অস্তিত্ । শেখ লুৎফর’র
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ অক্টোবর ২০১২, ৯:১০ অপরাহ্ণ, | ২৬২৫ বার পঠিত
অস্তিত্বে অন্য মুখ
এত অন্ধকার, এত কর্দমের জল
মানুষ যে, চোখের থেকে ফেলে নাই আঁজলাপুর আলো
উপরন্তু আরো কিছু আন্ধিয়ার ফেলে ফেলে
অভোলা হাওয়ার মতো ক্রীড়ার ভেতর…
টুল্লুক : মোস্তাক আহমাদ দীন
শরীরে সিফিলিসের ক্ষতের মতো অসংখ্য নয়া-পুরান সাইনবোর্ড নিয়ে, পাকা সড়কের মোড়ের বিশাল শিরীষ গাছটা, স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ২/১টা পুরোনো সাইনবোর্ডের বুক, জঙ্গারে খেয়ে খুবলে ফেলেছে। কিন্তু পেরেকের কঠিন দাঁত, শিরীষের গতর কামড়ে ধরে এখনো তাফালিং করছে। বিচিত্র বিজ্ঞাপনগুলোর উজ্জ্বল শরীরের নিচে চাপা পড়া, শিরীষের সেইসব গোপন ক্ষত থেকে, চুঁয়ে-চুঁয়ে দিনমান শুধু রক্ত ঝরে।
শিরীষের কোমর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুনিম অপেক্ষা করে, একটা রিকশার জন্য। কত বছর ধরে যে সে এই শিরীষের নিচে অপেক্ষা করছে। স্কুলের ছুটির দিনগুলো, ভরদুপুরে একা-একা বাড়ি থেকে বেরিয়েই সে চম্পট দিতো, লকলকে কচি শিরীষের চারাটাকে ঠার করে। দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাবা বাজার থেকে এলো বলে—নিশ্চয়ই তার জন্য বাদাম-বিস্কুট আনবে। ধুলোভরা ধু ধু পথটার দিকে চেয়ে চেয়ে মুনিমের চোখ টাটাতো। কত মানুষ আসে-যায়, বাবা কেন আসে না এখনো? বিশাল মাঠের বুক চিরে মাটির সড়ক গঞ্জের দিকে মুখ লুকিয়েছে। দূরে দূরে ছিন্ন গ্রামগুলোর কালচে রেখা, মাঝ দুপুরের ঠাঠা রোদের তেজে হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে ওঠে। মুনিম আর তার মাথার উপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কচি শিরীষের আধলা পরাণে, ডর ধরাতে ২/১টা হিয়াল তার কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে, আশপাশের ঝোঁপ থেকে একটু একটু মুখ বের করে ভেংচি মারে।
চারপাশের গ্রামগুলো থেকে আল-বাতর বেয়ে বেয়ে মুনিমের বয়সি যারা, স্কুলে যাবার জন্য আসতো তারা প্রত্যেকেই এই শিরীষতলায় এসে অপেক্ষা করতো। ৪/৫ জন হলে হৈ হৈ করে সড়কের ধুলো কিম্বা কাদা ঠেলে স্কুলের দিকে ছুটতো। রজব, রেহান, উমর…, মুনিমের বুকে কত নাম; মাঝে মাঝে অনাহক বিখাউজের মতো চুলকায়। উমর কথা বলতো গমগম করে, তাই সবাই তাকে ভোমা উমর ডাকতো। আঙুলের মতো বড়ো বড়ো দাঁত আর বাঘা কব্জির উমর, ডাকাতি করতে গিয়ে পাবলিকের ব্যারিকেডে পড়ে, দশ সন আগে খুন হয়ে গেছে। রজব রেলের খালাসি। ঈদ-পরবে ছুটিতে বাড়ি এলে মুনিমের আড়তে এক-আধ চক্কর আসে। পোশাক-গতরে অনটনের প্রকট উপস্থিতি, চোখে-মুখে পৌষের সন্ধ্যার মতো জড়তা, কষ্ট।
