সুফি সুফিয়ান এর নাটক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০১৪, ৫:১৪ অপরাহ্ণ, | ২৫৯২ বার পঠিত
আত্ম সংলাপ ১
কখনও কি ছোঁবে না আলো
এই অন্ধপ্রাণের বারান্দা
রোদ-তৃষ্ণায় আর কত রাখবো
করে গুহাবাসী মন
পৃথিবীর সঙ্গমে বেড়ে ওঠা পৃথিবী
তবে কী গায়ে মাখবে গ্রহচারী রোদ
দানবের কাছে ইজারা দিয়ে
গুহা আন্ধার বেছে
নেবেস্বপ্নচাষিরদল
আপনারাই ভালো বলতে পারেন, নিভন্ত প্রদীপ হয়ে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে পরে থাকার মানে– জীবন না মরণ। যদি জীবন হয়, হতে পারো কাহফবাসী। যদি মরণ হয় জীবনের মানে হবে আরও কিছু, আরও আলো আরও আলো এবং আশ্চর্য স্বপ্নের বুনন। যুদ্ধ ও স্বপ্নের আজন্ম সংঘাতে যা বেড়ে ওঠে। কবির আশ্চর্য প্রশ্নের অভিঘাতের ভেতর এক দ্বন্দ্বময় জীবনের নাট্যরূপ বের হয়ে আসতে চায়। যা একুশ শতকের মানুষের গল্প। জ্বলে উঠলেই যাদের জেগে ওঠে পলায়ন চিন্তা। জীবনের প্রতি যাদের অপরিসীম দরদ। ধ্যানমগ্ন কবি সমস্ত পরিকল্পনা মাথায় এঁটে আওড়ান–
কবি: গল্পটা হতে পারে মহাবিশ্ব থেকে খসে পড়া কোনও গ্রহ-নক্ষত্রের মতো অথবা চৌতা আসমান থেকে প্রেরিত কালো পাথর। পাপ-পুণ্যের হিশাব চেতনার রাজ্যে উসকে দিলেও আমি সেই চেতনায় একরাশ থুথু ছিটিয়ে বলে দেবো গল্পটা । যে গল্পের কোনও অতীত থাকলেও বলবো না- অতীত। যার ইতিহাস থাকলেও বলবো না- ইতিহাস। আমি দাকিয়ুস কিংবা জুলকার্নায়ের ইতিহাস খোঁজার প্রয়োজন বোধ করবো না। করবো না রোম তুরস্ক কিংবা সুমেরিয় সভ্যতার ইতিহাস। আপনারা ভাবলেও ভাবতে পারেন সেমেটিয় মিথলজির একটা অধ্যায় অথবা ঐশ্বরিক প্রেসে ছাপানো কাহফের ছায়া। তিনশো নয় বছর যার ব্যাপ্তি। এটি হতে পারে অতীতের তিনশো নয় অথবা ভবিষ্যতের তিনশো নয়। সভ্যতার ইতিহাস পরিক্রমায় এটি সবসময় বর্তমানের দেয়ালকে প্রসারিত করছে।
কবির মনোবৃত্তিকে বিকল করার জন্য ঘরের প্রতিটি বস্তুকণাই যেন বিদ্রোহ করে ওঠে।
নেপথ্য: না না না না না…।
কবি: কেন না?
নেপথ্য: কারণ এই গ্রন্থটা নিজেই তার বাহিরে অপ্রকাশ্যে তথ্যগ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।
কবি: কিন্তু এটি ছিল মানবজাতির শিক্ষার উদ্দেশ্যে। আমি তেমনই এক শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে মানবসভ্যতায় ক্রমান্বয়ে আসা অথর্ব শ্রদ্ধাভাজনেষুর রাজ্যপাঠ করছি। যা এখনও বর্তমান, অতীতে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
নেপথ্য: তোমার সমস্ত পরিকল্পনা একটা মিথ্যে খোলস মাত্র।
কবি: তোমরা জান কীভাবে?
নেপথ্য: দেহের সঙ্গে মিশে থাকা আবরণ যদি ভ্রূণের সংবাদ না-জানে তাহলে ভাবতে হয় প্রতিবন্ধীর আচ্ছাদন নিয়ে জীবন কাটাচ্ছ।
কবি: কী বলতে চাও?
নেপথ্য: বলতে চাই নিজের আশ্চর্য বিকাশের জন্য মিথ্যে গল্প শুনাতে যেয়ো না। কারণ ঘুমন্ত গুহাবাসী জেগে ওঠে ওই দাকিয়ুস দেখেনি।
কবি: দেখেনি, দেখবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তা-ই সত্য।
নেপথ্য: সত্য-মিথ্যের কতটা খোলস উন্মোচন করবে তুমি? সত্যতা নিশ্চয় তোমার চোখে ধারণ করা কোনও দৃশ্যায়ন নয়। তুমি যা বলবে তা-ই সত্য হবে এমন না। এই অর্থহীন শব্দবিলাসিতা বাদ দিন।
কবি: আমি জানি অর্থহীন। আর এই অর্থহীনতায় ভরপুর জীবনকেই তো ক্রমান্বয়ে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। আমি সেই ধারাবাহিকতা থেকে তুলে আনছি কয়েকটি মাত্র চরিত্র।
নেপথ্য: তাই বলে সত্যকে মিথ্যে করে?
কবি: এটা তোমাদের ধর্মবোধের ফসল।
নেপথ্য: আমি চাই এ ফসল নিয়ে তুমি তৃপ্ত থাকবে।
কবি: না।
নেপথ্য: অবশ্যই হ্যাঁ।
কবি: তোমরা আমাকে চেতনাগত দিকে গুহাবাসীর মতো বন্দি করে রাখবে নাকি? হয় দাসত্ব না-হয় নির্জন গুহার আঁধারে বন্দি।
নেপথ্য: কোটি কোটি মানুষ তাই থাকছে।
কবি: হতে পারে সত্য। এ গল্পের শেষ অংশ কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশা। যা বাস্তবে নাও হতে পারে ।
নেপথ্য: আবার বিরুদ্ধ কথা!
কবি: বিরুদ্ধের আবার কী হলো? একটা গল্পকে কল্পনা আর বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন আখ্যান লেখা নতুন কিছু নয়।
নেপথ্য: সেটা পৃথিবীর অন্যগ্রন্থে’র ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে । কিন্তু তুমি সত্যের চূড়ান্ত অবস্থায় বিরাজমান।
কবি: অন্যরা যে পাদদেশে তা কী করে বলো, এতে নিজের দাম্ভিকতা প্রকাশ পায় না?
নেপথ্য: সত্য প্রকাশ করা দাম্ভিকতা নয়।
কবি: নিজের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুভূতির দেয়ালে মাঝে উপহাসের রং ছিটানোর নাম কী?
নেপথ্য: সেটা যাই হোক আত্ম-প্রতারণা নয় ।
কবি: এর নাম আত্ম-প্রতারণা?
নেপথ্য: নয়তো কী, তুমি অস্বীকার করতে পারো তোমার উৎস-মাঠে
এই সত্যতার স্লোগান চলে না?
কবি: হ্যাঁ চলে।
নেপথ্য: তাহলে কেন গর্ভের মতো পবিত্র অন্ধকার নগ্ন করে দিতে চাইছো। এটা কি তোমার মহাজাগতিক লোভ?
কবি: না।
নেপথ্য: হ্যাঁ, অবশ্যই হ্যাঁ। তুমি চাইছো গর্ভের অন্ধকার এবং মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করে আলোচিত হতে।
কবি: না, না তোমরা যদি এটাকে গর্ভের মতো পবিত্র অন্ধকার বলো- তাহলে আমি বলবো আমি একটা ভ্রূণের জন্ম দিতে চাইছি। যা ওই অন্ধকারে আশ্চর্য একটা ফুল ফোটাবে; এ হবে গুহাবাসীর প্রত্যাশার মতো আমারই প্রত্যাশার ফুল।
নেপথ্য: না তোমার সঙ্গে তর্ক করবো না। সরাসরি নিষেধ করবো। কারণ নিষেধ না করলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে ।
কবি: মানুষ তো এমনিতেই বিভ্রান্ত। দাকিয়ুসরা তো প্রতিনিয়তই আমাদের মানসম্মান-ঐশ্বর্য নিয়ে নিজের শৌচের কাজে লাগাতে দ্বিধা করে না।
নেপথ্য: তোমার পাপ হবে, তুমি বন্ধ করো ফুল-পাখি-বৃক্ষ নিয়ে লেখো। লেখার অনেক উপকরণ জগতে আছে।
কবি: এতটুকু গল্পের নাট্যরূপে আর কতটুকু পাপ হবে।
নেপথ্য: ওফ! তুমি বড়ো গোয়াড়। নিজের ভাবনাকে বড়ো করে দেখো। তোমার ঘরের ইট-পাথর-সুরকি তোমাকে নিষেধ করছে- তুমি শুনছো না। লেখো দেখি তোমার দ্বৈরথ!
আপন চেতনার সঙ্গে আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত কবি। কী এমন গল্পের ফাঁদ পেতেছেন যে, ভ্রূজন্ম নিতে না নিতেই চেতনা নিষেধের দেয়াল তুলতে চাইছে। পারিপার্শ্বিকতা যেন বিদ্রোহ করে উঠছে। সমস্ত শরীরে বৃশ্চিকের লোমশ স্পর্শ যেন পিনপিনে অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। কবির মনোরাজ্যে ভেসে ওঠে এক অথর্ব রাজার দুঃশাসন, যা সহস্র বছর ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে সত্য।বন্দিশালায় বিদ্রোহীগণ
এক.
দেশ জুড়ে এক ভয়াবহ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। রাজার অনুগত অস্বীকারকারীদের ওপর চলে নির্যাতনের বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা। শহর- বন্দর-গ্রামে-গঞ্জে সবাই শুধু রাজা রাজা রবে চিৎকার করবে- এই বাসনায় ক্ষিপ্র সিংহের ন্যায় ধ্বনি উদ্বেলিত করে রাজ অনুগত হয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা। বিপ্লব সৃষ্টিকারী তেজস্বী যুবক ধরে এনে বন্দি করে রাখে রাজসৈন্যরা। বন্দিশালায় রাজা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে হাজির হন। এবং চোখের সামনে অনেককেই খুন করান–
রাজা: ও?
রক্ষি: দক্ষিণপাড়ার।
রাজা: ও?
রক্ষি: উত্তরপরগনার।
রাজা: ও?
