জয় হো” (২০১৪)… জয় নাকি পরাজয় / অনিক-উজ্জামান বাপ্পি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জানুয়ারি ২০১৪, ৬:৫৬ অপরাহ্ণ, | ২৫৭৬ বার পঠিত
“সালমান খান” মানেই এখন মসলা পূর্ণ অ্যাকশন মুভি। গত কয়েক বছরে “ওয়ান্টেড”, “দাবাং”, “রেডী”, “বডিগার্ড”, “দাবাং ২” রিলিজ হবার পর অন্তত এটাই সত্য হয়ে দাড়িয়েছে। (“এক থা টাইগার” একটু কোয়ালিটি ও ব্যতিক্রম ধাঁচের ছিল বলে এটার কথা বাদ দিলাম)। সবাই জানে ২০১৩ সালে “সালমান খান” এর কোন মুভি রিলিজ না হয়ায় ভক্তদের উত্তেজনার পারদ খুব বেশীই ছিল “জয় হো” কে কেন্দ্র করে। তার উপর এ মুভির শুরু থেকে কয়েকবার নাম পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে ঠিক হল “রাঁধে”, তারপর “মেন্টাল”, অতঃপর “জয় হো”। সুতরাং বেশ ভালোই জল ঘোলা হয়েছে এই মুভিটা নিয়ে। কিন্তু মুভি রিলিজের পর বক্স অফিস রিপোর্ট বলছে অন্য কথা… প্রত্যাশা অনুযায়ী রেকর্ড করা তো দুরের কথা, “সালমান খান” এখন নিজেই চিন্তিত যে “জয় হো’ এর কপালে হিট জুটবে নাকি ফ্লপ ? কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিল না… কি আছে এই “জয় হো” তে ? কেন “সালমান খান” থাকার পরও মুভির এই করুণ দশা ?
আমার নিজের মতামত এখানে তুলে ধরছি… প্রথমত এই মুভি তামিল রেকর্ড করা মুভি “স্টালিন” এর অফিসিয়াল রিমেক। এবং মুভির থিম সামাজিক সচেতনতা নিয়ে। “স্টালিন” আমি দেখিনি তাই জানি না তাতে কি আছে, কিন্তু “জয় হো” দেখার পর অন্তত একটা আইডিয়া পাওয়া গেছে। তাছাড়া তামিল সচেতনতা মূলক মুভিগুলো বরাবরই আউটস্টান্ডিং হয় (সস্তা ভাঁড়ামি গুলো বাদ দিলে)। এবং “জয় হো” তেও এটাই দেখা গেছে। এ মুভিতে ছিলো না “সালমান খান” এর আগের মুভি গুলোর মত কোন সস্তা তামিল মার্কা ভাঁড়ামি। গোটা মুভির পটভূমীতে একটা সিরিয়াস ভাব ধরে রাখা হয়েছে। আর যেটুকু হাস্যরস ছিল, তা না হলেই নয়। “জয় হো” পুরাটাই ছিল সিরিয়াস টাইপ মুভি। এ মুভি দেখতে দেখতে মনেই হচ্ছিল না যে এটা কোন তামিল মুভির রিমেক। এই মুভিতে কোন আইটেম সং তো দূরে থাক একমাত্র “তেরে নেইনা” ছাড়া তেমন কোন আকর্ষনীয় গান ছিল না যা দর্শক টানতে সক্ষম হবে। তবে অ্যাকশন গুলো দুর্দান্ত ছিল। বিশেষ করে বাইক চেজিং সিন গুলো। অতিথি চরিত্রে “জ়েনেলিয়া ডি সুজা” ও “সুনিল শেঠী” ভালোই করেছে। তবে আমার কাছে “জেনেলিয়া” এর পঙ্গুত্তটা একটু বেমানান লেগেছে আর শেষ অ্যাকশন সিনে “সুনিল শেঠি” এর ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়া চরম অসংগতি পুর্ণ, যুক্তিহীন ও অপ্রয়োজনীয় লেগেছে। আমার বাবা একজন আর্মি অফিসার। তাই আমার মনে হয় না একজন আর্মি অফিসার এভাবে হুট করে ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে বোমাবাজী করে একজন কমন ম্যান কে বাঁচানোর অফিসিয়াল অধিকার রাখে। যাই হোক, মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ ও উত্তেজনাকর ছিল। আমার অনেক ভাল লেগেছে। তবে এ মুভির সব থেকে বিরক্তিকর উপাদান ছিল স্বয়ং এ মুভির নায়িকা “ডেইজি শাহ”। যেমন তার বাজে গ্ল্যামারহীন চেহারা, তেমন তার বাজে এক্সপ্রেশন। এর থেকে “রকস্টার” এ “নার্গিস ফকরি” ও “বেশরম” এ “পল্লবী শর্দা” অনেক ভাল অভিনয় করেছে। “সালমান খান” এ পর্যন্ত “স্নেহা উলাল”, “সোনাক্ষী সিনহা” এর মত অনেক ভাল ভাল নায়িকা আবিষ্কার করলেও তার সব থেকে বাজে আবিষ্কার হল এই “ডেইজি শাহ”। অথচ এ মুভিতেই ভিলেন চরিত্রে “সানা খান” অনেক সুন্দর ও গ্ল্যামারপুর্ণ অভিনয় করেছে। আফসোস… “ডেইজি শাহ” এর স্থানে যদি “সানা খান” মূল নায়িকা থাকতো (আমি তাই আশা করে ছিলাম) তবে মুভিটা সেই রকম জমতো, দুজনকে অসাধারণ মানাতো এবং মুভির গান গুলোও চরম আকর্ষনীয় হত। তবে যাই হোক, এ মুভিতে “সালমান খান” অ্যাভারেজ টাইপ অভিনয় করেছে। এ কথা মানতেই হচ্ছে যে তামিল মসলা মুভি করতে করতে তার অভিনয়ে মরিচা ধরে গেছে। আগেই বলেছি “জয় হো” পুরাই ১০০% সিরিয়াস ও ইমোশোনাল মুভি, তাই “সালমান খান” ও চেষ্টা করেছে সিরিয়াস ও ইমোশোনাল দৃশ্য গুলোতে ১০০% দিতে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আগের মত তার কাছ থেকে পুরা ১০০% অভিনয় বের হয়ে আসেনি। ভিলেন হিসেবে “ড্যানি ডেঞ্জোনপা” বরাবরের মতই ছিল। অবশেষে… এ মুভির একমাত্র মূলপ্রাণ যাকে বলা যায়, সে হল “টাবু”। সকল সিরিয়াস ও ইমোশোনাল দৃশ্যে সে ১০০% নয় পুরাই ২০০% নিখুত অভিনয় করেছে। অতঃপর, শেষ অ্যাকশন দৃশ্যে বরাবরের মতই অপেক্ষায় ছিলাম কখন “সালমান খান” শার্ট খুলবে এবং শার্ট খোলার পর “সালমান খান” এর ফিগার দেখে আমি পুরাই বাকরুদ্ধ। গত বছর “কৃষ ৩” তে “হ্রিত্বিক রোশন” এবং এ বছর “জয় হো” তে “সালমান খান”। How is this possible Man ? Curious mind wants to know… যাই হোক, “সোহেল খান” মোটামুটি ভালই পরিচালনা করেছে, যদিও কিছু কিছু যায়গায় ঘটনা প্রবাহ কিছুটা লুজ লেগেছে তবে সেগুলো ক্ষমা-সুন্দর চোখে দেখা যায়। অন্তত “আরবাজ খান” এর “দাবাং ২” ও “সোহেল খান” এর “জয় হো” এর তুলনা করলে অবশ্যই “সোহেল খান” কেই আগে রাখতে ইচ্ছা করবে।
“সালমান খান” কে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই… ২০০৪ সালে তার মুক্তি পাওয়া “গর্ব” মুভিটা দেখেনি এমন পাবলিক এখানে খুজে পাওয়া যাবে না। “গর্ব” আমার অনেক প্রিয় একটা মুভি। সত্যি কথা বলতে কি, “জয় হো” দেখতে গিয়ে আমার বার বার “গর্ব” এর কথা মনে পড়ছিল। সেই রাগ, সেই একগুয়েমী, সেই অ্যাকশন, সেই দেশপ্রেম… একেইতো বলে “সালমান খান”। অনেক দিন পর মনে হচ্ছিল যে হ্যা… এইবার “সালমান খান” এর মুভি দেখছি। আফসোস… “সালমান খান” এখন তামিল মসলা কমেডী মুভির গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। এ বছর রোজার ঈদে আসবে “কিক”, যা কিনা চরম তামিল মসলা দ্বারা পরিপূর্ণ। “জয় হো” প্রত্যাশা অনুযায়ী “ধুম ৩” এর রেকর্ড ভাংতে না পারলেও আমি নিশ্চিত যে “কিক” অবশ্যই পারবে কারণ বলিউডের দর্শক যে এমন মুভিই দেখতে চায়।
এবার আসা যাক একটু হিসাব-নিকাসে। কেন এই মুভির বক্স অফিস এ এমন করুণ দশা… প্রথম ও সর্ব প্রধাণ কারণ হিসেবে আমি বলবো যে, বলিউডের দর্শকরা হল দুনিয়ার সব থেকে ফালতু ও রুচিহীন দর্শক। এরা মসলা, আইটেম গান ও সস্তা ভাঁড়ামি পুর্ণ মুভি দেখতেই বেশি পছন্দ করে। আর আগেই বলেছি “জয় হো” তে এসব কিছুরই ছিল অনুপস্থিতি। অনেকেই বলতে পারেন যে “স্টালিন” এর মত মেগা হিট মুভির রিমেক “জয় হো” যেখানে আবার স্বয়ং “সালমান খান” উপস্থিত, সেই মুভি কেন রেকর্ড করবে না ? তাদের উত্তরে বলছি… তামিল, তেলেগু