আড়তের পিচ্চিটা দু-কাপ চা আনে। মুনিম টোস্টে কামড় দিয়ে মরা চোখে পুরানা বন্ধুর দিকে চেয়ে থাকে। চায়ের গরম শরীর থেকে উঠে আসা ধোঁয়া দুজনের মাঝে ইন্দুরের মতো ল্যাজ নাড়ায়।
চা শেষ হয়ে গেলে রজব উঠতে চায় না। মুনিমের শরীর খিতখিত করে। খাতক কেউ এলে তার জানটা বুঝি বাঁচে।
মুনিমের আড়ত ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেলে সে চেয়ে দেখে বাইরে রাত আলকাতরার মতো ঘন হয়ে গেছে। খাতকশূন্য এরকম স্তব্ধ ঘরে, নিজের অস্তিত্বের বাসি ঘ্রাণে তার নিজের বুকটাই বিলবিল করে ওঠে। তখন সে বুকের কাঁচা-পাকা লোমে নখ ডুবিয়ে চুলকাতে চুলকাতে আরেকবার বাইরের দিকে চোখ পাকায়। আরো আশ্চর্য কোনো অন্ধকারের আগুনে মুখ ডুবিয়ে পরে থাকার একটা উৎকট লোভ তখন হু হু করে ডাঙ্গর হয়।
রিকশার চাকা পনপন করে ঘোরে। রাস্তার পাশের আতংকিত গাছগুলো, অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরে নিজেরাই গভীর অন্ধকার হয়ে যায়।
সড়কের দু পাশে বিস্তীর্ণ জমিন। ছোট-বড় আল-বাতর তুলে মানুষেরা অসীমকে আয়ত্তের মধ্যে কব্জা করে নিয়েছে। জোর বাতাস গ্রামের ঘর-ঘুপচি, বাঁশবন পেরিয়ে বিশাল মাঠে পড়ে খ্যাপার মতো দৌড় লাগায়। তখনো চৈতে, রুখু-শুখা মাঠের ধুলো-নেড়া নিয়ে টানাটানি করে। আকাশের জ্বলন্ত সূর্যটাকে থাপা দিয়ে ধরে কচলে অন্ধকারের কালো কালো গুঁড়োকে যেন চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। দিগন্তের উদলা কোনাকানা থেকে কালো মেঘ, কার যেন তাড়া খেয়ে ভেংচি কেটে তামাম দুনিয়াটাকে ঝলসে দেয়। এলেবেলে বাতাস খেলতে খেলতে এক সময় নেকড়ের মতো দুর্ধর্ষ আর একরোখা হয়ে ওঠে। কোনো কোনো দিন যদি মুনিমকে ধরতে পারে, তবে তারা রিকশা-সমেত লোকটার ওপর হামলে পড়ে।
প্রবল ক্রোধে মুনিমের বাক রোধ হয়ে আসে। নিজের ঘরে সে ধীরাজ; আড়ত, ইট ভাটা, অটো রাইছ মিলে প্রভু; আর এই ছোট থানা সদরের যে কজন সেরা হাড়কিপ্টে ক্যাশওয়ালা আছে, তাদের একজন; এবং নিজের কাছে সে যাই থাকুক কিন্তু যখন সে হাত দুটো পেছনে রেখে মাথাটা টানটান করে বিষাদ বদনে বাজারে কিম্বা বাইরে হাঁটে, আশ-পাশের মানুষ-তো মানুষ, ফরাজিরা যে কেউ হোক তার সামনে পড়লে মুনিম হাত তোলার আগেই তারা সালাম দেয়।
