এক রাশ হতাশা এবং ভিলেন সমূহের দৃষ্টি । মো. অনিকউজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৪ অপরাহ্ণ, | ১৮২৪ বার পঠিত
কিছু কিছু মুভি আছে যেখানে নায়কের থেকে ভিলেন চরিত্রগুলো দর্শককে বেশী করে টানে। দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বসে থাকে সেই মুভির পরবর্তী পর্বের ভিলেন চরিত্রের জন্য। যেমন বলিউডের ‘ধুম’ সিরিজের ‘জন আব্রাহাম’, ‘হৃতিক রোশন’ ও ‘আমির খান’ অভিনীত ভিলেন চরিত্র গুলো আমাদেরকে মন কেড়েছে সব থেকে বেশী এবং আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি ‘ধুম’ এর পরবর্তী পর্বে ভিলেন কে হবে তা দেখার জন্য। এখন আমরা যদি হলিউডে চোখ রাখি তবে এমন মন কাড়া ভিলেনের অভাব হবে না। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ মুভির ‘জোকার’, ‘থর’ মুভির ‘লোকি’, ‘ফিউরিয়াস সেভেন’ মুভির ‘ডেকার্ড শ’, ‘শার্লক’ টিভি সিরিজের ‘জিম মরিয়ার্টি’, ‘হ্যানিবল লেক্টার’, ‘ডেক্সটার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা সবাই ‘স্টার ট্রেক’ সিরিজের সাথে কম বেশী পরিচিত। মহাশূণ্যে দুর্দান্ত সব অভিযান ও ভয়ংকর ভিলেনের সাথে টক্কর সব মিলিয়ে ‘স্টার ট্রেক’ সিরিজ মানেই হচ্ছে এক অন্য মাত্রার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই সিরিজ সেই ১৯৭৯ সাল থেকে চলে আসছে এবং ২০০৯ সালে এসে এই সিরিজ রিবুট হয়ে নতুন করে নতুন আঙ্গিকে আবার রূপালী পর্দায় এসে হাজির হয়েছে। বিখ্যাত পরিচালক ‘জে জে আব্রামস’ এর পরিচালনায় ২০০৯ সালে নতুন রিবুট ‘স্টার ট্রেক’ মুভিটি আবার এই সিরিজটিকে জীবিত করে তোলে এবং গোটা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় হয়। অতঃপর ২০১৩ সালে ‘জে জে আব্রামস’ এর হাত ধরে আবার মহাশূণ্য কাঁপাতে হাজির হয় ‘স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস’ যা পুর্ববর্তী মুভির থেকেও বেশী আয় করে বিশাল মাপের হিট হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এই বছর আসছে রিবুট সিরিজের ৩য় পর্ব ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ তবে পরিচালকের আসনে নেই ‘স্টার ট্রেক’ কে পুনরায় জন্মদানকারী ‘জে জে আব্রামস’, তিনি চলে গেছেন বরং ‘স্টার ওয়ার্স’ কে পুনরায় জন্ম দিতে। যার হাত ধরে ‘স্টার ট্রেক’ আবার নতুন করে বিশ্ব মাতিয়েছে এখন সেই ব্যক্তির হাতেই তৈরী ‘স্টার ওয়ার্স-ফোর্স অ্যাওয়াকেন্স’ এখন ছুটে চলেছে ‘অ্যাভাটার’ এর রেকর্ড ভাঙ্গতে। তাহলে ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ পরিচালনা করছে কে ? এবার পরিচালনার আসনে আছেন ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজকে পুনরায় জন্মদানকারী ভাংচুর স্পেশ্যালিস্ট ‘জাস্টিন লিন’।
এবার ফিরে যাই মূল কথায়। লেখার শুরুতেই আলোচনা করেছিলাম ভিলেন প্রসঙ্গ নিয়ে। ২০০৯ সালের রিবুট ‘স্টার ট্রেক’ মুভির ভিলেন ‘ক্যাপ্টেন নিরো’ চরিত্রে অভিনয় করেন ‘হাল্ক’ খ্যাত বিখ্যাত অভিনেতা ‘এরিক বানা’। টাক মাথার ট্যাটু আঁকানো ভয়ঙ্কর চেহারার ‘এরিক বানা’ গোটা মুভিতে ধবংসলীলা কম করেনি। মুভির শেষে তাকে মারতে গোটা এন্টারপ্রাইজ টিমকে পুরাই নাকানি চুবানি খেতে হয়। সব মিলিয়ে ‘এরিক বানা’ অভিনীত ‘ক্যাপ্টেন নিরো’ চরিত্রটি ‘স্টার ট্রেক’ ভক্তদের আজীবন মনে থাকবে তার হিংস্রতার কারণে। এর পর ২০১৩ সালে ‘স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস’ মুভিতে হাজির হয় এ সিরিজের সব থেকে দুধর্ষ ও ভয়ঙ্কর ভিলেন ‘খান নুনিয়ান শিং’, এবং এই চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্ব