একঘণ্টা / এনায়েত ইউ এস ইসলাম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জানুয়ারি ২০১৪, ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৬৮ বার পঠিত
স্টেডিয়াম মার্কেটকে অনেকে আবার ডাক্তারপাড়াও বলে থাকেন। কারণ এখানে যারা ব্যবসা করেন তাদের মধ্যে সিংহভাগই ডাক্তার। ডাক্তারদের চেম্বার আর বিচিত্র সব ডিগ্রি লেখা বাহারী রঙের সাইনবোর্ডগুলো এ সাক্ষীটিই দেয়। ডাক্তারদের চেম্বার ছাড়াও এখানে আছে অনেক ফার্মেসি। প্যাথলজি ল্যাব। ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চশমার দোকান প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি হালকা খাবার ও পানীয়র দোকান। মার্কেটের সামনে একচিলতে খোলা জায়গা। সেখানে ঠাসা থাকে হরেক রকমের যানবাহন। টানা বারান্দা জুড়ে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগী, রোগীর সাথের লোকজন কিংবা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের ছুটাছুটি হামেশাই লেগে থাকে। বাদামভাজা, ঝালমুড়ি, বরিশালি আমড়ার ফেরিওয়ালা এবং আমার মতো আগন্তুকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বেশ কোলাহলময়। এর মধ্যে হঠাৎ স্টার্ট নেওয়া কোনো মটরসাইকেলের ভোম ভোম কিংবা রোগীর সাথে আসা কোনো শিশুর কেঁদে ওঠা কোলাহলে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। এভাবে মার্কেটটি সারাক্ষণ একটি অস্থিরতার চাদরে ঢাকা থাকে।
পূর্বদিকটা তুলনামূলক নিরিবিলি। ওখানে আছে একটি আর্টস্কুল। বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানো হয়। আর একটি চায়ের দোকান। পাখিভাইয়ের টি-স্টল। কয়েকটি বেঞ্চি পাতা। ভাঙাচোরা অবস্থা। ছোট ছোট টেবিলগুলোর অবস্থাও তেমন। চালের টিনে হাজারো ফুটো। ফুটো গলে নানা আকার-আকৃতির সূর্যরশ্মি এসে পড়ে টেবিল আর বেঞ্চগুলোর উপর।
আমাকে মূলত ঐ আর্টস্কুলটায় আসতে হয়। সপ্তাহে একদিন। ছবি আঁকার ক্লাসে বাচ্চাকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় যাই। ক্লাস শেষ হলে ফের নিয়ে আসি। শুনেছি বাচ্চাদের আঁকা নিয়ে একটি প্রদর্শনী হবে। প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি চলছে। সেজন্য আজ ক্লাস সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। ক্লাস হবে একঘণ্টা। ভাবলাম একঘণ্টা পথেই মরে যাবে। সুতরাং বাসায় গিয়ে লাভ নেই। এখানেই অপেক্ষা করা শ্রেয়। তবে সময়টা কিভাবে কাটানো যায়, তা নিয়ে ভাবনা হলো। একঘণ্টায় বড়সড় একটা গাছ কেটে ফেলা যায়। কিন্তু সময়ের তো শরীর নাই। কী আর করা। শেষপর্যন্ত পা বাড়ালাম পাখিভাইয়ের টি-স্টলের দিকে। একটু ভালো দেখে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আজ তেমন ভিড় নেই। আড্ডাবাজ ছেলের দলও অনুপস্থিত। কোলাহলহীন পরিবেশ আর ছোট ছোট বাতাসের স্পর্শ, বেশ ভালো লাগলো।
চায়ের অর্ডার দিতেই কেটলি থেকে ফুটন্ত লিকার ছাকনি দিয়ে কাপে ঢাললো পাখিভাই। তারপর এক চামচ চিনি আর আধা চামচ কন্ডেন্সড মিল্ক দিয়ে টিং টিং শব্দ তুললো। এটি আমার প্রিয় শব্দগুলোর মধ্যে একটি। চা বানিয়ে টেবিলে এনে দিলো পাখিভাই। কিন্তু কাপটি এত জোরে রাখলো যে, তাতে কিছু চা ছলকে পড়ে গেলো টেবিলের উপর। তাকিয়ে দেখলাম পাখিভাইয়ের সহকারী ছেলেটি এক পাশে বিমর্ষ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কাজে হাত লাগাচ্ছে না। অন্য সময় পাখিভাই চা বানায় আর ছেলেটি টেবিলে এনে দেয়। টেবিল মোছে। খালি কাপ সরিয়ে নেয়। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম। আজ পাখিভাই সব কাজ করছে। কারণ কী? পাখিভাই যেন এ-প্রশ্নটিরই অপেক্ষায় ছিলো। প্রশ্ন শুনে তার চেহারায় ঝুলে থাকা কপট গম্ভীর ভাবটি উবে গেলো। সাট্ করে খুলে গেলো তার মুখের কপাট।