বাতাস শো শো গর্জন তুলে ছুটছে। পথের পাশের তরুণ মেহগনির একটা বিরাট ডাল ছিঁড়ে নিয়ে ক্রোধে মোচড়াতে মোচড়াতে তারা মুনিমের দিকে এগিয়ে আসে। তার শরীর শক্ত হয়ে ওঠে, নিজের অস্তিত্বের অহং নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে সে ভ্রƒক্ষেপহীন দাঁড়িয়ে থাকে।
গেলো দিন মুনিম কাম শেষ করে লুঙ্গি গোছ-গাছ করছিল; আয়তুন পাটি থেকে উঠে সরাসরি মুনিমের পেটে হাত দিয়ে বললো,—মিয়া সাবের ভুড়িডা খালি মোটা অইতাছে। অহন আর মেয়া-মাগি দ্যায়া কি আইব, তারচে হুত্যায়া হুত্যায়া নাক ডাহাই ভালা। মুনিমের চোখ দপ্ করে জ্বলে ওঠে তবু কঠিন কিছু বলে না। সে লুঙ্গিতে গিঁট দিয়ে, মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে ফিটফাট হতে হতে বলে,—খালি ভুড়িডাই দ্যাখলে…।
নজর-মোটা মানুষকে মুনিম একদম সহ্য করতে পারে না। ছেমড়িডা একটুও বুঝে না, ট্যাহা বাড়লে-তো পেট বাড়বই। মানুষ যে ক্যান এত লেঙ্গুর-মোটা হয়।
মুনিম নিজেই-তো নিজেকে বোঝে না; তা না-হলে ঝকঝকে সকালের আলো ভরা পথে এসে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে প্রায়ই কেন চমকে ওঠে, দেমাগে প্রশ্নটা ঝাঁকি মারে, কীসের তাড়নায় সে এতোটা হন্ত-দন্ত? এক চুমুক উদাস্যের মধ্যেই যখন তার প্রিয় গদি ঘরখানা স্মৃতিতে উঁকি মারে, তখনি তার ঝাঁপসা চোখে-মুখে অজস্র আলোর তীর মুখিয়ে ওঠে। ডানদিকের শিরীষ গাছটা আজ কী পেল্লাই শরীর নিয়েছে, তা-আর মুনিমের চোখ মেলে দেখা হয় না। আজকের এই দাপটি বৃক্ষটা যখন কিশোর ছিলো, যখন মুনিমরা সবাই স্কুলে যাবার পথে এই শিরীষতলায় বাঁক নিতো, তখন লাল হয়ে আসা এক পড়ন্ত বিকেলে সে গোপনে তার ভূগোল বইয়ের পেট থেকে এক ফালি ব্লেড বের করে কচি শিরীষের বাকল কেটে কেটে-বেশ মোটা করে, তার আর রানুর নাম লিখে মাঝে একটা প্লাসচিহ্ন বসিয়ে দিয়েছিলো।
ফরাজি বাড়ির ছোট মেয়ে রানু। টুকটুকে ফর্সা। ছিংলার মতো লকলকে শরীর। বুকে বই চেপে যখন সে স্কুলের পথে হাঁটে, তখন চারপাশের সবকিছুই যেন তার সাথে মন্ত্র-মুগ্ধের মতো হাঁটতে চায়।
পরের দিন মুনিমের বাবা একটু আগধাবারে দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাড়ি ফিরে। মুনিম তখন এশিয়ার মানচিত্র আঁকতে গিয়ে খালি রানুর মুখ দেখছে। ইন্দ্রিয়ঘন এই নিবিড় মুহূর্তটিতেই তার বাবা এসে মুনিমের পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। অপমানে বাবার মুখটা আংরা হয়ে গেছে। মাথার চুল পটপট করে উঠলে মুনিম দেখলো রানু নেই, তার বাবা তাকে চুলে ধরে শূন্যে তোলে, মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে,-কুত্তার বাচ্চা, কত বড় হিম্মত তর, ফরাজিগর একটা লুম্বার সামান অইছস?
