পঞ্চস্বর । ঈপ্সিতা বহ্নি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪, ৪:০৭ অপরাহ্ণ, | ২৭৮৬ বার পঠিত
ডিসেম্বরের রোদ
সকালকে ঢেকে-রাখা কুয়াশা
যখন আমাকে চোখ খুলতে মানা করে,
বলে, ‘ঘুমিয়ে থাকো’ —
. আমি মেনে নেই।
আমার ঘুম ভাঙাবে বলে
স্বর্গ থেকে আলো নিয়ে আসে ডিসেম্বরের রোদ।
ভোরের সূর্যকে আচ্ছন্ন-করা কুয়াশা
অন্ধকারের ভয় দেখিয়ে
লুকিয়ে থাকতে বললে —
. আমি মেনে নেই।
আমার পূর্বপুরুষের সাহসিকতার গল্প —
আমাকে পুনর্বার শোনাতে আসে ডিসেম্বরের রোদ।
যখন আমার চারদিক ঘেরা দেয়াল —
লেখার কলম, আলোর দরজা বন্ধ;
আমার জানালা খুলে দিতে আসে
ডিসেম্বরের রোদ।
পতাকাওয়ালা
ছোট্ট শিশুটি
তখন খেলছিল পথের ধারে,
হঠাৎ দেখা সেই পতাকাওয়ালার সাথে।
পতাকাওয়ালা;
গায়ে ধূসর পাঞ্জাবি, কপালে লাল-সবুজ,
কাঁধে তাঁর অসংখ্য পতাকা;
যেন রাইফেল কাঁধে হেঁটে যায় একাত্তর।
শিশুটি ছুটে গেল তাঁর কাছে,
‘পতাকাওয়ালা, ও পতাকাওয়ালা’ — ডাকে শিশুটি
চোখে কৌতূহল, তার চেয়ে উজ্জ্বল গর্ব।
‘তোমার পতাকার দাম কত?’ — প্রশ্ন করে সে।
— ‘পতাকা তো আমার নয়; পতাকা তোমার।
দাম তো আমরা কবেই দিয়ে দিয়েছি।” — বলে পতাকাওয়ালা।
‘যখন আকাশ প্রকম্পিত মর্টারের শব্দে,
যখন লালচে শিখায় জ্বলছিল আমার গ্রাম,
যখন গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে পালাচ্ছে মানুষ,
যখন বধ্যভূমিতে আমি খুঁজছিলাম
আমার শিক্ষকের কঙ্কাল;
তখনি এর দাম দেয়া হয়ে গেছে।
যে ছোট্ট শিশুর লাশ ভাসছিল পদ্মার স্রোতে;
সেও এর দাম দিয়েছে।
কোনও মায়ের বাকহীন চোখ,
কারো কান্না, কারো আর্তনাদ,
কারো-বা দীর্ঘশ্বাস কিনেছে এই পতাকা।
এই পতাকার লাল সে তো শহিদেরই রক্ত;
সেই সতেজ প্রাণেই এই পতাকা সবুজ হয়েছে।
এই পতাকা আমি তোমার জন্যেই এনেছি।’
‘সত্যি? এই পতাকা তুমি আমাকে দেবে?’
— আনন্দে উদ্বেল শিশুটি চিৎকার করে ওঠে ।
— ‘এই পতাকার ভার কিন্তু অনেক। তুমি বইতে পারবে তো?’
‘পারবো।’ — কঠিন আত্মবিশ্বাস শিশুটির ।
— ‘যদি বইতে কষ্ট হয়? ফেলে দেবে না তো ?’
‘কক্ষণো না ‘ — শপথ শিশুটির ।
— ‘যদি কেউ কেড়ে নিতে চায়?’
‘দেবো না’ — সাহসী উচ্চারণ তার।
— ‘যদি তোমায় আঘাত করে?’
‘তবুও না’ — দৃঢ় প্রত্যয়ী সে।
— ‘তবে যাও আজ থেকে এই পতাকা তোমার হলো।’
‘পতাকাওয়ালা!’ — আনন্দে ডেকে ওঠে শিশুটি।
— ‘আজ থেকে পতাকাওয়ালা তুমি ।’ — নির্ভার পতাকাওয়ালা বলে।
পতাকা কাঁধে ছুটে যায় শিশুটি;
কপালে লাল-সবুজ, কাঁধে অসংখ্য পতাকা।
যেন রাইফেল কাঁধে ছুটে যায় আরেক একাত্তর।
যেন ভবিষ্যৎ কাঁধে হেঁটে যায় আরেক ভবিষ্যৎ।
দেবী
আমি চাই না আমায় দেবী বলে
অঞ্জলি দাও ফুলের ।
আমি চাই না আমায় রাণী বলে
সাজাও সিংহাসনে ।
আমি চাই না পাতাল-ফুঁড়ে-আনা
হীরকটুকরোকোনো।
আমি চাই না সাগর সেঁচে আনা
শুভ্র মুক্তোঝিনুক।
আমিচাই নাআমায়কোমলবলে
বাঁচাও আঘাত থেকে
আমি চাই না আমায় দামী বলে
লুকাও সবার থেকে।
আমি চাই না
শুনতেআমারস্তুতি
তোমার কবিতায়।
আমি চাই না তোমার গল্পে
আমার স্নেহময়ী রূপ।
যদি পারো —
আমায়দিওবিশালআকাশভরে
স্বপ্ন-দেখার-সমানস্বাধীনতা।
আমায়দিওমুক্তকিছুবাতাস
মুক্তভাবে নেয়ার স্বাধীনতা।
আমায়দিওনক্ষত্রেরআলোয়
অচেনা পথ খোঁজার স্বাধীনতা।
আমায়দিওঅনন্তএকপথ
হেঁটেচলারঅবাধস্বাধীনতা।
আমায় দিও আমার জগৎটাকে
নিজের আলোয় চেনার স্বাধীনতা।
বছরশেষ
বছরের শেষ সূর্য
ডুবে যাওয়ার আগে
নিয়ে যেও সাগরের
শেষ গাওয়া গান।
নিয়ে যেও বাকিসব
ঝরা পাতা আর শব।
নিভে-যাওয়া আলো
নিও
ভুলে-ভরা সাধ।
সুখছলে নিয়ে যেও
জলে-দেয়া বাঁধ।
বছরের শেষ সূর্য
শেষ সন্ধ্যা
দিয়ে যাবার আগে
নিয়ে যেও গোধূলির
শেষ আঁকা ছবি
নিয়ে যেও কবিতার
দুখ-পোষা কবি।
পুরাতন শোক যত;
বলতে-না-চাওয়া
কথা,
ভুলতে-না-চাওয়া
ব্যথা
ভুলে যাবার আগে
নিয়ে যেও।
জোর চাপে রাখা স্মৃতি;
শেষ চোখে রাখা চোখ,
শেষ প্রিয় হাসিমুখ
নিয়ে যাবার আগে
নিয়ে যেও।
শহরের শেষ বাতি
নিভে যাবার আগে
বছরের শেষ চাঁদ
শেষ রাতে ডুবে
যাবার আগে
সব নিও,
রেখে যেও
মমতার শেষ দুটি হাত।