধিস্থানীয়; বরঞ্চ দাবি এ-ই যে এরচেয়েও স্তব্ধ-করা ভাষাবাস্তবের দেখা পাঠক হিশেবে আপনি পেয়ে যাবেন বইটা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে। এখানে পত্রস্থ কবিতানিচয় ‘কাছিমের গ্রাম’ পাণ্ডুলিপি থেকে ঝটিতি বিবেচনায় গৃহীত, কবিতা আদৌ ভোটাভুটি নির্বাচনতরিকায় বাছাইয়ের ব্যাপার কখনোই নয়, বলা ভালো কবিতাগুলো দৈবচয়িত। গ্রন্থের ভিতরে যেয়ে পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন মণিমুক্তা আবিষ্কার করতে পারেন সন্দেহাতীতভাবে। এই সিলেকশন্ থেকে একটা আংশিক হলেও ধারণা পাবেন আপনি/আপনারা ‘কাছিমের গ্রাম’ সম্পর্কে। সেতু ধরে কেউ গ্রামের ভিতরভাগে যেতে উদ্যমী হবেন বলেই ‘রাশপ্রিন্ট’ প্রকাশ করছে এর গুটিকয় ঝিনুক।
বইটি ২০১৬ বইমেলায় প্রকাশ করেছে ‘চৈতন্য’। প্রচ্ছদ করেছেন রনি আহম্মেদ। ‘চৈতন্য’ প্রকাশনীর স্টলে যেয়ে এর দেখা পাবেন পাঠক। পড়ি তাহলে, ‘কাছিমের গ্রাম’ থেকে, একগোছা কবিতা? — কাছিমের গ্রামে যেয়ে দেখি অমরতা-নশ্বরতা দ্বান্দ্বিকতার দোলাচল ও দীর্ণপ্রায় পৃথিবীর সম্ভাব্য উপশম। — রাশপ্রিন্ট
ভাষা-বাস্তবতার বিশ্ব
কিছু আজ বলে যাও—আমি ফেলে যাচ্ছি সেইসব অনাবিষ্কৃত নির্জীব পথ, আমার ব্যর্থ ভাষা, যেখানে ছিলাম না কোনোদিন; তোমার জেদ, আশা, আকাঙ্ক্ষা আর হতাশা, জগৎ ব্যাখ্যার ইচ্ছা নিয়ে যেও ভাষা-কাছিমের দ্বীপে, যেখানে তোমার মুখে মুখ রাখবে শবভূক সঙের কুকুর; শীতল অস্থির আঁধারে ঢুকে যাবে শব্দ আর অক্ষর-ধূমকেতুর লালাভ লেজ আলোর চাকু হয়ে, ভাষা-বিশ্ব; ছায়াপথ জ্বলজ্বলে অজগরের মতো সেই বাস্তবতা গিলে শুয়ে আছে নিথর এই অন্ধকারে, সদা-প্রসারমাণ; আর আমাদের শুয়ে-কাটানো দিনের বাস্তবতায় ভেঙে-পড়ার আতঙ্কে শোকেসে দাঁড়িয়ে আছে কাচের ভেনাস, ভাষাহীন।
৩
ভাষা হলো ভঙ্গিমা। ভাষা হলো যোগাযোগ-মাধ্যমের সবচেয়ে নমনীয় ইলাস্টিক। ভাষা ছোট হয় বড় হয়, প্রয়োজন সে বোঝে, কোথায় কখন কেমন, কতটুকু নিজেকে তুলে ধরতে হয়। ভাষা দেহের বাইরে মনোদেহের একটা অদৃশ্য অঙ্গ, হাওয়ায় ভাসানো অদৃশ্য নিউরন, সংযোগজাল, নেটওয়ার্ক, সুপারন্যাচারাল স্প্রিট, রেইনবো।
তোমার ভাষার সুগন্ধ, স্মার্ট টেকনিক্যাল নিরলা ভেজা রস, গুপ্তময়তা, তোমার উৎক্ষেপণযন্ত্রের পিংক’স লিপ, দমের মেশিন, ভারতীয় তাজ, ঘাসে-ছাওয়া নিয়ন প্যান্টি, ফায়ার বিগ্রেডের লাল রক্তময়তা, সুরক্ষিত ফোমের গম্বুজে ললিপপ নিয়ে বসে-থাকা হ্যালো কিটি, নখে আঁকা লোহিত সাগর, ঘাড়ে ট্যাটুর আদিমতা, রেয়ন কোমল ত্বক, তোমার ভাষায় নামে নীরবতা, সন্ধ্যায় একা পাবার মজা, যেন সূর্যটাকে ডুবিয়ে দিয়ে এখানে নামালে সন্ধ্যা দুপুরের রোদে, আমার ভালো লাগে, তোমার ভাষার সুগন্ধ নেটওয়ার্কে জড়ায়া গিয়াছ আমার দুর্বল মফস্বলী সংকর পূর্ববঙ্গীয় ভাষা।