পরের জ্যৈষ্ঠে রানুকে দেখা গেলো তাদের বাড়ির পিছনের পাট ক্ষেতে, মুনিমের গলা জড়িয়ে ধরে ঘামছে। ফরাজিদের ছোট মেয়ের টুকটুকে ফর্সা হাত, পাটক্ষেতের মশার কামড়ে লাল চাকায় ভরে যায় তবু মুনিমের গলা ছাড়ে না।
তার পরের জ্যৈষ্ঠ মাসে, মুনিম ইন্টারের ফরম ফিলাপের টাকা কলেজের কেরানিকে না-দিয়ে, ছাগলের পাইকারকে চড়া সুদে দিয়ে দেয়। আর কলেজ নয়, লোকজন দেখে, বিকাল হলে মুনিম স্টেশনের পাশের টং দোকানে বসে বসে পা দোলায়; সদর ফেরত ট্রেনের ঘণ্টা বাজলে ছেলেটার চোখ-মুখ এক আশ্চর্য উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে। সেদিন থেকে পাইকারের প্রতিটা চালানের পর মুনিম শিরীষের কাঁচা বাকলে নয়, তার নিজের হৃৎপিণ্ডে একটা একটা করে প্লাস লেখে।
আজ ব্যাংকের সাহেবরা মুনিমের নামের পাশে কত যে প্লাস লেখে, কিম্বা তার আড়তের রোগা কেরানিটি সারা দিন অজস্র সংখ্যার পাশে শুধু প্লাসই লেখে। মাঝে মাঝে সেইসব লম্বা লম্বা সংখ্যাগুলোর শরীর ভরা প্লাস দেখে, মুনিম একটুও খুশি হয় না।
মুনিম মুখে আশ্চর্য এক গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে দিনমান ছুটে। অনেক দিন যাবৎ ছুটছে। প্রথম প্রথম মুখোশটা খুব চুলকাতো, খসে যেতে চাইতো, আকছা খসে গেলেও জটপট সে পরে নিতো, কেউ দেখে ফেলার আগেই। এখন মুনিমের মুখের সাথে ওটা বেশ মানিয়ে গেছে; হয়তো আজ মুখোশটাই তার প্রকৃত মুখ হয়ে গেছে। এবং ঘুমের মাঝেও হুঁতোম প্যাঁচার মতো থমথমে তার মুখখানায় এক বিস্ময়কর বিষাদ এঁটে থাকে। যখন সে ঘরে ফিরে গোসলখানায় ঢোকে, রানু হাত ভর্তি সোনার চুড়িতে রোদন তুলে লুঙ্গি-গামছা এগিয়ে দেয়। মাঝে-মধ্যে মুনিম অবাক চোখে সেই গোল-গাল ফর্সা হাতের দিকে চেয়ে থাকে; মনে করতে পারে না সে, এই দুখি হাত দুটো কোথায় দেখেছে, এরা কেন এত আশ্চর্য করুণ আর নিরর্থক।
মাঝে-মধ্যে সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে শুনে, তার মেয়ে পাশের বাড়ির আতাবুরের ছেলেকে ডাকছে,—বড় ভাই, আমার লাইগ্যা একটা রিকসা আটকাইয়ো, বড় দেরি অইয়াগেছে, আউছক্যা স্যারে বকবো। মুনিম কিঞ্চিত চিন্তিত হয়। আতাবুরের ছেলের মুখ মনে করতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। বুকের মাঝে কেমন ভার ভার লাগে। নিজের ছেলে নেই। রানু যে কি কল্ল!
…এই বড় ভাইডা ক্যাডা, আল্লাই জানে এই কুত্তার বাচ্চা যে কী করবো? মুনিম একটু নড়েচড়ে বসে। মেয়ের ব্যাপারে আরেকটু সর্তক হওয়া উচিত; এরকম একটা চিন্তা মগজে মুখ তুলতে চায় কিন্তু ভাবনাটা গাঁথুনি নেবার আগেই মধ্য বাজারের জায়গাটায় মার্কেট করার লোভ এসে হুড়মুড় করে তার কাছ থেকে মেয়ের মুখ আড়ালে ফেলে দেয়।
