যদি সে লখিন্দর, আমি তবে বেহুলা সাপ । শামশাম তাজিল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৩:৩০ পূর্বাহ্ণ, | ১৮২৬ বার পঠিত
পাথরের জিকির
ডিমের ভেতর আদম ফোটে হাওয়ার বুকের তাপে
স্বর্গচ্যুতির কারণে নয়, কেঁদেছে সন্তাপে
আলোর নদী পাড়ি দিয়ে অন্ধ হলো দিন
বন্যতাকে তাড়িয়ে বেড়ায় উঁচিয়ে সঙ্গীন
তিনশো বছর কেঁদে আবার হাওয়ায় ওতপ্রোত
পাঁজর ছেঁড়া আদিম নারী বেদনাসম্ভূত
স্নানযাত্রার পর্ব শেষে এসেছে সন্তান
খুনের ভেতর খুন জেগেছে — রাখে নি সন্ধান
ভ্রাতার হাতে নিহত ভাই, চিত্তে অবসাদ
দ্বন্দ্বমুখর জীবন প্রদীপ, — রক্তে ভেজা হাত
হস্তরেখায় ভুল ছিলো না, আত্মপহারক
ভয়ের দিশায় ফেরার জীবন রেখেছে বন্ধক
পিতার তবু কাঁদে হৃদয় কাঁদে প্রাণের বায়ু
আদিম মাতার বক্ষে পাষাণ রুদ্ধ পরমায়ু
পাষাণ ভাঙে পাষাণ পোড়ে বক্ষে পাষাণভার
চিত্তদাহে পাপের হরণ, জেগেছে এত্বার
রৌদ্রে জ্বলে লক্ষ বছর সাংখ্য-জাগতিক
কোরান মানে মুসলমানে হিন্দু পূজে ঋক
পিঠের উপর বইছে বোঝা ধনুকভাঙা শর
পাথর থেকে জীবন খোঁজে, মৃত্যু অতঃপর।
হিটলার
যুদ্ধ ফেরত সৈনিকের হাতে আজীবন বারুদের গন্ধ লেগে থাকে।
হিটলার, তুমিও ছিলে নিঃসঙ্গ সৈনিক। তোমার হাতে তবু পাই রঙের ঘ্রাণ।
কার মুখ আঁকতে চেয়েছিলে তুমি? তোমার চিত্রের জন্য কি খুব রক্তের ছিলো
প্রয়োজন? তোমার ক্যানভাসে রক্তাক্ত ভুবন। তোমাকে বুঝলো না কেউ!
— এই অভিমানে ডেমোস্থিনিসের প্রতিভা তুমি হারালে বেকার।
পদ্মপুরাণ ভুল
ঢেউ দিও না বৃষ্টি নামে বুকে
তুমি আমার স্বপ্নে দেখা নারী
হৃদয় জোড়ে শীতের নিরবতা
আকাশ থেকে ঝরে তারার ফুল
শীর্ণ নদী শুকিয়ে হলো খাক
তোমার সঙ্গে মাছের অতল ভাব
বক্ষে আমার বইছে প্রবল স্রোত
ভাসিয়ে দিলাম পদ্মপুরাণ ভুল
চরের পিঠে বাঁধা আদিম নাও
সেই নায়েতে যাত্রী ছিলো হাওয়া
গহীন বুকে উপচে উঠে ঢেউ
কামের চেয়ে প্রবল ভালোবাসা
ঘুমিয়ে থাকো বইয়ের পাতা খোলে
তোমার ঘরে সূর্য উঠে রোজ?
নায়ের থেকে উড়ে অবাক পাখি
রতিগন্ধ ছড়িয়ে ভালোবাসার
নারী ও নদীর হারিয়ে গেলে জল
পথের বাঁকে জীর্ণ জড়োসড়ো
রইবে পড়ে কুয়াশামাতাল মদ
সর্বনাশা ঘণ্টা বাজে কাসার
এক মগ জলের প্রস্তাব
চেয়েছিলাম নোনা নরোম জল।
মেলে দিলে ওমের ঊরুর মতো বঙ্কিম হাসি — শূন্য করতল।
দেখেছি হাঁটুভাঙা পথে পায়ের মাপে দিগন্তের সীমা
দশটি আঙুলে ডুবে থাকা শূন্যতার মহিমা
স্পর্শ করিনি, এমন কি তাকাই নি খুব করে
অন্ধকালো প্রজাপতির ডানায় লেগেছে জলের আগুন
প্রজাপতি সাঁতার জানে না। জলের আদরে
পরাশরের মতো কুয়াশার ভিড়ে হয়ে গেছি খুন।
চিরুনির বেখেয়ালে চড়াইয়ের ঠোঁটে যে-রকম চুল
নরোম নীড়ের দরদ আঁকে
আমি — যদিও মিছে — কিছু ভুল
কুড়িয়ে বেড়াই পায়ের ফাঁকে ফাঁকে।
জল চাইনি, চেয়েছিলাম স্রোত — জলের নির্জনতা
শব্দ ছিলো না ঠোঁটে, মনে মনে বলেছি অনেক কথা।
জিহবার সৌকর্যে সে কথা শুনেছে সুতোনলি সাপ
ঘুমের ভেতর আমিও মেপেছি নারীর ওম
ঘুমিয়েছি মৃতার সঙ্গে মৃত্যুর মতো ঘুম
পাপ ছিলো না; কেবল ঝরেছে জীবন্ত মনস্তাপ।
অবসর পেলে এক আঁজলা জল দিয়ে যেও
