বৃত্তের বাইরের মানুষ ও অন্য একটি গল্প । দেলোয়ার হোসাইন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০১৫, ৪:০১ অপরাহ্ণ, | ৪৬৫২ বার পঠিত
বৃত্তের বাইরের মানুষ
..
ফেরারি আসামি হয়ে কি লাভ বেঁচে থাকার ? এই তো সেদিন আমার মনবাড়িতে ঘটে গেছে সীমাহীন রক্তক্ষরণ। আমি অবাক হই মানুষের মিথ্যা স্বার্থকথা দেখে। কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, কাউকে অভিযুক্তও করি না। নিজেকে নদী ভাবি, তাই বয়ে নিয়ে চলি জীবনের সমস্ত ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস…
চোখের জলে সাঁতার কাটি আর বুকের ভিতর পোষে রাখি জমাট অভিমান। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে নিজেকে অভিশপ্ত মনে হয়। চলমান জীবনে সবার আগে আমি মানুষকেই ভয় পাই। মানুষের মন মানসিকতা কতটা নিচু আর মানুষের রুপ কতটা ভয়ঙ্কর তা আমি দেখেছি। আমার ভালো লাগে না এইসব নোংরামি। তাই মেনে নিতে পারি না কোন অনিয়ম। অথচ অনিয়ম দেখতে দেখতে নিজের চোখ দ’টিকে আজ নষ্ট করে ফেলেছি। নষ্ট চোখে সবকিছুকে তাই ময়লা মনে হয়…
তাই বলে ভেবনা আমি নষ্ট হয়ে গেছি। জেনে রাখ, জোসনার রুপালী আলোয় আমি তোমাকে আবিঙ্কার করবই। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আমিও তাই স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর সকালের। আমি তো জানি- আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না, বরং আমাকেই অপেক্ষা করতে হয় আকাশের দিকে তাকিয়ে…
নিরবতা, এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তা মানুষের জন্য। কিন্তু সবকিছু সব মানুষের জন্য নয়। এই যে আমাদের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা, এগিয়ে যাওয়া, গন্তব্যে পৌছা কিসের জন্য বলতে পারো ?
অথচ একটু চোখ মেলে দেখ না- আমাদের চারপাশে অসুখী মানুষ গুলোর দন্ডিত কালযাপন। যাদের মনের ঘরে শান্তির রেশ যন্ত্রনা কাতর। ভালোবাসার নিরেট অভিনয় নিজের সঙ্গে। তবুও জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে বেহিসািব আমি বারবার হেরে যাই বাস্তবতার কাছে। তাই তো তোমার কাছে আশ্রয় খুঁজি নিশুতি রাতের জোনাকির আড্ডায়…
কতটুকু পথ হাঁটলে পথিক ক্লান্ত হয় তা আমি জানি না। তবে আমি ক্লান্ত হইনি বলে আজও পথে পথে হাঁটি, পথ তৈরি করি। জানো- আমি আমাকে পথের মানুষ ভাবি বলে অনেকে আমাকে মানুষই ভাবতে চায় না। হয়তো তুমিও একদিন এভাবে আমাকে অমানুষ ভেবে ছুড়ে ফেলে দেবে। যেমনটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ঘরের মানুষ। এই ঘরটা তো আমার নয়, কোনদিন ছিলও না। নিয়তির খেলাঘরে আমি হলাম বৃত্তের বাহিরের কেউ। ঘরের বাহির নয়, বাহিরই যার ঘর- সে আমি।
আমাকে আর নতুন করে তোমার চিনতে হবে না। নীল জোসনা যাকে চিনে, রাতের জোনাকিরা যাকে ভালোবাসে আর নদী যার জীবনের তাবত গল্প জানে তাকে কি ঘরে আটকে রাখা যায ? দিন বদলের হেয়ালিপনায় আমাদের ভিতরটা একটুও বদলায়নি, কেবল আমাদের বাহিরটা শুধু বদলে যাচ্ছে বেখেয়ালিপনায়। দিন দিন আমরা আধুনিক হচ্ছি বটে কিন্তু আমাদের ভেতরটা এখনো অপবিত্র রয়ে গেছে। আমাদের সুন্দরটা তাই আজ কেবল পোশাকেই সীমাবদ্ধ। আমাদের এই সুন্দর দেখে সবাই মুগ্ধ হতে পারে কিন্তুু কেউ কোনদিন শুদ্ধ হতে পারেনা। মুগ্ধতা কাটিয়ে আমি যখন ফিরে পাই ফের নিজস্বতা, মনে হয় ভুলে ছিলাম ভুলে আছি- এইসব অপারগতা…
নিরবতা, প্রাত্যহিক জীবনে নিয়ম করে চালের দাম বাড়ে, বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের দামও ! কিন্তুু এই সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে আমাদের সবাই কে অবাক করে দিয়ে মানুষের দাম কমতে থাকে, কেবল কমতেই থাকে…