রক্ষি: পশ্চিম পরগনার।
রাজা একজন একজন করে সবার সামনে গিয়ে পাঠ করতে চেষ্টা করেন তাদের বিষণ্ন মুখের শানে-নজুল।
রক্ষি: রাজা অনুমতি দিলে এখনই ভবলীলা সাঙ্গ করি।
রাজা: অধৈর্য হইয়ো না। কয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
রক্ষি: তারপর সকাল বিকাল নির্যাতন করে বুঝিয়ে দিতে হবে বিপ্লব সৃষ্টি করার বীভৎসতা।
রাজা: ঠিক তা না, নিরীহ দু-একজন ছাড়া মোটামুটি সবাইকে মেরে ফেলতে হবে। যারা বেঁচে থাকবে তাদের দিয়ে আমরা আমাদের রাজ্যের সকল নীচু কাজগুলো করাবো।
রক্ষি: যেমন?
রাজা: যেমন রাজ্যের পরিষ্কারকর্মীরা যা করে।
রক্ষি: কিন্তু ওদের কেউই নিরীহ না রাজা! সুযোগ পেলেই ক্ষিপ্র সিংহের ন্যায় ঘাড়ে কামড়ে ধরবে। কারণ চোখের সামনে ওরা ওদের আত্মীয়স্বজনদের মরতে দেখেছে। স্বজন হারানোর বিক্ষিপ্ত যন্ত্রণা ওদের প্রতিনিয়ত খুঁড়বে। ওরা দারুণ সুযোগ সন্ধানী হবে।
রাজা: তুমি আমাকে বুঝাতে চেয়ো না। আমি বিপ্লবীদের চোখ দেখেই বুঝি। ওই ছেলেকে বাঁচিয়ে রেখো আর ওই পাশের দুজনকে।
রক্ষি: রাজা আপনি জানেন না ওরা দুজনই উত্তরপাড়ায় প্রথম বিপ্লবের বীজ রুয়ে দিয়েছিল। ওদের মুখ থেকে সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছে- পঙ্গু অথর্ব অত্যাচারী রাজার হাত থেকে সবাইকে বাঁচাতে হবে।
রাজা: কচুরিপানা বাড়বেই সেটা স্বাভাবিক, তাই বলে পুকুরের সব কচুরিপানা তুলে ফেলা বোকামি।
রক্ষি: তাই বলে কি ঘরের ভেতর সাপের অভয়াশ্রম করা ঠিক হবে?
রাজা: হ্যাঁ ঠিক হবে। এত এত সৈন্যসামন্ত তিনটা সাপের ভয়ে নিশ্চয় ভিত থাকবে না।
রক্ষি: ঠিক, কিন্তু বিপ্লব তো রাজা, শৃগালের চিৎকারের মতো, যদি একটা শুরু করে দিতে পারে তবে সবাই এক সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে।
রাজা: সেই চিৎকারের স্থায়িত্ব বেশি সময় থাকে না ।
রক্ষি: কিন্তু এ-ও সত্যি রাজা। একটু সময় হলেও শিরার ভেতর ভয়ানুভূতি ঢুকতে পারে।
রাজ: যুক্তি দেখাতে চেয়ো না। যা বলছি তা-ই করো। মনে রেখো খাঁচার সিংহ যতই ক্ষোভ প্রকাশ করুক না কেন তা গর্জন হয়ে বের হয় না- কান্না হয়ে বের হয়।
রাজা রক্ষির কথোপকথন বেশি দীর্ঘ হয় না। রাজা তিনজন মানুষ ছাড়া সবার প্রাণনাশের ঘোষণা দেন। একটা একটা করে ক্রমান্বয়ে রাজার আদেশ পালন করা হয়। রক্ত রঙে সাজে বিকালের সূর্য। শহর-নগর-গ্রামে ধ্বনিত হয় রাজার জয় জয়কার। এক অশ্চর্য আত্ম- অহংকার নিয়ে রাজা জনতার মঞ্চে ঘোষণা দেন–
রাজা: তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করার ঘোষণা করেছি, কারণ আমি মনে করি বিরুদ্ধশক্তিই মূলশক্তির প্রেরণাদায়ক। তাছাড়া আমার হস্ত-পদের সঞ্চালনহীনতার জন্য একদিন যদি আপন মাংসপেশি বিদ্রোহ করে, তাহলে তাকে দেখিয়ে দেওয়া হবে বিপ্লবীরা কীভাবে আস্তাবল পরিষ্কার করে ।
দুই.
রাজার বশ্যতা অস্বীকারকারী তিন বিপ্লবী প্রতিনিয়তই নিজস্ব ক্ষোভের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য নীরবে পথের সন্ধান করে। কিন্তু সে সুযোগ তাদের হয়ে ওঠে না। অহর্নিশি কয়েকটি প্রহরারত চোখের অগোচরে তারা মাঝে মাঝে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে। কোনও এক মধ্যরাত্রে তিনজন এক হলে–
১ম বিদ্রোহী: এখনও ঘুমাওনি?
২য় বিদ্রোহী: এমন সময় কখনও ঘুম হয় না। তাছাড়া অপেক্ষা করছিলাম, তোমাদের দেখা পাবার জন্য। মনে মনে প্রার্থনাও করেছি। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল ।
৩য় বিদ্রোহী: সন্দেহ কেন, আস্তাবল পরিষ্কার করো বলে? কিন্তু তুমি কি জান পশুর বিষ্টা মনুষ্যবিষ্টার চেয়েও পবিত্র? আমি তবু আত্ম দিকে ভীষণ পবিত্রতা অনুভব করি। কারণ আল্লাহ সব দেখেন।
১ম বিদ্রোহী: কিন্তু আমি যখন রাজার শৌচের পর রাজাকে পরিষ্কার করার জন্য পানি ঢালি, সমস্ত শরীর যেন নিশপিশ করে। মনে হয় তোমরা ভীষণ সুখি।
২য় বিদ্রোহী: তুমি তোমার কষ্টকে ঘৃণার দোহাই দিয়ে আমাদের কষ্টের চেয়ে ভারী করতে চাইছো।
১ম বিদ্রোহী: ও না, খোদার কসম বিশ্বাস করো এই হাত যখন রাজার গোপনাঙ্গ স্পর্শ করে মনে হয় টেনে ছিঁড়ে ফেলি।
৩য় বিদ্রোহী: উত্তেজিত হইয় না, ওরা টের পাবে।
১ম বিদ্রোহী: পাবে না কারণ রাজ্যশুদ্ধ এখন মেতেছে জুয়া-মদ-নারী নিয়ে, পঙ্গু রাজা স্বয়ং। …ওহ খোদা ওদের দাসত্ব আমাদের মানতে হয় ।
৩য় বিদ্রোহী: অধৈর্য হইয় না আল্লাহর কৃপা থেকে বঞ্চিত হবে ।
২য় বিদ্রোহী: এসো আমরা পালিয়ে যাই।
৩য় বিদ্রোহী: কোথায় যাবে?
২য় বিদ্রোহী: আল্লাহর এত বড়ো দুনিয়া আত্মগোপনের জায়গা নিশ্চয় পেয়ে যাবো।
১ম বিদ্রোহী: আত্মগোপন করে থাকতে হলে এখানেই থাকবো। সুযোগ পেলে আমার অতৃপ্ত বাসনাটাও পূর্ণ করে নেবো।
৩য় বিদ্রোহী: ভাসমান শ্যাওলা হয়ে জলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় না।
১ম বিদ্রোহী: আমি তো যুদ্ধ ঘোষণা করছি না, কাপুরুষের মতো পেছন থেকে মারবো ।
২য় বিদ্রোহী: তুমি কি মনে করো এরপর বাঁচবে?
১ম বিদ্রোহী: এখনও যে বেঁচে আছি সেটা কী করে বলো। নিজের সত্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে লিঙ্গহীন মানুষের মতো রমণী পাহারা দেবার নাম কি জীবন?
৩য় বিদ্রোহী: তুমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়ে আল্লাহর ভাবনা দূরে সরিয়ে দিয়েছ নাকি?
১ম বিদ্রোহী: না তা হবে কেন, কিন্তু আমি তো মানুষ। আর মানুষ বলেই সমস্ত ভাবনাকে কাবু করে সেই বীভৎস দৃশ্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
২য় বিদ্রোহী: দয়া করে শান্ত হও।
৩য় বিদ্রোহী: আল্লাহর কৃপা প্রত্যাশা করো দেখবে একদিন সমস্ত অন্ধকার ডিঙিয়ে আশ্চর্য আলো উদ্ভাসিত হবে।
১ম বিদ্রোহী: বিশ্বাস করো প্রতিনিয়তই আমি খোদার আশীর্বাদ কামনা করি। কিন্তু সেই বীভৎস দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি যখন মনের অজান্তেই হয়ে যায় আমি ঠিক থাকি না। আমার অন্তরাত্মা প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে ওঠে।
২য় বিদ্রোহী: তোমার মতো আমারও হয়।
১ম বিদ্রোহী: তোমরা নিশ্চয় জান না ওরা আমাকে ধরে আনার সময় কী করেছে।
২য় বিদ্রোহী: অনুমান করতে পারি।
১ম বিদ্রোহী: পারবে না। তোমাদের অনুমানের গাঢ়ত্ব সেখানে পৌঁছাবে না। কারণ ওদের ভাষায় বিপ্লব বলতে যা বোঝায় আমি তা করিনি। আমি শুধু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনের অজান্তেই বলেছিলাম পঙ্গুরাজার বশ্যতা স্বীকার করে কী অসহায় ভাবে বেঁচে আছি খোদা তুমি কী দেখ না।
৩য় বিদ্রোহী: যে কষ্ট তোমাকে পোড়ায় সেরকম কষ্ট আমাদেরও আছে।
১ম বিদ্রোহী: পরিমাণের দিক দিয়ে হয়তো আমিই বেশি। তুমি কি দেখেছো তোমার গর্ভবতী বধূর বুক কেটে বলের মতো লাথি দিতে? দেখেছো দুধ আর রক্তের স্রোত বুক বেয়ে পড়তে? তারপর বৃদ্ধ বাবা- মা ভাইবোনকে একঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিতে? ওরা আমাকে যখন কুকুরের মতো টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসে। আমার বাবার চিৎকারে আকাশ কাঁপে আর মায়ের চিৎকার অগুনের চিৎকারের সঙ্গে সমান তালে সুর করে বিলাপ করে । আমি ওদের সর্বশেষ অর্তনাদ শুনতে পারিনি। ওরা আমার পিঠে চাবকাতে চাবকাতে নিয়ে আসে বন্দিশালায়।
২য় বিদ্রোহী: তোমার চেয়ে আমার কষ্ট কম না। জানো আমার ছোট ভাইটা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা বোয়ালমাছের মতো গেঁথে ফেলে। তীক্ষ্ণ খোঁচ্ যখন তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়– নদীর জল রক্তে লাল হয়ে যায়। …আমার বাড়ির কুকুরটাকেও বাঁচতে দেয়নি ওরা…!