মুনিমের বুকের মাঝে কালো তাগার মতো একটা ক্ষোভ টান টান হয়ে লেগে থাকে। নিজের মেয়েটাকে সে একটুও বুঝে না। মেয়েকে খুশি করার জন্য কিছু একটা বললে উলটো সে রাগ করে। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে পড়ে, ২০ বছর আগের রানুকে পাটক্ষেতে খোঁজে। না-পেয়ে হয়রান হয়ে নিজের শূন্য বুক হাতড়াতে হাতড়াতে জেগে দেখে সে রানুর মাঝঘরে দাঁড়িয়ে আছে। নীল মশারির ভেতর দুই রানু এক সাথে। কোন রানুকে যে কানে কানে কথাটা বলবে? সে এক মস্ত ফাঁপর! আসল রানুকে ঠাওরাতে ঠাওরাতেই সে মোদ্দা কথাটা ভুলে যায়।
পরশু/তরশু হবে, মুনিম ঘুম থেকে উঠে রানুকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, অবাক এক নারী; ছবির মতো টানটান দিঘল শরীর। তার পিঠ ভর্তি ভেজা চুল থেকে আনারের ফুলের মতো টপটপ জল পড়ছে। স্তম্ভিতের মতো মুনিম চেয়ে থাকে। কাকে যেন কোথায় এমন করে একদিন দেখেছিলো…
মুনিমের ভেতরটা কলকল করে ওঠে। অনেকদিন পর তার শরীর-মন খুশিতে নির্ভার লাগে। নারী, ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ডান দিকের করিডোরে বাঁক লয়। সে তখন তীব্র চোখের এক ঝলক দৃষ্টিতে নিজের মেয়ের মুখটা চিনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মুহূর্ত কয়ের এইসব টুকিটাকির মাঝে, আড়ত আর ইট ভাটার জটিল দায় এসে চট করে জামবাক মলমের মতো লেপ্টে বসলে, মুনিম বিস্বাদ বদনে রিকশায় চড়ে।
নগরের গরম গরম খবর নিয়ে, আরো অনেক সাইনবোর্ড লেগেছে শিরীষ গাছটায়। দর্জির দোকান থেকে মোবাইল ফোন, অর্শ-গেজ থেকে কিন্ডারগার্টেন। পাকা সড়কের কালো পিচ, রোদের তেজে খা খা করে। আশপাশের খানা-খন্দ-ভরা বুনো মাঠটায় আজ ইরি চাষের জন্য হু হু করে ট্রাকটর ছুটছে, মাটির গভীর থেকে স্যালোকল আগ্রাসী চুমুক দিয়ে জল টেনে ক্ষেতে এনে উসটে ফেলছে। বস্তা বস্তা ইউরিয়া, টিএসপি সার ঠেলা থেকে ক্ষেতের বাতরে নামছে। সবকিছু কেমন অচেনা আর পরপর লাগে! তবু মুনিম চেয়ে থাকে। এসব চাইতে চাইতে সে রিকশায় বসে ঢোলে, অথবা ঢুলতে ঢুলতে সে রিকশায় ওঠে। আসলে সে এসব কিচ্ছুটি দেখে না। সে দেখে আড়ত, ব্যাংক, ইটের ভাটা, ছাগলের পাইকার।
এতো অবসাদ! ঘাড়ের রগে এতো হিম, জিভ-টাকরায় এতো মর্চে…। মুনিম…মুনিম…করে কে যেনো কয়টা ডাক দিলো। কিন্তু চর্বির আস্তরে ঠাসা মোটা ঘাড়খানা চাইলেও সে সহজে ঘোরাতে পারে না।
বড় রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে গুটি গুটি পায়ে, কয়টা চষা ক্ষেত-বাতর ডিঙিয়ে, আয়তুনের এই ঝুপরির ভেতর সামলে-সুমলে মুনিম ঢুকে কি উপাসির মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুতানোর জন্যে? তবে সে কেন আসে তাও খোলাসা করে বোঝে না। আজকাল অবশ্য মুনিম তেমন কিছু বুঝতে মাথা খাটায় না। একটু ভাবলেই গা বমি বমি করে।
সামনের দিকে বিরামহীন ছুটার যে ব্যামো তাকে কাবু করে বসেছে, তা থেকে ক্ষণিক মুক্তির আপাত সহজ উপায় হিসেবে হয়তো সে আয়তুনকেই বেছে নিয়েছে। মুনিমের ফিরতি পথের পাশেই এই টুকটুকি পাখিটি ছন-বন দিয়ে তার বাসাখানা সদ্য তুলেছে। সারাদিন খালি ট্যাহা আর মানু, মানু আর ট্যাহা। মুনিম বিড়বিড় করে। সমস্ত দিনের জটিল লেন-দেনের মতো তার সেই একান্ত সংলাপও জটিলতায় গুমরে ওঠে।