জলের বদলে পাবে না কিছু। মন নিয়ে যেও।
যদি অনিচ্ছেয়ও হয় ছুঁড়ে দিও জলে,
অন্যদিন ঠিক পাবে শাড়ির আঁচলে।
দেহের অক্ষর
চোখে তার উজ্জ্বল কামনার নদী
ত্রস্ত হাতে ধরা গোপন ঔষধি
ঘুম ঘুম ঠোঁটে হোম, পান্থবিলাস
কথার আড়াল খোঁজে দূর কৈলাশ
চঞ্চল পয়স্বিনী পতনোন্মুখ
উত্তাল ঢেউ ভাঙে বৈরাগী বুক
বৈরাগী বুকে তার রক্তের নাচ
সৌরভে বিকশিত শ্বেত কারুকাজ
কাজ ভোলে সুর তুলে হার্মোনিয়াম
ইশারায় ডাক দেয় ক্রিসেন্থিমাম
সেই ডাকে ফণা তোলে দরোজার খিল
শিকারী শিকার করে, উড়ে যায় চিল
চিল উড়ে সীমাহীন আকাশের পর
দরোজা বন্ধ করে খুলে দেয় ঘর
সেই ঘরে কাঁপে মাছ নদীর ভেতর
নিষাদকাব্য লেখে দেহের অক্ষর।
পিতা
আমার আব্বা তাজুল ইসলাম — পেশায় ছিলেন শিক্ষক — এখন ঘুমোচ্ছেন।
আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। সুস্থতাও
জিজ্ঞাসা
নিজেকে নিজের জিজ্ঞাসা
— কী হতে চাও? অনেক কিছুই।
কবি, প্রেমিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, জননেতা — এমন কি পিতা।
গোপনে কালোবাজারি হতেও আপত্তি নেই।
সত্য বলছি: কখনো মানুষ হতে চাইনি।
দুর্ঘটনাপ্রবণ কবিতার উৎস
হাত তো গুণবে গুণিন।— আসলে গুণার নামে ছুঁয়ে দেখে স্বপ্ন।
আমি হাত গুণি না, গুণি পায়ের পাতা।
মেধাবী পায়ের মসৃণতায় ছবি আঁকে সলাজ কবিতা।
ফিতে ছিঁড়ে গেলে তোমার হাতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে অলৌকিক জুতো।
ইচ্ছে হলো খুলে ফেলি আমার জুতো মুজো
নিজেকেই গলিয়ে দেই তোমার পায়ে।
ভগবান অনেক পেয়েছেন, এবার পায়ের পূজো হোক।
—এই কথা কাউকে বলি নি, তবু জেনেছো শিক্ষিত চোখে।
মাঝে মাঝে জুতো জোড়া ছিঁড়ে যাওয়া ভালো।
জুতোর সনির্বন্ধ আলিঙ্গনে পায়ের পাতার চুমো পৌঁছায় না চোখে।
তোমার পা দেখার অবসর তো পেলাম।
ভালো তো কবেই বেসেছি, আজ থেকে পায়ের গোলাম।
যদি সে লখিন্দর, আমি তবে বেহুলা সাপ
লেবুগন্ধী রাত — অনিশ্চিতির পাতায় টলমল কাঁপে দীর্ঘশ্বাস
মনসার করুণ আকুতি ভুলি নি আমি, স্মৃতিদর্পী গন্ধবণিক —পরাভব মানে না যদিও —
আজও পৃথিবীর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে মানুষের রক্তের ভেতর শানায় ক্ষুধার ছুরি
ডিঙিতে জিংলাবোরা, রঙিন, উজ্জ্বল — শৈশবের স্পর্শে মাতাল
ঢেউয়ের অঞ্জলি, তৃষ্ণার্ত জিভ
দেবতারা চিরকাল মানুষের মুখাপেক্ষী
কেবল ভাবনার বিহঙ্গ যন্ত্রনায় ডানা তড়পায়
সাতনদী পাড়ি দেয় আকাশগঙ্গা, কুয়াশায় অনুলিপ্ত ঘুঙুরের ঝংকার
নৃত্যপর পায়ে মূর্ছা যায় দৈবদ্যুতি
সর্প আর সাপুড়ে একই সঙ্গে নর্তকের ভূমিকায় বিমূঢ়
আজও সপ্তডিঙায় উড়ে আসে সুতোনলি সাপ
আসে অজগর, কেউটে — বেদনায় মৃত্যুর ভয়ে লীন
পূজো পায় আজ নবীন সওদাগর
লখিন্দর ভুলে গেছে — নৃত্যের মুদ্রায় কাতরা বেহুলার বর
মৃত্যু
শঙ্খচূড়
বাড়িয়ে জিভ
শুনছে কী?
করেছে কার
প্রাণহরণ,
বদনসিব
কোন্ লোকের?
কোথা’ দূরে
ফুটেছে ফুল
হাস্নুহেনা।
পূজ্যমান
সর্প সব,
আজ তবু
গাইতে হয়
পুরবী গীত
এই রাতে
তার তরে!
আর তারা
বাড়িয়ে জিভ
কাটছে কার
বাসর ঘর
বদনসিব
কোন্ লোকের?
ঘুমন্ত
এক নদী
তলিয়ে যায়
মৃত্যুলীন
তার চোখে…।