তোমার কী ভালো লাগে আর কী লাগে না, তোমার ইন্দ্রিয় সুখানুভূতি, বসার ভঙ্গিমা, ওপেন এন্ড, ক্লোজ এন্ড, ক্ষুধায় কত গ্রাম খাচ্ছ বা খাবে না, ওজন-সচেতনতা, কতটা লাভ করো, হেট করো বাবু জানুটাকে, মেক করো কতক্ষণ, কোন আলোর রেস্তোরাঁয় তোমার ভালো লাগে সন্ধ্যা, মধ্যরাতের ওয়ার্ম শাওয়ার, ওয়েট ক্যাট ফিলিং, স্বপ্নে তোমার আশাঘোড়ার কেশরে লেগেছে আগুন, মধ্যরাতের বৃষ্টিতে কোন গান তুমি শুনিয়েছিলে বিদেশি ভাষায়, আইস অন ফায়ার জানু, শীত শীত শহরে ব্ল্যাকআউট। তোমার ঐ দেহখানি তুলে ধরো ভাষার দেবালয়ে, মফস্বলী মুখের কাছে, অসমাপ্ত অঙ্গের পাশে, সুষমায়।
মানুষ পারে না ভাষা নিয়ন্ত্রণ করতে, সো দেহের বাইরে বেড়ে-ওঠা নিউরন, অদৃশ্য অঙ্গ বলে দিচ্ছে সব, কী হবে কোথায় কখন। তুমি ভাষার অধীন, ভাষাকারাগারে, ভাষায় গড়া ভুবনে বাইরের আলো চোখে পড়ে না।
৫
One morning, when Gregor Samsa woke from troubled dreams, he did not found himself transformed in his bed into a horrible vermin. We found a massive error in his highly coded communication program.
কোনো কোনো দিন বোঝো না নিজেই নিজের ভাষা। ভাষার ব্রেকডাউন, ব্ল্যাকআউট। কোনো কোনো দিন উচ্চারিত শব্দ থেকে অক্ষরগুলো ছিন্ন হয়ে হাওয়ায় ভাসে অক্ষর-বুদ্বুদ হয়ে। প্রতিটা বাস্তবতা থেকে উৎপন্ন শব্দ অক্ষরে অনূদিত হয়ে তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, ঠিক তখনই সূচিত হয় বাস্তবতার জারণ, ভাঙন, শুরু হয় অর্থহীনতা, রিয়ালিটি গড়ে ওঠে অসংখ্য বিমূর্তের খণ্ডাংশে, তখনই শুরু হয় অর্থহীনতা, না-বোঝা দৃশ্য। এখন বোঝা যায় ‘নীরবতা’র অনুবাদে বাতাসে উড়ছে রেডিয়ামে-তৈরি অক্ষর ন, ই, র, আ, ব, ন। কোনো কোনো দিন ভাষাকে আর বোঝা যায় না।
গ্রেগর সামসা এক মেশিন, সেলসম্যান, তার উন্নত নকশায় ভোরবেলা ঘুমঘোরে স্বপ্নের ভেতর ঝরে পড়ে তিনটা বিগলিত নীল কবুতর, ম্যালওয়ার, ভাইরাস, বিষণ্নতা, আত্মবিচ্ছেদ, অনস্তিত্বের কোড, যতই গভীরে যায় রাত আকাশ তত দীর্ঘ, গভীর হতে থাকে, ভাষা-বাক্যহীন গ্রেগর সামসা, তার মেশিনের কান পৃথিবীর তাবৎ অর্থময় ভাষাকে কাচের বাসনপত্র ভাঙনের আতঙ্ক হিসেবে অনুবাদ করছে এখন। তার ছিল কুমিরের চামড়ার মানিব্যাগ, গুইসাপের ছালের বেল্ট, সুইস রিস্টওয়াচ কাঁটাহীন, নির্ভুল সময়নির্দেশক, আফ্রিকান হরিণী নিজেই খুলে দিয়েছে চামড়ার পেলবতা তার জুতার আদলে, থাই বাঘের স্কিনের ডিভানে সে ঘুমিয়ে ছিল