৩য় বিদ্রোহী কাঁদতে কাঁদতে বলে–
৩য় বিদ্রোহী: আমার কিচ্ছু হয়নি ওরা আমাকে চুপচাপ ধরে এনেছে চুপচাপ ধরে এনেছে …।
২য় বিদ্রোহী: কেঁদো না, আমি জানি ওর কিংবা আমার চেয়ে তোমার বিষাদ কম নয়। এসো খোদার কাছে এই মধ্যরাত্রে সবাই মিলে প্রার্থনা করি। খোদা মুখ তুলে চাইতে পারেন ।
২য় বিদ্রোহী তার কান্নানুভূতি দমিয়ে রেখে সুর তুলে প্রার্থনা সংগীতে টান দেয় । ধীরে ধীরে বাকি দুজনও মিশে যায় সেই সুরের তাল–
ছায়ার জন্য হাত পেতেছি
আমাদের এই করুণ হাল
কাটাও কাটাও কাটাও খোদা
তোমার কৃপায় গ্রহণকাল।
ওদের প্রার্থনায় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই যেনই হৃৎপি- ছেঁড়া ধ্বনি হয়ে মিশে যায় রাজশালায়। কিন্তু এ ধারাবাহিকতা বেশি দূর এগোয় না। রাজার মাতাল দুই প্রহরী ওদের প্রার্থনায় বসার ভঙিমা থেকে লাথি দিয়ে তুলে বলে–
১ম প্রহরী: এই চুপ চুপ।
২য় প্রহরী: কৃপা যদি প্রার্থনা করতে হয় আমাদের সম্রাটের করো। তাহলে মুক্তি পেলেও পেতে পারো।
১ম প্রহরী: তাহলে আমাদের মতো মাতাল হয়ে নক্ষত্রের নীল আলো গায়ে মাখতে পারবে।
১ম বিদ্রোহী: কী, তোদের অথর্ব পঙ্গু রাজার কাছে কৃপা চাইবো? যে কি না নিজ হাতে শৌচ শেষে নিজেকে পরিষ্কার করতে পারে না।
২য় বিদ্রোহী: এই এটা কী বলছো?
২য় প্রহরী: হারামি যে রাজার কৃপায় বেঁচে আছিস তাকে অথর্ব বলছিস, তুই কি ভুলে গেছিস তোদের জীবন রাজার করুণার ফসল।
২য় প্রহরী: ২য় বিদ্রোহীকে আঘাত করতে থাকে, ১ম প্রহরীর মাতলামি যেন দ্বিগুণ তিনগুণ করে বাড়তে থাকে, ২য় প্রহরীর আঘাত সে ভীষণভাবে উপভোগ করতে থাকে এবং এক সময় ২য় প্রহরীকে উদ্দেশ্য করে বলে-
১ম প্রহরী: এই রাজার কাছে কী বলে আসবো?
২য় প্রহরী: না, রাজা এখন ভাবের রাজ্যে উড়ালডানায় চড়ছেন। কথা বলতে গেলে রাগ করতে পারেন।
১ম প্রহরী: তাহলে ওদের পিটানোর অনুমতি আনবো?
২য় প্রহরী: তুমি বেশি মাতাল হয়ে গেছো, কোনও কথা না ওদের পিটিয়ে তক্তা বানাও।
১ম প্রহরী: কেন তক্তা দিয়ে তুমি নৌকা বানাবে নাকি?
রাজপ্রহরী ও বিদ্রোহীদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মধ্যরাত্রের মাতাল রাজা তার প্রধান রক্ষিকে পাঠিয়ে জানতে চান এখানে চেঁচামেচির কারণ কী। রক্ষি আধো নেশা আধো ঘুম জড়ানো দেহে এসে বলে–
রক্ষি: কী হয়েছে মধ্যরাত্রে শৃগালের মতো চেঁচাচ্ছো কেন?
২য় প্রহরী: বিপ্লবীদের ঘুমন্ত-রক্ত জেগে উঠেছে!
রক্ষি: পৃথিবীর সবকিছু জেগে ওঠে, অনাদিকাল পলিপাথরে কিছুই চেপে রাখতে পারে না। ওরা তো জেগে উঠবেই। তাই বলে তোমরা চেঁচাচ্ছো কেন?
১ম প্রহরী: আমরা চেঁচাচ্ছি না আমরা রাগে সিংহের মতো হুংকার ছাড়ছি, কারণ ওরা রাজাকে নতুন করে ভর্ৎসনা করেছে।
২য় প্রহরী: আমাদের তা সহ্য হয়নি।
রক্ষি: কী বলে ভর্ৎসনা করেছে?
১ম প্রহরী: খুব খারাপ কথা। রাজা শুনলে কান্না শুরু করে দেবেন।
রক্ষি: চুপ! তুমি বড়ো মাতাল হয়ে গেছো। এই ওদেরকে শায়েস্তা করো, আমি রাজার পাশে যাচ্ছি কোনও চেঁচামেচি যেন না হয় ।
রক্ষির নির্দেশে প্রহরীরা ওদেরকে ক্রমান্বয়ে পিটিয়ে নিস্তেজ করে রাখে। এবং রাত্রি বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী দুজন ক্লান্তিতে চোখ বুজে দেয় ওদের পাশেই।
প্রত্যুষে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য রাজা রক্ষিকে বলেন ১ম বিদ্রোহীকে ডেকে আনতে। রক্ষি বিদ্রোহীদের মুর্মূষু অবস্থা দেখে অবাক হয়। তারা দাঁড়াতে পারে না নিস্তেজ শরীর নিয়ে। তবে কে করবে এখনকার কাজ?
রক্ষি: ওদের এই অবস্থা কেন?
১ম প্রহরী: গত রাত আপনিই তো বললেন ওদের শায়েস্তা করতে।
রক্ষি: তার মানে এমন ভাবে?
১ম প্রহরী: কেমন ভাবে আপনি তো বলে গেলে না।
রক্ষি: চুপ করো, গর্দব কোথাকার। জানোই তো এখন রাজার শৌচের সময়। কী করতে হবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন।
২য় প্রহরী: আগের লোককে কি পাওয়া যাচ্ছে না?
রক্ষি: সে গতকাল ছুটি নিয়েছে। রাজা মনে করেছেন তার কোনও কাজ নেই। বিপ্লবী দিয়েই কাজ হবে।
২য় প্রহরী: তা হলে উপায়?
রক্ষি: কোনও উপায় নেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ আমার সঙ্গে আসতে হবে।
১ম প্রহরী: আমি যাবো না কারণ আমি পিটাইনি- আমি জানতাম ওরা উপকারী জন্তু।
রক্ষি: কোনও কথা না, তোমাকেই যেতে হবে।
১ম প্রহরী: আমি ওকে একটাও মারিনি। কেন আমি ওর কাজ এখন করবো?
রক্ষি: কোনও কথা না এসো আমার সঙ্গে। আর এই তুমি ওদের পরিচর্যার ব্যবস্থা করো।
রক্ষি ১ম প্রহরীকে টেনে টেনে নিয়ে যায়। ২য় প্রহরী নীরব ভর্ৎসনার হাসি হেসে কয়েকজন সেবিকা ডেকে আনে। সেবিকাদের ক্লান্তিহীন পরিচর্যায় বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।গুহাবাসীর প্রার্থনা
একদিন মধ্যরাত্রে ওরা পরিকল্পনার জাল আঁটে। সমস্ত হিংসাত্মক মনোভাবের কবর দিয়ে– সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে যাবার। কিন্তু কোথায় যাবে? সে প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিলে ঈশ্বরের কৃপা প্রত্যাশী হয়ে ওঠে মন। কোথায় আশ্রয় হবে সেটা বড়ো কথা না। তারা যাবে, এটাই সত্য। তাই বের হয়ে হাঁটতে থাকে অজানা জগতের উদ্দেশে। ভোরের আলোর কাছে পরাজিত অন্ধকার মিইয়ে গেলে সূর্যরশ্মির নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয় জগৎ, ভয় আর সূর্য দেখার আনন্দ ওদের মনে মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে ঈশ্বরের জপতপের ব্যস্ততা। ওরা হাঁটতে থাকে হাঁটতে থাকে। তিনজনের মধ্যে থেকে একজন দেখে একটা কুকুর অনুুসরণ করছে। ২য় বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে ধমক দিলে কুকুরটা নিঃশব্দে একটু সরে যায়। পরক্ষণে আবার ওদেরকে অনুসরণ করে। ২য় বিদ্রোহী আবার ধমক দিতে চাইলে ৩য় বিদ্রোহী বলে–
৩য় বিদ্রোহী: ওকে তাড়িয়ে দিয়ো না ।
২য় বিদ্রোহী: কিন্তু ওটা তো নাপাক প্রাণী।
৩য় বিদ্রোহী: আল্লাহর সৃষ্টি কোনও কিছুই নাপাক না।
১ম বিদ্রোহী: তুমি ঠিকই বলেছো। এটি বোধ হয় আমাদের সঙ্গে যেতে চায়। দেখছো না একটা সময় আমাদের ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্টি দেয়নি।
২য় বিদ্রোহী: তার মানে কি রাজাকে কিৎমিরও ঘৃণা করে?
১ম বিদ্রোহী: করবে না কেন? অত্যাচারী পঙ্গু এই রাজা দেশ জুড়ে খুনখারাবি, ধর্ষণ, প্রতিনিয়ত হচ্ছে- তার বিচার করছে না। অথচ কেউ মাথা তুলে দাঁড়ালে তার বংশশুদ্ধ নির্মূল করে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে ।
২য় বিদ্রোহী: আমি আসলে বুঝি না মানুষ তার বিবেক বিক্রি করে ফেলেছে কি না। কেন সবাই বিদ্রোহ করে না। অথচ একটা কুকুর …!
১ম বিদ্রোহী: বিদ্রোহ করুক আর আমাদের মতো শৌচ পরিষ্কার করুক এটাতো সবাই চায় না।
৩য় বিদ্রোহী: সবই আল্লাহর খেলা, তিনি ইচ্ছা করলে সবার মনে বিদ্রোহ ভাবাপন্ন মনোভাব সৃষ্টি করিয়ে দিতে পারেন।
১ম বিদ্রোহী: আচ্ছা আমরা কি ডান দিকে যাবো?
২য় বিদ্রোহী: যেতে পারি।
অনেকক্ষণ তারা নিঃশব্দে হাঁটে। তাদেরকে অনুসরণ করে কুকুরটা। সকালের বাতাস তাদের মনে একধরনের সতেজ অনুভূতি সৃষ্টি করায়। এক সময় তাদের মনের সকল ভয়ভীতি উড়ে যায়। এটা হয় তো মুক্তির আনন্দে অথবা জীবনকে জানার নতুন পথের সন্ধানের উন্মুখ হৃদয়ের দৃপ্ত বাসনায়।
২য় বিদ্রোহী: এই দেখো সামনে কী সুন্দর সবুজ, খোদার কৃপা যেন এইখানে গলে গলে পড়ছে ।
৩য় বিদ্রোহী: জাগতিক ভাবনা তৈরি করো না। মনে আছে আমরা ভাবছিলাম গুহা কিংবা গর্তের ভেতর ঢুকে খোদার প্রার্থনা করবো। সেটা মনে রেখো?
