পাখিওয়ালা ও অন্ধকারের গল্প । মেঘ অদিতি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৪১ অপরাহ্ণ, | ২২১৭ বার পঠিত
১৯৫৭
কাহার সাম্পান ভাসে—
কাহারা চিৎকার করে?
দৌড়ে যাই তোমাদের মাঝ দরিয়ায়। ঝিনুক আয়না হাসে। আর যত ফুলডুংরি পুষ্পস্মৃতি দূরে ফেলে গাণিতিক জোন ধরে, বার বাই পাঁচের ভূমিহীন ফিরে আসি অসহ সঙ্গমের কাছে।
হাস্নুহেনার মত ছিমছাম, ১৯৫৭। সীমানা ভাঙে, ভাঙে হারমোনিকার সুর.. অনন্ত দহনে সরে ম্যাপেলের পাতা। অন্তর্বর্তী স্মৃতি থেকে ট্রেকিং পরবর্তী ডায়েরির পাতায় বাবার রেখে যাওয়া সেইসব শব্দরহস্য ঘেঁটে তুলে আনি তোমার স্মিতহাসি মুখ।
কাহার সাম্পান তবে ভাসে?
সমুদ্র জানতো, পেবল কুড়িয়ে আনা পুরুষের কাজ। ঝড় এলে আমি জানতাম তুমি আসবে। ৬৮ কিলোমিটারের একটানা বাতাসের বেগে ভেসে বেড়াত তোমার চাপা শ্বাস..
মোহহীন তুমি। আর আমার ছায়া পুড়ে যেত ছাতিমের বনে। উত্থান-পতনে গর্জে ওঠা সেই ঢেউদের দিনে বাতাস ভরে উঠত অগ্নিচূর্ণে।
কাহারা চিৎকার তবে করে?
……………………….
সমস্ত পণ্ডশ্রম। অনন্ত আঁধার।
সকল ফুরায় তবু
অপেক্ষার অজস্র পাতাগুলো ঝরে…
বুদ্বুদ
পালটে ফেলেছি নাম
নদীর ওপারে তীব্র দুপুর নামছে
ভাঙা ব্রীজ খুলে উড়ে আসছে চিঠি
নিজেকে চিনতে চিনতে
ছুটিগুলো গান হচ্ছে সন্ধ্যার হাওয়ায়
পরের সূর্যাস্ত থেকে
সন্ধ্যার বৃক্ষরোপণে
পূর্ণ হোক তোমার আকাঙ্খা
জড়িয়েছ ওই হাত এমন পরিহাসে
মৃত্যু ও বিভঙ্গের রাতে
লুপ্ত বাসনা থেকে ঘন হচ্ছে রঙবুদ্বুদ
অন্ধকার
বরং দিন থেকে রাত— একা হও আরো
বুঝে নাও সীমান্ত রক্ষীর চোখ
বুঝে নাও জমিনের হলুদ ছোপ
আর মৃত্তিকার ফুল থেকে ঝাঁকে ঝাঁক
উড়ুক মৃত্যুপাখি
লিখে রেখে অমলিন হাহাকার—
ভুল চাঁদে দৃষ্টি ফেরাও যদি
তুমি-আমি
আধভাঙা তেমনই অন্ধকার
গল্প
এস্রাজে ভরেছি যত সুর
তারও বেশি
সুতীব্র চুমু তোমার ছেয়েছে অরণ্য
এই শীতচন্দনচর্চিত বেলা
এগিয়ে আসছে শুধু আমারই দিকে
এবার অন্ধ হবে আলো
বাজবে পুরোনো ট্রানজিস্টর
বালিয়াড়ি ঝমঝম নদীর শরীর থেকে
অস্তগামী সব ডুবে যাবে আবাহনে
পারো যদি আজ গল্পের ভেতর এসো
এসো শুক টেনে দিই সারী-র মোহটানে
অনেকদিন, এদিকে গানওয়ালা আর আসে না..
পাখিওয়ালা
কার হাতে বাঁশি! প্রাণে লেগে যত সুর বাজে, পাথর রাতের কাছে বৃত্ত ভেঙে হাহাকার হয়! ও শীতকাল, কুয়াশাআকাশ— দূরে রেললাইনে হেঁটে যায় যে ছায়া সে কি তোমারই দীর্ঘশ্বাস, প্রভু?
কারা তবে তোমাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে?