দর্শক ও ফিল্মমেকারদের রুচি ও চিন্তা-ভাবনা অনেক উন্নত। সেখানে সব ধরণের মুভিই চলে। সেখানে “ওয়ান্টেড”, “রেডী”, “বডিগার্ড”, রোডী রাঠোড়”, “সিঙ্ঘাম” ইত্যাদী মুভির মত মসলা কমেডী-অ্যাকশান মুভি যেমনি হিট হয় তেমনি, “তেরে নাম”, “গজনি”, “চিরদিনই তুমি যে আমার”, “প্রেম আমার”, “বোঝেনা সে বোঝেনা” ইত্যাদী হৃদয় ভাঙ্গা রোমান্টিক মুভিও হিট হয়, আবার সেই সাথে “স্টালিন”, “কানামাছি”, “দুই পৃথিবী” ইত্যাদী সামাজিক সচেতনতা মুলক মুভিও রেকর্ড করে। তামিল-তেলেগু ইন্ড্রাটি অন্তত বলিউড থেকে অনেক অনেক দিক থেকে এগিয়ে আছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তারা মাঝে মাঝে মুভি বানাতে গিয়ে হলিউড থেকে ইন্সপায়ার হয়, কিন্তু সেখানে তারা নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা মিক্স করে যা দাঁড় করায় তা একটা মাস্টার-পিসের থেকে কম যায় না। এই ইন্ড্রাস্টির কাধে ভর করেই তো কলকাতা বাংলা মুভি টিকে আছে, কারণ সেখানকার আর্ট-ফিল্ম গুলো বাদ দিলে “জিত”, “দেব”, “সোহাম”, “হিরন” সবার মুভিই তামিল-তেলেগু মুভির রিমেক। তবুও সেখনকার বাঙ্গালী দর্শকদের রুচিও বলিউডের দর্শকদের থেকে হাজার গুনে উন্নত। কারণ সেখানে আর্ট-ফিল্মও হিট হয়। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি “অটোগ্রাফ”, “২২শে শ্রাবণ”, “হেমলক সোসাইটি”, “মিশর রহস্য”, “প্রলয়”, “মুক্তধারা”, “ফেলুদা”, “বোমকেশ বক্সী” এমনকি যদি “চাঁদের পাহাড়” ও বলিউডে রিলিজ হত তবে এই মুভি গুলো সর্বকালের সেরা ফ্লপের খাতায় নাম লেখাত, যদি এ মুভি গুলোতে “সালমান”, “আমির”, “শাহরুখ” থাকতো তবুও। যাই হোক, ফিরে আসি “জয় হো” তে… দ্বিতীয় ও সর্ব শেষ কারণ হিসেবে আমি বলবো এ মুভির কুখ্যাত নায়িকা “ডেইজি শাহ”। যদি এ মুভিতে কোন সুন্দর অভিনয় ও গ্ল্যামার সম্পন্ন নতুন মুখ বা এখনকার সময়ের আলোচিত নায়িকাদের মধ্যে কাউকে নেয়া হত তবে সেটা মুভির জন্য খুব ভাল প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াত। সবশেষে, আরো একটি গুরুত্তপুর্ণ কারণ হিসেবে বলা যায় যে কোন উৎসব মুখর পরিবেশে এ মুভি রিলিজ না করা। বলিউডের আসল হিরো “সালমান”, “আমির” বা “শাহরুখ নয়, আসল হিরো হল “দিওয়ালি”, “বড়দিন” এবং সবার বস “ঈদ”। এই “দিওয়ালি”, “বড়দিন” ও “ঈদ” এর জোরেই “ওয়ান্টেড”, “গোলমাল ৩”, “রাবনে বানাদি জোড়ি”, “গজনি”, “বডিগার্ড”, “এক থা টাইগার”, “জাব তাক হ্যায় জান”, “সন অব সর্দার”, “চেন্নাই এক্সপ্রেস”, এবং সর্ব শেষ “ধুম ৩” রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছে। “জয় হো” যদি এমন কোন একটি সময়, বিশেষ করে ঈদের মৌসুমে রিলিজ হত তবে নিঃসন্দেহে “এক থা টাইগার” এর মতই ফাটিয়ে ব্যবসা করতো।
সব মিলিয়ে “জয় হো” হল ওয়ান টাইম ওয়াচ মুভি। এ মুভি হয়তো “রেডী”, “দাবাং”, “সিঙ্ঘাম”, “রোডী রাঠোড়” এর মত বার বার দেখতে ইচ্ছা করবে না, কিন্তু একবার দেখেই অনেক কিছু অনুধাবণ করা যাবে, অনেক কিছু শেখা যাবে। অবশেষে একটি কথা বলেই শেষ করছি… কেউ যদি আপনার কোন উপকার করে তবে তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে বরং আপনি তিন জন মানুষের উপকার করুন এবং তাদের বলুন যেন তারা আরো তিন জন মানুষের উপকার করে… দেখবেন, সমাজ বদলে যাবে।