২য় বিদ্রোহী: না না… সেটা মনে আছে।…আল্লাহর সৃষ্টি সত্যিই অপূর্ব ।
১ম বিদ্রোহী: এই যে শিমুলগাছে হাওয়ালপাখি দেখছো; তার পালক অনেক বড়ো। জানো, এরকম পালক দিয়ে কলম হবে। আমার স্ত্রী এরকম কলম পছন্দ করতো না ।
২য় বিদ্রোহী: পুরোনো স্মৃতি আওড়াচ্ছ কেন এতে শুধু যন্ত্রণা বাড়বে।
১ম বিদ্রোহী: এই যে কুটুমপাখি দেখছো আমার স্ত্রী এরকম পাখি দেখলে বলতো কুটুম আসবে রান্না করে রাখতে হবে।
৩য় বিদ্রোহী: অহ! না .. না।
কান্না করতে থাকে ৩য় বিদ্রোহী।
২য় বিদ্রোহী: কাঁদছো কেন ।
এমন সময় কুকুরটা চিৎকার করে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের মনে। কারণটা কী হতে পারে? কেন বোবা কুকুরটা হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠল? এই প্রশ্ন মনের ভেতর প্রোথিত হতে-না দিয়েই তারা লুকাতে চেষ্টা করে। ২য় বিদ্রোহী জোড়া পাহাড়ের ঠিক মধ্যে দিয়ে এক সুরঙ্গের দিকে আঙুলি নির্দেশ করে এগিয়ে নিয়ে যায়। এক সময় তারা ওই সুরঙ্গে গিয়ে ঢুকে পরে। কিছুক্ষণ নীরবতার মধ্যে থেকে সুরঙ্গ বেয়ে আসে ওদের কণ্ঠে প্রার্থনাসংগীত। গাছের পাতায় পাতায় সৃষ্টি হয় শ্রুতিময় শব্দের ব্যঞ্জনা। বাহিরে হিংস্র শ্বাপদের চিৎকার তবু ওদের কণ্ঠে শব্দের জোর।
শকুনের ঠোঁট ভেঙে দাও বিধি
ভেঙে দাও তার ডানা
নিরীহ প্রাণে আর যেন না
করতে পারে হানা
নীরব ঝড়ে আবাসন তার
ভেঙে যাক খসে খসে
তোমার কাছে করছি মিনতি
আমরা বসে বসে।
অত্মসংলাপ ২
পরিকল্পনার দীর্ঘ জাল বুনে নিস্তেজ কবি বসে থাকেন। তার নিশ্বাসের স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে স্পন্দিত হয় ঘড়ির কাঁটা তথ্য উপাত্যহীন গল্পের শুদ্ধতা মাথার ভেতর আলোড়ন তুললে তিনি চোখ বুজে পারিপার্শি¦ক বীভৎসতার সঙ্গে গল্পের বীভৎসতা কিংবা পলায়নপর মানুষের চেতনার জায়গায় পৌঁছার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিজের ভেতর থেকে আসা অজস্র প্রশ্নকর্তার প্রশ্নেগুলো আপন সত্তাকেই যেন বিপর্যস্ত করতে চাইছে আবারও–
নৈপথ্য: সুন্দর গল্প ফাঁদছেন।
কবি: উপহাস?
নৈপথ্য: না তা না। কীভাবে একটা রেখাচিত্রকে কল্পনা করে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন খোলসপরা নগ্নতা, তা ভাবছি।
কবি: ভাবনার কী আছে। জানই তো দাসত্ব আমাদের উত্তরাধিকারে নেই। তবে যে চাপ চাপ অন্ধকার বুকের ভিতর আধিপত্য বিস্তার করে আছে তার মোড়ক উন্মোচন করছি মাত্র।
নৈপথ্য: মোড়ক উন্মোচন হবে না। বরং আরেকটা রহস্যের খোলস মুড়িয়ে দেবে।
কবি: সেটাও যদি হয় ভাববো সার্থক হয়েছে।
নৈপথ্য: প্রাকৃত মানুষের বানিয়ে বলা গল্প এখন খুবই সার্থক। কেউ কেউ তাকে পুরাণ বলে।
কবি: ওরা বানিয়ে বলতো না। বাস্তবতা উপলব্ধি করেই বলতো। আড়াল করার প্রবণতা থেকে উপমা উৎপ্রেক্ষার সাহায্য নিত- এই যা।
নৈপথ্য: তোমার গল্প তেমনই নাকি?
কবি: হ্যাঁ।
নৈপথ্য: কিন্তু মনে তো হচ্ছে একটা সত্যকে দলিত-মলিত করে তোমার চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে একটা গল্প লিখছো যেখানে মিথ্যে অনুভূতির প্রকাশ।
কবি: দেখো, আমি সত্য কিংবা ইতিহাস দলিত-মলিত করিনি। কিংবা কোনও ইহুদি পণ্ডিতের পরামর্শে ইবনে হারেস ও ওকবা ইবনে আবী মুরীর হয়ে মুহম্মদ (সা.) কে প্রশ্ন করে তাঁর উম্মতকে বিভ্রান্ত করতে চাইনি। আমি পূর্বেই বলেছি আবারও বলছি আমি গল্প শুনাতে চাচ্ছি- যা এই সময়ের গল্প।
নৈপথ্য: হা..হা..এই সময়ের গল্প না ছাই। তুমি ধর্ম আর গণ্ডার এক করতে চাইছ… চাইছ….!
কবি: ও না, তোমরা যে আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছ, আমার চেতনায় কুহক সৃষ্টি করে খেই হারিয়ে দিতে চাইছ তার বিস্তৃতি ঐশ্বরিক প্রেসে ছাপানো মাত্র তিনটি আয়াত। সেটা কি তোমরা জান?
নৈপথ্য: হ্যাঁ জানি। আর জানি বলেই নিষেধ করছি।
কবি: আর আমি শুনছি না কারণ- একটু আগে তোমরা বলেছিলে আমি ধর্ম ও গণ্ডার এক করে দিতে চাইছি। চোখমুখ খোলা থাকলে তোমরা নিশ্চয় দেখবে আমার দেশের প্রতিটি মানুষ তাই করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গল্পটা তেমন মানুষের এমন অনুভূতিতে আঘাত হানুক আমি চাই।
নৈপথ্য: কিন্তু?
কবি: কিন্তু কী? স্মরণ করতে পার দেশের মুক্তিকালীন মুহূর্ত-ধর্ম, মুক্তি আর প্রতিশোধ প্রবণতা মিশে গিয়ে কেমন ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে আমাদের ধর্ম হয়ে উঠেছিল ধর্ম। আর অন্য ধর্ম হয়েছিল অধর্ম। তাই তো আমাদের ধার্মিকেরা বিধর্মিকে ধর্ষণ করে বলেছে- বলাৎকার।
নৈপথ্য: সেটা ওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়েছিল। তবু…?
কবি: তবু, সেটা হওয়া স্বাভাবিক তাই না! কিন্তু দুধ আর রক্তস্রোত বয়ে যাওয়ার দৃশ্য কখনও স্বাভাবিক না?
নৈপথ্য: আমরা তা বলিনি।
কবি: তোমরা তা বলনি। কিন্তু তোমরা কি দেখেছো ক্ষমতার উন্মাদনা? দেখেছো অথর্বের হাতে নতজানু পৃথিবীর আহাজারি। বলো তোমরা কার সত্তা হয়ে কাজ করছো?
নৈপথ্য: তোমার। কারণ তোমার কাঠামো একটু হলেও ঐশ্বরিক।
কবি: অহ..আবার! হ্যাঁ ঐশ্বরিক এজন্যই ওদের আবারও জীবিত করে আনতে পারি কোনও ধরনের প্রশ্নের উত্তর ছাড়া।
কবি বোঝেন না এ বিতর্ক কার সঙ্গে। আপন আত্মার সঙ্গে- না দেয়ালের ইট, বালু, সুরকির সঙ্গে; না অবিরাম লিখে যাওয়া খাতা কলমের সঙ্গে। নিস্তেজ কবি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
চিন্তার জাল পাখির ডানায় উড়তে উড়তে পৌঁছে যায় গুহাবাসীর কাছে।নগ্নতার নতুনপাঠ
ঘুমন্ত গুহাবাসী জেগে উঠলে তাদের চোখে সূর্যের আলো রহস্যের মতো লাগে। সদ্যপ্রসূত শিশুর অনুভূতি যেন ওদের মধ্যে বিরাজমান। ওরা কোথায়? গুহার সুরঙ্গ থেকে দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো প্রাসাদ। এগুলো ঝোপঝাড় নাকি প্রাসাদ তারা ঠাহর করতে পারছে না। তবে বেশ কিছু সময় অতিক্রম হলে তারা ক্ষুধা অনুভব করে।
ধীরে ধীরে গুহার গর্ত বেয়ে আসা সূর্যরশ্মি তাদের চোখে সংবেদন হয়। দূরের বড়ো বড়ো প্রাসাদকে তারা প্রাসাদই ভাবতে শুরু করে। তবে রহস্যের জাল ছিঁড়ে তারা বেরোতে পারে না। পাহাড়ের পাদদেশে এই সুরঙ্গে যখন তারা ঢুকেছে তখন এখানে অরণ্য শোভিত এক ভৌতিক পরিবেশ ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? ক্ষুধা এক সময় বিদ্রোহীদের বের করতে বাধ্য করে। ১ম বিদ্রোহী হাঁটতে হাঁটতে এক দোকানের সামনে গিয়ে দোকানিকে বলে–
১ম বিদ্রোহী: ভাই আমাকে কিছু রুটি দেন ।
দোকানি লোকটার মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বিদ্রোহী মুদ্রা বের করে দিলে দোকানির চোখের বিস্ময় আরও বেড়ে যায়। মুদ্রা হাতে নিয়ে দোকানি পথ আটকে দিয়ে বলে-
দোকানি: এরকম মুদ্রা আপনার কাছে আর আছে?
১ম বিদ্রোহী: জি না। যে কটা ছিল দিয়ে দিয়েছি।
দোকানি: ভাই আপনার কাছে যদি আর থাকে আমাকে দিয়ে দেন আমি আপনাকে অনেক রুটি দেবো।
১ম বিদ্রোহী: আমার কাছে যে আর নাই ভাই।
দোকানি: আপনার সুবিধার জন্যই বলছি। যদি থাকে দিয়ে দেন লাভ হবে। অন্য কোনওখানে যদি বের করেন সমস্যা হবে। আমি বলেই এ মুদ্রা দিয়ে রুটি দিচ্ছি। অন্য কেউ হলে দিত না।
১ম বিদ্রোহী: আমি সত্যি বলছি আমার কাছে আর নাই ।
দোকানি: কোথায় পেয়েছিলেন?