নির্ভার, হঠাৎই নামে স্বপ্ন, আকাশ যখন দীর্ঘ ও গভীর, ভাষাসিংহের কেশরে ফসফরাস ঢেলে আগুন দিচ্ছে জোনাকির অর্গানিক মশাল, ঘুমটাই পুড়তে থাকে সমস্ত রাত, স্ট্রেস বার্নআউট ভ্যাকেশনে নেমে আসে বিগলিত নীল কবুতর, আজ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ঘুমের ভেতর। গ্রেগর সামসা এক মেশিন, সেলসম্যান, সে হারিয়েছে কম্পাস, সেক্সট্যান্ট, টেলিস্কোপ, দৃষ্টি-যন্ত্র ভাষার সমুদ্রে, দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি, ওয়ার্ড ওয়ার্ড এভরি হোয়ার, নট আ সিঙ্গেল টু আন্ডারস্ট্যান্ড।
ভাষা বিকাশমান নিজস্ব ফর্মে, সর্বব্যাপী সে। বোঝা না-বোঝা বা দেখা না-দেখা ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। এই নিজস্বতায় মানুষগুলো একা দাঁড়িয়ে থাকে ভিড়ের ভেতর, আরও যেন হতেছে আলাদা।
৭
রিপাবলিক থেকে বিতাড়িত কবিরা আর ফিরতেই পারে নাই রাষ্ট্রে। তারা স্যাটির বেশে ঘুরছে, না-মানুষ না-ছাগল, ছাগতত্ত্বের পোশাকাবৃত মানুষ, মাথায় পরেছে আলোজ্বলা শিং, বিষণ্ন মনে বসে আছে করুণ ট্র্যাজেডি খুলে, গভীর জঙ্গলে ডায়োনাইসিসের গুহায় নাচ গান হয়, আলো-অন্ধকার নিয়ে বাতচিত হয়। মূলত জনপদের ভাষা গড়ে ওঠে কবিহীন, আমজনতাই ভাষা গড়ে তোলে। পৃথিবীর তাবৎ ব্যবহারিক ও প্রোগ্রামকোডের ভাষায় কবির অবদান স্বীকার্য পর্যায়েও পড়ে না। কবি আসলে জনপদের ভাষার মেরুদণ্ডহীন পরজীবী, আর কবিতা জনজীবনের সত্যস্বরূপা রেপ্লিকা, ফ্যাক্টহীন শব্দবন্ধন।
কবিতা রাজনীতিতে তুখোড়, তিনিই প্রজাতন্ত্রে থাকবেন। ভাষাবিকাশের ব্যাকরণ তিনিই লিখবেন। আর হাঁদারা সব বিষণ্ণ মনে বসে আছে করুণ ট্র্যাজেডি খুলে, মহাকাল তাদের দিকে ছুঁড়ে মারবে নক্ষত্রের স্বর্ণ-আভা।
কাছিমের গ্রাম
একে বলো দেহ, তা থেকে কাঠামো; হাতে ধরা আছে মেটাল রিস্টওয়াচ, দেহে ঝুলছে সময়ের ফল, দেহ যেন সময়বৃক্ষ, তার ভেতরে নরম আইসক্রিমের মতো অস্তিত্ব, গলে পড়ছে ধূসর অ্যালিয়েনেটেড সন্ধ্যা আজ, হাড়ের গ্রিলে ঝুলে আছে অপরাজিতাফোটা প্রিন্টেড-টি, মোজাহীন লোফারে দাঁড়িয়ে আছো স্পেস, জিন্সে ঢাকা। এর নাম মানবদেহ।
এই সত্য-জীবনকে মনে হয় মেটাফিজিক্সের খেরোখাতা।
১
আজ আমার আশার অশ্ব, কোথায় থামবে তুমি! এই মুহূর্তে যে পাথর ছোঁড়া হলো সুনীল জলের দিকে —তার সাথে ডুবে যাচ্ছে আঙুলের ছাপ, অপরাধচিহ্ন। চিহ্নহীন হাতে আরও একটা কথা-না-বলা পাথর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কালো যমুনার দিকে, আজ যদি বিস্মরণ ঘটে যায় ডুবতে ডুবতে, তবে মাথার ওপর শান্ত বিপুল আকাশ হাজারে-হাজার নীল পাখি হয়ে উড়ে যাবে কোন অন্ধকারে! শূন্যতার অধিক কোনো নির্জনতায় বসে তারা গেয়ে চলেছে তাদের অবশিষ্ট পরাজিত গান। যে-পথের রেখা পার হয়ে গেছে দিগন্তের সিংহদ্বার, সেই পথে এক দ্রুতগামী অশ্বের ছায়ার পা মাড়িয়ে গেল আমার সাজঘরের রং, সোনার মুখোশ।