বিখ্যাত ‘শার্লক’ খ্যাত সুপার ট্যালেন্টেড অভিনেতা ‘বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ’। ‘স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস’ মুভিতে এই অভিনেতাটি তার মুখের এক্সপ্রেশন, শব্দের উচ্চারণ ও গলার ভয়েজ সব মিলিয়ে তার প্রতিটি মুভমেন্ট দিয়ে এমন এক ভিলেনের প্রতিকৃতি তৈরী করেন যা জয় করে নেয় কোটি কোটি ভক্তদের হৃদয়। ‘ক্যাপ্টেন নিরো’ সাজতে ‘এরিক বানা’কে টাক হতে হয়েছিল, মুখে ও মাথায় ট্যাটু একে ও নকল কান লাগিয়ে নিজের চেহারাকে ভয়ঙ্কর ও হিংস্র করে তুলতে হয়েছিল, কিন্তু ‘খান নুনিয়ান শিং’ হিসেবে ‘বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ’ কে কোন এক্সট্রা মেক আপ নিয়ে পর্দায় আসতে হয়নি। সে তার স্বাভাবিক চেহারা, ছোট চুল, ও স্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই পর্দায় যে পরিমাণ হিংস্রতা, ষড়যন্ত্র ও ধবংলীলা দেখিয়েছে তা ‘এরিক বানা’র ‘ক্যাপ্টেন নিরো’কেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে আমার মতে এই মুভিতে পরিচালক ‘বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ’কে ঠিক মত ব্যবহার করতে পারেন নাই এবং তার ‘খান’ চরিত্রটিকে খুব বেশী সুযোগ দেয়া হয়নি নিজেকে মেলে ধরতে যতটা দেয়া হয়েছিল ‘এরিক বানা’র ‘ক্যাপ্টেন নিরো’ চরিত্রটিকে।
একটি দীর্ঘ বিরতীর পর যখন রিবুট সিরিজের ৩য় মুভির নাম, পরিচালক ও রিলিজ ডেট ঘোষনা হল তখন থেকেই ভক্তদের মনে জল্পনা কল্পনা বাসা বাধা শুরু করলো যে এবারের পর্বের ভিলেন চরিত্রে কে থাকবে তা নিয়ে। যখন মুভির কাস্টিং প্রকাশ করা হল তখন পুর্বের পর্বের আর সকল চেনা মুখের সাথে যোগ হল একটি নতুন নাম ‘এদ্রিস এলবা’। অবশেষে, জানা গেল এবারের পর্বের ভিলেন হিসেবে পর্দায় আবির্ভাব ঘটবে ‘লুথার’ খ্যাত এই শক্তিমান অভিনেতার। তারপর থেকেই অপেক্ষা এই মুভির ট্রেলারের জন্য। ‘এদ্রিস এলবা’র ভিলেন লুকের এক ঝলক দেখা পাবার জন্য। অবশেষে, যখন ট্রেলার প্রকাশ হল কি দেখতে পেলাম আমরা ট্রেলারে ? এবারের পর্বে দেখা যাবে মহাশূণ্যে এক অজানা এলিয়েন বাহিনীর আক্রমনে ধবংস হয়ে যায় এন্টারপ্রাইজ শিপ। ‘ক্যাপ্টেন কার্ক’ তার বাহিনী নিয়ে ল্যান্ড করে একটি নতুন অপরিচিত গ্রহে। অতঃপর সেই গ্রহের অধিবাসীদের সাথে মিলে তারা মুখোমুখি হয় আরেক বর্বর ভিলেনের এবং প্ল্যান করতে থাকে সেই গ্রহ থেকে বের হবার। এ কাজে তাদের সাহায্য করে সেখানকার এক যোদ্ধা অধিবাসী মেয়ে ‘জায়লাহ’ এবং এই ভূমিকায় অভিনয় করেছে ‘স্ট্রিট ড্যান্স টু’ এবং ‘কিংসম্যান’ খ্যাত ‘সোফিয়া বউতেল্লা’। আর খুব সম্ভবত সেই গ্রহের বর্বর ভিলেন ‘ক্রাল’ চরিত্রে আছে আমাদের ‘এদ্রিস এলবা’। আগেই বলেছি, এবারের পর্বের পরিচালনার দ্বায়িত্বে আছেন ‘জাস্টিন লিন’। ‘জাস্টিন লিন’ এর মূলত কর্ম ক্ষেত্র হচ্ছে রাস্তা-ঘাট, কারণ তার কাজই হচ্ছে ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজে রাস্তা-ঘাটে অগণিত গাড়ি ভাংচুর করা, তাই ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ এর ট্রেলার দেখে যা বোঝা গেল তিনি এবার স্বয়ং ‘স্টার ট্রেক’ বাহিনীকেই মহাশূণ্য থেকে ভূমীতে নামিয়ে এনেছেন যেন তিনি তার মনের সুখে গাড়ি, মোটর সাইকেল (ট্রেলারে একটি দৃশ্যে ‘ক্যাপ্টেন কার্ক’ মোটর সাইকেল চালিয়ে জাম্প করে) এবং এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে ভাংচুর করতে পারেন। গোটা মুভিতে দেখা যাবে ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ স্টাইলের রক মিউজিক যা আগের দুটি পর্বের থেকে আলাদা। এমনকি ট্রেলারে দেখানো একটি