১ম বিদ্রোহী: আমাদের কাছে ছিল।
দোকানি: আমাদের কাছে ছিল মানে আরও নিশ্চয় আছে?
১ম বিদ্রোহী: বিশ্বাস করুন আর নেই আমাদের সবার কাছে এই সামান্য কটা মুদ্রা ছিল ।
দোকানি: আমার কথা দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করেন। এই মুদ্রা দিয়ে সবাই আপনার সঙ্গে বিনিময় করবে না। তার চেয়ে আমাকে দিয়ে দেন টাকা বানিয়ে দিই।
বিদ্রোহী: খোদার কসম ভাই আমার কাছে আর নেই।
বিদ্রোহী দোকান থেকে বের হতে চাইলে দোকানি পথ আটকে দাঁড়ায়। বিদ্রোহী নিজেকে আগলে নেবার জন্য বার বার কসম কাটে। কিন্তু দোকানির লোভের দেয়াল বিদ্রোহী নাড়াতে পারে না। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি বার বার হতে থাকে-
১ম বিদ্রোহী: বিশ্বাস করেন আমার কাছে আর নেই। আমাকে দয়া করে আটকাবেন না। আমার সঙ্গীরা বড়ো ক্ষুধার্ত, সঙ্গে আমিও।
দোকানি: একটা রুটি খেয়ে ফেলেন।
১ম বিদ্রোহী: আমার কণ্ঠনালি বেয়ে খাবার নামবে না। কারণ ওরা অপেক্ষা করছে।
দোকানি: তারা কোথায়, জায়গার নাম বলো আমি খাবার পাঠাচ্ছি।
১ম বিদ্রোহী: দেখুন আপনি বড়ো বাড়াবাড়ি করছেন। আপনার দোকান থেকে খাবার কিনে নিশ্চয় আমি পাপ করিনি। আমাকে যেতে দিন।
দোকানি: দিবো না। আমাকে বলে যেতে হবে ওরা কোথায়, আমি দেখা করে আসবো।
বিদ্রোহী: আপনি কী বিশ্বাস করেন- আমাকে বলেন। আমি তার দোহাই দিয়ে বলি, পরে বিশ্বাস করবেন।
দোকানি: কসমটসম করে লাভ হবে না। আমাকে চুপচাপ বলেন নয় নগররক্ষি ডেকে এনে রাজদরবারে পাঠিয়ে দেবো। ওরা সারারাত প্রহার করলে বুঝবে আমাকে না জানানোর কষ্ট।
১ম বিদ্রোহী: আপনি একজন দোকানি হয়ে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে পারেন না। পৃথিবীর কোনও বিক্রিতা তার ক্রেতার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে না।
দোকানি: নীতিকথা বলতে হবে না। বলেন, না হলে চোর বানিয়ে ধরিয়ে দেবো। আমাদের এখানের চোরের শাস্তি কী জানেন তো? সরাসরি হাত কাটা!
ওদের কথা এক সময় উত্তেজনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ সময় রাস্তা দিয়ে এক নগররক্ষি এলে দোকানি কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু রক্ষি সোজা দোকানের দরজায় এসে তাদের নীরবতায় হানা দেয়।
নগররক্ষি: এখানে কী হয়েছে?
দোকানি: জি, কিছু না।
নগর রক্ষি: তাহলে চেঁচাচ্ছিলে কেন? আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে কেন নীরব হয়ে গেলে? নীরবতার ভাষা তো বড়ো বিচিত্র, বড়ো বহুমুখি। বলো কী হয়েছে?
১ম বিদ্রোহী: ভাইজান আমি উনার কাছ থেকে কিছু রুটি কিনে দাম দিলে উনি আমাকে আরও মুদ্রা দিতে বলেন। এমন কী…!
দোকানি: মিথ্যে কথা উনার কাছে আমি কিছু টাকা পাই, গত আষাঢ়ে বউ অসুস্থ বলে নিয়ে লাপাত্তা। কোত্থেকে এখন বেশ ধরে এসে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, ভাবছে আমি চিনবো না। আরে আমার চোখ শকুনের চোখ…।
নগররক্ষি: চুপ ব্যাটা হরবর করে কথা বলিস না। ওই লোকটার কথা বিশ্বাস যোগ্য। এই আপনি মুদ্রার কথা কী বললেন?
দোকানি: না তেমন কিছু না।
নগররক্ষি: তোমাকে চুপ করতে বলছি না?
বিদ্রোহী: আমি রুটির বিনিময়ে যে মুদ্রা দিলাম উনি শুধু শুধু চাইলেন আমি যেন আরও …।
দোকানি: রুটির দাম হয়নি তো আরও চাইবো না?
নগররক্ষি: আমি কাক না যে, কোকিলের চালাকি বুঝবো না। তোর চোখের ভেতর ধূর্তামি লুকানো, সত্যি করে বল — কী? দেখি কী মুদ্রা দিয়েছে। দাম হয় না কীভাবে?
দোকানি হাতের ভেতর থেকে মুদ্রা লুকাতে চেষ্টা করে এবং ক্যাশবক্স থেকে অন্য মুদ্রা দেখাতে চায়। বিদ্রোহী বলে ওঠে–
বিদ্রোহী: উনি মুদ্রা লুকাতে চেষ্টা করছেন।
নগররক্ষি: দেখি হাতের মুঠোয় কেমন মুদ্রা?
দোকানি দেখাতে চায় না। নগররক্ষি লাঠি উঁচিয়ে ধমক দিলে মুঠোর ভেতর থেকে, দোকানি দেখায় আশ্চর্য মুদ্রাটি। রক্ষি পকেট থেকে রুটির দাম বের করে দোকরি মুখের ওপর ছুঁড়ে মারে, বিদ্রোহীকে টেনে টেনে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে–
নগররক্ষি: এই মুদ্রা কটি কোথায় পেয়েছেন?
বিদ্রোহী: আমার কাছে ছিল।
নগররক্ষি: আর কয়টা আছে?
বিদ্রোহী: বিশ্বাস করেন আমার কাছে আর নেই ।
নগররক্ষি: তুমি তো দেখলে তোমার জন্য আমি ঝগড়া করলাম। এখন তুমিই যদি আমার সঙ্গে এমন করো আমার পরিশ্রম বৃথা যাবে না?
বিদ্রোহী: খোদার কসম বিশ্বাস করেন…!
নগররক্ষি প্রথমত কোমল স্বরে বুঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু কোনও সত্যতাই প্রকাশ করতে পারে না। কারণ লোভের ভেতর সত্যভাষণ বরাবরই ম্রিয়মাণ। ধীরে ধীরে নগররক্ষি উত্তেজিত হতে থাকে। কিন্তু তার এই উত্তেজনা বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। অন্য একজন রক্ষি হাজির হয় সামনে।
২য় নগররক্ষি: কী করছো তুমি?
১ম নগররক্ষি: না কিছু না।
২য় নগররক্ষি: কিছু না মানে? ওই দোকানের লোকটা তোমার সম্পর্কে আমাকে বলেছো। এখন বলো কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছো?
১ম নগররক্ষি: না ও খুবই শক্ত, মরে যাবে তবু তার গোপন অনুষঙ্গের সংবাদ দেবে না। আশ্চর্য তার প্রাণশক্তি। জেনেই যখন ফেলোছো এসো ওকে নিয়ে নির্জন কোনও স্থানে চলে যাই।
২য় নগররক্ষি: কেন, নির্যাতন করে দেখবে কিছু মিলে কি না? তোমার এই বাসনা পূর্ণ হবে না। কারণ দোকানি বলেছে সে খেতে পারেনি তোমাকেও খেতে দেবে না। দেখি আশ্চর্য ওই মুদ্রা।
১ম নগররক্ষি: ওটার দিকে লোভ দেখালে হবে না। কারণ আমি অর্থের বিনিময়ে কিনেছি। দোকানি বাড়াবাড়ি করলে তো হবে না।
২য় রক্ষি: জানি না, কে বাড়াবাড়ি করছে। তবে এটাতো সত্য বানরের খাবার, বাঘ কেড়ে নিলে বানর নীরব থাকে না। গাছ থেকে ডাল ভেঙে ফেলতে না পারলেও মুঠো মুঠো পাতা ছিটায়।
১ম নগররক্ষি: সেই পাতার আঘাতে বাঘের কিছুই হয় না।
২য় বিদ্রোহী: হয় না তবে তোমার হবে কারণ তুমি বাঘ না- মিঁয়াও মিঁয়াও।
১ম নগররক্ষি: তুমি কি আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে ..?
২য় নগররক্ষি: মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক না। কারণ বৃত্তবেদী ভাবনা সবাই করতে পারে না। চলো।
১ম নগররক্ষি: কোথায়?
২য় নগররক্ষি: ওকে নিয়ে রাজার কাছে ।
১ম নগররক্ষি: ব্যাপারটা এখানেই নিষ্পত্তি করা উচিত।
২য় নগররক্ষি: উচিত কি না জানি না। তবে রাজার কাছে নিয়ে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ তুমি যত গোপন করতে চাইবে তত বেশি তোমার বিপদ ডেকে আনবে।
১ম নগররক্ষি: তুমি চাইলে তোমাকে ভাগ দিতে রাজি আছি। এসো কিছুক্ষণ জেরা করে যদি আরও কিছু পাই আমূল বদলে যাবে তোমার আমার জীবনাচার।
২য় নগররক্ষি: আমার কোনও ইচ্ছে নেই, আমি এইখানেই ভালো আছি। প্রতিদিনের একটা ধারাবাহিকাতা সৃষ্টি হয়েছে। যদি বদলাতে যাই আমার তো সমস্যা হবেই, সঙ্গে অন্যদের।
১ম নগররক্ষি: কেন, তোমার টাকার কোনও দরকার নেই?
২য় নগররক্ষি: আছে, তবে যে টাকা হবে আমার রক্তের মূল্যে কেনা!