একগোছা ফুল হাতে উড়ে যেতে যেতে অপেক্ষার আদলে এল শীতঘুম, এসব ছাড়িয়ে যে জীবন তাকে তুমি দেখেছিলে প্রিয়! শীর্ণ ওই নদীর নাম কী এ প্রশ্নে তুমি ডেকে নাও আমায়; আমি দেখি তোমার রহস্যপ্রবণতা!
স্থির হও আরও। শীত বাড়ুক।
বুদ্ধ না আগুন,..এ প্রশ্নে চঞ্চল হয়ো না আর
পাখিওয়ালা—
এ জনপদে আমিই আলো তোমার, আমিই অন্ধকার
গদ্য কবিতা
‘এসো শান্তি এসো শৃঙ্খলা
কাঠ-খোদাইয়ের আগে
. স্মরণ করি সকালবেলা’
নাম তার- কবিতা।
স্মৃতি বলে প্রাক কৈশোরেই হাতে হাত, যাকে আমি বন্ধু বলে চিনেছিলাম। বিস্মৃতি বলে, কত কী যে গেছ ভুলে। তোমাকে ঘুম পাড়াতে কোলে তুলে ঘুরে ঘুরে মা তোমায় কী শোনাত? ছড়া? মনে কর, বীরপুরুষ বা লিচুচোর আবৃত্তি করতে পাঁচের তুমি তোমার মেজদিকে দেখেছিলে মঞ্চে উঠে দাপিয়ে বেড়াতে। কবিতা তোমার আজন্ম সাথী। বোধের ভেতর তাকে চেনার প্রথম ধাপে তখনও হয়ত পাঠ। কিন্তু যখন আবৃত্তির নেশা ধরাল মন। ধীরে ধীরে সে অমৃতের ছোঁয়ায় তুমি হাঁটতে শুরে করেছ তার হাতে হাত রেখে। কত পথ ঘুরে তার সৌন্দর্যের কাছেই জানু পেতে বসেছ ফের, বারবার। মনে পড়ে মন? পড়ে মনে?
হ্যাঁ.. আমার কেবল মনে হয়েছে যা কিছু শিল্প তার কাছে মাথা নীচু করাই তো দস্তুর। কিন্তু আমি তো কখনও ভাবিনি কবিতাই লিখব আমি। তাহলে?
‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে…’ কবে? কখনও মনে হয় জন্ম থেকেই আমি লিখছি কখনও মনে হয় লেখার প্রচ্ছন্ন শক্তি নিয়ে দিনের পর দিন আমি ঘুরে বেরালেও কলম তুলেছি আর ক’দিন… দিন ক্ষণের হিসেবে সে হয়ত অনেকদিন হয়ত নয় কিন্তু যাপন তো শিল্পের সাথেই। সে কবিতা, ছবি, সঙ্গীত বা গদ্য জীবন। আমার লেখা যা কবিতা হয়ে ওঠে কি না কি না তা নিয়েও খুব ভাবি না কখনও। শব্দের বন্ধন জুড়ে বরং আমি ছবিই আঁকতে চেয়েছি বারবার। ভেবেছি কবিতা ধরা দেয় যার হাতে তাকে বলে কবি। নিজেকে তো ততটা কবি আমি ভেবে উঠতে পারি না কখনও। কবির বাস যে নির্জনতায় সেখান থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে গোলের মাঝে, শোর তুলে যে নৌকোটা দুলে দুলে উঠছে, সেথায় বাস আমার। সে নৌকো হয়ত সাম্পান। হতে পারে সমুদ্রঢেউও প্রবল। আর ঢেউয়ের গর্জন সেও কি কম! আছে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়া। ভয়ে করে খুব। মনে হয় অস্তগামী সূর্যের লালটুকু মেখে শাব্দিক ভ্রমণের দিন থেকে এই সরে যাচ্ছি বুঝি। কিন্তু সাথে সাথেই এও মনে পড়ে বাইরের কোনো আঘাতই একজন যোদ্ধাকে দমিয়ে দিতে পারে না। আর কবি তো যোদ্ধাই। লোকসমাজে থেকেই তাই তার লড়াই। ফলে যে হাতে হাল ধরা সে হাতে তুলি ফের শব্দ আঁকার তুলি। আবার আমি লিখি অথবা আঁকি। চারপাশে নিরন্তর ঘটে নানা ঘটনা, তা থেকে যে মনে যতটুকু উপলব্ধি এনে দেয় তার অনুবাদ করাটাই আমার কাজ। আর তা অনুবাদ করতে গিয়ে অনুভূতি থেকে যে নির্মাণ তা আমার শব্দে আঁকা ছবি।
‘ছয় লাইনের কবিতায় যুবক নেই…যুবতী নেই’