“নবাবজাদার কারবারটা দেখইন না। মাস পুরতে না পুরতে বেতনর টেখাগুইন গনিয়া গনিয়া দিলাম। এখদিনর কথা কইয়া বাড়িত গেলো। এখদিন গেলো, দুইদিন গেলো, তিনদিন বাদে আইয়া কয় মা’র বেমার আছিল। এর লাগিউ তোমরারে টেখা এখলগে দেওয়া ঠিক নায়। ভাঙ্গিয়া-ভাঙ্গিয়া, টুকরা-টুকরা করিয়া দিতে অয়। ত’উ গিয়া তোমরা ঠিক থাকো। এখলগে আস্তাটা দিলাইলে তোমরার পেট ভরি যায়। পেট ভরি গেলে তোমরা নবাব অই যাও। কইলাম তো ইখানো থাকিয়া আর কিতা করতে। ইখানো তোর কোনো কাম নাই। বাড়িত যা। বাড়িত গিয়া জমিদারী দেখভাল কর। ফয়দা অইবো।”
তখন দৃশ্যপটে হাজির হয় এক পাগলি। এলাকায় মনা পাগলি নামে পরিচিত। বাজার চত্বরেই থাকে। মাথার চুল বটের ঝুরির ক্ষুদ্র সংস্করণ। সেখানে হাজারো উকুনের বাস, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পরনে বস্ত্রখণ্ডের আদি রূপ কেমন ছিলো তা বোঝার কোনো উপায় নাই। সঙ্গে সেই কুকুরটিও আছে। যেটি সব সময় পাগলির সাথে সাথে থাকে। মনা পাগলির মতোই তার চেহারা-সুরত। হাড্ডিসার লিকলিকে। মনা পাগলির হাতে একটি পাউরুটি। কেউ দয়াপরবশ হয়ে দিয়েছে। কিংবা কোনো দোকান থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে এসেছে। মনা পাগলি টুকরো টুকরো করে পাউরুটি ছিঁড়ে কুকুরটিকে দেয়। নিজেও খায়। সামনের দু’পা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে কুকুরটি পাউরুটি খায়। আর লেজ নাড়ায়। কিছু সময় পর পর পাগলি কুকুরটিকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কুকুরটি যায় না। শেষপর্যন্ত একটি পাথরের টুকরো কুড়িয়ে এনে কুকুরটির দিকে ছুঁড়ে মারে। আঘাত পেয়ে কুকুরটি কুঁই কুঁই করে সরে যায়। কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর আবার এসে পাগলির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। আধ খাওয়া পাউরুটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রবলভাবে লেজ নাড়ায়। লেজের সাথে শরীরও নড়তে থাকে। লেজ শরীর নাড়ায়, নাকি শরীর লেজ নাড়ায়, ঠিক বোঝা যায় না।
মুখ-খোলা কলের পানির মতো গল গল করে কথা ওগড়াতেই থাকে পাখিভাই। চোখ তুলে সেই ছেলেটির দিকে তাকাই। তার সমস্ত শরীর জুড়ে দারিদ্র্যের প্রহার। সেও আমার দিকে তাকায়। তার চোখভরা জল। সেখান থেকে করুণার রেখা এঁকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তার দিকে আর তাকাতে পারি না। চোখ নামিয়ে হাতঘড়িটির দিকে তাকাই। দেখলাম একঘণ্টা সময় পার হতে আর দেরি নেই।
এনায়েত ইউ. এস. ইসলাম। জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯৫৬। গল্প ও কবিতা লেখেন। ফোটোগ্রাফি করেন। অসরকারী একটি উন্নয়নসংস্থায় কর্মরত। কাজের ক্ষেত্র প্রধানত নব্যসাক্ষর ও শিশুদের জন্য সহজ পদবিন্যাসের উপকরণ পরিকল্পনা ও প্রণয়ন। অনিয়মিত হলেও ব্লগে লেখেন, রয়েছে নিজের পৃথক ব্লগ-পরিসর।