ওরা কথোপকথনের মধ্যে ডুবে যায়। বিদ্রোহী নিঃশব্দে চলে যেতে পা বাড়ায়। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারে না। ২য় রক্ষি বলে–
২য় নগররক্ষি: এই আপনি কোথায় যাচ্ছেন? দেখেন না আপনাকে বাঁচানোর জন্য তর্ক করছি। যেতে হলে আমার সঙ্গে চলুন।
বিদ্রোহী: ভাই ক্ষুধায় আমার পাকস্থলি জ্বলছে। আমার আরও দুজন সঙ্গী অপেক্ষা করছে। তারাও ক্ষুধার্ত। বোবা কুকুরটাও বড়ো বেশি চেঁচাচ্ছে নিশ্চয় ।
২য় রক্ষি: ঠিক আমার সঙ্গে চলুন যেখানে যেতে চান চলে যাবেন।
১ম রক্ষি: না উনি আমার সঙ্গে যাবেন।
২য় রক্ষি: নিজেকে ইতর বানাতে চাচ্ছ কেন। তোমার স্বভাবতো এটা নয়, সামান্য একটা মুদ্রা নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
১ম রক্ষি: নীতিকথা আমাকে শুনাতে হবে না। ওকে আমি বাজপাখির মতো চিনিয়ে এনেছি স্ব-উদরে পাঠাতে। কারও গরাসে যাক, আমি চাই না ।
২য় রক্ষি: এমনটা নিশ্চয় দোকানিও চাইতো না?
১ম রক্ষি: আশ্চর্য তুমি সামান্য দোকানিকে পাত্তা দিচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে হাত মিলাও, দয়া করে ভুলে যেয়ো না আমি তোমার সঙ্গে কাজ করি। বন্ধু ভাবতে তোমার কোনও আপত্তি না থাকলে আমার কোনও আপত্তি নেই।
২য় রক্ষি: না। এই আপনি আমার সঙ্গে চলেন।
বিদ্রোহী: কোথায়?
২য় রক্ষি: রাজার কাছে।
সমস্ত অন্তরাত্মা যেন পানি হয়ে যায় বিদ্রোহীর। রাজা শব্দটা যেন কানের মধ্যে উত্তপ্ত সিসা হয়ে ঢোকে। অথর্ব রাজার এক দৃশ্যমান জগৎ চোখের সামনে এসে হাজির হয়। বিদ্রোহী নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ২য় রক্ষি বিদ্রোহীর হাত ধরে টেনে টেনে রাজার কাছে নিতে পা বাড়ালে, ১ম রক্ষি হিংস্র বাঘের মতো এসে সামনে দাঁড়ায়।
১ম রক্ষি: না ও যাবে না। ওর ভেতর থেকে সমস্ত সত্য আমি খুড়ে খুড়ে বের করবো।
২য় রক্ষি: বড়ো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তুমি ভাবতেও পারছো না বেশি খোড়াখুড়ি করলে গোক্কুর বের হয়ে ছোবল মারবে।
১ম রক্ষি: সে বিষ আমি হজম করার ক্ষমতা রাখি।
দুজনার মধ্যে তুমুল মল্লযুদ্ধ বেঁধে যায়। বিদ্রোহী দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারে না। দোকানি এসে তাকে ধরে ফেলে।
১ম রক্ষি: আমি বুঝেছি তোমরা ফন্দি করে এসেছো। আমার কাছ থেকে ওকে মুক্ত করে নেবার জন্য। খোদার খসম আমি বেঁচে থাকতে ওকে আমার সামনে থেকে নিতে পারবে না।
ঝগড়া বেঁধে যায়। দোকানি ধরে থাকে বিদ্রোহীর হাত। ২য় রক্ষিকে কোনও ভাবেই কাবু করতে পারে না, ১ম রক্ষি দোকানির মাথা বরাবর আঘাত করে। কিছুক্ষণ তড়ফাতে তড়ফাতে মারা যায় দোকানি। হাত ছাড়া পেয়ে দৌড়াতে থাকে বিদ্রোহী। তাদের পিছু পিছু দৌড়ায় রক্ষিদ্বয়। নগরের মানুষ দেখে তাদেরকে। তবে উন্মাদনার কারণ খুঁজে পায় না।
ফিরে আসা বিস্ময়ের দেশে
বিকালের সূর্য যখন ডুবে যায় রাজশালায় বসে সমস্ত দিনের হিশাবনিকাশের বৈঠক। পূর্ব পশ্চিম ঈশান অগ্নি নৈঋতের সমস্ত সংবাদ উপস্থাপন করে বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীরা চলে যায়। কেউ কেউ আগামী সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কর্মসূচি উপস্থাপন করে। রাজা হুইল চেয়ারে বসে তার প্রধান অনুচরকে আলদাভাবে রাজ্যসংক্রান্ত তথ্য জানতে প্রশ্ন করেন–
রাজা: সমস্ত দিনের সংগতি-অসংগতি কী দাঁড়ায়?
অনুচর: আজকের সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় শখানেক!
রাজা: সহনিয়ো।
অনুচর: বিদ্রোহী খুন হয়েছে একশো নব্বই জন। যাদের কোনও তথ্য-উপাত্ত যাতে না পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজা: চমৎকার।
অনুচর: আমাদের পক্ষের একজন কেরানি খুন হয়েছে! কে-বা কারা খুন করেছে কালকের ভেতর খুঁজে বের করা হবে। না হয় তিনশো নগররক্ষি বহিঃষ্কার করে দেওয়া হবে। তবে এর ভেতরেও একটা সূক্ষ্ম চাল খেলা হবে, যারা বহিঃষ্কার হবে তারা সকলই থাকবে আমাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এমন নগররক্ষি। ইতোমধ্যে এরকম অনেকেরই নাম লেখা হয়েছে। এবং খুঁজে বের করার জন্য কঠোরভাবে আদেশ করাও হয়েছে।
রাজা: চমৎকার।
অনুচর: রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কিছু টাকা বর্ধিত হয়েছিল, আমাদের অর্থমন্ত্রী নীরবে কিছু টাকা আপনার ব্যক্তিগত একাউন্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। ব্যাপারটা আমি আর মন্ত্রী ছাড়া কেউ জানে না।
রাজা: আর?
অনুচর: উত্তরপাড়ার প্রধান উজির বিপ্লবী হতে পারে বলে আপনাকে জানানো হয়েছিল, আপনি বলেছিলেন যদি নতুন কোনও বিপ্লবী দল উত্তরপাড়ায় গঠন হয় ওইদিন যেন তাকে খুন করা হয়। আমি ব্যাপারটা নিয়ে অন্য কারও সঙ্গে আলাপ করিনি। আজকে চাই ছিলাম কিন্তু…।
রাজা: কিন্তু কী?
অনুচর: আজকেই একটা সমস্যা হয়েছে।
রাজা: কী সেটা?
অনুচর: উত্তরপাড়ার দুই নগররক্ষি মারামারি করে প্রচ-ভাবে রক্তাক্ত হয়েছে। খুন হয়েছে এক দোকানি। সমস্ত নগর এ হত্যা নিয়ে খ্যাপে গিয়েছিল আমরা ক্রসহত্যা বলে ঘোষণা দিয়ে পরিবেশ শান্ত করেছি।
রাজা: খুনটা কেন হলো?
অনুচর: অপরিচিত একলোক নাকি ওই দোকানির দোকানে তিনশো বছর আগের মুদ্রা নিয়ে রুটি কিনতে চাইছিল। দোকানি লোকটাকে আটকে রেখে তার কাছ থেকে মুদ্রা ইতিহাস জানতে চায়। ঘটনায় এসে, উত্তরপাড়ার এক নগররক্ষি হাজির হয় এবং লোকটাকে দোকানির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক নির্জন জায়গায় জেরা করতে থাকে। ওদিকে চতুর দোকানি আরেক নগররক্ষির সঙ্গে চুক্তি করে ওই রক্ষিকে সংবাদ জানায়। তার পর দুই রক্ষির সঙ্গে কেমন কথা হয়েছিল জানা যায়নি। ধারণা করা হয়েছে রক্ষি দুজন এক হয়ে দোকানিকে খুন করেছে, ওই অচেনা লোকটার কাছ থেকে মুদ্রা উদ্ধার করে দোকানিকে ভাগ দেবে না বলে। এই তথ্যটা অনেকেই বিশ্বাস করছে না। ব্যাপারটা নিয়ে রাজ্যজুড়ে ফিসফাস শুরু হয়েছে। কেউ কেউ মিথ্যা-সত্য এক করে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছে।
রাজা: রক্ষিদ্বয় কোথায়?
অনুচর: ওদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। এবং নরহত্যার বিচারস্বরূপ ওদের একজনকে দোষী প্রমাণ করে ফাঁসি দেওয়া হবে। সবচেয়ে ভালো হবে আগন্তুক কে হত্যা করতে পারলে, কিন্তু আগন্তুকের আসল পরিচয় না জানা পর্যন্ত তো আর এ কাজ করা যাবে না। অপনি বললে আমরা অপেক্ষা করে করতে পারি। পরে যদি দেখা যায় সে আসলে আমপাবলিক তা হলে তাকে দিয়ে খেলাটা জমবে ভালো।
রাজা: প্রস্তাবটা মন্দ না। কারণ নগররক্ষিরা তো আমাদের, ওদের দরকার আছে। তবু আমাদের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য ওদের খুন করা যেতেই পারে। কথা হলো ওই লোকটা কোথায়?
অনুচর: ও বন্দি আপনার অনুমতি পেলে ডেকে আনতে পারি।
রাজা: যাও নিয়ে এসো।
অনুচর বের হয়ে বিদ্রোহীকে গিয়ে নিয়ে আসে। বিদ্রোহীর সমস্ত শরীরে আঘাতের চিহ্ন। হাত-পায়ে শিকল পরানো। রাজা বিদ্রোহীরকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নেন তার পর অনুচরের চোখে চোখ রেখে বলেন–
রাজ: মুদ্রাগুলো কোথায়?
অনুচর: আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে। ওদের ভাষ্য মতে তিনশো নয় বছর আগে রাজা দাকিয়ুসের আমলে এ মুদ্রা প্রচলিত ছিল।
রাজা: তা হলে ও পেলো কোথায়?
অনুচর: সেটা একটা বিস্ময়।
রাজা: নিশ্চয় কোনও মিউজিয়াম থেকে চুরি করেছে, ওকে হাত পা বেঁধে পিটানো শুরু করো এবং সত্য সন্ধানের জন্য দেশের সকল মিউজিয়ামে খবর নাও।
অনুচর বিদ্রোহীর পাশে এসে বলে–
অনুচর: কোথায় পেয়েছিস বল?
বিদ্রোহী: আমাদের কাছে ছিল।
অনুচর: কী রাজার সামনে এসেও মিথ্যে কথা। সত্যিই তোর স্পর্ধার ভিত দেখে অবাক হতে হয়।
রাজা হুঙ্কার দিয়ে, হুইল চেয়ার চালিয়ে বিদ্রোহীর সামনে গিয়ে হাজির হন। এবং ডাহুকপাখির মতো লাল চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলে বিদ্রোহী বলে ওঠে–
বিদ্রোহী: আমি খুব ক্ষুধার্ত রাজা। আমাকে একটু খাবার দাও রাজা আমি আমার রহস্যের ভেদ নিজেই আবিষ্কার করতে পারছি না।
রাজা: না খাবার দেওয়া যাবে না। আগে বল কোথায় পেয়েছিস? তার পর দেখা যাবে।
বিদ্রোহী: বলবো রাজা সব কথাই বলবো। বিশ্বাস করেন আমি বড়ো ক্লান্ত। আমার কণ্ঠ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সমস্ত দিনের নির্যাতন আর ক্ষুধা আমাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে। দয়া করে যদি আমাকে একটু…।
রাজা: না একটুও না। আগে বল কোথায় পেয়েছিস?