তুমি আমাকে মানুষ ভাব আর নাই ভাব তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। তবে দোহাই তোমার আমাকে বিশ্বাসঘাতক
ভেব না। তাহলে আমার বেঁচে থাকাটা মিথ্যা হয়ে যাবে। বাস্তবতার সাথে অভিনয় করতে করতে খুব সস্তা হয়ে গেছে
আমাদের মুখের কথাগুলো। এই মুখের কথাগুলো আজ আর কেউ বিশ্বাস করে না। যেমনটা আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের প্রজাতন্ত্রী শাসকদের কথা…
তুমি আবার আমাকে রাজনৈতিক দলের কেউ ভেব না। আমরা এক সপ্তাহ গোসল না করলেও পানি পানি বলে চিৎকার করতে পারি না। আমাদের ভয় হয়, আমাদের দিকে তেড়ে আসে অন্য কোন অন্ধকার…
আমরা তাই আমাদের গায়ের গন্ধ পারফিউম দিয়ে ঢেকে রেখে নিজেদের পবিত্র ভাবতে থাকি। আমাদের রান্না ঘরের চুলায় মাঝে মাঝে আগুন ধরে না. অথচ মনের ভেতর দাউদাউ করে আগুন। তবু আমরা কিছু করতে পারি না, কিছু বলতেও পারি না…
নিরবতা, আজ এইটুকুই। পথেই আছি, এই পথে যদি পথ তৈরি হয় তাহলে আবার লিখব, আরো অনেক কিছুই লিখব…
# # #
নিয়ন আলোর বায়োগ্রাফি
একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আঁতকে উঠি আমি, ভয়ে গলার পানি শুকিয়ে যায়। ঘুম ভাঙার এই জাগরণ বড়ই কষ্টের, বড়ই যন্ত্রনার। পাশের খাট গুলোতে বন্ধুরা ঘুমাচ্ছে, আমি তাদের কে ডাকার সাহস পাই না। মেসের জীবন, দশটা ছেলে দশ রকম মানসিকতা নিয়ে এখানে আছে। এত রাতে আমি তাদের বিরক্তির কারণ হতে চাই না। টেবিলে রাখা ওম গরম পানিতে গলা ভিজাই, তবু অশান্তি কাটে না। স্বপ্নে দেখা ভয়টা আমাকে এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি স্বপ্নের বিষয়টা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি, দরজা খুলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াই। বারান্দায় রাখা চেয়ারটাতে গিয়ে বসি, বসে বসে রাত দেখি…
মায়ের কথা মনে পড়ে, মা কাছে থাকলে নিশ্চয় এতটা ভয় পেতাম না। মনে মনে মাকে ডাকি, অনেক দিন হয় মাকে দেখি না। মায়ের জন্য মনটা ছটফট করে। মাকে বলতে ইচ্ছে করে- জানো মা, তোমার এই ছেলেটা মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠে। তুমি তো পাশে নেই তাই তোমার মতো পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কেউ আসে না আমার ভয় তাড়াতে। ইট-কাঠের এই শহরে মানুষ গুলোকেও আমার ইট-কাঠ মনে হয়, যাদের কোন প্রাণ নেই। ইট-কাঠ গুলোতো একটা জায়গায় থেমে থাকে অথচ মানুষ গুলো থেমে নেই। ওরা যন্ত্রের মতো চলে। আমি অবাক ভাবে মানুষ নামের এই যন্ত্র গুলোকে দেখি, এক সময় নিজেকেও যন্ত্র মনে হয়…
সময়ের হাত ধরে চারপাশের কত কিছুই না বদলায়- আমাদের পাশের বাসার চারতলা ভবনটা ক’মাস পরপরই বদলে যায়। যখন তখন আকাশের রং বদলায়, মানুষের মন বদলায়, ফুলের ঘ্রাণ বদলায়, ফলের স্বাদ বদলায়, গাছের পাতা বদলায়, নদীর জল বদলায়। বদলে যাওয়ার মিছিলে আমরা কেউই পিছিয়ে নেই। বদলে গেছি আমি, বদলে যাচ্ছি আমি। শুধু বদলায়নি আমার দুঃখগুলো। দুঃখ পুষে পুষে আমি বারমাসি কষ্ট হয়ে গেছি। কষ্ট বিষে আমি কেবল নীল হচ্ছি আর নুইয়ে পড়ছি বেঁচে থাকার ন্যূনতম অনুভূতি থেকে…
প্রচন্ড মনখারাপ নিয়ে বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। অন্ধকারে আকাশের দিকে মুখ তুলে তারা খুঁজার চেষ্টা করি। আমি হয়ে যাই নিজের কাছে অভিশপ্ত অন্ধকার। অন্ধকারে নিজেকে খুঁজি নিঃশ্ব ভাবে, নিঃশ্ব হয়ে…