ল্যাভেন্ডার কি হানিডিউ, স্লেট ব্লু কি ফ্লোরাল হোয়াইট শিল্পের ভুবন জুড়েই নানা রঙের খেলা। কবিতা, কথা সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, ছবির এই ভুবনে বোধহয় অন্য শাখাগুলোতে রঙ চাপানো সুযোগ যেখানে শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত সেখানে কবিতার স্বল্প পরিসরে, আঁটোসাটো শরীরে তিন কি চার পঙক্তিতে রঙের ব্যবহার খুব সিলেকটিভ ফলে তার বলে যাওয়া কথা থেকে যে ভাব তা আস্বাদনের পাঠক হাতে গণা অল্প কিছু মানুষ। কথা সাহিত্যে যেখানে হেঁটে চলবার জায়গাটি সুবিস্তৃত ফলে শ্বাস নেবার ও ফেলার খোলা আকাশ আর সবুজ মাঠের দেখা মেলে সেখানে নানা চরিত্র হেসে খেলে ঘুরে ফিরে যায়। কিন্তু কবিতায় সে সুযোগ নেই, কবিতার ভাবে আবার ’আমি’ শব্দেরও বিস্তৃতি বড় বেশি ফলে কবিতায় কখনও পাঠকের কৌতুহল ঘিরে কবির জীবনের প্রতি।
এবার একটা কবিতা পড়া যাক।
গান বাজছে
গান মুছে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম
উঠে আসছে শহর
শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তাস
মেঘ-ভিখারি আমি
. শুধু পুড়ছি রোদে
(মেঘ-ভিখারি)
প্রথম স্তবকের গান বেজে ওঠার ভেতর দিয়ে গ্রাম মুছে গিয়ে নাগরিক হয়ে ওঠার মধ্যে খুব কনফ্লিক্ট পাঠকের থাকে না। কিন্তু শেষে, মেঘ-ভিখারি আমি, এই আমিতেই পাঠকের ভেবে নেওয়া কবিরস বিষাদযাপন। কিন্তু এই আমি কি ব্যক্তিক কবি? পাঠক আমি নই?
‘কানে কানে ফিসফিস করে পাতা
‘আমি ভালো আছি, তুমি?”
উপমা, রূপক, অনুপ্রাস, যমক, সর্বপোরি ছন্দ, প্রায়ই তর্কের ঝড় ওঠে যখন আমি এক কোণে সরে ভাবি, জানাটা নিশ্চিত জরুরী। না জেনে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তাকে কবিতা আখ্যা দিতে পারি না আমি। কিন্তু জেনেবুঝে এ সমস্তের আলঙ্কারিক ব্যবহারে কবিতাকে শুধু সাজিয়ে তুললেই সে সুন্দরী কবিতা হবে..মনে হয়, এতসব মেনেই বা আমি চলেছি কবে! কাব্যগল্পে তো আমি গদ্য পদ্যের সীমানাই ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলাম। আবার ছন্দের ভ্রকুটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলাম এসো তোমার হাত ধরে হাঁটি কিছু সময়। সেটাও খারাপ লাগেনি কিন্তু অনুভূতির রঙগুলো সবসময় নিয়মের শাসন মানতে চায় না। মনের ভেতর ডুব দিলে যে মনের দেখা মেলে সে মস্তিষ্কের নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে চায় না সব সময়। কাজেই আমার জানলা খোলাই থাক। হাওয়া বইতে থাকুক মৃদুমন্দ। ক্রিমসন বা কপার কোরালে বোধ আর অনুভূতির রঙগুলো খেলা করুক শব্দে।
মন, যদি ইচ্ছে করে তাকে তুমি সাজিও তখন উপমা বা অনুপ্রাসে। ছন্দে বা অন্ত্যমিলে। পরিও অলঙ্কার।
না চাইলে মন, তাকে উড়তে দাও উড়াল ডানায় তোমার আকাশ জুড়ে।
যেভাবে তাকে দেখতে চাও, সেভাবেই দেখ। নবান্নের দিনে, বৃষ্টির দুপুরে, যুদ্ধ বা প্রেমে, সবুজ ভোরের আলো মেখে সে তো তোমার, একান্তই তোমার।
ভালবেসে ডাকো যাকে ‘কবিতা’