বিদ্রোহী: তা হলে একটু পানি।
রাজা: না তাও না। পানির তৃষ্ণায় কণ্ঠ কাঠ হয়ে গেলে সত্য বের হবে। কারণ আমি জানি প্রাণ বেরুবার আগে সত্য সঙ্গে নিয়ে বের হয়।
বিদ্রোহী: বলবো রাজা বলবো সব বলবো। আমাকে আগে বাঁচান। একটা মুদ্রার রহস্য আবিষ্কার করতে গিয়ে একজন মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হবে, প্রাণের চেয়ে কি বস্তু এত মহৎ?
রাজা: প্রশ্ন কিংবা উত্তর নয় — যা বলছি তার জবাব দাও।
বিদ্রোহী: যদি সত্য মনে করেন তাহলে বলতে পারি। রাজা আজ থেকে কত দিন আগে আমি বলতে পারবো না। আমি এবং আমার সঙ্গে আরও দুজন সঙ্গী এক অত্যাচারী রাজার কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে ছিলাম। রাজার অত্যাচারের হিংস্রতা এত তিক্ষ্ন ছিল যে, আমাদের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ চোখের সামনে ফালা ফালা হয়ে গিয়েছিল। আমরা তার দাস্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে ছিলাম। একরাত্রে যখন রাজ্যশুদ্ধ মানুষ মাতাল উৎসবে ব্যস্ত- আমরা পালিয়ে আসি সেখান থেকে। তারপর খোদার দরবারে শেষ মিনতি করে এক জোড়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী সুরুঙ্গে ঢোকে ঘুমিয়ে পড়ি । ঘুম থেকে উঠে আমরা ক্ষুধা অনুভব করি; আমাদের কাছে যত মুদ্রা ছিল তা দিয়ে খাবার কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু…
রাজা: সুন্দর গল্প। যা রূপকথাকেও হার মানায়।
বিদ্রোহী: এজন্যই বিশ্বাস করতে বলিনি, বলেছি যদি সত্য মনে করেন।
রাজা : সত্য মনে করলাম এখন বল জোড়া পাহাড়টা কোথায়?
বিদ্রোহী: আমি ঠিক বলতে পাবরো না। যে দোকানি আমাকে আটকে রেখেছিল, তার ঠিক সামনের দিকে হাঁটলে কিছুক্ষণের রাস্তা। তবে ওখানে আর জোড়া পাহাড় দেখা যাবে না, ছোট ছোট দুইটা টিলা। টিলার ঠিক মধ্যে।
রাজা: রক্ষি, ওখানে লোক পাঠাও।
এবং অনুচরের দিকে তাকিয়ে বলেন—
রাজা: সঙ্গে তুমিও যাবে। যদি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়। একটাও যেন না হারায় তুমি ঠিক ঠিক এনে আমাকে দেখাবে।
অনুচর: রাতটা অপেক্ষা করলে হয় না?
রাজা: না হয় না। রহস্য যত তাড়াতাড়ি উন্মোচন করা যায় তত মঙ্গল। তাছাড়া এখানে রাজ্যের উন্নয়ন জড়িত। যাও ফিরে এসে আমাকে ডাকবে। ও এখানে বন্দি থাক।
রাজাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ঠেলে ঠেলে বিশ্রামাগারে রেখে অনুচর তার দলবল নিয়ে অন্ধকার রাতের ভেতর বের হয়। তাদের কারও হাতে মশাল, কারও হাতে অস্ত্র। শূন্য রাজশালায় বসে বসে বর্তমানের সঙ্গে অতীত মিলায় বিদ্রোহী। ওদের ভাষ্য মতে তিনশো নয় বছর আগের মুদ্রা ছিল তার কাছে। এ সত্যিই রহস্য! যা তার ভাবনা উন্মোচিত করার ক্ষমতা রাখে না। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে রহস্যের ডানায় চড়ে আপন মনের অভিব্যক্তি আওড়ায়।
নীরব কেন কেন বিধি
নীরব কেন তুমি
এ কোন ভাঙন দিয়ে ভাঙাও
আমার মনোভূমি।
মাটির ওই আন্ধারেতে
বাঁচাইলা মাটি
মাটির উপর রাইখা
তুমি দস্যুতারই ঘাঁটি
তিন নয় ছুঁয়ে বছর গেলো
একই রকম কেন ভূমি।
গানের প্রতিটি শব্দ টুকরো টুকরো যন্ত্রণা হয়ে বের হয় তার বুকের ভেতর থেকে। খাঁ-খাঁ শূন্যতার ভেতর সে যেন এক আশ্চর্য রথযাত্রী। কোথায় এর পরিসমাপ্তি সে জানে না। তার দেহ আর চেতনার ভেতর যোজন যোজন ফারাক, এই মধ্যস্থিত দূরত্ব যখন কমতে থাকে সে নিজেই আবিষ্কার করে তার অনুভবের প্রাসাদ-কক্ষে লক্ষ লক্ষ বৃশ্চিক কিলবিল করছে। যেন খুবলে খুবলে খেতে চায় তার মন-স্তিষ্কের সকল আশা আকাক্সক্ষা। দেহের প্রতিটি কোষে কোষে সৃষ্ট যন্ত্রণার হিংস্রতা তাকে পৌঁছে দেয় নরকে। চোখটা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করালে হঠাৎ আটকে যায় অনুচরের ওপর, অনুচর ঠাস করে একটা চড় দিয়ে বলে–
অনুচর: মিথ্যাবাদী! তোর মিথ্যে গল্পের জন্য মধ্যেরাত্রে আমাদের গুহা খুঁজতে হলো।
বিদ্রোহী: বিশ্বাস করো আমি মিথ্যে বলিনি।
অনুচর: আবারও মিথ্যে কথা ।
বিদ্রোহী: দয়া করে আমাকে আর মেরো না। আমার সমস্ত শরীর ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আর তোমাদের অত্যাচারে ক্লান্ত। বিশ্বাস না হলে আমাকে নিয়ে চলো আমি খুঁজে দেবো।
অনুচর: চুপ একবার বলেছিস আর বলিস না।
বলেই বের হয়ে যায় অনুচর। একটু পরে রাজাকে নিয়ে আসে। রাজা বিদ্রোহীর দিকে তাকিয়ে বলেন-
রাজা: মিথ্যে বললি কেন?
বিদ্রোহী: আমি মিথ্যে বলিনি।
রাজা: তাহলে ওরা পায়নি কেন?
বিদ্রোহী: ওরা জায়গা চিনতো ভুল করেছে হয়তো।
অনুচর: না রাজা আমরা শুধু ওই জায়গাই খুঁজিনি এর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের আশেপাশের প্রায় অনেক জায়গা খুঁজে এসেছি। এতে করে বনে হারানো নুড়িপাথরও খুঁজে আনা সম্ভব ছিল। কারণ আমরা ছিলাম প্রায় শ’খানেক।
বিদ্রোহী: এই রহস্য আমার দ্বারা ভেদ করা সম্ভব না, রাজা আমার আল্লাই ভালো জানেন।
রাজা: অলৌকিকতার দোহাই দিয়ে আমার চেতনায় জায়গা করা যাবে না। সত্যটা কী বল?
বিদ্রোহী: আমি জানি কখনও বিশ্বাস করানো সম্ভব না। রাজা অনুমতি দিলে আমাকে সঙ্গে করে নিতে পারেন। আমি জানি মঙ্গলময় বিধাতা আমার পথ বের করে দিবেন। শুধু একটা মিনতি আমাদের বিচ্ছিন্ন করবে না। আমাদের যা আছে সব দিয়ে দেবো, বিশ্বাস করানোর জন্য আমরা আমাদের শেষ পোশাকটুকুও দিয়ে দেবো। প্রয়োজন হলে আমাদের গর্ত থেকে বের করে অন্য কোনও গর্তে চাপা দিয়ে দেবেন। আমাদের কোনও কষ্ট হবে না। তবু এই অসহ্য জায়গা থেকে আমাকে মুক্তি দিন।
অনুচর: মানে?
রাজা: যদি তোর সঙ্গে গিয়ে ওরা পথ না পায় ?
বিদ্রোহী: আমাকে টুকরো টুকরো করে কাক কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবেন। অথবা আপনাদের রাজ্যের পরিবেশ সামাল দেবার জন্য যা যা করার প্রযোজন তা-ই করবেন।
রাজা: এই তোমরা ওকে নিয়ে বের হও। কোথায় সেই জোড়া পাহাড়ের সুরঙ্গ বের করো। যদি সত্যি হয় তাহলে ওর সঙ্গীদের ধরে নিয়ে এসো। আর যদি না হয় ওকে বধ্যভূমিতে বেঁধে রাখবে, ও অনিদ্রা অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরবে।
রাজার নির্দেশে বিদ্রোহীকে নিয়ে বের হয় ওরা। বিদ্রোহী ওদের দ্রুত পায়ে হাঁটার সঙ্গে তাল দিতে পারে না। কারণ ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর নির্যাতন সহ্য করা দেহের প্রতিটি কলকব্জাই যেন বিকল হয়ে গেছে। অত্ম সংলাপ ৩
ওদেরকে গুহার খোঁজে পাঠিয়ে কবি আবারও নিজের প্রশ্নে নিজেই জর্জরিত হন। সমস্ত গল্পটাই যেন তার আত্মার সঙ্গে বিদ্রোহ। ওই গুহাবাসীর মতোই আঘাত করছে তাকে এবং তার পারিপার্শ্বিকতা।
নেপথ্য: রাজাকে পাঠাওনি কেন?
কবি: রাজাকে পাঠাইনি কারণ বিকলাঙ্গ একজন রাজা কোনও কারণেই মধ্যরাত্রে গুহা খুঁজতে যাবে না। সেখানে যত বড়ো বিস্ময়ই হোক না কেন।
নেপথ্য: কিন্তু উনিতো বিকলাঙ্গ ছিলেন না। কেউ কেউ উনাকে তুরস্কের একজন শক্তিশালী শাসক বলে মনে করে।
কবি: আমিও করি, তবে একটু ভিন্নভাবে। আমি চাই শক্তিশালী শাসক, একজন রাজা হোক।
নেপথ্য: তাহলে কেন?