আদরের ছোট বোনটির কানের দোলের বায়না আমি আজো পূরণ করতে পারিনি। তার স্বপ্নঘুমের রোজ আততায়ী আমি। কতটুকু নিরুপায় হলে ভাই তার ছোট বোনের নিকট অসহায়- সে আমি জানি। আমার ব্যর্থতার পান্ডুলিপিতে অপারগতার ছড়াছড়ি। অভিশপ্ত আমি, অভিশপ্ত আমার জমানো কাগজের সার্টিফিকেট গুলো। রঙচটা একটা ব্যাগের ভিতর যে গুলো পড়ে আছে টেবিলের এক পাশে। আর তার অসংখ্য ফটোকপি বিভিন্ন অফিসের ফাইলের নিচে চাপা পড়ে আছে, অথবা ডাষ্টবিনের আবর্জনার সাখে কবেই অদরকারী হয়ে গেছে। কে জানে…
প্রতিদিন রাত্রির খামে করে আমি আমার ছোট বোনটির কাছে অশ্রুজলের চিঠি পাঠাই। আমি জানি সে চিঠি কোনদিন তার হাতে পৌছবে না…
জীবনের শুরু থেকে অদৃশ্য এক মায়াজালে আটকে আছি আমি, তাই হারিয়ে যেতে পারি না নৈঃশব্দ্যের অন্তরালে। নয়তো কবেই উদাও হয়ে যেতাম উদিয়মান সূর্যের আলোর ঝলকানি থেকে। অথচ আমার দু’চোখের সামনে কেবলই ধু-ধুু মরুর আর্তনাদ। জীবনের মানে খুঁজে বেড়াই মানুষ হওয়ার যন্ত্রনা নিয়ে। আকাশের তারা দেখি, তারা গুনি…
ঐ যে, উত্তর আকাশে ঝলঝল করা তারাটি- ঐটা আমার বাবা। সংসারের বোঝা টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে যিনি ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আজ তিনি নেই- অথচ আমি আছি, আমরা আছি, আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কামনা-বাসনা, বঞ্চনা-তাড়না, স্বপ্ন-সাধনা…
তবু কোন কিছুই থেমে থাকে না, প্রকৃতির অলৌকিকতায় কোন কিছু থেমে থাকার কথাও নয়। চলতে চলতে চলে যাই শুন্যের ঘরে। আবার শুরু করি- ১, ২, ৩; শনি, রবি, সোম…
হেরে যাই, বারবার হেরে যাই। আবার ফিরে আসি, আবার স্বপ্ন দেখি- লাল, নীল, সবুজ। আবার নতুন করে শুরু করি- ১, ২… ৬, ৭, ৮…
সারাদিন এই অফিস থেকে ঐ অফিসে ঘুরি, ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যাই। একটু ছায়া পাওয়ার আশায় একটা সবুজ গাছ খুঁজে বেড়াই। যেখানে একটু ঠান্ড বাতাস গায়ে এসে লাগে। না, এই শহরে সবুজের দেখা পাওয়া এত সহজ ব্যাপার নয়। প্রকৃতির সাথে মানুষের মমতাতো দূরের কথা এখানে মানুষের সাথে মানুষের মমতা বলে কিছু নেই। আমি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি। পানির খুব পিপাসা পায়…
উদাস বিকেলে গুলো চারদিকে হাহাকারের বিষ ছড়িয়ে দেয়। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্য রকম এক দৌড়ঝাঁপ। চারদিকে কেবল ব্যস্ত মানুষের ছুটাছুটি, ঘরে ফেরার তাড়া। অথচ আমার কোন তাড়া নেই। আমি দাঁড়িয়ে থাকি অযাচিত ভাবে। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। উচু উচু দালান গুলোতে কৃত্রিম আলো জ্বলো ওঠে। যে আলোয় বদলে যায় মানুষের ব্যাকরণ। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে আর নিজের উপর বিশ্বাস কমতে থাকে। এই শহরটা প্রতিদিন আমার সাথে অবিশ্বাসী আচরণ করে। আমি তাই প্রতিদিন নিচু থেকে আরো নিচু হয়ে যাই। রাতের শহরে পথের নিয়ন আলোয় নিজেকে খুঁজার চেষ্টা করি। মনের ভিতর জ্বলে ওঠে নিয়ন আলোর বায়োগ্রাফি।
ভাবি কতটা কাগজের সার্টিফিকেট জমালে আমার একটা চাকরি হবে ? আমি মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে পারবো ? বোনকে সস্তা একজোড়া কানের দোল কিনে দিতে পারবো ?
না, কিছুই হয়না। আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে একসময় মেসে ফিরে আসি। আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করি। ঠোঁটে ধরা সিগারেটে আগুন ধরাই আর ফু দিয়ে চারদিকে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে দেই…
# # #