দৃশ্যে দেখা যায় যে ‘ক্যাপ্টেন কার্ক’ ও ‘জায়লাহ’ শূণ্য থেকে লাফ দিয়ে পরস্বপর পরস্বপরের হাত ধরে টেলিপোর্ট করে যা কিনা ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস সিক্স’ মুভির রাস্তায় ট্যাঙ্ক এর অ্যাকশনের সময় ট্যাঙ্ক উলটে ‘লেটি’ যখন ছিটকে পড়ে তখন ‘ডম’ শূণ্যে ডাইভ দিয়ে যেভাবে ‘লেটি’কে লুফে নেয় সেই দৃশ্যটির হুবহু কার্বন কপি। সব মিলিয়ে আমার মতে ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ মুভিটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘স্টার ট্রেক-ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’।
তবে, এগুলো নিয়ে কোন অভিযোগ নেই আমার। আমার অভিযোগ শুধু একটি জায়গায় আর তা হল ‘এদ্রিস এলবা’র মেক আপ। গোটা ট্রেলার আমি বার বার দেখেছি কিন্তু কোথাও আমার প্রিয় এই অভিনেতাকে খুঁজে পাইনি। পরে নেটে খবর পড়ে জানলাম যে এই মুভিতে ‘এদ্রিস এলবা’কে দেয়া হয়েছে এক ভিনগ্রহী এলিয়েনের মেক আপ যার ফলে ঢাকা পড়ে গেছে তার আসল চেহারা। পরে যখন ট্রেলারটি আবার অন করলাম অবশেষে আমি ‘এদ্রিস এলবা’কে খুঁজে পেলাম এবং তার চেহারা দেখে আমার তখন রাগে দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। মনে মনে ভাবলাম মুভিতে যদি মেক আপের ঠ্যালায় অভিনেতার চেহারাই চিনতে না পারি, তবে কি দরকার এত টাকা খরচ করে এত দামী অভিনেতাকে ভাড়া করার ? মেক আপ দিয়ে যখন চেহারাই ঢেকে দিব তখন কোন এক অগা মগা বগা কে ধরে মেক আপ করিয়ে দিলেই তো হত। এভাবে আমাদের মত দর্শকদের সাথে প্রতারণা করার কি দরকার ? কেন, ‘এরিক বানা’ও তো মেক আপ নিয়েছিল কিন্তু তাতে তার চেহারা তো ঢাকা পড়ে নাই। আর ‘বেনেডিক্ট’ তো বিনা মেক আপেই মুভি কাপিয়েছে তাহলে কেন এই কাহিনীটা করতে গেল পরিচালক ? ‘এদিস এলবা’র চেহারাতো ‘এরিক বানা’ ও ‘বেনেডিক্ট’ এর থেকেও দুধর্ষ ও অনেক ভাব গম্ভীর। তাকে দেখলেই মনে হয় এই অভিনেতার জন্ম হয়েছে ভিলেন চরিত্র করার জন্য। অথচ ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ মুভিতে তার চেহারা এমন বানিয়েছে যে তাকে দেখতে মনে হচ্ছিল ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ মুভির কোন সি গ্রেড এলিয়েন। গোটা মুভিতে ‘এদ্রিস এলবা’র ভয়েজ ছাড়া তাকে খুঁজে পাবার কোন সম্ভাবনাই নেই। এদিকে ‘সোফিয়া বউতেল্লা’ যে চরিত্রটি করেছে সেটাও কড়া মেক আপে ভরা কিন্তু তবুও এক নজর দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এটাই ‘সোফিয়া’ অথচ ‘এদ্রিস এলবা’র সাথেই কেন এমনটা করতে গেল ? যখনই ‘এদ্রিস এলবা’র ঐ বিদঘুটে এলিয়েন চেহারাটা দেখি ইচ্ছা করে ‘জাস্টিন লিন’ কে গরম পেট্রোলে চুবাই। বন্যেরা বনে সুন্দর, ‘জাস্টিন লিন’ রাস্তা-ঘাটে। এই ব্যাটা ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ এই ভাল ছিল, ‘স্টার ট্রেক’ এ এসে এ সিরিজের একদম ইজ্জত মেরে দিল।
ব শেষে, কে কি বলবেন জানি না। তবে, আমার ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ নিয়ে যত আশা প্রত্যাশা ছিল সব ধুলায় মিশে গেছে এ মুভির ট্রেলার দেখার পর। এ মুভি যত টাকাই আয় করুক না কেন, আমার কাছে সব সময় সিরিজের সর্ব শ্রেষ্ঠ পর্ব ‘স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস’ এবং সিরিজের সর্ব শ্রেষ্ট অভিনেতা ও ভিলেন ‘বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ’। এই পর্বটি এবং এই অভিনেতাটির কাছে ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ এবং গিরিগিটির মেক আপে ‘এদ্রিস এলবা’ আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই না।