কবি: কেনর জবাব তোমার কিংবা তোমাদের জানা। তবু বলছি। কারণ পৃথিবীর সবখানে এখন পঙ্গু এবং অথর্ব রাজাদের অভয়াশ্রম। যারা পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করতে ভালোবাসে ।
নেপথ্য: কথায় এত তেজস্বিতা কোথা থেকে পান, হ্যাঁ। আপন দীনতার খরব রাখেন?
কবি: কেন নয়। এই দীনতা তো আমোদেরই দুঃশাসনের ফসল। তাছাড়া দৈন্য আমি অর্থে হতে পারি মনে নই।
নেপথ্য: নিজের প্রতি খুব উচ্চমর্গীয় ধারণা তাই না। দাম্ভিকতার চূড়ান্ত রূপ আর কী।
কবি: দাম্ভিক আমি নই। আমি আত্ম-স্বাধীনতার জন্য যে ভাবে বড়ো বড়ো কণ্ঠে রেওয়াজ করি, অন্যের জন্যও করি।
নেপথ্য: তাহলে তুমি ওদের স্বাধীন করে দিলে না কেন?
কবি: দিইনি কারণ মনুষ্যরাজ্যে কেউ স্বাধীন নয়। এই যে আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে। প্যাডের কাগজ সরে যাচ্ছে। তাহলে স্বাধীনতার প্রশ্ন কীভাবে আসে?
নেপথ্য: তার মানে কী তুমি বলতে চাও সবাই গুহা আঁধারে বন্দি মানুষের মতো?
কবি: হ্যাঁ তাই, তবে অন্তরাত্মা দিয়ে প্রত্যাশা করি- সবাই স্বাধীন পাখির মতো উড়ুক, উড়ন্ত ঘুড্ডির মতো কেউ যেন নাটাই না ধরে ।
নেপথ্য: কেউ না-কেউ নাটাই ধরতে হয়, না হলে ঘুড়ি উড়ে না।
কবি: জীবন কোনও লেজকাটা ঘুড়ি নয় যে তাকে টান-ঢিলের মধ্যে আকাশে উড়াতে হবে। জীবনের একটা স্বভাবিক গতি আছে সেই গতিতেই জীবন জীবন হয়ে ওঠে।
নেপথ্য: তোমাকে যদি জন্মাবদি কোনও মাঠে ছেড়ে দেওয়া হতো তোমার স্বাভাবিক গতি স্বাভাবিক থাকতো? তোমার চেতনায় কি এমন কোনও ভাব উদয় হতো যা বিশ্বমানবের ভাবনা বলে চালাতে পারতে?
কবি: তোমরা কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কথা বলছো না। তোমাদের কথাবার্তা বড়ো বেশি আক্রমণাত্মক। তবে মনে রেখো সব জন্মেরই এক ধরনের স্বাভাবিকত্ব আছে। আমি চাই তার ভেতরকার দেয়াল ভেঙে যাক।
নেপথ্য: দেয়ালের মাঝে বড়ো হওয়াই ভালো অনেক ব্যাপারে যুক্তিহীনতা কে নিয়তি মনে করা যায়।
কবি: আমি তো সেই নিয়তির দ্বার উন্মুক্ত করতে চাই। তিনশো যোগ নয় বছরে যে নিয়তির কোনও পরিবর্তন হয় না। অন্ধকার, মৃত্যু, আঘাত, শীতনিদ্রা যে নিয়তির একমাত্র উপাদান। তবে পশুর মতো জেগে ওঠা নখের থাবা প্রদানকারীর নিয়তির রোশনাই আমাকে ভাবায়; তাই তো এই গল্পের ফাঁদ।
নেপথ্য: তোমার নীতি-আদর্শের কথায় সত্যই আমরা বিমোহিত…হা হা হা শোনাও দেখি পরে কী হয়।
কবি: কী আর হবে সেটাতো অনুমানই করতে পারো।
নেপথ্য: আমরা অনুমান করতে পারছি না- তুমিই অনুমান করে বলো। কারণ আমরা একটা বলয়ের ভেতর থাকতে পছন্দ করি। প্রচলিত নিয়ম নিয়ে উলটাপালটা কিছুই ভাবি না।
কবি: আমিও ভাবি না। তবে পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে সবকিছুকে-ই আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করি। সব ছাপার অক্ষর সব জীবনের জন্য সত্য হবে এমন না।
নেপথ্য: ওহ…আবার! তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। তুমি গল্প সাজিয়েছো ভালো কথা, তবে কিছু সত্য অনেকেই জানে তুমি পারলে এগুলি ব্যবহার করতে পারো। অনেকে গবেষণা করে অনেক গুহাতে কুকুরের হাড় ও মানবের হাড় পাওয়ার দৃশ্য নিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করে গেছেন। তুমি পারলে এর সত্যতা প্রমাণ করে মানবজাতিকে আরেকটা বিস্ময় দেখতে পারো। অথবা রাজার আশ্চর্য হওয়া এবং প্রার্থনালয় গড়ে তোলা নিয়ে কিছু বলতে পারো। তাহলে কিছুটা সত্যতার আঁচ পাওয়া যেতে পারে।
কবি: আমার চেতনাকে বিকল করে দিতে চাইছো কেন। আমি বলি না আমার মতো করে দুচারটি কথা। যদি অস্বাভাবিককতার ফুলঝুড়ি মনে করে মানুষ নর্দমায় ফেলে দেয় তাতে কি-বা যায় আসে।
কবি নিশ্চুপ হয়ে চোখ বুজে থাকতে চেষ্টা করেন। সকল কথাই যেন তার মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায়। এ-এক আশ্চর্য বোরাকে চেপে কবি আবার পৌঁছে যান বিদ্রোহীদের আত্মগোপন করা গুহায়। কখনও শাসিতদের কাতারে কখনও শোষিতদের কাতারে। গোলকধাঁধা অথবা সমাপ্তিপর্ব
অন্ধকার রাত্রিতে ওরা বিদ্রোহীকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ভীত এবং যন্ত্রণায় কাতর বিদ্রোহী আল্লাহর প্রার্থনা করে মনে মনে। রাজসৈন্যের পুঞ্জীভূত আক্রোশে বিদ্রোহীর উপর আরও প্রবল হয়। কেউ কেউ মধ্যরাত্রের ঘুমাক্রান্ত মানুষের মতো হাই তোলে। ঝিঝি পোকার ঝি ঝি শব্দে ঝিমমারা অন্ধকার রাত ওদের নিশ্বাস ভারী হয়। জোড়া পাহাড়ের পাদদেশে ওরা যখন পৌঁছায়, এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একজন একজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ওদের চোখ মুখের অভিব্যক্তির ভেতর যেই সত্য কিংবা রহস্যের মোড়ক উন্মোচিত হয় তার ভেতরকার সত্যতা কেউ কল্পনা করতে পারে না। বিদ্রোহী ওদের ঘোরলাগা অনুভবের ভেতর- আঙুল উঁচিয়ে সুরঙ্গ দেখায়।
১ অনুচর: সত্যিই তো।
২য় অনুচর: আমরা তাহলে কোথায় খুঁজেছিলাম? একটু আগে কি আমরা এখানে আসিনি?
১অনুচর: হ্যাঁ এসেছিলাম। কিন্তু?
২য় অনুচর: কোনও কিন্তু না, দেখি কী হয়।
বিদ্রোহীর দিকে চেয়ে-
২য় অনুচর: আচ্ছা আপনি বলেছিলেন, ভেতরে আরও দুজন মানুষ আছে।
বিদ্রোহী: হ্যাঁ শুধু মানুষ না একটা কুকুর আছে।
১ম অনুচর: এই কেউ একজন গিয়ে ওদের বের করে আনো।
অনুচরের এই কথা কেউ পালন করে না। কারণ সুরঙ্গের ভেতর অন্ধকারের মতোই ওদের মনে অন্ধকার জমে। কেউ ভয় পায়, কেউ ঈশ্বরের অপার রহস্যের সত্যতা নতুন করে স্বীকার করে । ইতোমধ্যে অনেকেই সরে যায় বিদ্রোহীর পাশ থেকে, বিদ্রোহী নিজেই যেন একটুকরো রহস্যের ভেতর সাদাকাগজ।
১অনুচর: কী হলো যাও না কেন?
বিদ্রোহী: ওরা ভয় পাচ্ছে। আমার মনে হয় আপনিও।
১অনুচর: রাজরক্ষির গুর্দা অনেক বড়ো। ওরা জ্যন্ত হায়েনার কলজে ছিঁড়ে খায়। এই তোমরা যাবে না। না গেলে আমি যাবো।
বিদ্রোহী: আপনি কিংবা আপনারা গেলে ওরা বের হবে না।
১অনুচর: তাহলে তুমি ডেকে আনো।
বিদ্রোহী: সেটাই ভালো ।
ত্রস্ত পায়ে বিদ্রোহী সুরুঙ্গে গিয়ে ঢোকে। রাজ অনুচরেরা যে যার মতো স্তব্দ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের কারও চোখ-মুখের ভয় কিংবা রহস্য মেশানু উদ্বেগ কারও চোখে পড়ে না। সবাই মশাল উঁচিয়ে দৃষ্টি নিবন্ধন করে, বিদ্রোহীর হাঁটা এবং ক্লান্ত শরীরের দিকে। বিদ্রোহী সুরঙ্গের ভেতর পা রেখেই চিৎকার করে বলে ওঠে–
বিদ্রোহী: হে খোদা তুমি এই সুরঙ্গ বন্ধ করে দাও। ওরা যেন প্রবেশ না করতে পারে। হে খোদা এই নরকের অনন্ত ঋতুতে চাই না আবার প্রত্যাবর্তন। এতে যদি আমাদের মৃত্যুটাই শ্রেয় মনে করো– আমাদের কোনও কষ্ট থাকবে না। এখনই মৃত্যুরদূত পাঠাও। মৃত্যুর অমৃত স্বাদ গ্রহণ করি।
সঙ্গে সঙ্গে এক বিকট শব্দে সুরঙ্গ মুখ বন্ধ হয়ে যায়। রাজসৈন্যরা কোনও কথা বলে না। একজন অরেকজনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ওদের
স্তব্ধকণ্ঠের মুখের ভেতর বিস্ময়ের ছায়া।
সমাপ্ত কথন
সবাই ফিরে যায় । অন্ধকারের ভেতর কবির হৃদয়, ওদের সুরে সুর তোলে–
ফুলে ফুলে যাক ভরে যাক
ঈশান অগ্নি নৈঋতে
বন্ধু ভাবের হোক না উদয়
সকল প্রকার বৈরিতে।
নীরব ঝড়ে আবাসন তার
ভেঙে যাক খসে খসে
তোমার কাছে করছি মিনতি
আমরা বসে বসে।
(ইতি সুফি সুফিয়ান কর্তৃক রচিত বৃশ্চিক নাটক)