ধান-চাউলের আড়ত থেকে তার ছুটতে হয় অটো রাইছ মিলে, সেখানে থেকে ইটের ভাটায়। মাঝ বাজারে একটা জাগা কেনার জন্য মলামলি চলছে। দামটা একটু চড়া হলেও, মার্কেট করার খোয়াবটা কিন্তু দিনে দিনে মুনিমের বুকে পোক্তই হচ্ছে। কারণ, স্থাপনাভিত্তিক বাণিজ্য না থাকলে ওপরতলায় কলকে মিলে না। তাই ফাঁকমতো সেদিকেও এট্টু চক্কর দিতে হয় দম নেবার জন্য।
সন্ধ্যা নামলে, মুনিম চা-নাস্তার পরে গরু-খাসি আর মুরগির পাইকারদের কাছ থেকে, লগ্নির মাল সুদে-আসলে আদায় করে। টাকা ছাড়া আর কিছুতেই তার রুচি নেই। ইলিশ ভাজা কিম্বা মুরগির রানের চে’ পাইকারের শুকনো মুখ দেখে মুনিমের বেশি আনন্দ। চোখে-মুখে, ঘনায়মান রাতের অন্ধকার লেপ্টে মোকাম ফেরত পাইকাররা যখন তার অপেক্ষায় আড়তে বসে বসে ঝিমায়, তখন সে আমুদে হাই তোলে। এদের মাঝে কেউ কেউ কুড়ি বছর ধরে মুনিমের বিশাল বপুটির রসদ যোগাচ্ছে। সে এমন চালে এদের সাথে লেনদেনটা করে যাতে কেউ-ই আর নিজের তহবিলটা গড়ে তুলতে না পারে। নরখাদক বাঘের মতো সন্ধ্যা হলেই সে পাইকারদের জন্য খাপ পেতে বসে থাকে। তার কাছে এই নেশা বাংলা মদের চে’ উত্তেজক। সেজন্যই এই পুরোনো কারবারটা সে ছাড়ে-ছাড়ে বলেও আর ছাড়তে পারছে না।
এবং, তখন থেকেই সন্ধ্যার আকাশের মতো মুনিমের মেজাজের ওপর অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে। ফুটো টিনের ভেতর দিয়ে বাইরের পৃথিবী যেমন অন্ধকার ঘরে চোরা চোখে চেয়ে থাকে—তেমনি মুনিমের বুকের জটিল গহ্বরে একটি তৃষিত চেতনা আনকা দৃষ্টিতে মাঝে-মাঝে চোখ মেলে মুচড়ে ওঠে। কিন্তু সেই অনুভব কঠিন-কঠিন বিস্তর উপাত্তঠাসা বিষয়ী গহ্বরে তিলেকেই চাপা পড়ে।
রাত দশটার পরে অফিসের ডিপ লকারে হার্ড মাল ঢুকিয়ে, মুনিম বুক পকেটে মাত্র ৫০ টাকার দুটো নোট রেখে রিকশায় ওঠে। এবার পঙ্খিরাজ দুলে-দুলে হাওয়ায় উড়ে। রাস্তার পাশের গাছ-পালার ভুতুড়ে ছায়ার চিপা-চাপা দিয়ে নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো দ্বিধায় নড়েচড়ে। মুনিমের মুখে হুতুম প্যাঁচার গম্ভীর্য। আশ্চর্য এক মুখোশ এঁটে মুনিম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জেগে থাকে। সামনে ডাকু মার্কা সারথি পনপন করে রিকশার প্যাডেল মারছে। হু হু করে মাঠের বাতাস তার নাক-মুখ ছুঁয়ে-ছেনে মাথার চুলে বিলি কেটে পিছিয়ে যায়। দরকার মতো এই ছেলেটা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। অনুগত ষণ্ডা সারথির জন্য তাই এই নোট, কচি আয়তুন বাকিটা। মুনিমের তৃপ্তি অজস্র সমস্যা ও সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে ঢেকুরের মতো বেরিয়ে আসতে চায়; আসলে মাইনষ্যের দাম কয় ট্যাহা?