১০
সবুজ আপেল, কেন আজ পড়ে আছো ভেজা মাটির ওপর; তোমাকে তো কাল দেখলাম এই ছিঁড়ে-পড়ার নির্লজ্জ ব্যথা থেকে উড়ে যেতে পাতার আড়ালে, তোমার বৃন্তঠিকানায় পুনরায়।
এমন মায়াবী কুহকের পর আর কি বলা যাবে এই হলাম আমি, সত্য-আমি, এই হলো আমার সত্য-বরফ, শুভ্র উজ্জ্বলতা, এ হলো শীতল জলের নিথর কম্পহীন মাথাকাটা ধড়। কিছুই হলো না আপেল, তোমার এই ভ্রান্ত পড়ে-থাকায় এভাবে।
যে-কোনো ঘরের দিকে চলে গেছে পোস্টম্যান আর তার ভাঙা সাইকেল, তার ধাতব শব্দের সুরহীন চলনে বিরক্ত হাওয়া একে একে খুলে দিচ্ছে সমস্ত ঘরের কারুকর্মময় অদৃশ্য দরজা। সেই দৃশ্যহীন খোলা ঘরে, প্রাণের ভেতর বয়ে এনেছে মদের লাল রং; পরিদের দেশ থেকে কেটে-আসা নীল ঘুড়ি, তাতে লেগে আছে মোলায়েম ডানার পশম, কামনার মতো গোলাপি, দীর্ঘশ্বাসময় —এই হলো তার সংকেত-চাতুর্যে ভরা চিঠি আমাদের লাল ঘরের অজানা ঠিকানায়। পোস্টম্যান, পোস্টম্যান; তার জাদুসাইকেলে চলে গেছি রক্ত, ঘাম আর ক্ষুধা চলার পথে, দেহের ভেতর অন্ধকারে, অর্ধপচা বাষ্প-ওঠা টগবগে কাঁচা মাংসে, হাড়ে, রগনালিকায়, এই ভাঙা সাইকেল বেশি দূর যাবে না আর তোমার ভেতর।
রোজ রোজ একই সাবান ঘষে ঘষে ক্লান্ত বাদামি ত্বকের ঘ্রাণ পাল্টে বাগানের পাশে ফুলকেও আমি বিভ্রান্ত করে দেবো আজ, জোছনার গাঢ় আলোর তরলে ডুবে-থাকা পৃথিবীর তলদেশ থেকে দমবন্ধ উঠে যাচ্ছি হাওয়ামণ্ডল ভেদ করে রূপারং আকাশেরও ওপাশে, শূন্যতায়।
২০
নিথর সমুদ্রদ্বীপে ভোর হয়; কেয়াবনের মাতাল, নেশাখোর সে-ও জেগেছে আশায় আজ, আর বহু দূরে তাদের নিপাট ঘুমের রোমে আলোর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রশীদের গান, আহ্ অমরত্ব, আহ্ আশা; রাত্রির দোয়াত হতে অন্ধকার রং চুষে নিচ্ছে হাওয়াকাগজ, এখানে এখন ভোর ভোর আলো। এমন উদ্বায়ী আঁধারে স্যান্ডস্কিনে ভেসে ওঠে মৃত সমুদ্রকাছিম, তার উল্টানো দেহ, খোলস, পরমায়ু; সহস্র বছর বয়সী কাছিম মরে গেলে জেগে ওঠে এই মেটাফর। লক্ষ মার্বেল আর তার পতনের ত্রিমাত্রা একসাথে ঝরে পড়ছে সরলরৈখিক আশার ওপর, এর নাম পরমায়ুদৃশ্য; পিকাসোর আঁকা আবছা কুকুর নেমে এসেছে এখানে, টেনে নিয়ে চলেছে মাংসল দেহ, পিঠের বর্ম কেয়ার ছায়ায়, কাছিমের গ্রামে। মাতাল সে-ও জেগেছে আজ আশায়, আর বহু দূরে বেজে চলে রশীদের গান, সমুদ্রদ্বীপে আবার ভোর হয় রাত্রির দোয়াত ভেঙে।
জীবন আবার জেগেছে আশায়।