এক্ষণ, এই মুহূর্তে সে যদি একটু উপরে কয়টা ফোন লাগায়া চায়-তবে থানা সদরে একটা হুলুস্থূল ফেলে দিতে পারে এবং অবশ্যই সে চাইলে কয় হাজার মাল খরচ করে জিন্দা যে কাউকেই লাশ বানিয়ে চিরদিনের জন্য গুম করে ফেলতে পারে। সে বাম হাত দিয়ে তার নিজের ডান হাতটা চেপে ধরে। কব্জির ঘসঘসে রোঁয়া বাঁ হাতের আঙুলে তুরতুরি দেয়। এক আদিম উত্তেজনায় মুনিম ডান হাতে মুঠি পাকিয়ে নিজের তেজ পরখ করে।
মুনিমের হুঁশ ফিরে। আয়তুনের ঘরের তরল অন্ধকারে বুনো ফলের একটা তেজি ঘ্রাণ তাকে উন্মার্গ করে। মুনিমের চোখ দুটো মুহূর্তে উধাও; সেই শূন্য গর্তে এসে ঠাঁই নেয় কোনো নিশাচরের ধাঁধানো তীব্র চোখ। মাড়ির হাড় ফেটে যেন বেরিয়ে আসে কোনো মাংসাশীর দীর্ঘ-ধারালো কর্তন-দন্ত। সে ইচ্ছে করলেই এই দুবলা কামিনীর আস্ত মস্তকটাই মুখে ফেলে পিষে-চুষে নিতে পারে। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে অপেক্ষা করে। আঁটো চোখের অন্ধকার মণিতেই চিন্তার দ্যুতিটা ঝিলিক দেয়, আসলে পুরুষ মানুষ বিত্তের পাশাপাশি তর্জনি উঠাতেই বেশি পছন্দ করে।
মুনিম একটু একটু করে শুধু ধনার্জনই করেনি; শিখেছে কেমন করে বছরের-পর-বছর শীত-গ্রীষ্মকে তুচ্ছ করে অপেক্ষা করতে হয়, কেমন করে বিষ হজম করে মুখে মধু উগড়াতে হয়; আর কীভাবে একটু একটু করে মানুষকে মুঠির ভেতর ভরে জিন্দা রেখে রস শুষে নিতে হয়।
সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে মুনিম প্রায়ই চমকে ওঠে; পান-জর্দার রস মুখের ভেতর সারাটা রাত পচে পচে বুঝি পাইকারদের রক্ত হয়ে গেছে। থুথুর সাথে চাকা চাকা রক্তে সাদা বেসিনের শরীর ভরে ওঠে। মুনিম দিশেহারার মতো কাশতে থাকে। তার হাত-পায়ে খিল ধরে, একটু একটু ঘামের সাথে মাথাটাও ঝিমঝিম করে ঘুরে ওঠে।
সারা শরীরে একটা উৎকট জ্বালা তিরতির করে দখল নেয়। ফুটবলের মতো গোল শরীরের মুনিম, তার হাতের আঙুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। জোঁক যেমন রক্ত চুষে-চুষে কালো জামের মতো গোল আর অসার, তেমনি তার আঙুলগুলোও, সারাদিন শুধু যন্ত্রের মতো টাকা গোনে। কিন্তু তার সেই গোদা-গোদা আঙুলের ডগাগুলো হঠাৎ শিরশির করে ওঠে আর তক্ষুণি সে টের পায় তার নখগুলো পশুর নখের মতো তীক্ষè আর দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তার হাতের ত্বক ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসছে কুচকুচে কালো লম্বা লম্বা রোঁয়া। পলে-পলে তার হাত দুটো শিম্পাঞ্জির হাতের মতো ঘন লোমে ছেয়ে যাচ্ছে।
মল দেখার মতো মুনিম থুতু ফেলে সব কিছু ভুলে যেতে চায়। তার সক্কল ইন্দ্র্রিয়ের উপর একতরফা আধিপত্য সে হারাতে বসেছে। আজ-কাল সে প্রায়ই জংলী ফুলের মতো আয়তুনের গতরের উপর উঠে যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
তামাদি সবকিছু উদ্ধারে মতো সে মরিয়া হয়ে হাত বাড়িয়ে আয়তুনের দীর্ঘ আর নরম গ্রীবাটা ছুঁয়ে দেখে, মাগির অসমাপ্ত কামনা ঘাড়ের ধমনীতে তীব্র মাথা মারছে। সে জানে আয়তুনকে আরো লন্ডভন্ড করা উচিত ছিলো। মাড়াই কল দিয়ে চাষা যেমন আখ পিষে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, দরকার কি অনাহক সময় আর শরীর ক্ষয় করে, আয়তুনের তৃপ্তিতে মুনিমের কী ফায়দা।
মুনিম দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই আয়তুনের একটা স্তন খামচে ধরে। অল্প দিন হলো এ লাইনে আসা মেয়েটার শরীরে এখনো একটা খাঁজও পড়েনি। আয়তুন বুকের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে; তাতে মুনিমের স্নায়ুতে অন্যরকম একটা সুখ শিরশির করে দৌড়ে। মেয়েটার কচি স্তন তার মুঠির লম্বিত চাপে ডিম্বাকৃতি থেকে বেলুনের মতো চ্যাপ্টা-দিঘল হয়ে যাচ্ছে।
আয়তুনের স্তনের উত্তাপ আর আকৃতির রূপান্তর দেখার সময় কই, সে ঠার করে তার হাতটাকে। আশ্চর্য এক আবিষ্কার হচ্ছে এই হাত। মানুষ তার কব্জিকে ইচ্ছে মতো রূপান্তর করতে পারে। মুমূর্ষুর মুখে জল তুলে দিতে পারে, পারে দুর্বলের টুঁটি টিপে স্তব্ধ করতে। সে শিহরিত হতে হতে আন্দাজ করে, ভরা নর্দমার মতো তার ভেতরটাও এক আদিম সুখে গলগল করে উপচে উঠছে।
উলঙ্গ আয়তুনকে দেখার সাধ হলে সে তার বন্ধ চোখ দুটোতে লাইট জ্বালিয়ে নেয়;…আহ…তার লোভাতুর ক্ষীণ কটি, চওড়া-চেটালো পাছা, নাছোড় ভগমানের মতো দেমাগি আর রহস্য ভরা উঁচুমুখী স্তন আর অনন্ত কামনার জ্বালা-ধরা চোখ নিয়ে সে কাৎ হয়ে পড়ে আছে একটা মাঝবয়সি ভাল্লুকের হাতে!
মুনিমের তালু জ্বলছে। সে পালাতে চায়।
উচ্ছিষ্ট নারী, অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে অপেক্ষা করে। একটু বুঝি কেঁদেও নেয়। ঘরের অন্ধকারে আরো অন্ধকার হয়ে মুনিম দাঁড়িয়ে-দাড়িয়ে আয়তুনের বুক দুটো ডলে। বাইরে দরকচা চাঁদটা খানিক উঁকি দিলো, হয়তো সে বাঁশবনের আড়াল দিয়েই জন্মের মতো চলে যাবে।
আয়তুন চাঁদটা দেখার জন্য ছটফট করে।
একটা পঞ্চাশ টাকার লাল নোট ছোটখাটো কালচে ছায়াটার দিকে মুনিম কফের মতো ছুঁড়ে মারে। আহত, অসুখী, দুর্বল প্রাণীটা সহজে ছাড়া পেয়ে আনন্দে কিচিরমিচির করে ওঠে। আর মুনিম ভাবে কত কম পেয়েও মাগিটা খুশিতে মরছে!
কী পেলে সে একটু খুশি হতে পারে, এরকম একটা ভাবনাকে মুনিম টোকা দিয়ে চমকে ওঠে।
বড় রাস্তার দিকে ফিরতে ফিরতে মুনিম, মানুষ নামের ছোট শব্দটার সুদ-আসল গুনতে গুনতে চোখ মুছে আর চারপাশের অন্ধকারকে দুহাতে নিজের বুক পকেটে ভরে মজুদ করে…।
লেখাটি প্রকাশিতহয়